পোস্ট বার দেখা হয়েছে
অঙ্কন : বিরাজলক্ষ্মী ঘোষ
অরণ্য সপ্তাহ উপলক্ষ্যে বিশেষ প্রতিবেদন
আদিপ্রাণ
ড.বিরাজলক্ষ্মী ঘোষ (মজুমদার)
"পান্থানাং পশুনাং চ হিতেচ্ছায়াএষা পঞ্চবটী রবীন্দ্রনেহ রোপিতা"
সমস্ত দেশ জুড়ে পালিত হয়ে চলেছে পরিবেশ দিবস,পরিবেশ সপ্তাহ,অরণ্য সপ্তাহ ও বন মহোৎসব উপলক্ষে বৃক্ষ রোপন।
সামাজিক বনসৃজনের এই প্রথার অন্যতম পথ প্রদর্শক হলেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।বৃক্ষকে তিনি অদিপ্রান রূপে উল্লেখ করেছেন।কারণ সমস্ত প্রাণ সৃষ্টির পূর্বে সৃষ্টি হয়েছে বৃক্ষ।যাকে কেন্দ্র করে সূচনা হয়েছে ধরণীর হৃদ স্পন্দন।পৃথিবীর আদিপ্রাণ বৃক্ষকে বর্ণনা কালে কবি বলেছেন :
"আজ আমার নমস্কার গ্রহণ করো,পৃথিবীশেষ নমস্কারে অবনত দিনাবসানের বেদি তলে।"
বিশ্বের জন্ম লগ্ন থেকেই অরণ্য প্রকৃতি তাকে পরম যত্নে মাতৃ দুগ্ধ দান করে যেনো লালিত করেছে।আশ্রয় দিয়েছে তাকে নিবিড় ছায়ায়।আলিঙ্গন করেছে সবুজ বনানী দ্বারা।
"কাল ছিল ডাল খালিআজ ফুলে যায় ভরেবল দেখি তুই মালিহয় সে কেমন করে"
প্রকৃতির সঙ্গে মানব মনের বিশেষ সেতুটি যে শৈশবেই নির্মাণ করতে হবে এ বিষয়ে তিনি নি:সন্দেহ ছিলেন।যার অন্যতম সূচনা তিনি করে গেছেন সহজ পাঠের প্রতি ছত্রে।যাকে সহজ পরিবেশ পাঠ বললেও কোনো ভুল হবে না।
"ফলসা বনে গাছ গাছেফল ধরে মেঘ ঘনিয়ে আছেওই খানেতে ময়ূর এসেনাচ দেখিয়ে যাবে।"
সুনিপুণ ভাবে তিনি শিশুর ভাব জগতে প্রকৃতির চেতনা জাগরণ করে তাকে মানস পটে অঙ্কন করে গেছেন সহজ পাঠের দুটি ভাগে।
রবি ছিলেন প্রকৃতিবাদী শিক্ষক।
ছবি সহজপাঠ
মানুষের সুস্থতার অন্যতম কারণ প্রকৃতি এবং সেই কারণেই তাকে সুস্থ ভাবে লালন করা প্রয়োজন একথা তিনি বিশ্বাস করতেন।সেই কারণেই অরণ্য প্রকৃতিতে নিবিড় বনরাজির ছায়ায় তার তপোবন আশ্রম বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন।তিনি মনে করতেন ইট কাঠ পাথরে গোড়া অট্টালিকায় শিক্ষা দান করা হয় তা নিতান্তই সাধারণ শিক্ষা মেকি শিক্ষা।তার মাঝে কোনো প্রাণ নেই।প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে তার সঙ্গে মিশে উন্মুক্ত ভাবে যে শিক্ষা লাভ করা যায় তাই হলো প্রকৃতি শিক্ষা।তার মধ্যেই প্রাণ আছে। শান্তিনিকতনের শিশুদের উদ্দেশ্যে তিনি বলতেন:
"তোমরা আনন্দ করবে।সকালে উঠে হাত মুখ ধুয়ে বেড়াতে যাবে।বনের মধ্যে ছুটোছুটি করবে।তারপর সেখানে পূর্ব দিগন্তে প্রথম সূর্যোদয় দেখে বেশ হই চই করে আশ্রমে ফিরবে।"
প্রকৃতিক লালিমা ও ভারসাম্য রক্ষা করতে কবিগুরু যে সমস্ত অনুষ্ঠান গুলির সূচনা করেছিলেন তার মধ্যে অন্যতম হল, হলকর্ষণ, বর্ষা মঙ্গল ও বৃক্ষরোপণ। তিনি বলেছেন :
