প্রেমিক কবি নজরুল - দেবলীনা




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

প্রেমিক কবি নজরুল 
  দেবলীনা 


মূলত "বিদ্রোহী কবি" নামে পরিচিত কবি নজরুল ইসলাম আদতে ছিলেন এক প্রেমিক মানুষ , তাঁর জীবনেও প্রেম এসেছে বারংবার - কখনো তা প্রকাশ্যে কখনো তা নিঃশব্দ চরণে! তার জীবনে এসব প্রেমের ছোঁয়া তার সৃষ্ট গান ও সাহিত্যকে দিয়েছে অনন্যমাত্রা।

নজরুল রচনায় তেজোদৃপ্ত ও উদ্দীপিত জীবনচেতনার বিপরীতে যে প্রেমচেতনা সেখানে নারীও ভিন্ন মাত্রায় উপস্থাপিত। তাঁর প্রেমমূলক কাব্য ভাবনায় প্রেমিক নজরুলের বিরহী, অভিমানী, অতৃপ্ত ও ক্ষুধার্ত রূপ দেখা যায়। প্রেমের কবিতা ও গানে তাঁর মূল সত্তাটি হচ্ছে বিরহী আত্মার প্রতীক। তবে নজরুলের জীবনে বহুবার প্রেমের উষ্ণ হাওয়া বইলেও বিশেষভাবে তিন নারীর সঙ্গে প্রেমে জড়ানোর ঘটনা ব্যাপক আলোচিত হয়েছে। প্রথমত, নার্গিস আসার খানম, দ্বিতীয়ত, তার স্ত্রী প্রমীলা দেবী এবং তৃতীয়ত, মিস ফজিলাতুন্নেসা। এর মধ্যে নার্গিস ও প্রমীলা দেবী ছিলেন নজরুলের হৃদয়ের দুই সারথী- একজন চাঁদ তো অন্যজন নীল সরোবর।  প্রিয় কবি নজরুলকে, তার প্রথম স্ত্রী নার্গিস একটি পত্র লিখেছিলেন সেই কুমিল্লা থেকে বিয়ের প্রথম রাতে নজরুলের চলে যাবার অনেক দিন পর।সেই চিঠির উত্তর নজরুল দিয়েছিলেন একটি গানের মাধ্যমে-
                                  “যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই, কেন মনে রাখ তারে্।।
                                    ভুলে যাও তারে ভুলে যাও একেবারে্।।”

-কিন্তু নজরুল কি সত্যিই ভুলতে পেরেছিলেন নার্গিসকে? পনেরো বছর পর একটি আবেগময় চিঠি লিখেন নার্গিসের কাছে- যা হৃদয় ছুঁয়ে যায়- যে চিঠিখানা বিশ্বের সেরা ভালবাসার তথা প্রেমপত্রের একটি। নজরুল নার্গিসকে কতটুকু ভালবাসতেন- সেটা এই চিঠিতেই সেই ভালবাসার রূপ শাশ্বত হয়ে ফুটে উঠেছে- একজন মানুষ কি তার প্রিয়তমাকে এর চেয়ে বেশি ভালবাসতে পারেন! নজরুল দৌলতপুরে বসেই ১৬০টি গান এবং ১২০টি কবিতা রচনা করেন। উল্লেখযোগ্য কবিতাগুলোর মধ্যে- ‘বেদনা-অভিমান’, ‘অবেলা’, ‘অনাদৃতা’, ‘পথিক প্রিয়া’, ‘বিদায় বেলা’ প্রভৃতি- তাই নজরুলের জীবনে যদি নার্গিস না আসতেন তাহলে হয়তো বাংলা সাহিত্য ভান্ডারে এই অমূল্য সম্পাদ থেকে আমরা বঞ্চিত হতাম।

-কবির লেখা সেই প্রথম ও শেষ চিঠি তাঁর প্রথম স্ত্রী নার্গিসকে .........



