ছড়া লেখার নানা কৌশল | এ কে আজাদ




পোস্ট বার দেখা হয়েছে
ছবি : সংগৃহীত

ছড়া লেখার নানা কৌশল:
ছড়ার বাড়ি রঙের হাঁড়ি, রঙ ছড়ানো সারা বাড়ি


লোকসাহিত্যের এক অতি চমকপ্রদ শাখা হলো ছড়া। সাহিত্যের এই শাখা চিরসবুজ হলেও, এতে রয়েছে রঙধনুর সাত রঙের সমাহার। ‘বেনীআসহকলা’ মিশে আছে আকাশের নীলে, গ্রামের সবুজে, প্রজাপতির পাখনায়, পাখির ডানায়, মায়াবী জ্যোস্নায়; এমনকি রঙ লেগে আছে রাতের নরম আঁধার কোলেও। রঙে রঙে বহুরূপে রঞ্জিত এই পৃথিবীর সন্তান বহুরূপী মানুষের মন এবং মগজে, মেধা এবং মননেও লেগে আছে রঙ। রঙ লেগে আছে মানুষের ভাব প্রকাশের ভাষাতেও। আর তাই তো ভাষায় রয়েছে এত রূপ, এত ছন্দ, এত লালিত্য আর এত মায়া। বাহ্য জগতের রূপ-রস এবং গন্ধ-স্পর্শ শব্দের মাধ্যমে আত্মগত অনুভূতি-রসে স্নিগ্ধ করেই একজন ছড়াকার সেই মায়াবী ভাষাতে প্রকাশ করেন তাঁর ব্যক্তি অনুভূতি-নিরপেক্ষ বিশ্বজগতের বস্তু সত্বাকে। বোধ করি, সে কারণেই জন্মসিদ্ধি লাভ করে ছড়ার মত এমন মনকাড়া সাহিত্য। 

ছড়া আসলে কি? কলকাতার ‘সাহিত্য সংসদ’ প্রকাশিত এবং শৈলেন্দ্র বিশ্বাস (এম.এ.) কর্তৃক সংকলিত “সংসদ বাঙ্গালা অভিধান’ মতে ছড়া হলো- “গ্রাম্য কবিতা বিশেষ; শিশু ভোলানো বা মেয়েলী কবিতা”। 

আশুতোষ দেব কর্তৃক সংকলিত ‘স্টুডেন্টস্ ফেভারিট ডিকশনারী (বাংলা টু ইংরেজি)’তে ছড়া-এর ইংরেজি প্রতিশব্দ করা হয়েছে- ‘Doggerel Verse’ (ডগারেল ভার্স) অর্থাৎ মূল্যহীন অকেজো ছড়া। যতটুকু বুঝি- এটাকেই বোধ হয় “ননসেন্স রাইম” বলা হচ্ছে। 

তবে সমধিক গ্রহণযোগ্য ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো- রাইম (‘Rhyme’)। আশুতোষ দেব সংকলিত এবং দেব সাহিত্য কুটির (প্রাঃ) লিঃ প্রকাশিত ‘স্টুডেন্টস্ ফেভারিট ডিকশনারী (ইংরেজি টু বাংলা)’ তে ‘রাইম’ এর অর্থ করা হয়েছে - “শব্দের বা কবিতার চরণের ধ্বনির বা শব্দের মিল; মিত্রাক্ষর কবিতা”। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত এ, এস, হর্নবি সংকলিত অক্সফোর্ড এ্যাডভান্স লার্নারস্ ডিকশনারি অব কারেন্ট ইংলিশ এ ‘রাইম’ এর অর্থ করা হয়েছে- 

Rhyme: “A short poem in which the word or syllable at the end of each line has the same sound as the word at the end of another line.  (See – also Nursery Rhyme).” 
স্বল্প পরিসরে ছোট্ট কবিতা (পদ্য) যার এক চরণের শেষের শব্দ বা শব্দাংশের ধ্বনির সাথে আরেক চরণের শেষের শব্দ বা শব্দাংশের ধ্বনির মিল অর্থাৎ অন্ত্যমিল হয়। 

