কবি তুলসী দাস ও ভক্তি আন্দোলনের প্রেক্ষাপট | অলিপা পাল




পোস্ট বার দেখা হয়েছে
                                          ছবি সংগৃহীত 

কবি তুলসী দাস ও ভক্তি আন্দোলনের প্রেক্ষাপট
অলিপা পাল

_________________________________

তুলসীদাস শুধুমাত্র কবি ন’ন। তিনি ছিলেন একটি বিস্তীর্ণ সভ্যতার বিবর্তিত মূল্যবোধের প্রতিনিধি। ভারতবর্ষে মধ্যযুগে সনাতনধর্মের  বিবর্তনের একজন পথিকৃৎ।  ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ তুলসীদাস সম্বন্ধে বলেছিলেন the greatest man of his age in India and greater than even Akbar himself বিখ্যাত ভারততত্ত্ববিদ জর্জ গ্রিয়ার্সন বলেছিলেন the greatest leader of the people after the Buddha and the greatest of Indian authors of modern times.
কবি তুলসী দাস'কে জানতে আগে জানতে হবে ভক্তিআন্দলনের প্রেক্ষাপট—
আদি শঙ্করাচার্য(৭৮৮-৮২০)ছিলেন একজন দার্শনিক ৷অদ্বৈত বেদান্ত নামে হিন্দু দর্শন শাখার প্রবক্তা ৷ভারত ঘুরে তার মত প্রচার করেছিলেন ৷ দেশের চার প্রান্তে চারটি মঠ তৈরি করেছিলেন ৷কেরল রাজ্যের কালাডি গ্রামে তাঁর জন্ম ৷

 শংকরের অদ্বৈত বেদান্তবাদী ভাবধারার পরবর্তী প্রবর্তক দাক্ষিণাত্যের ব্রাহ্মণ রামানুজ ৷ সৃষ্টি করেছিলেন শ্রী সম্প্রদায়। শংকরের মোক্ষবাদী দর্শনকে বিবর্তিত করে এনেছিলেন বিশিষ্ট অদ্বৈত দর্শন।  তাঁর প্রধান শিষ্য ছিলেন বৌধায়ন, টঙ্ক, গুহদেব, দ্রামিড় প্রমুখ।  বৌধায়ন ছিলেন বেদান্তের এক জন প্রবাদপ্রতিম ব্যাখ্যাকার। 

