নজরুলকাব্যে মিথোলজি - অলিপা পাল




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

নজরুলকাব্যে মিথোলজি


সমাজের আদিম অসংলগ্ন অবস্থার সবচেয়ে প্রাচীন কাব্য পূরাণ ৷পূরাণ কাহিনী ও ধর্মকাহিনীর উদ্ভব থেকে, প্রকৃতি ও সঙ্ঘবদ্ধ মানুষের মনের প্রতিক্রিয়া কিন্তু পরবর্তী কালে,কাব্য সাহিত্যে পূরাণ বেঁচে রইল নূতন অর্থ ও তাৎপর্য নিয়ে ৷আধুনিক কালে বাংলা সাহিত্যে পূরাণকে আমরাপাই রূপক ও প্রতীক হিসাবে ৷রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে পূরাণ কাহিনী অতীতের বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে আধুনিক ভাবের বাহন হয়েছে ৷রবীন্দ্রকাব্যে পুরাণের ব্যবহার অপেক্ষাকৃত কম হলেও তাঁর পরবর্তী নজরুলের কাব্যে পূরাণের ব্যবহার সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ৷নজরুল কাব্যে পূরাণের ব্যবহার পুরাণ হিসাবে
নয় ৷আধুনিক কাব্যের ভাবের বাহন ও প্রতীক হিসাবে ৷কাহিনী গুলো প্রাচীন ধর্মগতগণ্ডী থেকে মুক্তি পেয়ে একটা সার্বজনীন রূপে সাধারণ ভাব প্রকাশের মাধ্যম রূপে ব্যবহৃত হয়েছে ৷ আমরা ধর্মান্ধতার দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে পৌরাণিক কাহিনীর ব্যবহারকে একমাত্র পৌরাণিক অর্থেই সংকীর্ণ ভাবে বিচার করি ৷নজরুল কাব্য থেকে দেখাযায় হিন্দু ও মুসলিম দুই সমাজের এমনকি বাইবেল গ্রীক প্রচলিত কাহিনী কবি অসংকোচে গ্রহণ করেছেন ৷এদেশের দুটি প্রধান সমাজের পূরাণ কাহিনী কে সমান ভাবে ব্যবহার করা একমাত্র নজরুল ইসলামের পক্ষেই সম্ভব হয়েছে এবং সার্থক ও সুন্দর হয়েছে ৷

বিজ্ঞান যেমন আমাদের ধারণাকে বিশ্বাসে স্থাপন করায় তেমনি কবিতায় পূরাণের ব্যবহার চেতনাকে প্রাণদেয়,উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা যোগায় ৷কবির ছিলো হিন্দু ইসলাম বাইবেল গ্রীক পূরাণের প্রতি অগাতজ্ঞান,আর সেই জ্ঞানকে প্রয়োগ করে,অপূর্ব ছন্দে অলংকারে আলোকিত করেন বাংলার
কাব্যজগৎ ৷তিনি কাব্যে পূরাণ প্রয়োগ করে অতীত জীবন সত্যের সঙ্গে বর্তমানের সত্যকে এক করে পাঠকের হৃদয়ে পৌছে দিয়েছেন এক অচেনা সৌরভ৷

পূরাণ প্রসঙ্গ প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাঁর কবিতায় দেখায়ায় সুনির্দিষ্ট কিছু নাম,ঘটনা,এবং পটভূমি ৷এ গুলোই হলো তাঁর মিথ-মস্কতার স্থায়ী উদ্দেশ্য নজরুলের কবিতায় পূরাণের উল্লেখ  কতখানি মেলে? এমন প্রশ্ন উঠলে শুরুতেই যেটা মনে আসে তা হল বিখ্যাত বিদ্রোহী কবিতার সুপরিচিত পংক্তি ৷"আমি বিদ্রোহী ভৃগু ভগবান বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন" ৷এই কবিতায় আরও একবার এই চরণটি পুনরায় এসেছে —শুধু সেখানে 'দিই' পরিনত হয়েছে 'দেব' এ ৷

