এসো শৈশব | নীলাঞ্জনা ভৌমিক




পোস্ট বার দেখা হয়েছে


  এসো শৈশব 
 নীলাঞ্জনা ভৌমিক 

সমুদ্রের পার ঘেসে ছড়িয়ে আছে ছোট ছোট কতো নুড়ি পাথর.......ছোট -বড়-মাঝারি .....গোল-চ্যাপ্টা- ডিম্বাকৃতি--ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সেই পাথর -বালি-জল দিয়ে বাড়ি বানাচ্ছে- -যতবার বাড়ি বানাতে যায় ভেঙে যায় বারে বারে । 
কেন ? ওমা ঢেউ এসে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে যে ! কি করা যায়! এদিকে সন্ধ্যে হয়ে আসছে ,বাড়ি ফিরতে হবে! নাঃ আজ থাক ,আবার কাল দেখা যাবে ।খেলা ফেলে ঘরে ফিরে 
যায় ।এভাবে কেটে যায় কতগুলো বছর ' হরিষে-বিষাদে '।সেই ছোট্ট ছেলেমেয়েরা এখন 
বেশ কিছুটা বড় হয়েছে তাই তারা যে যার পথে ।
                
               মাঝ সমুদ্রে একটা নৌকা ভেসে চলেছে । একা এক মাঝি দাঁড় টানছে  , 
ঢেউয়ের তালে তালে নৌকা উঠছে নামছে ।ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামছে ।মানুষটি বোধহয় 
একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছে, ঝিমুনি মতো এসেছিল হয়তো ।কিন্তু শীত শীত করছে 
যেন!বাতাসটা জোরে বইছে কি! আরে আকাশটা কখন মেঘে ঢেকে গেল! নৌকার মানুষটা এবার একটু  নড়েচড়ে বসল। হালটা আর একটু শক্ত করে ধরল সাহসী মাঝিটি। দাঁড় টানা থামালে চলবে না যে, কূলে যে তাকে ফিরতেই হবে ।সমুদ্র উত্তাল হয়ে উঠল, ঢেউ পর ঢেউয়ের ধাক্কায় নৌকা বুঝি ভেঙে এবার টুকরো টুকরোই না হয়ে যায় ! বৃষ্টি এলো জোরে। ঝম্ ঝম্ করে বড় বড় ফোঁটায় পরতে লাগল। চারদিক নিকষ কালো অন্ধকার । কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আর সেইসাথে বুঝি ঝড়ের বার্তা বয়ে নিয়ে এলো। ঢেউ আর ঝড়ের দাপটে সবকিছু তছনছ হয়ে যায় আর কি!  বৃষ্টির অঝোর ধারায় মাঝিটি ভিজজে আর ভিজজে! 

পৃথিবী যেন রণচণ্ডী মূর্তি ধরেছে ! বৃষ্টি কমার কোনো লক্ষণ নেই । এ এক অসহায় 
করুন অবস্থা ! কিন্তু সে ভেঙে পড়ল না একেবারেই বরং আরো জোরে দাঁড় টানতে লাগল। 
জীবনের নানা সংকটের  নানান ঘাত প্রতিঘাতের মাঝে হতচকিত  মানুষের মতোই মাঝি  মাঝ সমুদ্রে দিশাহারা  ।    কিন্তু এতটুকু বিচলিত হয় না সে। ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে 
নৌকার ওপর। কড়াৎ কড়াৎ করে বাজ পড়তে  লাগল ।একবারের জন্যও বুঝি বা বুকটা তার কেঁপে উঠল।চারদিকে দৃষ্টি বুলিয়ে নিল -- ' নাঃ কেউ নেই ,একটা নৌকাও কোথাও নেই!' এতবড় পৃথিবীতে সে যেন একা এক জীবন যুদ্ধের সৈনিক ।    তীব্র অভিমানে বুক ফেটে যায়, চোখ  ভরে ওঠে জলে ---- ' এ কোথায় এলাম আমি, কোথায় আমার 
মা-বাবা-ভাই-বোন, কোথায় হারিয়ে গেল আমার খেলার সাথিরা !' আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবে, 'হা ঈশ্বর! কি অপরাধ আমার! কী পাপ করেছি আমি !'হঠাৎ ই যেন সে শুনতে পেল এক জলদ গম্ভীর কন্ঠস্বর ----'জীবনের ধর্ম তো পালন করতেই হবে ।পরীক্ষা দিতে হবে তোমাকে '। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে চোখের জল মুছে আরও শক্তহাতে দাঁড় টানতে থাকে---' নাঃ কূলে তা কে পৌঁছাতেই হবে ।ভেঙে পড়লে চলবে না '। 
আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে নৌকা  বাইতে থাকে ।রাত বুঝি আর শেষ হতে চায় না ।তবু সাহস 
করে এগিয়ে  চলে ।                    
                   ধীরে  ধীরে বাতাসের গতিবেগ কমে  আসতে থাকে,ঢেউয়ের তালে তালে নৌকা দুলতে থাকে ।আরও কিছুক্ষণ  পর বৃষ্টি ও থেমে যায় ।অন্ধকার  ফিকে হয়ে আসে । রাত বুঝি শেষ হয় এবার । ভোর হয়ে আসছে । মেঘও সরে গেছে । মানুষটির মুখ হাসিতে  উজ্জল হয়ে ওঠে - ---' ঐ ঐতো সূর্য উঠ্ছে ,ঐতো পার 
দেখা  যাচ্ছে ।' ক্লান্ত  উদ্বিগ্ন  চিত্ত এবার শান্ত হয়ে আসে । মনে মনে ভাবে 'নাঃ আর ভয়ের কিছু নেই । আর কিছুটা গেলেই পৌঁছে যাবো ।' যাক্ এবার যুদ্ধ শেষ ।  কূলে এসে তরী ভেরায় সে।ভাবে, 'যা দুর্যোগ গেল!  ফিরতে পেরেছি এই যথেষ্ট ।' গুন  গুন  করে উঠল মন, "বুঝি গো রাত পোহালো,  বুঝি ওই রবির আলো, আভাসে দেখা দিল গগন পারে"। সহসাই  তার দৃষ্টি আটকে গেল নূড়ি ভেজানো পারের দিকে- ----'ওরা কারা ? একমুখ হাসি নিয়ে ঐ যারা দাঁড়িয়ে আছে ?' নতুন ভোরের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে  তার মুখ-------'ওরা যে আমার খেলার  সাথি --আমার  শৈশব '! দুই হাত বাড়িয়ে দেয়,ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে বুকে ।এবার আর জলের নয় , সুখের সাগরে ভাসতে ভাসতে মানুষটি আরও একবার আকাশের দিকে তাকায়- -----'হে ঈশ্বর! তোমাকে প্রণাম! তুমি  সবসময় আমার সাথেই আছো।'

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