স্বামী রামানন্দের কর্মভূমি ছিলো বারাণসী। পরবর্তীকালে তিনি বিশিষ্ট অদ্বৈতবাদের শিক্ষা নিতে দাক্ষিণাত্যে যাত্রা করেছিলেন। দীর্ঘকাল সেখানে রামানুজপন্থী গুরু রাঘবানন্দের কাছে শিক্ষা নিয়ে ফিরে আসেন বারাণসীতে। কিন্তু তৎকালীন ব্রাহ্মণ্য রক্ষণশীলতায় অধ্যাত্ম আবহে তিনি স্বস্তি পাননি। নাথপন্থী যোগীদের সংস্পর্শে এসে অদ্বৈতবাদ ও লৌকিক বৈষ্ণব চেতনার সংশ্লেষণে প্রবর্তন করেন ভক্তিবাদী আন্দোলনের রূপরেখা।ভক্তি আন্দোলনকে জনআন্দোলনের রূপ দিয়েছিলেন  রামানন্দ।মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষের অধ্যাত্মচেতনার ধারা ছড়িয়ে পড়ে পঞ্চনদ থেকে বঙ্গদেশ ।
সনাতনপন্থীদের মধ্যে রামানন্দ ভারতে প্রথম ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সূত্রপাত করেন, রামানন্দি সম্প্রদায়, যেখানে বর্ণবাদ এর স্থান ছিল না । বিখ্যাত দোহা, যা পরবর্তীকালে রামানন্দের শিষ্য কবীরের নামেই প্রচলিত রামানন্দের মতে সাধুর কোনও জাতি হয় না। তার জ্ঞানই তার পরিচয়।  সেকালে একজন ব্রাহ্মণ্য প্রতিভূ দিগ্বিজয়ী পণ্ডিতের এই অবস্থান শুধু দুঃসাহসীই নয় যুগান্তকারী। রামানন্দ ছিলেন ক্রান্তদর্শী। ভারতীয় সনাতনবাদী জনসমষ্টিকে রক্ষা করতে  নিম্নবর্গীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে ধর্মের মূলস্রোতে নিয়ে আসতে হবে। এর একমাত্র পথ বর্ণাশ্রমের বিভেদবাদী নীতি থেকে সরে এসে ভালোবাসার  আবেগকে আশ্রয় করা। এ নীতির প্রয়োগ পাঁচশো বছর আগে ইসলামে মহাত্মা আলির অনুগামীদের মধ্যে ছিলো। যাকে পরবর্তীকালে সুফিধর্ম বলা হয়েছে। রামানন্দ  বৈদান্তিক ঈশ্বরের ভূমিকা অপসারণ করে হরি'কে আশ্রয় করলেন। এই হরি,  রাম বা কৃষ্ণ। রামানন্দের প্রধান শিষ্যদের মধ্যে যেমন ছিলেন ব্রাহ্মণ অনন্তানন্দ, ভবানন্দ, সুখানন্দ, তেমনই ছিলেন ম্লেচ্ছ ও অচ্ছুত কবীর, রবিদাস, সেনা, সধনা ও ধন্না।তাছাড়াও তাঁর অনুগামীদের মধ্যে ছিলেন শিখধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গুরু নানক, সন্ত জ্ঞানদেব, সন্ত নামদেব, সন্ত তুকারাম, সন্ত নাভাদাস, সন্ত একনাথ এবং আমাদের একান্ত বাঙালি শ্রীচৈতন্য। ছিলেন সেকালের বিচারে প্রায় অবিশ্বাস্যভাবে দু’জন নারী সাধিকা সুরসরি ও পদ্মাবতী। বহুদিন পরে আমাদের বাংলার সাধক লালন সাঁইয়ের লেখায় যেমন পাই—
ভক্তের দ্বারে বাঁধা আছেন সাঁই
হিন্দু কি যবন বলে কোনও জাতের বিচার নাই।
                                    ছবি সংগৃহীত
 রামানন্দের শিষ্যদের মধ্যে সগুণ ও নির্গুণ ব্রহ্ম, উভয় মতের সাধক ছিলেন। রামানন্দ নিজে সগুণ বা নির্গুণ কোনও মতের পক্ষে ছিলেন না। তাঁর জন্য ভক্তির গভীরতাই একমাত্র বিবেচ্য। শিষ্য সন্ত কবীর ছিলেন নির্গুণপন্থী। আবার ভবানন্দ বা সুখানন্দ ছিলেন সগুণব্রহ্ম ৷ ভক্তি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত জন্মগত ব্রাহ্মণদের মধ্যে সগুণপন্থী সাধকরা সংখ্যাগুরু। আবার ইতরবর্গীয় সাধকেরা ছিলেন মূলত নির্গুণপন্থী। সগুণপন্থীরা উপাস্য হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন রাম (তুলসীদাস) বা কৃষ্ণ'কে (সুরদাস)। রাম ও কৃষ্ণ, দুটি প্রতীকই সগুণ মনুষ্যমূর্তিতে কল্পিত হ’ন। নির্গুণপন্থীর আরাধ্য ছিলেন শুধু হরি। তিনি নিরাকার, নির্গুণ, নিরঞ্জণ ও অখণ্ড। কবি তুলসী দাস নির্গুণপন্থী সাধকদের মতো বর্ণবাদী অনুশাসনের বিরুদ্ধে যাননি । 

