মল্লিকা সেনগুপ্ত




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

মল্লিকা সেনগুপ্ত 

১৯৬০ সালের ২৭ মার্চ কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তার লেখা নারীবাদী ও সংবেদনশীল, সমসাময়িক ও ইতিহাস মুখী। পেশায় তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিদ্যার অধ্যাপক ছিলেন।

১৯৮৩ সালে মল্লিকা সেনগুপ্তের ‘চল্লিশ চাঁদের আয়ু’ শীর্ষক প্রথম কবিতার বই প্রকাশিত হয়। এই প্রথম বইটিতেই তাঁর কবিতাগুলোর ভাবনা ছিল সামাজিক পটভূমিকায় নরনারীর সম্পর্ক। এরপর ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয়েছে প্রতিভাস প্রকাশনার ‘আমি সিন্ধুর মেয়ে’। এছাড়াও ‘হা-ঘরে ও দেবদাসী’, ‘অর্ধেক পৃথিবী’, ‘মেয়েদের অ-আ-ক-খ’, 'কথামানবী’, ‘দেওয়ালীর রাত’, ‘আমরা লাস্য আমরা লড়াই’, ‘পুরুষকে লেখা চিঠি’, ‘পুরুষের জন্য একশো কবিতা’, ‘বৃষ্টিমিছিল বারুদ মিছিল’ প্রভৃতি নানা স্বাদের কবিতার বই তিনি লিখে গেছেন।

সাহিত্য পত্রিকা ‘ভাষানগর’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদিকা ছিলেন কবি মল্লিকা সেনগুপ্ত। ৯০-এর দশকে সানন্দা পত্রিকাতেও কবিতার সম্পাদনার কাজ করেছেন।

মল্লিকা সেনগুপ্তের কবিতায় নারীর প্রতিবাদ আছে, কিন্তু তথাকথিত পুরুষবিদ্বেষ নেই।মল্লিকা সেনগুপ্ত খুবই সহজ ভাষায় তুমুল প্রতিবাদী কবিতা লিখতে পারতেন।‘তেভাগার ডায়েরি’ নামের এক কবিতায় শ্রমজীবী নারীর প্রতিবাদ ফুটে উঠেছে নতুন এক ভাষায়।মল্লিকা সেনগুপ্ত একজন সমাজসচেতন এক কবির নাম।

।। কবিতা। ।


পুরুলিয়ার মেয়ে

চোত বোশেখের বাতাসে
পুরুলিয়ার মাটিতে
একটি মেয়ে বাঁশি বাজায়
ল্যাংড়া আমের আঁটিতে।

ছাগল চরায় ভর দুপুরে
কাঁঠাল গাছের ছায়াতে
পাহাড় টিলায় খাঁ খাঁ রোদের
শুখা জমির পাড়াতে।

জল নেইকো , হয়না ফলন
তবুও বাঁচি সজোরে
অযোধ্যার ওই পাহাড় তলায়
ঘর বেঁধেছি ক'জনে।

=====

ফ্রয়েডকে খোলা চিঠি


পুরুষের দেহে এক বাড়তি প্রত্যঙ্গ
দিয়েছে শাশ্বত শক্তি, পৃথিবীর মালিকানা তাকে
ফ্রয়েডবাবুর মতে ওটি নেই বলে নারী হীনমন্য থাকে
পায়ের তলায় থেকে ঈর্ষা করে পৌরুষের প্রতি

প্রকৃতি সদয় নয়
পুরুষ সদয় নয়
সন্তান সদয় নয়
মেয়েদের প্রতি শুধু ফ্রয়েড সদয় !

এই দয়া কে চেয়েছে ! চিত্রাঙ্গদা ! জোন অব্ আর্ক !
সিমোন দ্য বোভোয়া না শ্যামল দ্রৌপদী !

"পেনিস-এনভি" বলে একটি শব্দ
পৃথিবীতে এনেছেন ফ্রয়েড সাহেব
ওই যে বাড়তি শুধু পুরুষের থাকে
ওই নাকি মেয়েদের কমতি বানায়
তাই তারা শিশুকালে টলমল করে
বালিকা বয়সে তাই শিবলিঙ্গ আকন্দে সাজায়
খেলাঘর ভরে ওঠে পুতুলে ও বাসনকোসনে
কারণ সে নাকি তার মায়ের প্রতিভূ |

অন্যদিকে রোহিতের জন্য থাকে শৌর্যপ্রস্তুতি
জংলাসবুজ উর্দি মার্কিন সেনারা তার ঘরে
ছোটায় মেশিনগান, ট্রা রা রা রা শব্দে সুগঠিত
হয়ে ওঠে পুরুষের আক্রমণ
শাণিত নখরে যদি গাল চিরে দেয়
দিদিমারা খুশি হয় বারতি বীরত্বে |
ওই যে বাড়তিটুকু শরীরের, ওই ছাড়পত্র
ওই তাকে পৃথিবীর মালিক বানাবে

রোহিত মালিক হবে কোন পৃথিবীর ?

