মহাদেব সাহা (জন্ম: ৫ আগস্ট ১৯৪৪)




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

মহাদেব সাহা (জন্ম: ৫ আগস্ট ১৯৪৪) 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তীকালের একজন অন্যতম প্রধান কবি। তিনি তার সাহিত্যিক অবদান দিয়ে সব ধরনের পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। তিনি রোম্যান্টিক গীতিকবিতার জন্য জনপ্রিয়। তার কবিতা অপরিশ্রুত আবেগের ঘনীভূত প্রকাশে তীব্র। তিনি জীবিকাসূত্রে একজন সাংবাদিক ছিলেন, এবং দীর্ঘকাল দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০১৬ থেকে তিনি কানাডা প্রবাসী

।। কবিতা। ।

সুন্দরের হাতে আজ হাতকড়া

সুন্দরের হাতে আজ হাতকড়া, গোলাপের বিরুদ্ধে 
 হুলিয়া, 
 হৃদয়ের তর্জমা নিষিদ্ধ আর মননের সম্মুখে প্রাচীর 
 বিবেক নিয়ত বন্দী, প্রেমের বিরুদ্ধে পরোয়ানা; 
 এখানে এখন পাখি আর প্রজাপতি ধরে ধরে 
 কারাগারে রাখে- 
 সবাই লাঞ্ছিত করে স্বর্ণচাঁপাকে; 
 সুপেয় নদীর জলে ঢেকে দেয় বিষ, আকাশকে 
 করে উপহাস। 
 আলোর বিরুদ্ধাচারী আঁধারের করে শুধু স্ততি, 
 বসন্তের বার্তা শুনে জারি করে পূর্বাহ্নে কারফিউ, 
 মানবিক উৎসমুখে ফেলে যতো শিলা ও পাথর- 
 কবিতাকে বন্দী করে, সৌন্দর্যকে পরায় শৃঙ্খল।
 
======

তোমাকে লিখবো বলে একখানি

তোমাকে লিখবো বলে একখানি চিঠি 
 কতোবার দ্বারস্ত হয়েছি আমি 
 গীতিকবিতার, 
 কতোদিন মুখস্ত করেছি এই নদীর কল্লোল 
 কান পেতে শুনেছি ঝর্ণার গান, 
 বনে বনে ঘুরে আহরণ করেছি পাখির শিস্ 
 উদ্ভিদের কাছে নিয়েছি শব্দের পাঠ; 
 তোমাকে লিখবো বলে একখানি চিঠি 
 সংগ্রহ করেছি আমি ভোরের শিশির, 
 তোমাকে লেখার মতো প্রাঞ্জল ভাষার জন্য 
 সবুজ বৃক্ষের কাছে জোড়হাতে দাঁড়িয়েছি আমি- 
 ঘুরে ঘুরে গুহাগাত্র থেকে নিবিড় উদ্ধৃতি সব 
 করেছি চয়ন; 
 তোমাকে লিখবো বলে জীবনের গূঢ়তম চিঠি 
 হাজার বছর দেখো কেমন রেখেছি খুলে বুক।
 
