ধারাবাহিক ভৌতিক উপন্যাস | ৪র্থ পর্ব | সোমনাথ ঘোষাল




পোস্ট বার দেখা হয়েছে



লম্বিত জিহবা
সোমনাথ  ঘোষাল
চতুর্থ পর্ব



ত্রিবেদীর এই কথায় জমিদার বাবুর মাথায় ধাক্কা মারলো। যৌবনটাকে তিনি পুরো ভাসিয়ে দিতে চান নারীর খেয়ায়, সেই খেয়ায় থাকবে উদ্দাম হাওয়া, দাঁড় বিহীন, পাল বিহীন, মাঝি বিহীন এ এক মধুর খেয়া। যার কোন দিক থাকবে না, গন্তব্যের কোনো নিদিষ্ট স্হল থাকবে না। তার শরীরে বইছে জমিদারি রক্ত। যদিও মহলে তার সুন্দরী বৌ আছে, কিন্তু সেতো বড় একঘেয়ে একঘেয়েমি  হয়ে গেছে। রজনীতে যদি গন্ধ না থাকে তাহলে সে কিসের রাত? 

ত্রিবেদী সিং রাতের কু-কাজ বন্ধ করে দেওয়ায়,তখন প্রায়সই বাগান বাড়িতে জলসা বসা বন্ধ হতো কিন্তু মদের আসর বসতো। ত্রিবেদী ছাড়া জমিদার শঙ্খনাথ চট্টরাজের আরো যেসব লাঠিয়াল ছিলো তারা শক্ত পোক্ত কিন্তু সাহসের অনেক অভাব ছিলো। ত্রিবেদী সিং-এর সাহস, দাপটে মনোভাবে একটা রাত ও বাগান বাড়ি নারী শূন্য হতো না। ত্রিবেদী এসব কাজ করতে দ্বিধা বোধ করতো কিন্তু মনিবের আদেশ অমান্য করা যায় না।
কিন্তু সে অনেকবার জমিদার বাবুকে এসব কুকাজ বন্ধ করতে বলেছেন, কিন্তু বিফল হয়েছেন। 

এদিকে বাগান বাড়িতে নারী শূন্য জলসা কি ভালো লাগে জমিদারের।  তখন প্রায় দিনই ভোর রাতে মদ্যপ অবস্হায় এই ঘরে, এই পালঙ্কে নিজের বৌ-এর ওপর  চলতো অমানুষিক অত্যাচার যা সারা মহলে চিৎকার ছড়িয়ে পড়তো। এই একই রকম খাবার রোজ তেনার আবার ভালো লাগে না। তাই এবার কলকাতা থেকে বাঈজী আসতে শুরু করলো, হাওয়ায় উড়তে লাগলো টাকা, সিন্ধুক খালি হলো, জমিদার গিন্নীর সোনাদানা বিক্রি হলো। শেষে চললো, প্রজা শোষন আর তাতেই শুরু হলো বিদ্রোহ, ভেঙ্গে পড়লো জমিদারি, নড়বড়ে হলো এই মহল। ততদিনে আমার ঠাকুমার কোল আলো করে জন্ম নিলো আমার বাবা লাঠিয়াল কাঁচলাল সিং। আর এই জমিদারি বিরুদ্ধ  বিদ্রোহ দমনের একজনই মানুষ ছিলেন, তিনি আমার দাদু লাঠিয়াল ত্রিবেদী সিং।

আমার দাদু যখন তার লাঠিয়ালদের নিয়ে  বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত, তখন এই চরিত্রহীন লম্পট, বর্বর, পাষন্ড জমিদার শঙ্খনাথ চট্টরাজ রাতের অন্ধকারে বাগান বাড়িতে মদ,বাঈজী আর নিরীহ মেয়ে বৌ-দের ধরে এনে জমিদারের বীরত্ব দেখাচ্ছেন। আর আমার ঠাকুমা চম্পাকলি তার ছোট্ট ছেলে কাঁচলালকে নিয়ে আনন্দে আত্মহারা। 

সেদিন বিকেল থেকেই আকাশ অন্ধকার করে এলো। বৈশাখ মাস, কাল বৈশাখীর লক্ষন। কদিন ধরেই আকাশ মেঘলা,  ঝিঝঝিরে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিও হচ্ছে তার ওপর গুমোট গরম। এদিকে খবর আসে পাশে কয়েকটা গ্রাম খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তারওপর গ্রাম বাসীরা জমিদারের লোকজনদের দেখলেই মারধর করছে। জমিদারের কানে এ খবর আসতেই তিনি ত্রিবেদী সিং-কে তা দমনের জন্য পাঠিয়ে দিলেন। 


জমিদার বাবুর  আদেশ পাওয়া মাত্রেই ত্রিবেদী সিং তার দলবল নিয়ে বিদ্রোহী গ্রামের দিকে রওনা দিলেন, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল শুরু হয়েছে। তাদের গ্রামে পৌঁছতেই সন্ধ্যে হয়ে যাবে। তারওপর মার দাঙ্গা হট্টগোল তো আছেই, অতএব সব ঠিকঠাক থাকলে ফিরতে তাদের ভোর হয়ে যাবে। 

দুষ্টু মানুষের দুষ্টু বুদ্ধি সবসময়ই কাজ করে। মানুষের চাহিদার শেষ নেই, কিন্তু সে চাহিদা যদি শারীরিক হয় তাহলে তা অপরের জীবন নিতেও দ্বিধা বোধ করে না। জমিদার শঙ্খনাথ চট্টরাজ ছিলেন এর থেকেও নিম্ন মানের অমানুষ। আগে থেকেই তিনি মনে মনে এমনই একটা সময়ের সুযোগ খুঁজছিলেন আর তা পেয়েও গেলেন। 

সন্ধ্যে নামার সাথে সাথে শুরু হলো কাল বৈশাখীর প্রচন্ড ঝড় জল। অসভ্য লম্পট জমিদার শঙ্খনাথ তখন বাগান বাড়িতে শুরু করলেন রঙ্গিন জলের আসর। কিন্তু এই আবহাওয়ায় বড়ই বেমানান এই পরিবেশ নারী বিনা। তাই তিনি তার দুই  অনুচরকে শিখিয়ে পাঠালেন চম্পাকলি কাছে গিয়ে তারা বলে, বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে ত্রিবেদী প্রচন্ড আহত হয়েছে, তাকে মহলে নিয়ে আশা হয়েছে এখনই তিনি যেন তার সাথে আসেন, তার ছেলে বাড়িতেই থাক, এই ঝড় বৃষ্টিতে তাকে নিয়ে গিয়ে কাজ নেই, ওপর এক অনুচর তাকে পাহাড়া দেবে তিনি আশা না পর্যন্ত সে এ বাড়ি থেকে নড়বে না। 

সরল মনে স্বামী দরদী চম্পাকলি অনুচরের মুখে একথা শুনে মূহূত্বে দিশাহারা হয়ে ছেলেকে জমিদারের আর এক অনুচরের কাছে রেখে ঐ ঝড় জলের রাতে মহলের দিকে পা বাড়ালেন। সে তখনও পর্যন্ত জানতে পারেনি যে কি ঘটতে চলেছে তার জীবনে। ডাকাত ঘরে তার জন্ম, ডাকাতের রক্ত বইছে তার শরীরে,তার স্বামী একজন দাপুটে লাঠিয়াল, সুতরাং মৃত্যু ভয় তার নেই। 

ঝড় জল মাথায় করে চম্পাকলি অনুচরের সঙ্গে মহলের সিংহ দ্বারে আসতেই হটাৎই তাকে জনা ছয়েক লাঠিয়াল ঘিরে ফেলে,  তাদের প্রত্যেকের মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা হাতে ছিলো লাঠি। সে মস্ত বড় একটা ভুল করে ফেলেছে, ঘর থেকে বেড়ােবার সময় লাঠিটা নিতেই ভুলে গেছে, সেও একজন বড় লেঠেল,বিয়ের পর তার স্বামী ত্রিবেদীর কাছে আরো কিছু খুঁটিনাটি শিক্ষা নিয়েছে, সুতরাং হাতে লাঠি যদি থাকতো তাহলে দেখিয়ে দিতো সে কে। 

