নিবন্ধ|| বাংলা কবিতার চল্লিশের দশক || অলিপা পাল




পোস্ট বার দেখা হয়েছে


বাংলা কবিতার চল্লিশের দশক

(সুমিতা চক্রবর্তীর চল্লিশের কবিতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে মূল বিষয়বস্তু)

                   

বাংলা কবিতার ধারায় চল্লিশের দশক বাস্তব  ইতিহাসের  আলোড়নকে ধারণ করেছে ৷পরিবর্তন ঘটেছিলো বিশ্বের রাজনৈতিক মঞ্চে ৷কবিতায় সেই পরিবর্তন১৯৩৭-৩৮স্পষ্ট দেখা যায় ৷

বাংলা কবিতায় চল্লিশের দশক ১৯৩৭-১৯৫০ এই তেরো চৌদ্দ বছর ধরই বিস্তৃত ৷
চল্লিশের কবিতার সমকালীন প্রেক্ষাপট এখানে উল্লেখকরা প্রয়োজন :—ত্রিশের দশকের প্রথমার্ধে বিশ্বযুদ্ধের পরে ভারতে দেখা দিয়ে ছিলো অর্থনৈতিক সংকট,বেকারত্ব বৃদ্ধি ,খাদ্য বস্ত্রের অভাব—এর মধ্যেই স্বাধীনতা আন্দোলনের চেতনা বিভন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে ৷কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে কাজী নজরুল ইসলামের উচ্ছ্বাস দ্বীপ্ত ভাবাবেগ ময় রচনা ৷১৯৩৫সাল থেকে ফ্যাসিবাদের বিরোধী চেতনা সংগঠিত ৷ ১৯৩৫-৩৮এর মধ্যেই  প্রতিষ্ঠা ঘটলো বেশ কিছু নতুন কবির ৷অরুন মিত্র,বিমল চন্দ্র ঘোষ, চঞ্চলকুমার চট্টোপাধ্যায়,দিনেশ দাস,মণীন্দ্র রায়,মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত, সুভাষ মুখপাধ্যায় ,সমর সেন—কবিতার বক্তব্য ও বাক্য গঠনে নতুন দিনের বার্তা শোনালেন এঁরাই প্রথম ৷

দেশের মাটিতে১৯৪২'ভারত ছাড়ো' আন্দোলন,১৯৪৩মন্বন্তর,১৯৪৪গণনাট্য সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠা,১৯৪৬সাম্প্রদায়িক কলুষিত রূপ,১৯৪৭দেশ টুকরো হওয়া স্বাধীনতা,১৯৪৮সাম্প্রদায়িক হানাহানি ৷এই অশান্ত পরিবেশের মধ্যে জেগে উঠেছিলেন আরও কবি—বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শুকান্ত ভট্টাচার্য, রাম বসু, সিদ্ধেশ্বর সেন, মৃগাঙ্ক রায়,জগন্নাথ চক্রবর্তী,নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী,গোলাম কুদ্দুস, অসীম রায়, চিত্ত ঘোষ, কৃষ্ণ ধর,অশোকবিজয় রাহা, অরুনকুমার সরকার, নরেশ গুহ, বিশ্ব বন্দ্যোপাধ্যায়, অরুন ভট্টাচার্য, হরপ্রসাদ মিত্র, রমেন্দ্রকুমার আচার্য চৌধুরী,বাণী রায়, রাজলক্ষ্মী দেবী —প্রমুখ৷এঁরা মধ্য ত্রিশ থেকে মধ্য চল্লিশ দশকের অন্তর্গত সময়ে লিখতে শুরু করেন ৷ এঁদের সকলের লেখা নিয়ে চল্লিশের কবিতা ৷

এক দশকের ব্যবধানে প্রকাশিত দুটি সংকলন দু পাশ থেকে ধরে রেখেছে অন্তবর্তী চল্লিশের দশককে

—"আধুনিক বাংলা কবিতা"(১৯৪০)
"সমকালীন বাংলা কবিতা"(১৯৫০)

অরুন মিত্র:— যশোরে বড় হওয়া অরুন মিত্র এর আনন্দবাজার পত্রিকায় সাংবাদিকতা ১৯৩১-৪২ ৷
তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রান্তরেখা তে আছে সামাজিক ও স্বাশ্রয়ী—এই দুই ধরণের কবিতা ৷ 'অগ্রণী','কসাকের ডাক','সাময়িক', উল্লেখযোগ্য ৷
"এখন প্রহর গোন/উপোসী হাতের হাতুড়িরা উদ্যত " ৷