"ধরণীর প্রতি কর্তব্য পালনের জন্য তার ক্ষত বেদনা নিবারণের জন্য আমাদের বৃক্ষরোপণের এই আয়োজন।"
ছবি সহজ পাঠ
১৯২৮ সনে ২৫ শে বৈশাখ তাঁর শুভ জন্ম তিথিতে তিনি বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন করেন। শান্তি নিকেতনে তার আবাস স্থল উত্তরায়ণ সন্নিকটে তিনি স্থাপন করেন পঞ্চবটী।যেখানে তিনি রোপণ করেছিলেন বট, অশ্বত্থ,বেল,অশোক ও আমলকী চারা।সেই উদ্দেশ্যেই আশ্রম পণ্ডিত বিধু শেখর শাস্ত্রী রচনা করেন উপরের শ্লোক টি।
১২২৮ সালে ১৪ই জুলাই তিনি শান্তি নিকেতনে বকুল চারা রোপণ করেন।
"বকুল মুকুল রেখেছি গাঁথিয়াবাজিছে অঙ্গনে মিলন বাঁশরী।"
এই উপলক্ষ্যে তিনি তার প্রবাসী পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী কে বলেন:
"তোমার টবের বকুল গাছটিকে নিয়ে অনুষ্ঠান হলো।সুন্দরী বালিকা সুপরিচ্ছন্ন হয়ে শাঁখ বাজাতে বাজাতে গান গাইতে গাইতে গাছের সঙ্গে যজ্ঞ ক্ষেত্রে এলো।"
এভাবে শান্তিনিকেতনের বৃক্ষরোপণ উৎসব ক্রমশ নিজস্ব মহিমায় বিকশিত হতে লাগল।
ছবি সংগৃহীত
১৯২৯ এ ১০ই জুলাই বৃক্ষরোপণ উৎসব পালন জন্য তিনি একটি গান রচনা করেন:
"আয় আমাদের অঙ্গনেঅতিথি বালক তরুণ দলমানব স্নেহের সঙ্গ নে।"
১৯৩৬ সালে শান্তিনিকেতন আশ্রমের গণ্ডি ছাড়িয়ে ভুবন ডাঙায় অনুষ্ঠিত হ বর্ষা মঙ্গল ও বৃক্ষরোপণ উৎসব।এই অঞ্চলটিতে বড়ই শুষ্ক ও জলাভাব যুক্ত ছিল।সেই উদ্দেশ্যেই খনন করা হয় এক বিরাট জলাশয়।
১৯৩৭ সালের ২৪সে আগস্ট আন্দামান দিবস উপলক্ষে বোলপুরের অদূরে সাঁওতাল গ্রামে কবিগুরুর পৌরহিত্তে বৃক্ষরোপণ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৪০সালের ৩রা সেপ্টেম্বর কবি শেষ বারের মতো বর্ষা মঙ্গল ও বৃক্ষরোপণ উৎসব পালন করেন।এই উদ্দেশ্যে তিনি রচনা করেছিলেন তাঁর শেষ বর্ষা সঙ্গীত:
"এসো এসো হে শ্যামছায়াঘন দিন"
১৯৪১ সালে ২২ শে শ্রাবণ কবি শেষ বারের মতো তার প্রাণবায়ু গ্রহণ করেছিলেন।তাঁর পরমাত্মার মিলনের কিছুদিন পর পুত্র রথীন্দ্রনাথ বৃক্ষরোপণ করেছিলেন।তার পরের বছর কবি কন্যা মিরা দেবী বৃক্ষরোপণ করেন।তারপর থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিবছর ২২ শে শ্রাবণ তাঁর তর্পণ এর সঙ্গে মহাসমারোহে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন অব্যাহত রয়েছে শান্তিনিকেতনে।
২০১৭ সালে ১৪জুলাই দিনটিকে বন মহোৎসব শুরুর দিন হিসাবে ঘোষণা করে একসপ্তাহ যাবৎ অরণ্য সপ্তাহ পালিত হয় সারা রাজ্য জুড়ে। এভাবেই সকলে আমরা আদিপ্রাণ রোপণ এর মাধ্যমে এই প্রকৃতি পালক ও প্রকৃতি বাদী শিক্ষকের চেতনা কে কার্যে রূপান্তরিত করতে পারি।।
2 মন্তব্যসমূহ
অনবদ্য ... অপূর্ব লেখা 💚💚💚💚
উত্তরমুছুনঅপূর্ব তথ্য পূর্ণ লেখা । খুব ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুন