গল্প || স্টেশনের সংসার | রত্না চক্রবর্তী




পোস্ট বার দেখা হয়েছে
                                        ছবি সংগৃহীত 

স্টেশনের সংসার
রত্না চক্রবর্তী

  স্টেশনেই ওদের একটা বেশ সুখের সংসার আছে। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখেন সরমা। নাতিকে বোর্ডিং থেকে নিতে আসেন সরমা আর তার ছেলে শুভ।   বৌ রিমির কর্মস্থল চেন্নাই, ছুটি পড়লে চলে আসে চেন্নাই থেকে, ছেলে থাকে সিউড়িতে,  ও চলে আসে সেখান থেকে,   ওরা এসে সরমাকে নিয়ে আসে ওল্ড এজ হোম 'আলো 'থেকে। রিমি ফ্ল্যাটে থেকে যায় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে তোলে বাড়িঘর, যমুনাদির কাছে চাবি থাকে ঝাড়পোঁছ করে কিন্তু চাদর পর্দা  বদলানো, বাসনপত্র ধোয়ানো, ট্যাংক পরিষ্কারের ব্যবস্থা করে রিমি। সরমা আর  শুভ আসে ছেলেকে নিতে বোর্ডিং থেকে। নাতি ব্যস্ত থাকে বোর্ডিং থেকে বেরিয়ে আসার জন্য। সেইজন্য তাড়াতাড়ি স্টেশনে আসা।
 স্টেশনে অপেক্ষা করতে হয় তাই অনেকক্ষণ।  তখনই দেখেন এই পরিবারটিকে, একটি বোবা কালা বুড়ি কুঁজো হয়ে পড়েছে, তার ছেলের বৌ পোলিওতে পা সরু, কিন্তু খাটিয়ে একটা জোয়ান মেয়ে আর ছেলেটা লালচুলো গন্নাকাটা। বুড়িকে সামনে বসিয়ে বৌটি ভিক্ষে করে, জংশন ষ্টেশন, অনেক ট্রেন আসে যায় যাত্রীরা   কখন কখনও ভিক্ষা দিয়েও যায়। সরমারা অপেক্ষা করে তাদের ট্রেনের জন্য।  দুপুরের দিকে একটু ট্রেন কম থাকে। বৌটা ওই খোঁড়া পায়েই দিব্বি বুড়িকে টেনে নিয়ে যায় প্ল্যাটফরমের ধারে, কল থেকে বোতলে জল ধরে  মাথা ধোয়ায়, গা মোছায় ছেঁড়া ন্যাকড়া দিয়ে আবার নিয়ে জায়গায় বসায়। আবার সুর করে ভিক্ষা করে "এই বোবাকালা মানুষটাকে  কিছু দিয়ে যাও গো বাবা। খোদা অনেক দেবে। " ট্রেন এসে যায়, ভিক্ষা পায় দু একটা।  লালচুলো ছেলেটা আসে,  গাড়ির কামরায় জোর করেই স্বেচ্ছায় ঝাঁট দেয়  আর গাড়ি চলে গেলে নেমে আসে একমুঠো কয়েন, কিছু জলের খালি বোতল আর কিছু ফেলা খাবার। দুপুরে গাড়ির খাওয়ার অনেকটাই লোকেরা ফেলে দেয়। গুছিয়ে নিয়ে আসে ছেলেটা, ওর নাম বোধহয় জন, মেয়েটা হেঁকে বলে, 'দুবোতল জল আন জন। ' জন স্টেশনের টয়লেটেই কাজ সেরে জল আনে, তারপর পাঁউরুটির টুকরো, রুটি, তরকারির, কিছুটা ভাত ভাগ করে খায়। বৌটা খেতে খেতে বুড়ির রুটির টুকরোগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে দেয়। খাওয়া শেষে বৌটা প্লাস্টিক এর টিফিন কৌটোগুলো ধোয়। ছেলেটা তার  নাকিসুরে বলে "মাদার এবার শোবে "। কালা বুড়ি বোঝে  না, লালচুলো জন একগাল হেসে বুড়িকে পাঁজাকোলা করে তোলে, ওভারব্রিজ এর সিঁড়িরতলায়  ঢাকা জায়গায় চটের বিছানায় শুইয়ে, মাথায় একটা পোঁটলা  ঠুসে দেয়। ফোকলা বুড়ি হাসে, ঘাড় নেড়ে হেসে তাকে ঘুমুতে বলে জন। তারপর এসে বসে প্ল্যাটফর্মে পাশাপাশি দুজনে। মেয়েটার নাম বোধহয় আসমানি,  চাওয়ালাটা তাই বলেই তো ডাকে।, ওরা মৌজ করে বসে গুজগুজ করে কথা বলে, মেয়েটা মাথার উকুন বাছে আর ছেলেটা পকেট থেকে একটা আধখাওয়া সিগারেট বার করে চাওয়ালার থেকে আগুন নিয়ে ধরায়, কি এক আবেশে চোখ বোজে, ওরা বারবার তাকায় সরমাদের দিকে আর স্বপ্নালু চোখে গল্প করে চুপিচুপি। মাথার উপর পাখা আছে,জল আছে, বাঁধানো বেঞ্চ আছে, এমন কি পায়খানা বাথরুম আছে, প্রচুর বন্ধুবান্ধব আছে, ওদের খুব পরিপূর্ণ মনে হয় নিজেদের। আর কত কম আয়োজনে কত সহজে মানুষের প্রয়োজন মেটে!  সরমা বিস্মিত চোখে প্রতিবার দেখে। ট্রেন আসে সরমারা চলে যায়।
 আসমানি বলে " আবার বোধহয় পূজোর আগে আসবে, বাচ্ছাটার ইসকুল এখানে কেন দিল?  মন কেমন করে না মা টার?  বাচ্চাটার কথা শুনে বুজি মা আছে, তাও দাদি কেন আসে?  কি বড়লোক তাও কত কষ্ট করে। আমার ছেলে হলে আমি ছেড়ে থাকতাম না। " জন তাকায় আসমানির দিকে, কেমন এক হেসে বলে "তাও ভালো পার্বতী মার মত ছেলেবৌ বোবাকালা বুড়িকে তো অচেনা স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে চলে যায় নি। মনে আছে কি সব দামি জামা কাপড় পড়ে এসেছিল, তারপর বুড়িকে বসিয়ে রেখে একটা দূরপাল্লার ট্রেনে উঠে চলে গেল। অসহায় মানুষটা তখন কাঁদছে আর ওদের খুঁজছে। তোকে তখন সবে খুঁজে পেয়েছি, তোর চাচা তোর উপর রোজ অত্যাচার করত শেষে বিককিরি করে দিচ্ছিল, তুই ট্রেনে  গলা দিতে এসছিলি.....।" আসমানি ঘাড় নাড়ে.  বিড়বিড় করে বলে " কেউ সেদিন দেখেনি রে, আব্বু মরে যাবার পর খুব কষ্ট দিয়েছে... তোর ও তো তখন খুব খারাপ অবস্থা তোর সাহেব মিথ্যে চোর বদনাম দিয়ে ইস্ত্রি তোর পিঠে চেপে ধরেছিল। কি নিষ্ঠুর!  মাবাপ মরা একটা ছেলেকে মিশন থেকে এনে চাকর খাটানো আর অত্যাচার করা...." আসমানি তার হাতটা বাড়িয়ে  জনের জামার মধ্যে ঢুকিয়ে দিল,  কোঁচকানো চামড়াটা খসখস করে ওঠে হাতে...  জন হেসে উঠে বসল, আয়েস করে হাত ছড়িয়ে হাই তুলে বলল " ছাড়, এখন তো আমরা খুব সুখে আছি, মাদার আছে, তুই আছিস, আমি আছি, খোলা আকাশ আছে রোদ ঝড় নেই, খাসা আছি রে। ওই দেখ ট্রেনে আসছে, এই ট্রেনটায় বেশ মাল ভালো পাই। বিলুদা বলছে আর একটু পয়সা জমাতে পারলেই পান সিগারেটের কাজটা ধরতে পারব,' সংসারটা' আরো ভালো চলবে। " আসমানি উঠল। পার্বতী মাকে আনতে হবে, প্যাসাঞ্জার আসছে। পার্বতীমার পুঁটুলির মধ্যে দুটো ব্লাউজ সায়া শাড়ি আর একটা সাদাকালো ছবি ছিল। অনেক পুরনো কিন্তু বোঝা যায় সময় টা এই বুড়িরই ছবি। বিলু চাওয়ালা হলেও পড়তে পারে। ওই বলেছিল ছবিটার পিছনে লেখা ছিল পার্বতী।। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