উদাহরণ স্বরূপ নার্সারী রাইম (Nursery Rhyme) এর কথা বলা হয়েছে।  

Nursery Rhyme:  A simple traditional poem or song for the children. (শিশুদের জন্য রচিত সহজ-সরল প্রথাগত কবিতা বা গান।)

রায় রাধিকা নাথ বোস এবং টি. এস. স্টার্লিং রচিত “রেটরিক এন্ড প্রোসোডি” বইতে ছড়ার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে- “Rhyme denotes the recurrence of similar sounds in the closing syllables of different verses”. (কবিতার চরণের সমাপনী শব্দাংশে সমজাতীয় ধ্বনির পুনরাবৃত্তিকেই ছড়া বলা হয়।) 

“এ গ্লোসারী অব লিটার‌্যারী টার্মস্” এর প্রণেতা এম. এইচ. আব্রামস্ এর মতে ছড়ার এই ধ্বনির মিল দুই প্রকারের। যথাঃ- 

১. ইন্টারন্যাল রাইম বা অন্তর্গত মিল, অর্থাৎ অন্তঃস্থিত ধ্বনির মিল অথবা ছন্দমিল- ছড়া পড়তে গেলে পাঠকের হৃদয়মর্মরে বা কন্ঠস্বরে কিংবা শ্রোতার কর্ণকুহরে যে মিল ধ্বনিত হয়; এবং

২. এন্ড রাইম বা অন্ত্যমিল বা চরণান্তিক মিল, অর্থাৎ এক চরণের শেষের শব্দ-ধ্বনির সাথে আরেক চরণের শেষের শব্দ-ধ্বনির মিল। 

আমেরিক্যান সাহিত্য সমালোচক প্রফেসর বেইন এর মতে “It (Rhyme) is so pleasing and so easily understood as to stand higher than any other poetic artifice in popular estimation” (ছড়া এতটাই তৃপ্তিদায়ক এবং সহজেই বোধগম্য যে জনবিবেচনায় এটি অন্য যে কোন সাহিত্য কর্মের চেয়ে এর অবস্থান উচ্চে।) 

অন্নদা শঙ্কর রায়ের মতে - ‘ছড়া চোখে দেখবার জিনিস নয়, কানে শুনবার’। অর্থাৎ ছড়ায় যেমন অন্ত্যমিল থাকে, তেমনি থাকে গতিশীল ছন্দময়তা। চঞ্চলা হরিণীর মত নেচে চলে ছড়া, এ যেন পাহাড় থেকে নেমে আসা মনোমুগ্ধকর ঝর্ণাধারা। ছড়ায় থাকে “বেস্ট ওয়ার্ডস্ ইন বেষ্ট ওয়ার্ডার” (ইংরেজ কবি এস টি কোলরিজ)। ছড়ার যে গতিময়তা প্রাণে দোলা জাগায় তা-ই ছড়ার ছন্দ। ছন্দ হলো ছড়ার প্রাণ আর অন্ত্যমিল হলো ছড়ার পোশাক আশাক। ছন্দমিল আর অন্ত্যমিল এক সাথে গড়ে তুলে এক চঞ্চলা গ্রামীণ কিশোরীকে, যার পায়ের নূপুর ঝুমুর ঝুমুর তালে আবেশী ঢং-এ দোলা জাগায় প্রাণে। আর ছড়ায় থাকে ভাষার সরলতা, যদিও শব্দমালায় কখনো সখনো থাকে কথার চাতুরী। তাই বুঝি সর্বসাধারণে ছড়ার এত জনপ্রিয়তা। 

যাহোক, এতক্ষণে হয়ত এ কথা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে ছড়ার প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট হলো - 

১. সংক্ষিপ্ত রূপ,
২. প্রথাগত লোকজ বিষয়,
৩. গীতিময় গতিশীল ছন্দ,
৪. ভাষার সরলতা এবং 
৫. অন্ত্যমিল বা অনুপ্রাস। 