যেখানে রোহিতা তার সহকারী ! অধম লিঙ্গ !
ছুটন্ত ঘোড়ার পিঠে খোলা তলোয়ার
বিশ্ববিজয়ে যাবে সম্রাট রোহিত
আর তাকে যুদ্ধ সাজ পরাবে তার মা বোন বউ
এই শুধু চেয়েছেন আপনি ফ্রয়েড !
উল্টোদিক থেকে যদি ঘোটকীর পিঠে কোনও নারী যোদ্ধা আসে
সে কী অস্ত্র ফেলে দেবে ভীষ্মের মতন---
"নারীর বিরুদ্ধে আমি অস্ত্র ধরবো না"
অর্থাত নারীকে আমি দেব না অস্ত্রের অধিকার---

এই লিঙ্গরাজনীতি আদি পুরুষের
ফ্রয়েড আপনি নিজে বাড়তির দলে বলে ধরেই নিলেন
মেয়েরা কমতি, তাই পুরুষের প্রতি তারা ঈর্ষাকাতর !

আমার শৈশবে কোনও লিঙ্গঈর্ষা কখনও ছিল না
আত্মপরিচয়ে আমি সম্পূর্ণ ছিলাম
আজও আমি দ্বিধাহীন সম্পূর্ণ মানুষী
তৃতীয়বিশ্বের এক স্পর্শকাতর কালো মেয়ে
আজ থেকে আপনার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে
কে অধম কে উত্তম বাড়তি কে কমতি কোনটা--
এই কূট তর্কের মিমাংসা করবার ভার
আপনাকে কে দিয়েছে ফ্রয়েড সাহেব !

======

আমাকে সারিয়ে দাও, ভালোবাসা


প্রতিদিন ভোর হয়, জীবন স্রোতের মত চলে
কারও কারও ভোরে আর একদিন সূর্য ওঠে না
সূর্যকে আমি তাই ভয়ংকর দিব্যি দিয়ে বলি
আমি না জাগলে তুমি উঠবে না ভোরের আকাশে।

আমি না,থাকলে সূর্য উঠবে কী করে
কী,করে ফসল হবে নবান্নের মাঠে?
কমে যাবে প্রতিবাদী মেয়েদের গলা
পৃথিবীটা মুহূর্তের জন্য থেমে যাবে।

তোমার কপালরেখা কাঁপে তিরতির
তোমার বুকের মধ্যে উদ্বেগ নড়ছে
তোমার মুখের মধ্যে শুশ্রূষার মুখ
আমাকে সারিয়ে তোলে তোমার সাহস।

একটু একটু করে আমি সেরে উঠি
একটু একটু করে জল দাও তুমি
একটু একটু করে আগুনে পা দিই
দুই হাতে রুখে দাও খাঁ খাঁ মরুভূমি।

চল্লিশ চাঁদের আয়ু, না বুঝে লিখেছি
এখনও অনেক কাজ বাকি আছে,যাবই না আমি
দু'-দশ বছর আরও তোমাদের জ্বালাব পোড়াব
না রে মৃত্যু আজ আর তোর জন্য সময় হবে না।

শিশির,তোমার কেন কোনোদিন অসুখ করেনা?
রোদ্দুর কখনও বুঝি মনখারাপ হয় না তোমার?
সারস তোমাকে কেউ প্রতারণা করেনি কখনও?
আমিও শিশির হয়ে, রোদ্দুর, সারস হয়ে থেকে যেতে চাই পৃথিবীতে।

=======

কন্যাশ্লোক

আশ্বিনের এক প্রাগৈতিহাসিক সকালে শ্রীরামচন্দ্র যে দুর্গার বোধন করেছিলেন
স্বর্গের দেবপুরুষগণ যুদ্ধে পরাজিত হয়ে যে রণদেবীকে অসুর নিধনে পাঠিয়েছিলেন
সেই দুর্গাই একুশ শতকে নারীর ক্ষমতায়ন।
তাঁর মহাতেজ চিরজাগরুক আগুন হয়ে জ্বলে উঠুক
মাটির পৃথিবীর প্রতিটি নারীর মধ্যে।
হে মহামানবী, তোমাকে সালাম!
মেয়েটির নাম দুর্গা সোরেন বটেক
মায়ের ছিলনা অক্ষর জ্ঞান ছটেক।
সর্বশিক্ষা অভিযানে পেয়ে বৃত্তি
দুর্গা হয়েছে ইংরেজি স্কুলে ভর্তি।
সাঁওতালি গান, ইংরেজি ভাষা বাঁ হাতে
কম্প্যুটারে শিখেছে ইমেল পাঠাতে।
অঙ্কের স্যার ভুল হলে যোগ বিয়োগে
গায়ে হাত দেয় পড়া শেখানোর সুযোগে।
দুর্গা জানেনা কোনটা যৌন লাঞ্ছনা
স্যারটা নোংরা বটেক!--কথাটা মানছ না?
শেষে একদিন স্যারের নোংরা হাতটা
মোচড়ে দিয়েছে দুর্গা, মেরেছে ঝাপটা!
ওরে অর্ধেক আকাশে মাটিতে শ্যাওলা
আকাশে উড়বে, হবে কল্পনা চাওলা।
যদি না বিমান ভেঙে পড়ে তার দুদ্দাড়
মহাকাশচারী হবেই বটেক দুর্গা।
বিশ্বায়নে পণ্যায়নে
খণ্ড খণ্ড মানচিত্রে বাংলা বিহার রাজস্থানে
সাধারণী নমস্তুতে!
পণ্যব্রতে, পত্নীব্রতে মোহমুদ্রা,ধ্বংসমুদ্রা প্রযুক্তিতে
গৃহকর্মে সাধারণী নমস্তুতে!
আমার দুর্গা পথে প্রান্তরে স্কুল ঘরে থাকে
আমার দুর্গা বিপদে আপদে আমাকে মা বলে ডাকে।
আমার দুর্গা আত্মরক্ষা শরীর পুড়বে, মন না
আমার দুর্গা নারী গর্ভের রক্তমাংস কন্যা।
আমার দুর্গা গোলগাল মেয়ে, আমার দুর্গা তন্বী।
আমার দুর্গা কখনো ঘরোয়া, কখনো আগুন বহ্নি।
আমার দুর্গা মেধাপাটেকর, তিস্তা শিতলাবাদেরা
আমার দুর্গা মোম হয়ে জ্বালে অমাবস্যার আঁধেরা।
আমার দুর্গা মণিপুর জুড়ে নগ্নমিছিলে হাঁটে
আমার দুর্গা কাস্তে হাতুড়ি, আউশ ধানের মাঠে।
আমার দুর্গা ত্রিশূল ধরেছে,স্বর্গে এবং মর্ত্যে
আমার দুর্গা বাঁচতে শিখেছে নিজেই নিজের শর্তে।
আন্দোলনে উগ্রপন্থে, শিক্ষাব্রতে কর্মযজ্ঞে রান্নাঘরে, আঁতুড় ঘরে।
মা তুঝে সালাম !
অগ্নিপথে, যুদ্ধজয়ে, লিঙ্গসাম্যে, শ্রেণিসাম্যে দাঙ্গাক্ষেত্রে, কুরুক্ষেত্রে।
মা তুঝে সালাম!
মা তুঝে সালাম!
মা তুঝে সালাম!

======

আপনি বলুন, মার্কস…

ছড়া যে বানিয়েছিল, কাঁথা বুনেছিল
দ্রাবিড় যে মেয়ে এসে গমবোনা শুরু
করেছিল
আর্যপুরুষের ক্ষেতে, যে লালন
করেছিল শিশু
সে যদি শ্রমিক নয়, শ্রম কাকে বলে ?
আপনি বলুন মার্কস, কে শ্রমিক,
কে শ্রমিক নয়
নতুনযন্ত্রের যারা মাসমাইনের
কারিগর
শুধু তারা শ্রম করে !
শিল্পযুগ যাকে বস্তি উপহার দিল
সেই শ্রমিকগৃহিণী
প্রতিদিন জল তোলে, ঘর মোছে,
খাবার বানায়
হাড়ভাঙ্গা খাটুনির শেষে রাত হলে
ছেলেকে পিট্টি দিয়ে বসে বসে কাঁদে
সেও কি শ্রমিক নয় !
আপনি বলুন মার্কস, শ্রম কাকে বলে !
গৃহশ্রমে মজুরী হয়না বলে মেয়েগুলি শুধু
ঘরে বসে বিপ্লবীর ভাত রেঁধে দেবে
আর কমরেড শুধু যার
হাতে কাস্তে হাতুড়ি !
আপনাকে মানায় না এই অবিচার
কখনো বিপ্লব হলে
পৃথিবীর স্বর্গরাজ্য হবে
শ্রেণীহীন রাস্ট্রহীন আলোপৃথিবীর
সেই দেশে
আপনি বলুন মার্কস,
মেয়েরা কি বিপ্লবের সেবাদাসী
হবে ?



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. অসামান্য সংযোজন .... ভীষন প্রিয় কবির লেখা দর্পণ ব্লগে সংরক্ষিত হওয়ায় খুব ভালো লাগছে 🌷🌷

    উত্তরমুছুন
  2. প্রত্যেকটা কবিতা অসামান্য
    দর্পণের তথা সম্পাদক দেবাশীষ ভট্টাচার্য্যের অভিনব প্রয়াসকে ধন্যবাদ

    উত্তরমুছুন