ভক্তি আন্দোলনের সাধকগণ কাব্য ও সঙ্গীতচর্চার মাধ্যমে নিজস্ব মতবাদ প্রচার করতেন। তাঁদের মধ্যে অনেকের কবিত্বশক্তি ঈশ্বর প্রদত্ত।  কবি তুলসীদাস ছিলেন সবার মধ্যে অনন্য। তাঁর কবিত্বশক্তি অতি গভীর। আধুনিক হিন্দিভাষা'র মূল ছিলো কবি তুলসী দাসের ব্রজভাষায় রচিত রচনাবলির মধ্যে। তাঁকে নিয়ে গড়ে ওঠা গল্পকথা আসলে ভক্তকথা, প্রতিষ্ঠা করে তাঁর লোকপ্রিয়তা ও জনজীবনে আকাশচুম্বী প্রভাবকে। যেমন একটি লোককথা দেখা যাক। জন্মস্থান রাজপুর থেকে প্রথমে যখন তুলসী বারাণসীতে আসেন, তখন অস্সিঘাট ছিল একেবারে জনহীন, অরণ্যসংকুল স্থান। তাই তিনি প্রহ্লাদঘাটের কাছে বসবাস করতে থাকেন। সেই সময়েই তাঁর সংস্কৃতভাষায় কাব্য রচনার প্রয়াসও শুরু হয়। তিনি সারাদিন ধরে যা কিছু রচনা করতেন, রাত হলেই তা কোথায় হারিয়ে যেত। এইরকম কিছু দিন চলার পর কাশীবিশ্বনাথ তাঁকে স্বপ্নাদেশ দেন সংস্কৃতভাষা পরিত্যাগ করে অওধিভাষায় কাব্য রচনা করতে। তাহলে তুলসী দাসের কাব্য গরিমা অর্জন করবে। আধো তন্দ্রায় তুলসীদাস নিজস্ব ভাষামাধ্যম বিষয়ে যে সিদ্ধান্তটি নেন তার তাৎপর্য ছিল অসীম।তুলসীর প্রতিভা সীমাবদ্ধ থাকলো না বিষ্ণুপূজক সংস্কৃতজ্ঞ ব্রাহ্মণসমাজের মধ্যে ৷ তুলসীদাসের এই সিদ্ধান্তের পিছনে ছিল রামানন্দীয় প্রভাব। ক্রান্তদর্শী তুলসী দাসের মত সিদ্ধান্ত এর আগে প্রথম নিয়েছিলেন শাক্যমুনি বুদ্ধ। সারনাথ থেকে তাঁর প্রথম উপদেশাবলী প্রচার করার জন্য বেছে নিয়েছিলেন পালি ভাষা। উচ্চবর্ণের স্বীকৃত দেবভাষা ছেড়ে । পঞ্চম শতক থেকে পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত ভারতবর্ষে মধ্যযুগ পেরিয়ে আর্য ব্রাহ্মণ্য ইসলাম সুফি ভক্তিবাদী সমন্বয়ের সংস্কৃতিবোধ নির্মাণ হয়েছিল তুলসীদাসের রচনাবলির মধ্য দিয়ে।
                            ছবি সংগৃহীত
তুলসীদাস রামভক্তি আন্দোলনের প্রধান পুরুষ। রামানন্দ অনুগামীদের জন্য রাম বা কৃষ্ণ কোনও প্রতীকেরই নির্দিষ্ট রূপকল্প তৈরি করে দেননি। তাঁর এই উদার গণতন্ত্রপ্রিয়তায় শিষ্য'রা ইচ্ছেমতো ঐশীপ্রতিমা বেছে নিতে পারত যার প্রতি থাকবে প্রেম ও ভক্তি ৷প্রশ্নহীন প্রেম, ব্যতিক্রমহীন ভক্তিই ছিল এই আন্দোলনের একমাত্র চালিকাশক্তি।সগুণপন্থীদের মধ্যে ছিল রামভক্ত ও কৃষ্ণভক্ত ৷  নির্গুণপন্থীদের মধ্যে ছিল জ্ঞানমার্গী ও প্রেমমার্গী।প্রেমমার্গী পরবর্তীতে ভারতীয় সুফিধর্মের অনুগামী । বাল্মীকির রামায়ণ  আর্য ও অনার্য সভ্যতার মধ্যে পরস্পর ধর্ম-সংস্কৃতি, নীতিবোধের টানাপড়েনের ইতিকথা। বাল্মীকির রাম দোষমুক্ত ঈশ্বরপ্রতিম । তিনি একজন আর্য রাজপুরুষ। মহৎ ও রজোগুণ সম্পন্ন একজন মানুষের যা কিছু দোষ-গুণ থাকে, তাঁর মধ্যে সব কিছু রয়েছে। সারাজীবনে তিনি বহুবার ন্যায়ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়েছেন। যে কোনও সাধারণ মানুষের মতোই। কিন্তু তুলসী দাস এই রামচরিত্রটিকে সৃষ্টি করলেন   মনুষ্যরূপে বিষ্ণুর অবতার। তাঁর সবকিছুই শ্রেষ্ঠ। কোনও দোষ থাকতে পারে না ৷ তুলসীর রামচরিত্র এই চিন্তনেরই প্রকাশ। তাঁর রচনার নাম তুলসীরামায়ণ নয়। তিনি এর নাম দিয়েছিলেন ‘রামচরিতমানস’। অর্থাৎ তুলসীদাসের মনোজগতে রামচরিত্র যে মহিমা, গরিমা, সর্বজয়ী নৈতিক শক্তি নিয়ে প্রতীত হয়েছিল, তারই কাব্যরূপ। গত পাঁচছশো বছর ধরে এদেশে যে রামকে মানুষ চেন তিনি তুলসীর রাম। আজকের ভারতীয় সমাজব্যবস্থা স্থাপিত হয়েছে তুলসীদাস নির্মিত মূল্যবোধের ভিত্তির উপর এবং আজ ভারত যে রামকে চেনে, তিনি তুলসীর রাম। বাল্মীকির নয়। 