অন্ত্যমিলান্তিক ধ্বনির শব্দ বা শব্দাংশের (সিলেবল) সংখ্যাগত দিক থেকে ছড়া তিন প্রকার। যথাঃ- 

১. পুং-অন্ত্যমিল (Male Rhyme/Single Rhyme): যার প্রতিটি চরণের শেষে একটি মাত্র সিলেবল বা শব্দাংশ থাকে। যেমনঃ-
ট্রাক! ট্রাক! ট্রাক!
শুয়োরমুখো ট্রাক আসবে
দুয়োর বেঁধে রাখ্  । (আল মাহমুদ) 

২. স্ত্রী-অন্ত্যমিল বা দ্বৈত-অন্ত্যমিল (Female Rhyme/Double Rhyme): যার প্রতিটি চরণের শেষে দুইটি সিলেবল বা শব্দাংশ থাকে। যেমনঃ-

আম্মা বলেন পড়রে সোনা
আব্বা বলেন মন দে,
পাঠে আমার মন বসে না
কাঁঠাল চাঁপার গন্ধে।   (আল মাহমুদ)

৩. ত্রৈয়ী অন্ত্যমিল (Triple Rhyme): যার প্রতিটি চরণের শেষে তিনটি  সিলেবল বা শব্দাংশ থাকে। যেমনঃ-  

বিষটি এলো কাশ বনে
জাগল সাড়া ঘাস বনে (ফররুখ আহমদ)

অন্ত্যমিলান্ত ধ্বনির গঠন অনুযায়ী ছড়া আবার দুই প্রকার। যথাঃ-  

১. স্বাভাবিক/পূর্ণ ছড়া (Perfect/True/Full Rhyme)t পূর্ণ অন্ত্যমিলযুক্ত ছড়া- যে ছড়ায় ছড়াকার পূর্ণ আস্থার সাথে অন্ত্যমিল গঠন করতে পারেন। যথাঃ- উক্ত ছড়ায় “কাশ বনে” এর সাথে “ঘাস বনে” এর অন্ত্যমিল। 

২. অস্বাভাবিক/অপূর্ণ ছড়া (Forced/Imperfect/Partial/Near/Para Rhyme)t যে ছড়ায় অন্ত্যমিলান্ত ধ্বনির সাযুজ্য (Coherence/Correspondence) হয় না বরং  শব্দের অসদ্ব্যবহার (Maltreatment) হয় যাতে এই ধারনাবোধ হয় যে ছড়াকার যেন ছড়ার অন্ত্যমিলের নিকট অসহায়ভাবে আত্মসমর্পন করেছেন- এই রকম ছড়াকে অস্বাভাবিক বা অপূর্ণ ছড়া (Forced/Imperfect/Partial/Near/ Para Rhyme)  বলে।  

যেমনঃ-           
একুশে ফেব্রুয়ারী 
তুমি কার
বরকত সালাম
না সফিকের
তেমনি ‘সুবাস’ এর সাথে ‘আকাশ’, এবং ‘আবাস’ এর সাথে ‘উল্লাস’ এর অপূর্ণ অন্ত্যমিল। 

ছড়ার বিষয়-আশয় নিয়ে আলোকপাত করার পূর্বে ছড়া সম্বন্ধে কয়েকজন কবি ও ছড়াকারের বক্তব্য উত্থাপন করার প্রয়োজন বোধ করছি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরঃ 

“বাংলা ভাষায় ছেলে ভুলাইবার জন্য যে সকল মেয়েলী ছড়া প্রচলিত আছে, আমাদের ভাষা এবং ইতিহাস নির্ণয়ের পক্ষে সেই ছড়াগুলির বিশেষ মূল্য থাকিতে পারে। কিন্তু তাহাদের মধ্যে যে একটি সহজ স্বাভাবিক কাব্যরস আছে সেটিই আমার নিকট অধিকতর আদরনীয় বোধ হয়। এই সকল ছড়ার মধ্যে একটি চিরত্ব আছে। কোনটির কোন কালে কোন রচয়িতা ছিল বলিয়াও পরিচয় নাই এবং কোন্ সনের কোন্ তারিখে কোনটা রচিত হইয়াছিল এমন প্রশ্নও কাহারও মনে উদয় হয় না। এই স্বাভাবিক চিরত্বগুণে ইহারা আজ রচিত হলেও পুরাতন এবং সহস্র বৎসর পূর্বে রচিত হলেও নূতন। (ছেলে ভুলানো ছড়াঃ লোক সাহিত্য)” 

