গল্প || খুনী | জয়া চক্রবর্তী সোমা




পোস্ট বার দেখা হয়েছে
                                            ছবি সংগৃহীত 


খুনী
জয়া চক্রবর্তী সোমা


"খুনী খুনী....আস্ত ডাইনী একটা".....কথাগুলো কানে যে আসছিল না তা নয়।তবু এখন এসব কথা গা সওয়া হয়ে গেছে মিঠুর।কানে লাগে মনে লাগে না।সে নিবিষ্ট মনে হাঁড়ির পিছনে পরা কালি তুলতে থাকে।শ্বাশুড়ী রোজকার মত বলে চলে একি সুরে-"কোন কুক্ষণে গো...বাবুকে বারবার কয়েছিলুম এই মেয়ে ঘরে আনিস না বাবু।নীচু জাত তায় বাঙাল।ও মেয়ে কক্ষনো ভালো হবে না।" বাবু মানে মিঠুর স্বামী।মিঠুর বিয়েটা প্রেম করে।মিঠু বাঙাল পরিবারের মেয়ে।দুইভাই এক বোন ওরা।বাবুদের পরিবার বেশ বড়।দুই দাদার পর বাবু।বাবুর নীচে এক বোন।বাবু আর মিঠু যখন বিয়ের কথা বলে মিঠুর পরিবার সাফ জানিয়ে দেয় বিয়ে করলে কর,কিন্তু বিয়েতে এক পয়সা খরচ করতে পারব না।মিঠু সেলাই করে যা জমিয়েছিল তাই দিয়ে নমো নমো করে বিয়ে হয়।বাবুর পরিবার তো রাজীই ছিল না।আসলে বাবুর তেমন পার্মানেন্ট কাজ ছিল না।

তারপর ওদের জাতের বাতিক।তবু একরকম চলত।কিন্তু মিঠু বড় দুর্ভাগা।বিয়ের তিনমাসের মাথায় যে কাজটা বাবু করত সেটাও চলে গেল।মিঠুর এক ভাসুর আগেই আলাদা।এবাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ নেই।শুধু বড় ভাসুরের রোজগারেই চলে।উঠতে বসতে খোঁটা শুনতে হয়।বাবু কাজের চেষ্টা করতে থাকে।কিন্তু তেমন ভালো কিছু পায় না।এর মধ্যে গোদের উপর বিষফোঁড়া মিঠু আর বাবুর মেয়ে মৌ জন্মায়।সংসারে একটা বাড়তি খরচ।মৌ হবার আগে মিঠু বাবুর জন্য সহানুভূতিশীল ছিল।কিন্তু মৌ এর দুধের জন্য বড় জাএর কাছে কথা শুনতে হল যখন তখন লজ্জা দু:খ আর রাগটা গিয়ে পরল বাবুর অক্ষমতার উপর।বাবু প্রথম প্রথম নিজের অক্ষমতায় লজ্জা পেত।পরের দিকে সেও বিরক্ত হয়ে উঠল।ঝগড়া বারতে লাগল।মৌ তখন চার বছরের।সেই রাতটা মিঠুর জীবনের বিভীষিকার রাত।

বাবু গাড়ির ব্যবসা করবে ঠিক করেছিল।মিঠুর যা সামান্য গয়না আছে সেই গয়না বিক্রি করে টাকা দিয়েছিল বাবুকে।বাসুদার সাথে এই নিয়ে ঘোরাঘোরি করছিল ও।একটা ধারের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল বাসুদা।বাসুদাই একদিন জোর করে মদ খাইয়েছিল বাবুকে।মিঠু রাগারাগি করেছিল।কিন্তু তারপর প্রায়ই শুরু হল মদ খাওয়া।সেই রাতেও মদ খেয়ে ঢুকেছিল বাবু।সারাদিনের ক্লান্তি,অপমান,গঞ্জনার পর রাগে ফেটে পরেছিল মিঠু।বলেছিল কাপুরুষ নপুংসক।বাবুর জায়গায় মিঠু থাকলে আদি গঙ্গায় ডুবে মরত।বাবু কথাটা যে সত্যি মনে নিয়ে নেবে মিঠু বোঝে নি।সেই রাতে একটা স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল বাবু।আর ফেরেনি।বিভীষিকায় কেটেছিল চারটে রাত।তারপর পাওয়া গিয়েছিল বাবুর দেহ...গলা পচা বিকৃত।সনাক্ত করা যাচ্ছিল না।শুধু গায়ের ওই স্যান্ডো গেঞ্জিটা দেখে...পাথর হয়ে গিয়েছিল মিঠু।কেউ স্বান্তনা দেয়নি সদ্যবিধবাকে।সবাই কানাকানি করেছিল।শুধু বুক চাপড়ে কেঁদেছিল বাবুর মা-"রাক্ষুসী তোর খিদে মিটেছে তো?"মিঠু শুধু মৌকে বুকে আগলে বসে ছিল।তারপর এই তেরটা বছর।মিঠুর চোখে জল আসে নি কখনো।সে এই সংসারে কাজ করে উদয়াস্ত।মৌকে মানুষ করতে হবে।বড় জা শ্বাশুড়ী চারবেলা যা নয় তাই শোনায়।বড় ভাসুর হয়ত মায়া বোধ করেন কিন্তু দেখাবার সাহস তার নেই।মিঠু বাপের বাড়ি যায় নি।কারণ সে জানে বাবা মরে যাবার পর মাই ভাইদের কাছে গলগ্রহ। সেখানে বিধবা বোন বাচ্চা নিয়ে গেলে তারা থাকতে দেবে না।আজও বাসন মাজছিল মিঠু।শ্বাশুড়ির গঞ্জনা তার কানে যাচ্ছিল না।সে একমনে ভাবছিল মৌ সম্পর্কে রাস্তার কলে জল আনতে গিয়ে পর্ণা বৌদি যা বলল সেটা কি সত্যি।হারু নামের ওই খালপাড়ের চালচুলোহীন ছেলেটার সাথে সাইকেলে মৌকে দুদিন দেখেছে পর্ণা বৌদি।কি করবে এখন মিঠু।মৌএর এই কচি বয়েসে কি বোঝে সে।না:,নিজের জীবনটা তার নষ্ট হয়েছে।কিন্তু মৌ এর জীবনটা....