বিমল ঘোষ:—'জীবন ও রাত্রি' প্রকাশিত প্রথম কবিতা সংঙ্কলন ১৯৩৩ ৷তাঁর রচনায় গীতিকবিতা বিশেষ উল্লেখ যোগ্য( কোকিল এবং উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা ) ৷"শেষের
উইল" কবিতায় তিনি কল্পনা করেছেন"বুড়ো ভগবানকে" যার গতিবিধি বস্তির ডোম,কামার, চামার, মুদ্দাফরাসদের মধ্যে ৷

জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র:—  বর্ণময় মানুষ ছিলেন জ্যৈাতিরিন্দ্র মৈত্র, তাঁর ভালোবাসা ছিলো মানুষ,ফুল পাখি গাছের জন্য ৷ বাংলা কবিতায়  তাঁর দুটো সৃষ্টি স্মরণীয় হয়ে আছে ৷ প্রথম
মন্বন্তরের অভিজ্ঞতার আঘাতে রচিত অপেরাধর্মী গীতিসংঙ্কলন "নবজীবনের গান "  
"পথে পথে শঙ্কা/মোড়ে মোড়ে বাজে মৃত্যুর জয়ডঙ্কা " ৷
দ্বিতীয় দীর্ঘ কবিতা "মধুবংশী গলি " ৷

দিনেশ দাস:—'দেশ'ও 'বঙ্গশ্রী'পত্রিকায়  ১৯৩৪ সালে তাঁর কবিতা মুদ্রিত হয়েছে ৷ভুমিকা,দিনেশ দাসের কাব্যসমগ্র,মনীষা (১৯৪৮)  ৷এর পর "কাস্তে"তাঁর উল্লেখযোগ্য কবিতা ৷
"বেয়নেট হক যত ধারালো
কাস্তেটা ধার দিও বন্ধু,
শেল আর বোম হক ভারালো
কাস্তেটা শান দিও বন্ধু " ৷ 
কবিতাটি প্রকাশ হয়েছিল১৯৩৮এশারদীয়া "আনন্দবাজার পত্রিকায় "৷

চল্লিশের দশকে বাংলা কবিতায় বিতর্কিত নাম সমর সেন ও সুভাষ মুখপাধ্যায় ৷দুজনের কবিতা প্রকাশিত
হত বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত "কবিতা" পত্রিকায় ৷
সমর সেনের  কবিতায় পাওয়া যায় বিশ্বযুদ্ধের পরে সম্রাজ্যবাদী শাসনের চাপে থাকা কলকাতার মত উপনিবেশ নগরীগুলির প্রকৃত অবস্থা ৷

১৯৩৬সালে প্রকাশিত "নাগরিক" কবিতা —"মহানগরীতে এল বিবর্ণ দিন/তারপর আলকাতরার মতো রাত্রি আর কত লাল শাড়ী আর নরম বুক/ আর টেরিকাটা মসৃণ মানুষ/আর হাওয়ায় কত গোল্ডফ্লেকের গন্ধ?
হে মহানগরী!" 
দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ "গ্রহণ"(১৯৪০) ৷
"একের বুদ্ধিজীবী " কবিতায়, বুদ্ধিজীবীদের তিনি অন্ধ ধৃতরষ্ট্রের মত বিচলিত হতে দেখেছেন,যারা ঘরে বসে সর্বনাশের ইতিহাস শোনে এবং জয়ের কোন আশা রাখে না ৷তাঁর এই মনভাব তখনকার মার্কসবাদীদের ভালো লাগেনি ৷তাঁর হতাশা ও এলিয়ট প্রীতি, এই প্রবনতাকে প্রতিক্রিয়াশীল এবং অসাম্যবাদসুলভ বলে তাঁরা আক্রমণ করেছিলেন,বিশেষ করে সরোজ দত্ত "অগ্রণী" পত্রিকায়(১৯৪০)৷
সুভাষ মুখোপাধ্যায় যৌবনেই জাতীয়তাবাদী চেতনা ও সাম্যবাদী ভাবনা দ্রুত গ্রহণ করেছিলেন ৷কবিতা ও রাজনৈতিক কর্মসূচীতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন ৷"চীন১৯৩৭" প্রকাশিত হয় ১৯৩৮ সালে শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকায় ৷"পদাতিক"প্রকাশিত১৯৪০৷