যে কবিতা গুলির মধ্যদিয়ে কবিরপূরাণের প্রতি অভিব্যক্তি ফুটে  উঠেছে
______'বিদ্রোহী','পূজারিণী','মানুষ',
'বারাঙ্গনা','সব্যসাচী','ইন্দ্রপতন',—এই ৬টি কবিতায় পূরাণপ্রসঙ্গ প্রয়োগের পরিমান খুব বেশি*৷
তাছাড়া আছে 'আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে','অবেলার ডাক','শায়ক বেঁধা পাখি','ছাত্রদলের গান','সাম্যবাদী','পাপ','নারী','কুলি-মজুর','দ্বীপান্তরের বন্দিনী','সত্য কবি','সত্যেন্দ্র প্রয়াণ গীতি','অন্তর-ন্যাশনাল সঙ্গীত','পথের দিশা','হিন্দু-মুসলিম
যুদ্ধ','সিন্ধু','অনামিকা','দারিদ্র্য','চাদনী রাতে','সান্ত্বনা','অগ্রপথিক','চিরঞ্জীব জগলুল",'এ মোর অহংকার','জীবনবন্দনা','ফরিয়াদ', ৷

এই সমস্ত কবিতার মধ্যে রামায়ণ,মহাভারত,শিবপ্রসঙ্গ, বিষ্ণুকথা,কৃষ্ণকথা,অমৃতমন্থনবৃতান্ত,দধীচির আত্মদান,গ্রীক,খৃষ্টীয়,মুসলিম
পূরাণতত্ত্বের প্রকাশঘটে তার কবিতায়৷ ব্যপকতম ব্যবহার ঘটেছে রামায়ণ ও মহাভারতের  চরিত্র,ঘটনা ইত্যাদির* ৷

পূরাণঅনুষঙ্গের পাশে বন্ধনীতে কবিতার নামের তালিকা উল্লেখিত:—
রামায়ণ প্রসঙ্গ:— ( কবির কাব্যের চরিত্র ও ঘটনা)

অনাদৃতা সীতা(পূজারিণী), লঙ্কাসায়ারে কাঁদে বন্দিনী ভারতলক্ষ্মী সীতা(সব্যসাচী), সীতারাম সতী(বারাঙ্গনা),
রামরাজা দিল সীতারে বিসর্জন,তাঁরাও হয়েছিলো যজ্ঞে জানকীর প্রয়োজন(ইন্দ্রপতন),অসুর-নাশিনী জগন্মাতার অকাল উদ্বোধনে,আঁখি উপাড়িতে গেছিলেন রাম(ইন্দ্রপতন),লঙ্কাকাণ্ডে(সব্যসাচী),জ্বলিবে তাহার আঁখির সমুখে কাল রাবণের চিতা(সব্যসাচী), জনক(মানুষ),মন্দোদরী(মানুষ) ৷

মহাভারত প্রসঙ্গে:—(কবির কাব্যের
 চরিত্র ও ঘটনা)
সব্যসাচী
—————
কুরুক্ষেত্রে,,জাগিছে সব্যসাচী,,বিরাট কালের অজ্ঞাতবাস ভেদিয়া পার্থ জাগে,,দানিতে দীক্ষা আসিতেছে ফাল্গুনী,,যুগে যুগে হল শ্রীভগবান তাঁহারি রথ-সারথি,,যুগে যুগে আসে গীতা উদ্গাতা,ন্যায় পান্ডব সৈন্যের ত্রাতা,,বাজিছে বিধান, পাঞ্চজন্য,,গাণ্ডীব ধনু রাঙিয়া উঠিল,,লক্ষ লাক্ষারাগে,,রথের সমুখে বসায়ো চক্রী চক্রধারীরে টানি,,দুর্মতি কুরুসেনা,দুর্যোধনের পদলেহী ওরা,দুঃশাসনের কেনা,,দ্বাপর যুগের মৃত্যু ঠেলিয়া,,আসে নৃসিংহ ৷

ইন্দ্র পতন
——————
অকল্যাণের কুরুক্ষেত্র,,কৃষ্ণের মহাগীতা,,সত্যের পাঞ্চজন্য,,
কুরু-মেদ-ধূমে জ্বলে অত্যাচারের চিতা,,যুধিষ্ঠিরের সম্মুখে রণে পড়িল সব্যসাচী,কৌরব সেনা ওঠে উল্লাস নাচি,,স্বরাজ-রথের চক্র করিল গ্রাস,,
দাতাকর্ণের সম নিজ সুতে কারাগার-যুপে ফেলে ত্যাগের করাতে কাটিয়াছ,,হে যুগ ভীষ্ম! নিন্দার শরশয্যায় শুয়ে,,তুমি নব-ব্যাস,,নব যুগের হরিশচন্দ্র,,নব-নৃসিংহ অবতার,,আর্ত-মানব-হৃদি প্রহ্লাদ ৷