======

সব তো আমারই স্বপ্ন

সব তো আমারই স্বপ্ন মাথার উপরে এই যে কখনো 
 উঠে আসে মরমী আকাশ কিংবা স্মৃতি ভারাতুর চাঁদ 
 মেলে ধরে রূপকাহিনীর গাঢ় পাতা। কোনো এক 
 কিশোর রাখাল কী করে একদা দেখা পেয়ে গেলো 
 সেই রাজকুমারীর আর পরস্পর ভাসালো গন্ডোলা। 
 সেও তো আমারই স্বপ্ন রূপময় এই যে ভেনিস 
 কী যে সিক্ত বাষ্পাকুল ছিলো একদিন রঙিন বর্ষণে 
 শিল্পের গৌরবে তার মুখচ্ছবি উদ্ভাসিত আর থেকে থেকে 
 জ্যোৎস্নখচিত সারা দেহে খেলে যেতো চিত্রের মহিমা! 
 এসব তো আমার স্বপ্নের মৃত শিশু এই যে কখনো 
 দেখি শৈশবের মতো এক স্মৃতির সূর্যাস্ত, অনুভূতিশীল মেঘ 
 যেন রাত্রি নামে নক্ষত্রের নিবিড় কার্পেটে 
 বুঝি যামিনী রায়ের কোনো সাতিশয় লোকজ মডেল। 
 সব তো আমারই স্বপ্ন তবে, মাঝে মাঝে উদ্যান, এভেন্যু, 
 লোকালয় মনে হয় অভ্রভেদী অব্যক্ত ব্যাকুল 
 এই গাছগুলি কেমন মিষ্টিক আর প্রকৃতি পরেছে 
 সেই বাউল বর্ণের উত্তরীয়! এও তো আমারই স্বপ্ন 
 আঙিনায় একঝাঁক মনোহর মেঘ 
 আর উন্মুক্ত কার্নিশে দোলে নীলিমা, নীলিমা! কিংবা 
 টবে যে ব্যাপক চারাগুলি তাতে ফুটে ওঠে মানবিকতার 
 রাঙা ফুল; এখনো যে কোনো কোনো অনুতপ্ত খুনী 
 রক্তাক্ত নিজের হাত দেখে ভীষণ শিউরে ওঠে ভয়ে 
 আর প্রবল ঘৃণায় নিজেই নিজের হাত ছিঁড়ে ফেলে 
 সেখানে লাগাতে চায় স্নিগ্ধ গোলাপের ডালপালা। 
 সেও তো আমারই স্বপ্ন এই যে চিঠিতে দেখি 
 ভালোবাসারই তো মাত্র স্বচ্ছ অনুবাদ কিংবা 
 একটি কিশোরী এখনো যে বকুলতলায় তার 
 জমা রাখে মৃদু অভিমান; এখনো যে তার গণ্ডদেশ 
 পেকে ওঠে পুঞ্জীভূত মাংসের আপেল। এসব তো 
 আমার স্বপ্নের মৃত শিশু, বিকলাঙ্গ, মর্মে মর্মে 
 খঞ্জ একেবারে! যেন আমি বহুকাল-পোষা 
 একটি পাখির মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে আছি। 
 আমি জানি সবই তো আমার স্বপ্ন নীলিমায় 
 তারার বাসর আর এভেন্যুতে গূঢ় উদ্দীপনা- 
 এইগুলি সব তো আমারই স্বপ্ন, সব তো আমারই স্বপ্ন। 
 
======

মানুষের বুকে এতো দীর্ঘশ্বাস

কেউ জানে না একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস 
 নিয়ে বেড়ায়- 
 কোনো বিষণ্ন ক্যাসেটেও এতো বেদনার সংগ্রহ নেই আর, 
 এই বুকের মধ্যে দীর্ঘশ্বাসের পর দীর্ঘশ্বাস যেন একখানি 
 অন্তহীন প্রগাঢ় এপিক! 
 পাতায় পাতায় চোখের জল সেখানে লিপিবদ্ধ 
 আর মনোবেদনা সেই এপিকের ট্রাজিক মলাট; 
 মানুষের বুকে এতো দীর্ঘশ্বাস, এতো দীর্ঘশ্বাস, কে জানতো! 
 দীর্ঘশ্বাসভরা এই বুকের চেয়ে শীতপ্রধান বিপন্ন অঞ্চল 
 আর কোথাও নেই, 
 এমন হলুদ, ধূসর ও তুষারাবৃত! 
 একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে 
 বেড়ায়, কেউ জানে না 
 হঠাৎ একসঙ্গে অসংখ্য দুঃখ যদি কখনো কেঁদে ওঠে 
 কিংবা যদি 
 প্রাচীন শিলালিপি থেকে সব শোকের গান সশব্দে বেজে যায়, 
 তাহলে যেমন মধ্যাহ্নের আকাশ সহসা দুঃখে ম্লান হয়ে যাবে 
 গোলাপ হবে কৃষ্ণবর্ণ, তার চেয়েও বিষণ্নতা নেমে আসবে 
 মানুষের বুক থেকে এই দীর্ঘশ্বাস যদি বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ে। 
 তেমন সম্ভাবনা আছে বলেই মানুষ বুকের মধ্যে দীর্ঘশ্বাস 
 চেপে রাখে 
 তার চোখে নিয়তই জল ঝরে তবু দেখা যায় না; 
 মানুষের বুকের ভেতর কতো যে দীর্ঘশ্বাস, জমাট বেঁধে আছে 
 কতো যে ক্রন্দন, পাতা ঝরার শব্দ, মৃত্যুসংবাদ 
 মানুষের বুকের মধ্যে ব্যথিত ব্যাকুল ইতিহাস 
 আর আহত সভ্যতা 
 মেঘের মতো ঘনীভূত হতে হতে একেকটি মর্মানি-ক 
 দীর্ঘশ্বাস হয়ে আছে 
 মানুস তাকে বয়ে বয়ে দগ্ধ বেঁচে থাকে; 
 একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস বয়ে 
 বেড়ায়, কেউ জানে না 
 একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস বয়ে 
 বেড়ায়, কেউ জানে না 
 একেকটি মানুষ নিজের মধ্যে কীভাবে নিজেই মরে যায়, 
 হায়, কেউ জানে না! 
 