অন্নদা শঙ্কর রায়ঃ

“জনসাহিত্যের মতই আমি ছড়াকে নিলুম। এমন লেখা যা সেলফ্ কন্সাশ না হয়ে মানুষ পড়ে। যা পড়ার দরকার নেই। শুনলেই সবাই বুঝে, বুঝতে পারে। .. .. .. .. .. ছড়ার ছন্দ একটু দুলকি চালে চালে .. .. .. .. যাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন ‘ছড়ার ছন্দ’। .. .. .. .. .. আর ছড়ার মিল? দু’সিলেবল হবেই। তিন সিলেবল হলে আরও ভাল হয়। আর শেষে কোন যুক্তাক্ষর থাকবে না। 
ছড়া হবে ইররেগুলার, হয়তো একটু আন্ইভেন। বাকপটুতা বা কথার কারিকুরি নয়। কবিতার থেকে ছড়া আলাদা। ছড়াকে কবিতার মধ্যে ঢোকাতে গেলে কবিতাকে ব্যপ্ত করে নিতে হয়। কবিতা তো যে কোনভাবেই হয়, যে কোন ছন্দে, এমনকি গদ্যেও। ছড়ার কিন্তু একটাই ছন্দ, রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছেন - ছড়ার ছন্দ, একটু দুলকি চালে চালে, শাস্ত্রমত নামও একটু আছে তার। ছড়াকে ওই ছন্দেই লেখা যায় শুধু।   (প্রসঙ্গঃ ছড়া। স্রোতের দীয়া)”  
                                                                                           
ছড়ার বিষয়-আশয়ঃ

ছেলে ভুলাইবার জন্য ছড়া কাটা হতো। কিন্তু কালের বিবর্তনে ছড়ার বিষয়ে এসছে ব্যপকতা। ছড়ায় উঠে আসছে ছেলে ভুলানো গান, রম্যরস, সমাজচিত্র, রাজনীতির হালচাল, এমনকি সমাজের নানাবিধ বিষয় ব্যাঙ্গাত্মকভাবেও স্থান পাচ্ছে ছড়ায়। নিম্নে তার মধ্য থেকে দু’চারটি বিষয়ের আলোকপাত করা হলো।  

১. ছেলে ভুলানো এবং আবেগপূর্ণঃ- 

নানাবিধ বিষয়ের মধ্যে ছেলে ভুলানোটা ছড়ার প্রধান বিষয় বলে অনেকে মনে করেন। তবে এই ছড়ায় থাকে উপমার চমকপ্রদ ব্যবহার, গভীর আবেগ, হৃদয়ানুভূতি এবং কল্পনার সংমিশ্রণও এই ধরনের ছড়াকে চিত্তাকর্ষক করে তোলে । যেমনঃ- 
আয় আয় চাঁদমামা
টিপ দিয়ে যা,
চাঁদের কপালে চাঁদ
টিপ দিয়ে যা।    (প্রচলিত) 
 
ছেলের কিছু একটা বায়না ভুলানোর জন্যই ছেলেকে চাঁদ দেখাচ্ছেন আর এমন ছড়া কাটছেন মা। চাঁদকে মামা বলে ডেকে আত্মিক পার্সোনিফিকেশন এর মাধ্যমে এক চমৎকার কাব্যালঙ্কার ব্যবহার করা হয়েছে প্রচলিত এই ছড়ায়। অন্ত্যমিলের অভিনবত্ব নেই, অথচ রয়েছে যেমন মনকাড়া উপমা, তেমনি রয়েছে গভীর আবেগ এবং সন্তানের প্রতি এক স্নেহময়ী মায়ের প্রগাঢ় মমতা। অনুপম চিত্রকল্প (ইমেজারী) এই ছড়ার মর্মমূলে অন্তর্নিহিত মানবীয় আবেগের মাধ্য দিয়ে প্রকাশ করেছে এক মমতাময়ী মায়ের আতীব্র হৃদয়ানুভূতি। সরল কথামালা, ধ্বনিপুঞ্জের ব্যবহারও সরল। অথচ ব্যাখ্যাতীত ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করে আমাদের হৃদয়ের নিভৃত কন্দরে। তাই বুঝি এই ছড়াটি যুগের পর যুগ ধরে চিরত্ব লাভ করেছে মানুষের মুখে মুখে। 