এই যে, চাপা গলায় কে একজন বললো, যা বলছি চুপচাপ শোনো, আমরা যেখানে তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি চুপচাপ আমাদের সঙ্গে চলো, কোনো রকম চালাকি করার চেষ্টা করলে তোমার ছেলেকে জ্যান্ত ঐ বাড়িতেই পুঁতে দেবো। 
মানুষ যতই শক্তিশালী হোক, কিছু না কিছু দুর্বল জায়গা তার থাকেই, আর সেই জায়গায় হাত দেবার নাম করলেই সে নিথর হয়ে যায়, আর চম্পাকলি তো মা, সন্তানের জন্য সে সব কিছু করতে পারে। 

লাঠিয়ালরা তাকে ঘিরে নিয়ে বাগান বাড়ির দিকে এগোলো, তখন আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি পড়ছে, হু হু হাওয়ায় সাথে তা মিশে অন্য এক রূপ নিয়েছে। বাগান বাড়ির সামনে এসে লাঠিয়ালরা দাঁড়ালো। দুজন লাঠিয়াল তাকে নিয়ে বাগান বাড়ির ভিতর চলে গেলো বাকিরা সব বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো। 

বাগান বাড়ির একটি ঘরে দুই  লাঠিয়াল চম্পাকলি-কে ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে দরজা টেনে দিয়ে পাহারা দিতে লাগলো। ঘরের ভেতরে তখন জমিদার শঙ্খনাথ তার চেলাদের  নিয়ে মদের ফোয়ারা ওড়াচ্ছেন। চম্পাকলি ঘরে ঢুকতেই তারা সবাই পাথরের মূর্তির মতো তার দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলো। বৃষ্টিতে ভিজে চম্পাকলির চাবুক চেহারার সাথে শরীরের কাপড় মিশে গেছে। সে এক অন্য রূপ অন্য মাদকতা, লম্পটের চোখে সে শরীর শুধু পাওয়ার কামনায় ছটপট করে। 

বেশ কিছুক্ষন পর জমিদার শঙ্খনাথবাবুর  ইশারায় তার চেলাদের চলে যেতে বলেন।  নেশায় চুর চেলারা জমিদারকে প্রনাম ঠুকে টলতে টলতে ঘর থেকে বেড়িয়ে যেতেই লম্পট শঙ্খনাথ উঠে দাঁড়িয়ে চকচকে চোখ দুটো নিয়ে টলতে টলতে চম্পাকলির দিকে এগিয়ে এসে জড়ানো গলায় বললো, ইস বেয়াদপ বৃষ্টি আমার চম্পা-কে পুরো ভিজিয়ে দিয়েছে। যাক ভালোই হয়েছে, একদম পবিত্র হয়ে গেছিস। নে নে ভিজে কাপড় সব খুলে ফেল, না হলে ঠান্ডা লেগে যাবে, এই বলে নিজেই হাত বাড়িয়ে চম্পাকলির কাপড় খুলতে গেলেন।
 চম্পাকলি স-জোরে জমিদারের হাতে ধাক্কা মেরে কর্কশ গলায় বললেন, আমার স্বামী কোথায়? এখানে আসতেই আমি বুঝেছি আমাকে মিথ্যে বলে এখানে আনা হয়েছে, আর আমার স্বামী ত্রিবেদী সিং এতো দুর্বল মানুষ নয় যে তার লাঠিকে ভেদ করে কেউ তার শরীরে আঘাত করবে, এই বলে সে চকিতে ঘুড়ে বন্ধ দরজার দিকে পা বাড়তেই জমিদারবাবু টলবলে হাতে চম্পাকলির ভিজে কাপড় টেনে চিৎকার করে বললেন, এই হারামজাদী চম্পাকলি বড় বেশি দেমাক হয়েছে না তোর, শোন এই বাগান বাড়িতে মেয়েরা আমার ইচ্ছেই আসে আর আমার ইচ্ছেই বাইরে যায়, আর সেটা আমার ইচ্ছের ওপরই নির্ভর করে। আর নারীরা চিরকালই পুরুষের ভাগের জন্যে জন্ম নেয়, পুরুষ বিনা নারী জন্ম বিথা। 