১৯৪৯-৫০তিনিছিলেন প্রগতিমুখী কর্মকাণ্ডের সাথে সমাজমনস্ক ও প্রতিবাদী কবিতার ধারায় প্রধান কবিকন্ঠ ৷তাঁর লেখা সরল অথচ সুরেলা ভাষা,মিছিলে চলার তাল 
যেন ৷"শতাব্দী লাঞ্ছিত আর্তের কান্না/প্রতি নিঃশ্বাস অনে লজ্জা" ৷

১৯৪৩ মন্বন্তরের দহন শুরু,১৯৪৬-৪৭ তেভাগ আন্দোলনের দবানল ৷ সব কিছুর প্রতিফলন ঘটল চল্লিশের কবিতায়* ৷

সুকান্ত ভট্টাচার্য্য:—অকাল মৃত্যু ১৯৪৭,একুশ বছর বয়সে ৷প্রথম কবিতা সংকলন "ছাড়পত্র" প্রকাশিত হয় মৃত্যুর পরে ৷১৯৪১-৪২এই প্রতিভাবান কিশোর বাংলা কবিতায় পরিচিত নাম হয়ে উঠেছিলেন ৷ "বোধন","রানার","ছাড়পত্র","ঠিকানা",
"কলম","হে মহাজীবন","প্রিয়তমাসু" ৷ সর্বজন পরিচিত এই কবিতা গুচ্ছ চল্লিশের দশকের প্রতিবাদী কবিতার সবদিক থেকে আম্তরিকতায় ঘনীভূত উদ্দীপনাকে সংযত প্রয়োগ কুশলতায় ধারণ করেছে ৷

"তারপর বহু যুগ পরে/ভবিষ্যতের কোন যাদুঘরে/নৃতত্ত্ববিদ হয়রান হয়ে মুছবে কপাল তার/মজুতদার ও মানুষের হাড়ে মিল খুঁজে পাওয়া ভার"৷
এই অভিব্যক্তির তীক্ষ্ণতা ও তির্যকতা মিলিত হয়ে যে শিল্পসৌন্দর্য নির্মাণ করেছে তার নিহিত শক্তিতে কবির স্থির বিশ্বাস৷ এই বিশ্বাসের জোরেই চল্লিশের দশকের প্রতাবাদী কবিতা স্থায়িত্ব পেয়েছে ৷



মণীন্দ্র রায় :—তাঁর লেখায় পান্ডিত্যের দ্যুতি লক্ষণীয় ৷ প্রাচীর কবিতা ১৯৪৩ এ রচিত ৷তেভাগা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে১৯৪৮নাগাদ রচিত কবিতা"ইয়াসিন মিঁয়া" ৷ তাঁর নিসর্গদৃশ্য এর কবিতা
"রঙিন ঘাঘরা তার ভাঁজে লালা/মাটির মাঠের ঢেউয়ে নদী হাঁসে রূপের হাঁসুলি"৷

মঙ্গলাচারণ চট্টোপাধ্যায়:—১৯৪৬-৪৭এ তেভাগা আন্দোলনের সময় ঘুরেছিলেন উত্তরবাংলার গ্রামে ৷ ১৯৫১তে প্রকাশিত "মেঘবৃষ্টঝড়" সংকলনের সব কবিতাতেই দেশের মাটি আর দেশের মানুষের প্রতি সংবেদনশীলতা উথলে উঠেছে ৷

অবিভক্ত ভারতের ঢাকা শহরে আধুনিক কবিতাচর্চার একটি কেন্দ্র গড়ে উঠেছিলো ১৯২৬-২৭থেকেই বুদ্ধদেব বসু, অজিত দত্ত, প্রভু গুহ ঠাকুরতা প্রমুখদের মিলিত প্রয়াসে ৷

১৯৩৯ সালে ঢাকায় "প্রগতি লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘ" স্থাপিত হয় ৷ এই সঙ্ঘেরই সক্রয় সদস্য ছিলেন সোমেন চন্দ, রনেশ দাশগুপ্ত, সরজ দত্তএবং কবি কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত৷

চঞ্চলকুমার চট্টোপাধ্যায়:— ১৯৪৮সালে "সাহিত্যপত্র" পত্রিকার সম্পাদক ৷তাঁর কবিতার সূত্রপাত১৯৩৭-৩৮মধ্যে ৷ সঙ্গীত,চলচ্চিত্র, বিদেশী ভাষা ও সাহিত্যে নিমজ্জিত তিনি কবিতা কমই লিখেছেন ৷প্রাচীন গ্রীক,লাতিন,ইতালীর কাব্যকল্পনার ভাবনা থেকে ভিন্নস্বাদের বাংলা কবিতা "ওডিসিউস" ৷

বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়:—কবিতা রচনায় নির্দিষ্ট কোন বক্তব্য বা রীতি অনুসরণ করতে তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন 
না ৷তাঁর প্রথম কবিতা সংকলন"গ্রহচ্যুত"প্রকাশিত১৯৪৪ এ ৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বাকি জীবন তাঁর লেখনী সর্বত্র অত্যাচারের বিরুদ্ধে মুখর থেকেছে ৷
১৯৪৬ প্রকাশিত সংকলন "নতুন মাস" অন্তর্ভুক্ত কবিতা—
"রোম পোড়ে
নেরো বেহালা বাজায়—
পেট্রনিয়স,ভিসিনিয়সের,পীটারের রোম  সোনালি হল" ৷
অরণি পত্রিকায় লেলিনের মৃত্যু,১৯৪৯ এ মহাচীন,১৯৫৪"নীলনির্জন" ৷

অশোকবিজয় রাহা:—তিনি ছিলেন কল্পনার এক মায়ারাজ্যের অধিকারী ৷
নিসর্গসৌন্দর্য নিয়ে রচিত কবিতার কোন অপ্রতুলতা নেই বাংলা 
সাহিত্যে ৷কিন্তু রবীন্দ্রনাথ,সত্যেন্দ্রনাথ,জীবনানন্দের পরেও যে স্বতন্ত্র্য সৌন্দর্যলোক নিঃস্বর্গের বুকে রচনা করতে পেরেছিলেন তিনি তা নিঃসন্দেহে স্বতন্ত্র্য ৷
অসম অঞ্চলের পাহাড়ের রূপ তিনি দেখেছেন—"অতিকায় দনুর সন্তান
লাফ দিয়ে উঠে আছে অর্ধেক আকাশে—
কোমরে জঙ্গল গোঁজা, সূর্যের মাকড়ি জ্বলে কানে
দূরে শূন্য বল্লম উঁচানো"—
তাঁর"তারা চাষের স্বপ্ন"চল্লিশের দশকের পরিচিত কবিতা ৷

অরুনকুমার সরকার:—তাঁর বিচরণ বাস্তব জগতে,মায়ার জগতে না ৷
১৯৫২সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ"দূরের আকাশ" প্রকাশিত
 হয় ৷

নরেশ গুহ:—তিনি শিল্পের বাস্তবতা সুক্ষ্ম কারুকাজ গুলি তুলে ধরতেই তিনি আনন্দ পেতেন ৷ ১৯৫১সালে"দুরন্ত দুপুর" সংকলন চল্লিশের দশকে লেখা ৷

দুই বিশ্বযুদ্ধ মধ্যকালীন কবিতায় সরস মনোভঙ্গি প্রাধান্য পায় নি ৷তবুও ক্ষীণতর হলেও হাসির এবং রঙ্গ ব্যঙ্গ কবিতার ধারাটি বহমান ছিল ৷পরিমল রায়, বনফুল, অন্নদাশঙ্কর রায়, অজিত দত্ত ,এঁদের কলমে সরস ও ব্যঙ্গ কবিতা উৎসারিত হয়েছিল চল্লিশের দশকে ৷

চল্লিশের কবিতায় প্রাণের স্পন্দন ছিলো অকৃত্রিম,তা বিদ্রোহের বাণী হোক,পুঁজিবাদের প্রতিরোধী সংকল্পই হোক,অথবা ভালোবাসার স্মৃতি হোক ,কোথাও কবিরা যেন খুব বেশি বানিয়ে তুলে কোন শিল্প নির্মাণ করতে যান নি ৷এখানেই চল্লিশের কবিতার মূল শক্তি ৷

তথ্যসূত্র ও ছবি : ইন্টারনেট সংগৃহীত 




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

3 মন্তব্যসমূহ

  1. ভীষন সুন্দর উপথাপনা আর বিষয় নির্বাচন অসাধারণ ....খুব ভালো লাগলো , তথ্যমূলক লেখা পড়লাম।

    উত্তরমুছুন
  2. সুন্দর তথ্য সংগ্রহ ও লেখার কৌশল,
    সাবলীল ও প্রাণবন্ত ।

    উত্তরমুছুন