২. ঘুমপাড়ানি গান আর সমাজ চিত্রঃ- 

ছড়া শুধু ছেলে ভুলানো গানেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, ঘুমপাড়ানি গানেও ছড়িয়েছে আবেশ। সমাজচিত্রও উঠে এসেছে মনের অজান্তেই। ছেলেকে ঘুমিয়ে দেয়ার প্রয়াসে মায়ের নানা কৌশল, সেই কৌশলে দেশের প্রতি মায়ার কারণে বৃর্গীদের উৎপাতে একটা আতঙ্কও স্থান করে নিয়েছে ছড়ায়।

খোকা ঘুমোলো 
পাড়া জুড়োলো
বর্গী এলো দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেব কিসে। 

ধান ফুড়ালো 
পান ফুড়ালে
খাজানার উপায় কি
আর ক’টাদিন সবুর কর
রসুন বুনেছি।    (প্রচলিত)

অন্ত্যমিলের কড়া ছকে পড়েনি প্রচলিত এই ছড়াটি। অথচ বহুকাল পূর্ব হতেই ছড়াটি ঘুম পাড়ানি গান হিসেবে মা-বাবার মুখে মুখে অতি আদরের সাথেই বহমান। যুগপৎভাবে তৎকালীন সমাজের চিত্রও ফুটে উঠেছে এই ছড়াটিতে। ইতিহাস কথা বলে- অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে মারাঠা বর্গীদের অত্যাচার নিপীড়নে তৎকালীন বাংলার মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত মানুষ যে আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করত সেই সমাজচিত্রও এই ছড়াতে বিবৃত হয়েছে অতি সাবলিলভাবে।   
 
৩. রম্যরসঃ 

 “অ-মা তোমার বাবার নাকে কে মেরেছে ল্যাং
  খাঁদা নাকে নাচছে ন্যাদা নাক ড্যাঙা ড্যাঙ”
 (কাজী নজরুল ইসলাম)

কী রম্যরসে ভরা এই ছড়াটি! মায়ের কাছে দাদুর বোঁচা নাকের যে বর্ণনা দিচ্ছে ছেলে তা সত্যিই হাসির উদ্রেক করে। রম্যতা দিয়েছে প্রাণ, মানুষের মুখে মুখে তাই ছড়া হয়ে উঠেছে গান। 

৪. রূঢ় সমাজচিত্রঃ-

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দারিদ্রের কষাঘাতে ক্লিষ্ট বাঙালীর রূঢ় সমাজচিত্র উঠে এসেছে বাংলাদেশের প্রধান কবি আল মাহমুদের ছড়ায়। চির অভাব তাড়িত বাঙালী সমাজচিত্রের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত কবি আল মাহমুদের ‘ঝালের পিঠা’র অন্ত্যমিল। 

ঝালের পিঠা, ঝালের পিঠা,
কে রেঁধেছে কে,
এক কামুড়ে একটুখানি
আমায় এনে দে।
কোথায় পাব লঙ্কা বাঁটা
কোথায় আতপ চাল,
কর্ণফুলির ব্যাঙ ডাকছে 
হাঁড়িতে আজ কাল। 

সুকুমার বড়ুয়াও কম যাননি দারিদ্র পীড়িত বাংলাদেশী মানুষের কঠিনতর ছবি আঁকতে- 

এমন ঠেকা ঠেকছি রে ভাই
এমন ঠেকা ঠেকছি,
পেটের দায়ে বেইচা দিলাম
হাঁড়ি পাতিল ডেকছি।