বারাঙ্গনা
—————
স্বর্গবেশ্যা ঘৃতাচীপুত্র হল মহাবীর দ্রোণ,,কুমারীর ছেলে বিশ্বপূজ্য কৃষ্ণ-দ্বৈপায়ণ,,কানীনপুত্র কর্ণ হইল দানবীর মহারথী,,শান্তনু রাজা নিবেদিল প্রেম পুনঃ সেই গঙ্গায়—তাঁদেরি পুত্র অমর ভীষ্ম, কৃষ্ণ প্রণমে যাঁয় ৷

শিব-প্রসঙ্গে:—(কবির কাব্যের চরিত্র ও ঘটনা)
মহাপ্রলয়ের আমি নটরাজ,,আমি ধূর্জটি,,কৃষ্ণকন্ঠ,মন্থন বিষ প্রিয়া,,
বোমকেশ,ধরি বন্ধনহারা ধারা গঙ্গোত্রীর,,মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে,,ধরি পিনাকপানির ডমুর ত্রিশুল
(বিদ্রোহী)
এলো ভোলানাথ,,শ্মশানের শিব
(মানুষ)
ব্যাথাবিষে নীলকন্ঠ,,পরশু ত্রিশুল,,
মহাকাল ভৈববর নেত্র,,হারা-সতী উমা হয়ে ফিরে ডেকেছিল ভোলানাথে,,
(পুজারিণী)

বিষ্ণু-প্রসঙ্গে:—
আমি বিদ্রোহী ভৃগু ভগবান বুকে একে দিই পদচিহ্ন,,ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু বক্ষ হইতে যুগলকন্যা,,চক্র মহাশঙ্খ
(বিদ্রোহী)
অবতার,,কল্কি(সান্ত্বনা)
ভৃগুর মতন যখন দেখেছ অচেতন নারায়ণ,পদাঘাতে তাঁর এনেছ চেতনা,,
নর-নৃসিংহ অবতার,,শতদল নারায়ণ পদতলে,,শঙ্খ-চক্র গদা যাঁর হাতে,,
পায়ের পদ্ম হাতে ওঠে,,বিষ্ণু দিলেন ভাঙনের গদা(ইন্দ্রপতন)

কৃষ্ণ প্রসঙ্গে:—
কারার কেশব,,বংশীধারী,,অনাগত বৃন্দাবনে মা যশোদা শাঁখ বাজায়,,
মিলনরাস,,মৃত্যু বাসদেবের কোলে
(সান্ত্বনা)
কংসকারায় কংসহন্তা,,যুগে যুগে আসে গীতা উদগাতা,,যুগে যুগে হন শ্রীভগবান তাঁহারি রথ সারথি,,বাজিছে বিষাণ পাঞ্চজন্য(সব্যসাচী)
                 
        ~: ইসলামীয় পূরাণ :~ 

মোহম্মদ(মানুষ),ফেরেশতা(অবেলার ডাক,পাপ),হারুত-মারুত(পাপ),
জোহরা(পাপ),হাবিয়া দোজখ(বিদ্রোহী),জাহান্নামের আগুন(বিদ্রোহী),জিব্রাইলের আগুনের পাখা(বিদ্রোহী),ইস্রাফিলের শৃঙ্গার(বিদ্রোহী)

          ~:বাইবেলীয় পূরাণ:~

আদম,,দাউস,,মুসা,,ইসা,,ইব্রাহিম,,যত নবী ছিলো মেষের রাখাল(মানুষ)
জনমিল মুসা,রাজভয়ে মাতা শিশুরে ভাসায় জলে(চিরঞ্জীব জগলুল)
যীশু,,মেরী(বারাঙ্গনা)

           ~:গ্রীকীয় পূরাণ:~

আর্ফিয়াসের বাঁশরি(বিদ্রোহী)