======

রেখে দিও

এখানে তোমাদের এই অশ্রুহীন চোখ, 
 কয়েক লাইন বিদ্যা মুখস্থ করা গম্ভীর মুখ 
 আর মলাট চিবানো দাঁত দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত; 
 আমি তাই হাত বাড়িয়ে আছি তাদের দিকে 
 যারা ডোবা বিল আর পুকুরে পদ্মফুল ফোটায়, 
 বাংলা সন-তারিখ দিয়ে চিঠি লেখে; 
 
 আমি তোমাদের দিকেই তাকিয়ে আছি, যদি পার 
 একগুচ্ছ তৃণ আর একফোঁটা অশ্রু 
 আমার জন্য রেখে দিয়ো; 
 আমি তার গন্ধে মৃত্যুলোক থেকে জেগে উঠতে পারি। 
 
 আজ আর আমার শহরের এই অন্ধ 
 ফুটপাতের কাছে, 
 এই সব মুখোশ-পরা মুখের কাছে 
 কিছুই চাওয়ার নেই; 
 দাঁত আর নখের গর্বে যারা মত্ত তারা কেন 
 আমার জন্য কখনো চোখের জল ফেলতে যাবে? 
 
 তোমরা যারা ডোবা-বিল খেতখামারের লকলকে 
 ঘাসের মধ্যে ডুবে আছ, 
 তোমরা যারা গায়ে মাখ পাকা ধানের গন্ধ, 
 তাদের বলি, আমার জন্য রেখে দিয়ো 
 একফোঁটা অশ্রু।
 
======

বসন্তের একটি বাংলা উদ্বৃতি

চুনা-ওঠা দেয়ালের মতো প্রকৃতির এই খসখসে গালে 
 আর কী রং মাখাবে চৈত্র, 
 তোমার পকেটে ভাঁজ-করা শতবর্ষের শীতকাল, 
 মাতাল হাওয়ায় যতই এই বার্ধক্য ঢেকে দিতে চাও 
 তার মুখমণ্ডলে জমে আছে 
 উত্তর গোলার্ধের অনন্ত বরফ 
 তার শরীর ২৫ ডিগ্রি মাইনাস শীত রাত্রে; 
 
 কেনা জ্যেত্স্না, গোলাপ আর সৌরভের জন্য 
 হাহাকার করে 
 আমি কতোকাল শিশুর মতো হামাগুড়ি দিয়ে 
 এই শীতকাল পেরুব? গুনগুন করা চৈত্রসন্ধ্যা 
 মধুর দুপুর 
 এখনো আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে, 
 আমি সাড়া দেই না; 
 কেন দেব? আমার শীত কখন অস্ত যাবে, 
 কেউ জানে না। 
 