ভূখা-নাঙ্গা মানুষের আরেক জাজ্বল্যমান চিত্র উঠে এসেছে নব্বই দশকে বগুড়ার শক্তিমান ছড়াকার এফ শাহজাহানের “কলের গান”এ - 
এপাশ ওপাশ ঘুম ধরে না
রাত কাটে না ক্ষুধায়,
কখন মাগো খাইতে দেবে
কোলের শিশু শুধায়।

মনুষ্যত্বহীনতা এবং মানবিকতাবোধ বিবর্জিত, মানুষের চরিত্রের চত্রিায়ণ করেছেন কবি ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ :
ইস্ !
বাগান জুড়ে মৌমাছি নেই
ফুলের মুখে বিষ্ !  (টুকরোমাইট: ছড়ামাইট) 

৫. বাদ-প্রতিবাদ-রাজনীতি ও ব্যাঙ্গ ছড়া: 

শুধুমাত্র ছেলে ভুলানো আর ঘুমপাড়ানী গানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি ছড়ার আবেদন। ক্ষুদ্র পরিসরে বিশাল প্রতিবাদের এক অনন্য প্রতীক হিসেবেও প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে আধুনিক ছড়া। 

শাসক দলের অন্যায় অত্যাচারে অতীষ্ট মানুষের মনে পুলিশভ্যান সম্বন্ধে যে আতঙ্ক, বিরাগ এবং প্রতিবাদ তার এক অনন্য সাধারন দৃষ্টান্ত হলো কবি আল মাহমুদের “ঊনসত্তরের ছড়া”- 

ট্রাক! ট্রাক! ট্রাক!
ট্রাকের মুখে আগুন দিতে
মতিউরকে ডাক। 

কড়া প্রতিবাদের ঝড় তুলতে কম যাননি “কলের গান”এর ছড়াকার এফ শাহজাহানও। জঙ্গীবাদ আর বোমা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এক তীব্র অগ্নি-প্রতিবাদে ফেটে পড়েছেন তিনি। ডিনামাইট এর বিপরীতে তিনি তৈরী করেছেন কড়া ছড়ামাইট। তিনি লিখেছেন -
বোমার ওপর বসত বাড়ী
বোমায় ভরা ঘর,
এত বোমা বানায় কারা
ধর শালারে ধর ।

রাজনীতি নিয়ে কথা বলেছেন ভারত-বিভাগ বিরোধী ঝুনা ছড়াকার অণ্নদা শঙ্কর রায় ও। ভারত দ্বিখন্ডকারীদের সমালোচনা করে অখন্ড ভারতে বিশ্বাসী এই ছড়াকার লিখেছেন চমৎকার ছড়া- 
তেলের শিশি ভাঙলো বলে
খুকুর পরে রাগ করো
তোমরা যে সব বুড়ো খোকা
ভারত ভেঙ্গে ভাগ করো।


 
আত্মীয়করণ, স্বজনপ্রীতি এবং দূর্নীতির বিরুদ্ধে খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষের যে প্রতিবাদ এবং দূর্নীতিবাজদের যারা অন্ধ মোসাহেবী করে তাদের বিরুদ্ধে যে ঘৃণা তাও বিষয় হয়েছে ড. রফিক রইচের ছড়ার ভাষায় - 

বোনের জামাই ভগ্নিপতি থাকেন যদি চেয়ারে
সব শালারাই থাকেন ভালো ভগ্নিপতির কোয়ারে!   (চাকরি মেলে: ছড়ামাইট)

শোষক ও জুলুমবাজ সমাজের দ্বারা অত্যাচারিত ও নিপীড়িত মানুষের মনের আতঙ্কও ব্যঙ্গচিত্রের মাধ্যমে বাঙ্ময়তা লাভ করেছে ছড়ায়:

আমার বাড়ি ভুতের আড়ি ভূত খেলে কুঁৎকুঁৎ
কখন জানি ভূতে ধরে মন করে ছুঁৎছুঁৎ। 
ভূতোগঞ্জের ভুতো-মামা ভুত ভরা তার থলে,
তার ভাগ্নিই ভুতের রানী বাস সে জলে ।
জলের ভেতের কলের নৌকায় রাখে চটের ছালা,
দিন দুপুরে মানুষ মারে – “ধর শালা মার শালা”।  
(এ কে আজাদ: ভূতের উপদ্রব। গ্রন্থ: কালো রোদ্দুর লাল বৃষ্টি)

৬. প্রকৃতির রূপ ও প্রকৃতি প্রেমঃ-
প্রকৃতির রূপও হয়েছে ছড়ার বিষয়- 

বিষটি এলো কাশ বনে 
জাগল সাড়া ঘাস বনে
বকের সারি কোথায় রে 
লুকিয়ে গেল বাঁশ বনে।    (ফররুখ আহমদ)

কিংবা 
নারকোলের ঐ মাথার উপর হঠাৎ দেখি কাল
ডাবের মত চাঁদ উঠেছে লম্বা ও গোলগাল।     (আল মাহমুদ)
 
জীববৈচিত্র, জীবপ্রেম এবং প্রকৃতিপ্রেমও ছড়ার বিষয়বস্তু হয়েছে অত্যন্ত স্বার্থকভাবে । সেই সাথে শিশুমনের খেয়ালীপনা এবং সচেতনতা যুগপৎভাবে প্রকাশিত হয়েছে ছড়ার পয়ারে: 
১. 
আম্মা বলেন পড়রে সোনা
আব্বা বলেন মন দে,
পাঠে আমার মন বসে না
কাঁঠাল চাঁপার গন্ধে। 
.. .. .. .. .. .. .. .. .. .. 
.. .. .. .. .. .. .. .. .. ..
তোমরা যখন শিখছ পড়া
মানুষ হওয়ার জন্য
আমি না হয় পাখিই হবো
পাখির মত বন্য।  (আল মাহমুদ)

২.
কী আর করি পকেট থেকে খুলে ছড়ার বই,
পাখির কাছে ফুলের কাছে মনের কথা কই।    (আল মাহমুদ)

৩. 
পাখির বাসা ভাঙবো না আর 
ডিমগুলো যে পারবো না,
কুটিকুটি বাচ্চাগুলো 
একটাও যে মারবো না।
ডিমগুলো যে বাচ্চা হবে 
বাচ্চাগুলো মাও,
পাখিরা সব ভালো থেকো
ভালবাসা নাও।   (এ কে আজাদ: ইষ্টি ছড়া মিষ্টি ছড়া)

৭. উদ্ভটত্বঃ
উদ্ভট কল্পনাও স্থান পেয়েছে ছড়ার বিষয়ে- 

বাবুরাম সাপুড়ে কোথা যাস বাপুরে
আয় বাবা দেখে যা দু'টো সাপ রেখে যা
যে সাপের চোখ নেই শিং নেই নোখ নেই
ছোটে না কি হাঁটে না কাউকে যে কাটে না
করে না কো ফোঁস ফাঁস মারে না কো ঢোঁস ঢাঁস
সেই সাপ জ্যান্ত গোটা দুই আনত
তেরে মেরে ডান্ডা করে দেই ঠান্ডা ।

৮. নীতিকথা/শিক্ষা:
কখনো কখনো ছড়ার ভেতরে একটা শিক্ষা দেবার চেষ্টা করেন ছড়াকার। অনেক সময় গুজবে আমরা ভূয়া খবরের উপর ভিত্তি করে সত্য না জেনে লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়ে ফেলি। এহেন ঘটনা থেকে শিক্ষা নেয়ার কথা বলে শিক্ষামূলক ছড়া "পণ্ডশ্রম"  লিখেছেন  শামসুর রাহমানঃ

এই নিয়েছে ঐ নিল যাঃ! কান নিয়েছে চিলে,
চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে।
কানের খোঁজে ছুটছি মাঠে, কাটছি সাঁতার বিলে,
আকাশ থেকে চিলটাকে আজ ফেলব পেড়ে ঢিলে।
.....................................................................
যাচ্ছে, গেল সবই গেল, জাত মেরেছে চিলে,
পাঁজি চিলের ভূত ছাড়াব লাথি-জুতো কিলে।
সুধী সমাজ! শুনুন বলি, এই রেখেছি বাজি,
যে-জন সাধের কান নিয়েছে জান নেব তার আজই।

মিটিং হল ফিটিং হল, কান মেলে না তবু,
ডানে-বাঁয়ে ছুটে বেড়াই মেলান যদি প্রভু!
ছুটতে দেখে ছোট ছেলে বলল, কেন মিছে
কানের খোঁজে মরছ ঘুরে সোনার চিলের পিছে?

নেইকো খালে, নেইকো বিলে, নেইকো মাঠে গাছে;
কান যেখানে ছিল আগে সেখানটাতেই আছে।
ঠিক বলেছে, চিল তবে কি নয়কো কানের যম?
বৃথাই মাথার ঘাম ফেলেছি, পণ্ড হল শ্রম।

৯. ননসেন্স রাইম (অর্থহীন ছড়া)ঃ
ছড়ায় যেমন শিক্ষামূলক বার্তা থাকে, তেমনি কখনও কখনও ছড়া হয় অর্থহীন।  ননসেন্স রাইম বা অর্থহীন ছড়া। এটাকে ডগারেল ভার্স বা মূল্যহীন অকেজো ছড়াও বলা হয়ে থাকে। এটাকে আমরা শিল্পের জন্য শিল্প বা "আর্টস ফর আর্টস শেক" - বলেও ধরে নিতে পারি। এটা "আর্টস ফর লাইফ শেক" নয়। এখানে শিল্প থাকে, কিন্তু জীবনের কোন মানে থাকে না। বা থাকলেও এতটাই শিল্পের মোড়কে ঢাকা থাকে যে, সরল চোখে খুঁজে পাওয়া যায় না। যেমন: 

হাট্টিমা টিম টিম
তারা মাঠে পারে ডিম,
তাদের খাড়া দুটো শিং
তারা হাট্টিমা টিম টিম। (প্রচলিত) 

এটি একটি বহুল প্রচলিত মজার ছড়া। কিন্তু 'হাট্টিমা টিম টিম' বলে কোন প্রাণীর অস্তিত্ব পৃথিবীতে আছে বলে জানা নেই। ছড়াটিতে শিল্প আছে, কিন্তু জীবনের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে এটি একটি ননসেন্স রাইম।

যাহোক, পরিশেষে বলা যায় যে, ছড়ায় থাকে যেমন সরলতা, তেমনি থাকে উপমার চমকপ্রদ ব্যবহার। গতিময় ছন্দ আর বর্ণিল শব্দের ব্যবহারে ছড়া হয়ে উঠে প্রাণবন্ত। তাই তো ছড়া আমাদের চিত্তকে এমন আকর্ষণ করে, আমাদের কর্ণকুহরে এমন ব্যঞ্জনা দেয়, আমাদের হৃদয়ে এমন দোলা দেয়। বোধ করি, সে কারণেই  ছড়া অন্য যে কোন সাহিত্য কর্মের চেয়ে বেশী অমরত্ব পায়। তাই তো ছড়ার জন্য আমাদের এত ভালবাসা। ছড়ার জন্য তাই বুঝি বলতে ইচ্ছে করে- ছড়া বেঁচে থাকুক যুগের পরে যুগ ধরে। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

6 মন্তব্যসমূহ

  1. একটি মূল্যবান বিশ্লেষণ পেলাম ও ঋদ্ধ হলাম ।আলোচক এ কে আজাদ ও দর্পণকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ ।

    উত্তরমুছুন
  2. শিক্ষণীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করলি , ভীষন ভালো লাগলো

    উত্তরমুছুন
  3. অশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই প্রিয় সম্পাদক দেবাশীষ দা' কে আমার এ লেখাটি প্রকাশ করায়।

    উত্তরমুছুন
  4. দূর্দান্ত লেখা। অনেক জানলাম।

    উত্তরমুছুন