দীর্ঘকাল ধরে গাঙ্গেয় অববাহিকায় তথা মধ্যযুগের প্রধান সন্তদের মতো তাঁর সম্পর্কে লোককথা বা কল্পিত ভাবনায় প্রচলিত আছে। তাঁর ব্যক্তিজীবন বিভিন্ন জন্মসন সহ  জন্মস্থান ৷ সরকারী ভাবে তাঁর জন্ম বিতান্ত —
জন্ম ১৪৯৭ বা ১৫৩২ (শ্রাবণ মাসের শুক্লা সপ্তমী তিথিতে )
রামবোলা গোন্ডা, উত্তরপ্রদেশ ভারত 
মৃত্যু ১৬২৩ অসিঘাট বারাণসী (অধুনা উত্তরপ্রদেশ) ভারত বঙ্গদেশে বিশের শতকে যে মাত্রায় আমরা আমাদের জীবনচর্যা যাপনে রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ করেছি, তিন-চারশো বছর ধরে বিস্তীর্ণ গাঙ্গেয় ভূভাগের মানুষ সেই মাত্রা তাদের যাপনে প্রেরণায় গ্রহণ করেছে কবি তুলসী দাস'কে ৷ ব্রাহ্মণ্যচিন্তার বহুমুখী গভীরতা ও ঐশ্বর্য এবং ভক্তিবাদের প্রেম অনুভূতি, এই দু’টির সমন্বয়ে তুলসীদাস একটা স্বীকৃত মূল্যবোধের জনক। এই মূল্যবোধটি আজকের বিচারে হয়তো সামন্ততন্ত্র ও পিতৃতন্ত্রের বহন করে ।ঐতিহাসিক স্থান কাল পাত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে তুলসীদাসের অন্তর্দৃষ্টি ছিল  মানববাদী। জীবনকথার নানা ইঙ্গিত বিভিন্ন সময়ে তাঁর রচনার মধ্যে পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন আজন্ম দরিদ্র নিপীড়িত ভারতবাসী । তাঁর পিতাামাতা নামে আছে দ্বন্দ্ব ৷ আত্মারাম দুবে ও হুলসি দেবী (অন্য মতে সরযূপারিন/ কনৌজিয়া) পুত্রের জন্মের সময় গ্রহনক্ষত্রের কিছু অশুভ যোগাযোগ থাকায় সদ্যোজাত সন্তানকে পরিত্যাগ করেন। শিশুটি পালিত হয় চুনিয়া নামে এক অন্ত্যজ নারীর আশ্রয়ে।শিশুর কথার বুলিতে প্রথম উচ্ছারিত হয় 'রাম' শব্দ ৷ লোকমুখে সে ‘রামবোলা’৷ পাঁচ বছর বয়সে মৃত্যু হয় পালিতামাতার । সেই বয়স থেকেই তাঁকে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করতে হয়। এমনি একসময়   রামানন্দস্বামীর শিষ্য সাধক নরহরিদাস তাঁকে আশ্রয় দেন। শুরু হয় শিক্ষা। সম্ভবতঃ সাত বছর বয়সেই তিনি সাধুব্রত গ্রহণ করেন।রত্নাবলীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ, পুত্রের জন্ম, পত্নীর ভৎর্সনায় গৃহত্যাগ ইত্যাদি  পরবর্তীকালে গল্প কথা আছে । 