মৌ স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতে মিঠু জিজ্ঞেস করল-"হ্যাঁ রে হারুর সাথে তোর এত কিসের ভাব।"মৌ একটু থমকালো।তারপর ঝাঁঝের সাথে বলল-"কেন আমার বন্ধু থাকতে পারে না?"আজকাল মৌ এর গলায় যেন ওর জ্যেঠী ঠাকুমা পিসির স্বর শুনতে পায় মিঠু।শান্ত স্বরেই বলল-"না ওরকম বন্ধু তোমার থাকতে পারে না।আর যেন ওর সাথে তোমায় মিশতে না দেখি।"মিঠু ঘর ছেড়ে বেরিয়েই আসছিল। মৌ বলল-"আর যদি মিশি কি করবে?"মিঠু বিস্মিত ফিরে তাকায়।মৌ বলে -"দেখ মা, আমার বাবাকে তো খেয়েছ টাকা টাকা করে।আমার জীবন নষ্ট করতে আসবে না।আমি তোমার মত টাকা লোভী নই বুঝেছ যে ভালোবাসার চেয়ে টাকাটাকে বড় করে চিনব।হারুর টাকা না থাক, সে আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু এসব তুমি বুঝবে না।বুঝলে এভাবে হাসি মুখে ঘুরে বেরাতে পারতে না।"মৌ চলে যায় ঘর ছেড়ে।মিঠু চৌকি তে বসে থাকে।মৌ তাকে ভাবে তার বাবার খুনী।খুনী সে সত্যিই খুনী তবে।সেদিন ঘোষালদের বাড়ি আবার একটা অপমৃত্যু হল।গলায় দড়ি দিয়ে মরল ঘোষালদের ছোটবৌ।বরের শোকে অনেককালই মাথাটা একটু একটু বিগড়োচ্ছিল।আর অনুতাপ বলেও তো একটা কথা আছে।কিছুদিন পুলিশি হাঙ্গামা চলে।বড় ভাসুর টাকা খাইয়ে সব মেটায়।পার্টিতে মোটা অঙ্কের চাঁদা জমা পরে।তারপর দুবছর কেটে গেছে।পরিবর্তন তেমন কিছু হয়নি।মৌ এইচ এসের পর পরা ছেড়ে বিউটিশিয়ান কোর্স করে এখন একটা পার্লারে কাজ নিয়েছে।হারুর সঙ্গে সম্পর্কটা নেই।আর বাড়িতে একটা কাজের লোক রাখা হয়েছে।কাপড়কাচা, বাসন মাজা, ঘর ধোয়া মোছা, রাস্তার কল থেকে জল আনা.....অনেকগুলো বাড়তি টাকা নেয় মেয়েটা।একদিন দুপুরে ঘোষাল বাড়ির খাওয়া দাওয়ার পাট তখন সবে মিটেছে।দরজার কড়া নাড়লো কে।মৌ দরজা খুলে চিনতে পারেনা ভদ্রলোককে।কিন্তু মৌ এর জ্যেঠী এসে দেখে ডুকরে কেঁদে ওঠে-"ঠাকুরপো!!তুমি বেঁচে আছ..."

মৌ এর বাবা ফিরে এসেছে পনের বছর পর।তিনি নাকি কোন বাবার সঙ্গে এতদিন সারা ভারত ঘুরেছেন।কিন্তু শেষে মনে হয়েছে সংসারের মোহ তার কাটে নি।তাই শেষে মায়ের কাছেই ফিরে এসেছেন।পাড়ায় খবরটা ছড়িয়ে পরে।ঘোষাল বাড়িতে খুশীর অন্ত নেই।ঠাকুমা সামনের পূর্নিমায় সত্যনারায়ণ দেবেন।মিঠুর কথা কেউ বলে না।খুনী যে কবে খুন হয়েছে কে জানে?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