সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন যাত্রা সম্রাট ত্রিদিব ঘোষ | ডাঃ সঞ্জয় কুমার মল্লিক




পোস্ট বার দেখা হয়েছে
                                                                              ছবি সংগৃহীত 

সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন যাত্রা সম্রাট ত্রিদিব ঘোষ


বারবার ঘটে যাওয়া অঘটন গুলো সত্যিই ভাবিয়ে তুলেছে,2020 সত্যিই খারাপ বছর। এবছর অনেক কিছু খারাপ খবরের সাথে সাথে আমাদের কাছ থেকে আমাদের অনেক প্রিয় মানুষদের কেড়ে নিয়ে গেল।   গতকাল(29/062020) ভোর সাড়ে পাঁচটায় যাদবপুরের নিজ বাস ভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন বর্তমানের যাত্রা জগতের নক্ষত্র,আমার কথায়,যাত্রা সম্রাট ত্রিদিব ঘোষ।মৃত্যকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর।
        "আজকের মীরজাফর"যাত্রাপালা শুনে ত্রিদিব ঘোষকে আমার প্রথম চেনা।একসময় গ্রামের প্রতিটি বিয়ে বাড়িতে দুপুরে মাইকে বাজত এই যাত্রাপালাটির অডিও রেকর্ড।তারপর তিনি সাধারণ মানুষের কাছে অতি প্রিয় একজন যাত্রাপালার অভিনেতা হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। সুনিপুন অভিনয় দক্ষতা, বাচন ভঙ্গিমা ও নির্দেশনা দিয়ে তিনি মানুষের মন কেড়ে নিয়েছিলেন। ওনার নির্দেশিত যাত্রাপালা গুলোতে 
উনি ভিলেন চরিত্রের মধ্য দিয়ে সমাজের নানার অন্ধকার দিকগুলো তুলে ধরে মানুষকে যে বার্তা দিয়ে গিয়েছেন তা ভাববার ও গবেষণার বিষয়। ওনার অভিনীত চরিত্রের মুখ থেকে নির্গত একটি বাক্যও ভুল নয়, যা চিরকালীন সত্য।
         আজকের মীরজাফর যাত্রা পালার এক পর্বে বিজলীর ওপর অত্যাচার পর্বে স্টেজে এক দর্শক ওনাকে লক্ষ করে জুতো ছুঁড়ে মেরেছিলেন। ওনার অভিনয় দেখলে যে কোন মানুষের লোম খাড়া হয়ে যাওয়ার ই কথা। উনি অভিনয় বন্ধ করে,জুতোটা কুড়িয়ে দুহাতে করে প্রণাম করে বলেছিলেন, আমার সেরা প্রাপ্তি আমি পেয়ে গিয়েছি!
      ১৯৭৫ সালে চিত্তরঞ্জন অপেরার মাধ্যমে যাত্রা জগতে ওনার আত্মপ্রকাশ। তারপর একে একে নট্য কোম্পানি,ভারতী অপেরা,অগ্রগামী অপেরা, লোকনাট্য অপেরা, জ্ঞানবানী অপেরা,নটরাজ অপেরা সহ বিভিন্ন অপেরার মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তার অভিনয়ের জাদু।ওনার অভিনীত যাত্রাপালা গুলোতে পেন্ডেলে জনতার ঢল নামত। একসময় গ্রামের দিকের মানুষ রাত্রিবেলা ত্রিশ কিমি সাইকেল চালিয়ে যেতেন ত্রিদিব ঘোষের যাত্রা দেখার জন্য। যাত্রা সম্রাট ত্রিদিব ঘোষের অভিনীত কিছু যাত্রাপালার নাম আজকের মীরজাফর, মা বিক্রির মামলা,নরকের হেডমাস্টার,হাটে-বাজারে, ভগবানের ছদ্মবেশে, কালকেউটের ছোবল, সম্রাট ঔরঙ্গজেব,বুনো ওল বাঘা তেঁতুল,কসাই খানার কান্ডারী,শকুনির পাতা মরন ফাঁদ,কালাচাঁদের কবলে মধুবালা,উলঙ্গ সম্রাট ইত্যাদি।বেশিরভাগ যাত্রাপালাই ছিল ত্রিদিব ঘোষ অভিনীত ও নির্দেশিত।
        যাত্রাপালা ছাড়াও টলিউডের কিছু বাংলা সিনেমায় তিনি অভিনয় করেছিলেন যেমন, আত্মীয়-স্বজন,বাহাদুর,আশ্রয় ও সুপার-ডুপার হিট শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ। এছাড়াও টেলিভিশনের বাক্সবদল ধারাবাহিকে অভিনয় করেছিলেন। একজন শিল্পীর সমস্ত কাজ তুলে ধরা সম্ভব নয় তবু ওনার ভক্ত হিসেবে যেটুকু পারলাম তুলে ধরলাম।
                                                    ছবি সংগৃহীত 
        ৪৫ বছরের যাত্রা জীবনে উনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বহু পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন।ত্রিদিব ঘোষের অভিনয়ের সুবাদে গ্রামবাংলার যাত্রা পেন্ডেলে জনজোয়ারে ভাসত। ওনার মৃত্যুতে যাত্রাজগতে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল।সমগ্র যাত্রা সমাজ,সংগঠন একজন অভিভাবককে হারাল।সেই সঙ্গে ওনার ভক্তরা একজন দক্ষ যাত্রা শিল্পীকে হারালেন। গতকাল টেলিভিশনে ওনার মৃত্যুর খবর দেখতে পেয়ে অনেকেই মর্মাহত।
সংবাদ সূত্রে খবর কয়েকবছর আগে তিনি তার একমাত্র সন্তানকে হারিয়েছিলেন।যদিও লকডাউন উঠে গেলে তিনি তার দর্শকদের জন্য নতুন যাত্রাপালার জন্য তৈরি ছিলেন।কিন্তু মৃত্যু নামক কাল এসে ওনাকে আপামর দর্শকদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল।
        এই ছিল বাঙালির প্রিয় যাত্রা অভিনেতা বা যাত্রা সম্রাট ত্রিদিব ঘোষ। শহুরে বাঙালি আপনাকে মনে রাখবে কিনা জানি না তবে কয়েক কোটি গ্রাম্য বাঙালি আপনাকে চিরদিন মনে রাখবে।    youtube র কল্যানে যে কোন সময় আমার মতো আপনার ভক্তরা আপনার নাম দিয়ে সার্চ করে আপনার সৃষ্টিকে বারবার শুনে নিজেকে ধন্য মনে করবে।
          যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন। যদি পুনর্জন্ম থাকে,ফিরে আসুন আবার আপনার যাত্রা জগতে অন্য কোন নামে।কয়েক কোটি শ্রোতা-দর্শক আপনার অপেক্ষায় রইলো। আপনার আত্মার শান্তি কামনা করি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