        প্রাসঙ্গিক তালিকা থেকে নজরুলের মিথমনস্কতার কতগুলি লক্ষণ নজরে পড়ে ৷
পূরাণকাব্যের মধ্যে মহাভারতের কাহিনী তাঁকে সবচেয়ে বেশি প্রেরণা দিয়েছিল ৷উল্লেখযোগ্য বিষয় সীতা সম্পর্কে নজরুল প্রবল সংবেদনশীল হলেও,তাঁর কবিতায় ভারতীয় পূরাণের আর একটি সমান হয়তো বেশি,গুরুত্ব সম্পন্ন নারী চরিত্র দ্রৌপদীর একবারও উল্লেখ মেলেনা ৷
যেখানে গান্ধারী,গঙ্গা,মন্দোদরী,
অহল্যা, শকুন্তলা,অশোকবনের চেড়ীরা অবধি এক বা একাধিকবার উপস্থিত সেখানে দ্রৌপদীর মতো আকর্ষণীয় এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের অনুপস্থিতির কোন
ব্যাখ্যানেই ৷যেখানে কুরুক্ষেত্রর যুদ্ধ কবির মনে প্রবল ভাবে অভিঘাত সৃষ্টিকরেছিলো,সে ক্ষেত্রে যুদ্ধের
অন্যতম মূখ্যচরিত্র অনুপস্থিত ৷
কবির ভাবনার গভীরতম স্তরে কৃষ্ণ-কংস-বৃত্তান্ত এবং মোজেস-ফারাও একই ভাবব্যঞ্জনায় প্রকাশ পেয়েছে ৷সত্য রক্ষার জন্য নিজের সন্তানকে হত্যা করেছিলেন কর্ণ এবং আব্রাহাম দুজনেই ৷বহু ক্ষেত্রেই নজরুল নিজেকে পূরাণের কোনো চরিত্রের সাথে তুলনা করেছেন ৷কখন তিনি দধীচি,কখন ভৃগু, কখন অগস্ত্য ,আবার কখন অর্জুন ৷মনো বিজ্ঞানে যাকে " Identification of the self with imaginary sequences" হিসাবে গণ্য করা হয় ৷তার চূড়ান্ত অভিব্যক্তি নজরুল দেখিয়েছেন বিদ্রোহী কবিতায় ৷ পূরাণ চরিত্রে, নিজেকে সেই চরিত্রে ভেবে নেওয়ার আড়ালে কবি এতটাই মগ্নছিলেন যে,নিজের মন সম্বন্ধে সচেতন না থাকার প্রবণতা অবশ্যই ছিলো ৷হয়ত,কবির পূরাণ ব্যবহারের সুবিশাল ফর্দ থেকেই তা পাওয়া যায় ৷

       তাঁর পূরাকাব্য থেকে বোঝা যায় তিনি তাঁর মনের গভীরের অর্থাৎ অন্তর্কাঠামোর বাইরের দিকে পূরাণ রেখেছেন ৷সচরাচর ব্যপারটা ঠিক উল্ট হয়, পূরাণ থাকে ভাবনার ভেতরে ৷


 তিনি মাইকেলর মত পুনরায় ব্যাখ্যা করেননি কিংবা রবীন্দ্রনাথের মত পুনরায় সৃষ্টি করেননি যেমন "মেঘনাদবধকাব্য" এবং "কর্ণ-কুন্তী" সংবাদ ৷
ভৃগুপদ লাঞ্ছিত নারায়ণের যে বিবরণী বিষ্ণুপূরাণে আছে,সেখানে ভৃগুর দুঃসাহসকে ভক্তির অভিব্যক্তি হিসাবে প্রকাশ করা হয়েছে ৷নজরুল নিজের মনের গভীরতায় পূরাণের ভৃগুকে প্রকাশ করেছে বিদ্রোহী রূপে ৷

পূরাণ মতে স্বর্ণলঙ্কাদহন,ধর্মের প্রতিষ্ঠাকল্পে ৷কিন্তু নজরুলের কবিতায় এই ছবি তে এসেছে দেশপ্রেমের সঙ্কেত ৷
নজরুল নিজেকে দধীচি রূপে বারংবার যে কল্পনা করেছেন ৷এ যুগের দধীচি শুধু ভাঙনের বজ্রই জোগান না,সৃষ্টির গানও বাজে ৷কবির পূরাণের প্রতি উপলব্ধি র এটাই সম্ভবত চূড়ান্ত সীমা ৷
নজরুল পূরাণবিদ নন কিম্বা পূরাণভিত্তিক সৃষ্টিও করেননি ৷কিন্তু পূরাণকথা —স্বদেশের,বিদেশের—তাঁকে প্রেরণা জুগিয়েছে অবিরাম ৷

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

4 মন্তব্যসমূহ