১০৬ উচ্চ চিৎপুর রোড
"গ্রামোফোন রিহার্সাল রুম"
কলকাতা.
১-৭-১৯৩৭
কল্যানীয়াসু,
তোমার পত্র পেয়েছি সেদিন নব বর্ষার নবঘন-সিক্ত প্রভাতে। মেঘ মেদুর গগনে সেদিন অশান্ত ধারায় বারি ঝরছিল। পনের বছর আগে এমনি এক আষাঢ়ে এমনি এক বারিধারায় প্লাবন নেমেছিল, তা তুমিও হয়তো স্মরণ করতে পারো। আষাঢ়ের নব মেঘপুঞ্জকে আমার নমস্কার। এই মেঘদূত বিরহী যক্ষের বাণী বহন করে নিয়ে গিয়েছিল কালিদাসের যুগে, রেবা নদীর তীরে, মালবিকার দেশে, তার প্রিয়ার কাছে। এই মেঘপুঞ্জের আশীর্বাণী আমার জীবনে এনে দেয় চরম বেদনার সঞ্চার।

এই আষাঢ় আমায় কল্পনার স্বর্গলোক থেকে টেনে ভাসিয়ে দিয়েছে বেদনার অনন্ত স্রোতে। যাক, তোমার অনুযোগের অভিযোগের উত্তর দেই। তুমি বিশ্বাস করো, আমি যা লিখছি তা সত্য। লোকের মুখে শোনা কথা দিয়ে যদি আমার মূর্তির কল্পনা করে থাকো,তাহলে আমায় ভুল বুঝবে- আর তা মিথ্যা।

তোমার উপর আমি কোনো ‘জিঘাংসা’ পোষণ করিনা –এ আমি সকল অন্তর দিয়ে বলছি। আমার অন্তর্যামী জানেন তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত, কি আসীম বেদনা! কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি, তা দিয়ে তোমায় কোনোদিন দগ্ধ করতে চাইনি। তুমি এই আগুনের পরশমানিক না দিলে আমি ‘অগ্নিবীণা’ বাজাতে পারতাম না। আমি ধুমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না।

তোমার যে কল্যাণ রূপ আমি আমার কিশোর বয়সে প্রথম দেখেছিলাম, যে রূপকে আমার জীবনের সর্বপ্রথম ভালবাসার আঞ্জলি দিয়েছিলাম, সে রূপ আজো স্বর্গের পারিজাত-মন্দারের মতো চির অম্লান হয়েই আছে আমার বক্ষে। অন্তরের সে আগুন-বাইরের সে ফুলহারকে স্পর্শ করতে পারেনি ।
তুমি ভুলে যেওনা আমি কবি, আমি আঘাত করলেও ফুল দিয়ে আঘাত করি। অসুন্দর কুৎসিতের সাধনা আমার নয় । আমার আঘাত বর্বরের কাপুরুষের আঘাতের মতো নিষ্ঠুর নয়। আমার অন্তর্যামী জানেন (তুমি কি জান বা শুনেছ জানিনা) তোমার বিরুদ্ধে আজ আমার কোন অনুযোগ নেই, অভিযোগ নেই, দাবীও নেই।

তোমার আজিকার রূপ কি জানিনা। আমি জানি তোমার সেই কিশোরি মুর্তিকে, যাকে দেবীমূর্তির মতো আমার হৃদয় বেদীতে অনন্ত প্রেম, অনন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম। সেদিনের তুমি সে বেদী গ্রহণ করলেনা। পাষাণ দেবীর মতই তুমি বেছে নিলে বেদনার বেদিপাঠ …জীবন ভ’রে সেখানেই চলেছে আমার পূজা আরতি। আজকার তুমি আমার কাছে মিথ্যা,ব্যর্থ ; তাই তাকে পেতে চাইনে। জানিনে হয়ত সে রূপ দেখে বঞ্চিত হব,অধিকতর বেদনা পাব, তাই তাকে অস্বীকার করেই চলেছি।

দেখা? না-ই হ’ল এ ধূলির ধরায়। প্রেমের ফুল এ ধূলিতলে হয়ে যায় ম্লান, দগদ্ধ, হতশ্রী। তুমি যদি সত্যিই আমায় ভালবাস আমাকে চাও ওখান থেকেই আমাকে পাবে। লাইলি মজনুকে পায়নি, শিরি ফরহাদকে পায়নি, তবু তাদের মত করে কেউ কারো প্রিয়তমাকে পায়নি। আত্মহত্যা মহাপাপ, এ অতি পুরাতন কথা হলেও প্রেম সত্য। আত্মা অবিনশ্বর,আত্মাকে কেউ হত্যা করতে পারেনা। প্রেমের সোনার কাঠির স্পর্শ যদি পেয়ে থাকো, তাহলে তোমার মতো ভাগ্যবতী আর কে আছে ? তারি মায়া স্পর্শে তোমার সকল কিছু আলোয় আলোময় হয়ে উঠবে।