কাজরী এক ঝটকায় জমিদারের হাত থেকে কাপড়ের আঁচলটা ছাড়িয়ে নিয়ে চিৎকার করে বললেন, হ্যাঁ রে কা-পুরুষ জমিদার এই এক নারীরই গর্ভে তোর মতো পাষন্ডের  জন্ম হয়েছে, তাঁর কি যন্ত্রনা যে তোর মতো কুলাঙ্গারকে জন্ম দিয়ে এই বংশের জমিদার করেছে। এখন আমি নিরুপায় আমার ছেলেটা তোর লোকের কাছে আছে বলে, না হলে এই বাগান বাড়িতেই তোকে পুঁতে দিতাম। মনে রাখিস আমি মনু ডাকতে মেয়ে আর আমার স্বামী লাঠিয়াল ত্রিবেদী সিং। যদি সে একবার জানতে পারে যে আমার ওপর তুই অত্যাচার করেছিস তাহলে তোর বংশের প্রদীপ জ্বালানোর কেউ থাকবে না। তাই ভালো চাস তো আমায় ছেড়ে দে, আমি কথা দিচ্ছি কাউকে কোনো কিছু বলবো না। 


জমিদারবাবু হাঁক মারলেন, সঙ্গে সঙ্গে দুজন লাঠিয়াল দরজা খুলে ঘরে ঢুকলো। 
জমিদারবাবু বললেন, এই বাইরে লেঠেলদের খবর দে, এর ছেলেকে যেন জ্যান্ত পুঁতে দেয়। তারপর ত্রিবেদীকে দেখছি, এই শালীর খুব রস হয়েছে, এই রস একটু মড়িয়ে দিতে হবে। শালী ডাকাতি করতে এসে ধরা পড়ার পর আমার সাথে কি চুক্তি হয়েছিলো তোর? তখনতো সব চুক্তি মেনে নিয়েছিলিস, আর প্রথম প্রথম আমার কাছে এসেওছিস,বিছানায় শুয়েছিস, আর এখন সতী গিরি দেখাচ্ছিস। তখন যদি আমার চুক্তি না মানতিস তাহলে আমার এক ইশারায় তোর স্বামী ত্রিবেদী সিং তোর বাপ, গুষ্টিদের ঐ মহলেই জ্যান্ত পুঁতে দিতো। ডাকাতের বংশ নিঃবংশ হয়ে  যেতো। আমি তােদের ভালোর জন্য তােদের বিয়ে দিয়েছি, থাকার জায়গা দিয়েছি, চারবেলা খাবারের, কাপড়ের কোনো অভাব রাখেনি, তার বিনিময়ে আমি শুধু চেয়েছি আমার শারীরিক চাহিদা পুরোনের। তোর ঐ শরীর শুধু আমার জন্য, আমি জমিদার শঙ্খনাথ চট্টরাজ তোর শরীর ছুঁলে তোর নারী জীবন সার্থক হবে। 
এবার লাঠিয়ালদের লক্ষ্য করে বললেন, এই তোরা এখনো এখানে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস যে, যা ওর ছেলেকে জ্যান্ত মাটিতে পুঁতে দে, তারপর দেখছি ত্রিবেদী সিং-কে। 

চট্টরাজ বংশের জমিদার শঙ্খনাথ চট্টরাজ নির্দয়, অমানুষ জমিদার এই বংশে কেন অনেক বংশেই জন্ম নেননি। রাতের পর রাত নিজের শারীরিক চাহিদা মেটাতে অনেক নারীর জীবন চলে গেছে, দয়ামায়া তার মনে একেবারে নেই। সে নিজের ছাড়া কিছুই বোঝেন না। চম্পাকলি এসব শুনেছে তার স্বামীর কাছ থেকে, সুতরাং সে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো, হাঁটুগেড়ে বসে তার স্বামী আর ছেলের জন্য প্রান ভিক্ষা চাইলো। 
জমিদারবাবু ইশারা করলেন, দুই লাঠিয়াল ঘর থেকে বেড়িয়ে গিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিলো। শঙ্খনাথ চট্টরাজ একজন চরিত্রহীন লম্পট নারী শিকারী,তিনি চম্পাকলির  দিকে তাকালেন, অসহায় চম্পাকলি তার শরীরের সমস্ত লজ্জা বস্ত্র খুলে জমিদারের বিছানার সঙ্গী হলেন। 

                             🎊চলবে.....


আরও পড়ুন -

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