 অওধি ছাড়াও ব্রজভাষাতে তিনি  কাব্য রচনা করেছেন। এই দুটি ভাষার পাঠকগোষ্ঠী আলাদা। তাঁর লক্ষ্য ছিল সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়া। তাঁর মাথার উপর রাম বা শিবের আশীর্বাদ ছিল কি ছিল না তা অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু সম্পূর্ণ গাঙ্গেয় উপত্যকার মানুষের ভক্তিভালোবাসা অঝোরধারে তাঁর উপর বর্ষিত হয়েছিল। রামচরিতমানসের দু’টি মূল পাণ্ডুলিপি প্রায় অবিকৃত, উদ্ধার হয়েছে।  তুলসীদাসের কাব্য পারদর্শিতা নিয়ে সারা পৃথিবীর পণ্ডিত ও পাঠকদের মধ্যে কোনও দ্বিধা নেই। রামচরিতমানসে ১২৮০০ পংক্তি ও ১০৭৩টি  স্তবক আছে। বাল্মীকি রামায়ণের মতোই সাতটি কাণ্ড এবং সামগ্রিকভাবে ১৮ রকম ছন্দ ব্যবহার করা হয়েছে। তার মধ্যে দশটি শাস্ত্রীয় সংস্কৃত ছন্দ ও আটটি প্রাকৃত ছন্দ। ভারতবর্ষের কোনও কাব্যে ছন্দ নিয়ে এত ব্যাপক পরীক্ষানিরীক্ষা করা হয়নি। মধ্যযুগের অন্যান্য প্রধান সাধক কবীর, নানক, রহিম, নামদেব, রামদাস প্রমুখ ব্যক্তি থেকে তুলসী ছিলেন বিশেষভাবে আলাদা। কারণ অধ্যাত্মসাধনার বিশাল পরিধিকে ছাপিয়ে গিয়েছিল তাঁর কাব্যশক্তির মহিমা।ভারতীয় জনমানসে তুলসীদাসের দিগদর্শন ও প্রভাব এখনও সুদূরপ্রসারী ও দীর্ঘস্থায়ী।কিংবদন্তি ধীমান স্রষ্টা মানুষ নিবেদিত ছিলেন লোকজীবনের মূল শিকড়ের প্রতি। অসংখ্য কাল্ট বা নিহালি গোষ্ঠী(মধ্য প্রদেশের নিমার জেলার  বুরহানপুর টেম্বি গ্রামের আশেপাশে তাপ্তি নদীর ঠিক দক্ষিণে নিহালি উপজাতি অঞ্চল) স্বার্থসন্ধ দল-উপদলে বিভক্ত মধ্যযুগের ভারতবর্ষে একটা স্বীকারযোগ্য রোলমডেল না থাকলে সেসব নিপীড়িত দরিদ্র মানুষের নৈতিক শক্তি ধ্বংস হয়ে যাবে সেটা তুলসীদাস হৃদয় দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন। তাঁর সৃষ্ট রাম নৈতিক শক্তির আধার। হেরে যাওয়া হারিয়ে যাওয়া মানুষ সেই শক্তিকে সঞ্চয় করে এগিয়ে যেতে পারে জীবন তরী নিয়ে ৷ 
                                      ছবি সংগৃহীত

সন্ত নাভাদাস তুলসীর জীবৎকালেই শ্রীভক্তমাল গ্রন্থে বলেছিলেন তুলসী আসলে বাল্মীকির অবতার। নবযুগে মানুষের কাছে নতুনভাবে রামায়ণকে প্রস্তুত করতে আবির্ভূত হয়েছেন।

ঊনিশ শতকে ফ্রেডরিক গ্রাউস সাহেব ইংরিজিতে অনুবাদ করেছিলেন রামচরিতমানস। তিনি বলেছিলেন সমগ্র বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি’তে, কলকাতা থেকে হরিদ্বার পর্যন্ত এই গ্রন্থের মতো প্রভাব ও অভিঘাত অন্য কোনও সাংস্কৃতিক সৃষ্টির নেই। তখনই রচনাটি পাশ্চাত্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। 
ভিনসেন্ট স্মিথ মন্তব্য করেছিলে—
not merely as the greatest modern Indian epic, but as something like a living sum of Indian culture…………the tallest tree in the magic garden of medieval Hindu poesy (Akbar: The Great Mughal-Smith)।

গান্ধিজি তাঁর আত্মজীবনীতে বলেছিলেন—
the Bible of Northern India……..the best and most trustworthy guide to the popular living faith of its people (Gandhi-Autobiography)।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