দুঃখ নিয়ে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে গেলেই সেই দুঃখের অবসান হয়না। মানুষ ইচ্ছা করলে সাধনা দিয়ে, তপস্যা দিয়ে ভুলকে ফুল রূপে ফুটিয়ে তুলতে পারে। যদি কোনো ভুল করে থাক জীবনে, এই জীবনেই তাকে সংশোধন করে যেতে হবে; তবেই পাবে আনন্দ মুক্তি; তবেই হবে সর্ব দুঃখের অবসান । নিজেকে উন্নত করতে চেষ্টা করো, স্বয়ংবিধাতা তোমার সহায় হবেন। আমি সংসার করছি, তবু চলে গেছি এই সংসারের বাধাকে অতক্রম করে উর্ধ্ব লোকে। সেখানে গেলে পৃ্থিবীর সকল অপূর্ণতা, সকল অপরাধ ক্ষমা সুন্দর চোখে পরম মনোহর মূর্তিতে দেখা যায়।…

হঠাৎ মনে পড়ে গেল পনর বছর আগের কথা। তোমার জ্বর হয়েছিল, বহু সাধনার পর আমার তৃষিত দুটি কর তোমার শুভ্র ললাট স্পর্শ করতে পেরেছিল; তোমার তপ্ত ললাটের স্পর্শ যেন আজো অনুভব করতে পারি। তুমি কি চিয়ে দেখেছিলে? আমার চোখে ছিলো জল, হাতে সেবা করার আকুল স্পৃহা, অন্তরে শ্রীবিধাতার চরণে তোমার আরোগ্য লাভের জন্য করুন মিনতি। মনে হয় যেন কালকের কথা। মহাকাল যে স্মৃতি মুছে ফেলতে পারলেননা। কী উদগ্র অতৃপ্তি, কী দুর্দমনীয় প্রেমের জোয়ারই সেদিন এসেছিল। সারা দিন রাত আমার চোখে ঘুম ছিল না ।
যাক আজ চলেছি জীবনের অস্তমান দিনের শেষে রশ্মি ধরে ভাটার স্রোতে, তোমার ক্ষমতা নেই সে পথ থেকে ফেরানোর। আর তার চেষ্টা করোনা। তোমাকে লিখা এই আমার প্রথম ও শেষ চিঠি হোক। যেখানেই থাকি বিশ্বাস করো আমার অক্ষয় আশির্বাদ কবচ তোমায় ঘিরে থাকবে । তুমি সুখি হও, শান্তি পাও, এই প্রার্থনা। আমায় যত মন্দ বলে বিশ্বাস করো, আমি তত মন্দ নই, এই আমার শেষ কৈফিয়ৎ।

ইতি
নিত্য শুভার্থী
নজরুল ইসলাম

'

নার্গীসের সাথে বিবাহ বিচ্ছেদের পর সালের ২৫ এপ্রিল কলকাতায় নজরুল ও প্রমীলার বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিবাহ-আইনের নানা চড়াই-উতরাই পার হয়ে তাঁদের বিয়েটা হয়েছিল স্ব-স্ব ধর্মপরিচয় বহাল রেখেই । তখন প্রমীলার বয়স ছিল ১৪ আর নজরুলের ২৩। বিয়ের পর স্ব ধর্ম-আচরণ বহাল রেখেই প্রমীলা দেবী আমৃত্যু সকল সুখ-দু:খের বোঝা মাথায় নিয়ে কবির জীবন সঙ্গিনী হয়েছিলেন। প্রমীলার প্রতি কবির প্রেমের কথা তাঁর ‘বিজয়িনী’ কবিতায় প্রকাশিত হয়েছিল । ‘বিজয়ীনি’ ছাড়াও নজরুল প্রমীলাকে নিয়ে ‘প্রিয়ার রূপ’, ‘দোদুল দুল’ সহ আরও অনেক কবিতা রচনা করেন। ‘ দোদুল দুল’ কবিতায় কবি প্রমীলার রূপের বর্ণনা এভাবে তুলে দেন-

‘মৃণালু হাত/নয়ানু পাত/গালের টোল,/চিবুক দোল/সকল কাজ/করায় ভুল/প্রিয়ার মোর/কোথায় তুল?/কোথায় তুল?/কোথায় তুল?/কাকঁল ক্ষীণ/মরাল গ্রীব/ভুলায় জড়/ভুলায় জীব,/গমনু দোল/অতুল তুল্।’
দোলন চাঁপা কাব্যগ্রন্থে সবার আগে এই কবিতাটি রয়েছে। এই কাব্যগ্রন্থটি ১৯২৩ সালের ১৫ অক্টোবর মাসে প্রকাশিত হয়।

তৃতীয়তঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্নাতকোত্তর মুসলমান ছাত্রী এবং সওগাত পত্রিকার একজন বিশিষ্ট লেখিকা মিস ফজিলাতুন্নেসার প্রতি কবির অনুরাগকে কিংবদন্তী তুল্য বলা যেতে পারে। কিন্তু এইক্ষেত্রে কবির একতরফা প্রেম কোনভাবেই পূর্ণতা পাই নি তবু প্রেমিক কবি প্রিয়তমার উদ্দেশে প্রচুর কবিতা , গান রচনা করেছিলেন ।

ফজিলাতুন্নেসা প্রতি নজরুলের প্রেম সম্পর্কে কাজী মোতাহার হোসেন লেখেন, ‘ফজিলতের প্রতি নজরুলের অনুভূতির তীব্রতা দু’তিন বছরের সময়সীমায় নিঃশেষিত হয়ে যায়। সমান্তরাল আর একটি স্তবকে লক্ষ্য করা যায় কবি তার আকাঙ্ক্ষিত প্রেমকে সুন্দরতর আর এক জগতে খুঁজে ফিরেছেন যেখানে প্রেমে কোন নৈরাশ্য নেই, কোন বেদনা নেই। প্রেমের জন্য নারীর কাছ থেকে তিনি চেয়েছিলেন পূর্ণ আত্মসমর্পণ কিন্তু কোথাও তিনি তা পান নি। ফলে ধীরে ধীরে তিনি খোদা প্রেমের দিকে ঝুঁকে পড়লেন’। পার্থিব প্রেমকে বিদায় দিয়ে নজরুল লেখেন-

‘পরজনমে দেখা হবে প্রিয়
ভুলিও মোরে হেথা ভুলিও।।
এ জনমে যাহা বলা হ’ল না,
আমি বলিব না, তুমিও বলো না।
জানাইলে প্রেম করিও ছলনা,
যদি আসি ফিরে, বেদনা দিও।।
 হেথায় নিমেষে স্বপন ফুরায়
 রাতের কুসুম প্রাতে ঝরে যায়,
 ভালো না বাসিতে হৃদয় শুকায়,
 বিষ-জ্বালা-ভরা হেথা অমিয়।।
 হেথা হিয়া উঠে বিরহে আকুলি,
 মিলনে হারাই দু’দিনেতে ভুলি,
 হৃদয়ে যথায় প্রেম না শুকায়-
 সেই অমরায় মোরে স্মরিও।’

ব্যথার দান গ্রন্থের উৎসর্গপত্রে কবি লিখেছেন-‘মানসী আমার, মাথার কাঁটা নিয়েছিলুম বলে ক্ষমা করোনি, তাই বুকের কাঁটা দিয়ে প্রায়শ্চিত্য করলুম।”
সত্য-সুন্দর-সৌন্দর্যের পূজারি নজরুল আজীবন বড় প্রেমের কাঙাল ছিলেন। এই প্রেম শুধুমাত্র নারী - পুরুষের ভালবাসা নয় , বরং তিনি দেশকে ভালবেসেছিলেন, মানুষকে ভালবেসেছিলেন, মানবতাকে ভালবেসেছিলেন, ভালবেসেছিলেন সত্য-সুন্দরকে। কিন্তু ব্যক্তি জীবনে প্রেমে ব্যর্থতার পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সমাজ বাস্তবতার বৈপরীত্যে সত্য-সুন্দর-সৌন্দর্যের মাঝে যখন তিনি প্রেমের কুৎসিত ঘৃণ্য দিক লক্ষ্য করেছেন তখন কবি দারুণভাবে আহত হয়েছেন। তাঁর হৃদয়ের ব্যাথা তাঁর লেখনীর মাধ্যমে, সুরের বেহাগে, সভা-সমিতির বক্তৃতায়-ভাষণে প্রকাশ করেছেন। তার কাব্যে, গানে, গল্পে, উপন্যাসে বারবার তাই উপজীব্য হয়েছে প্রেম। মানুষের মানবিক অনুভূতির অনন্য ভাষা ভালোবাসা ও প্রেমকে তিনি সাহিত্য অঙ্গনে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. ভীষণ ভালো লিখেছ
    খুব ভালো লাগলো

    উত্তরমুছুন
  2. অভিমানী নজরুলের জীবনের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে এসেছে। বিশেষ করে তার চিঠিটার ভাষা সব সময়ই একটা ভিন্নমাত্রা এনে দেয় পাঠক মনে।
    চমৎকার উপস্থাপন করলি দিদি।

    উত্তরমুছুন