 হয়ত তবু সদ্যফোটা স্তনের গন্ধে, ঠোঁটের লাবণ্যে 
 জেগে উঠবে ঝিমিয়ে-পড়া দিনরাত্রি, 
 একুশ শতকের এই দীর্ঘ শীত পাড়ি দেওয়ার জন্য 
 আর কতো হিমযুগ পার হতে হবে আমাকে, 
 বসন্ত, তোমার হাতবাক্সে কি সেই উত্তর লেখা আছে? 
 চলো বসন্তের একটি বাংলা উদ্ধৃতি শোনাতে শোনাতে 
 আমরা পৃথিবীর সব নদী পার হই।
 
======

চিঠি দিও

করুণা করে হলে চিঠি দিও, খামে ভরে তুলে দিও 
 আঙুলের মিহিন সেলাই 
 ভুল বানানেও লিখো প্রিয়, বেশি হলে কেটে ফেলো তাও, 
 এটুকু সামান্য দাবি চিঠি দিও, তোমার শাড়ির মতো 
 অক্ষরের পাড়-বোনা একখানি চিঠি। 
 চুলের মতন কোনো চিহ্ন দিও বিস্ময় বোঝাতে যদি চাও 
 সমুদ্র বোঝাতে চাও, মেঘ চাও, ফুল, পাখি, সবুজ পাহাড় 
 বর্ণনা আলস্য লাগে তোমার চোখর মতো চিহ্ন কিছু দিও! 
 আজো তো অমল আমি চিঠি চাই, পথ চেয়ে আছি 
 আসবেন অচেনা রাজার লোক 
 তার হাতে চিঠি দিও, বাড়ি পৌঁছে দেবে। 
 এক কোণে শীতের শিশির দিও একফোঁটা, সেন্টের শিশির চেয়ে 
 তৃণমূল থেকে তোলা ঘ্রাণ 
 এমন ব্যস্ততা যদি শুদ্ধ করে একটি শব্দই শুধু লিখো, তোমার কুশল! 
 ওই তো রাজার লোক যায় ক্যাম্বিসের জুতো পায়ে,কাঁধে ব্যাগ, 
 হাতে কাগজের একগুচ্ছ জীজন ফ্লাওয়ার 
 কারো কৃষ্ণচূড়া, কারো উদাসীন উইলোর ঝোপ, কারো নিবিড় বকুল 
 এর কিছুই আমার নয় আমি অকারণ 
 হাওয়ায় চিৎকার তুলে বলি, আমার কি কোনো কিছু নাই? 
 করুণা করেও হলে চিঠি দিও, ভুলে গিয়ে ভুল করে একখানি চিঠি 
 দিও খামে 
 কিছুই লেখার নেই তবু লিখো একটি পাখির শিস 
 একটি ফুলের ছোটো নাম, 
 টুকিটাকি হয়তো হারিয়ে গেছে কিছু হয়তো পাওনি খুঁজে 
 সেইসব চুপচাপ কোনো দুপুরবেলার গল্প 
 খুব মেঘ করে এলে কখনো কখনো বড়ো একা লাগে, তাই লিখো 
 করুণা করেও হলে চিঠি দিও, মিথ্যা করে হলে বলো, ভালোবাসি। 
 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

5 মন্তব্যসমূহ

  1. প্রতিটা কবিতা
    যেনো নিজেরই মনের কথা
    সমৃৃৃদ্ধ হলাম

    উত্তরমুছুন
  2. প্রতিটি কবিতা বারবার পড়তে ইচ্ছে করে।

    উত্তরমুছুন
  3. মহাদেব সাহার কবিতাগুলো
    মনের ভিতরের মনকে নাড়া দেয়। এক কথায় অপূর্ব সৃষ্টি।

    উত্তরমুছুন
  4. মহাদেব সাহার কবিতাগুলো
    মনের ভিতরের মনকে নাড়া দেয়। এক কথায় অপূর্ব সৃষ্টি।

    উত্তরমুছুন