প্লাস্টিকব্যাগ মুক্ত দিবস | অলিপা পাল




পোস্ট বার দেখা হয়েছে
                                                অঙ্কন লাবনী সরকার 

৩রা জুলাই প্লাস্টিকব্যাগ মুক্ত দিবস

 লাবণী আজ তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠেছে ৷ অন্যদিন লাবণীর মা ঘুম থেকে তোলার জন্য কত চেষ্টা করে তবু লাবণীর ঘুম ভাঙেনা ৷অথচ আজ! আজ যে বিশেষ দিন লাবণী ও গঙ্গোত্রী দিদি যাবে এলাকার কয়েকটি পাড়ায় প্লাস্টিক সংগ্রহ করতে ৷ অবাক লাগছে তাই তো! সত্যিই অবাক হওয়ার ৷ লাবণীর কাকু আন্তর্জাতিক বঙ্গীয় সাহিত্য দর্পণ ফেসবুক পত্রিকার সম্পাদক দেবাশীষ ভট্টাচার্য ৷ তার উদ্যোগে আজ ৩রা জুলাই বিশ্ব প্লাস্টিক মুক্ত দিবসে অসাধারণ কাজের উদ্যোগ নিয়েছে গোটা দর্পণ পরিবার ৷ ফেসবুকে দর্পণ পত্রিকা সাহিত্য চর্চার পাশে গুরুত্বপূর্ণ অংশ গ্রহন করে সমাজ সেবায় ৷ বিশ্বজুড়ে করোনার ভয়াবহতায় দর্পণের অভিনব উদ্যোগ প্রত্যেক দর্পণ সদস্য নিজের এলাকা প্লাস্টিকের দূষণ থেকে মুক্ত করবে,তারা অঙ্গীকারবদ্ধ ৷ 
 লাবণী ও গঙ্গোত্রীদি কয়েকটা পাড়ার ক্লাব সদস্যদের সাহায্যে এলাকার গরীব মানুষদের থাকতে বলেছে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কয়েক কিলো প্লাস্টিক। যেমন—ফেলে দেওয়া জলের বোতল,পলি ব্যাগ,থার্মাকলের থালা-গ্লাস মিলিয়ে কয়েক কিলো প্লাস্টিক জমা করে দর্পণের সমাজসেবকদের হাতে তুলে দিতে পারলেই বিনিময়ে দর্পণের তরফথেকে মিলবে চাল ডাল মুদি মশলা ৷প্লাস্টিকের দূষণ রুখতে দর্পণের অভিনব ভাবনায় সামিল হয়েছে সুদূর হায়দ্রাবাদ থেকে দেবলীনা ও ব্যঙ্গালোর থেকে স্বপ্নাদি,তারাও তদের এলাকা প্লাস্টিক মুক্ত করতে বদ্ধপরিকর । আরও অনেক সেচ্ছাসেবী সংস্থা এগিয়ে এসেছে,বর্জ্য প্লাস্টিকের বিনিময়ে ছোট শিশুদের স্কুলের মাইনে দিয়েছে সে কথাও শোনা যায় ৷গতানুগতিক শিক্ষার বদলে শিশুদের দূষণমুক্ত নির্মল পরিবেশ তৈরির পাঠ দেওয়া এক অভিনব প্রয়াস ৷
জীবনের  ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ করতে মানব জাতি তার উন্নতি আর স্বাচ্ছন্দ্যের লক্ষ্যে পৌছাতে গিয়ে পরিবেশকে প্রতিনিয়ত আঘাত করে চলেছে,উপেক্ষা করছে প্রকৃতির দূষণকে।প্লাস্টিক দূষণ তার মধ্যে অন্যতম এই দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য 2018সালে বিশ্ব পরিবেশ দিবসের থিম ছিল—বিট প্লাস্টিক পলিউশন।ভারতবর্ষ ছিলো আয়োজক দেশ ।জনসচেতনতার জন্য 3 জুলাই দিনটি পালন করা হয় বিশ্ব প্লাস্টিকব্যাগ মুক্ত দিবস হিসেবে৷ 
রাষ্ট্রপুঞ্জের তরফ থেকে সমস্ত দেশের কাছে 2030 সালের মধ্যে প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করার আর্জি রাখা হয়েছে। 
সত্যিই কি কমানো গেছে বা যাবে প্লাস্টিক দূষণ ?
প্লাস্টিকের প্রতি আমাদের আকর্ষণ নিরন্তর। কেনা, ব্যবহার করা, ফেলে দেওয়া, আবার কেনা ব্যবহার করা ফেলে দেওয়া আবার...
প্লাস্টিক দূষণ নিয়ে আমরা কমবেশি চিন্তিত। প্লাস্টিক বর্জন করুন—এই স্লোগানও আমাদের কাছে পরিচিত।দৈনন্দিন কাজে আমাদের জীবন জুড়ে থাকা প্লাস্টিক আমরা কেন বর্জন করব কিংবা কী ভাবে বর্জন করব, বড় প্রশ্নের সম্মুখীন মানবজাতি ।
প্লাস্টিকের বহু সুবিধা থাকলেও সবচেয়ে বড় অসুবিধা হল,এটি বায়োডিগ্রেডেবল নয় অর্থাৎ প্রকৃতিতে মিশে যায় না ৷ আসলে প্লাস্টিক হল বেশ কিছু যৌগের পলিমার। এই যৌগগুলি মানুষের শরীরে দীর্ঘমেয়াদি বিষক্রিয়া তৈরি করে,ফলে প্লাস্টিকে ব্যবহৃত বিসফেনল এ, থ্যালেট প্রজননতন্ত্রের ক্ষতি করে। প্লাস্টিকের কাপে বা অন্য পাত্রে গরম পানীয় বা খাবার খেলে তার থেকে যে ডাইঅক্সিন শরীরে প্রবেশ করে তা আমাদের শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কমিয়ে দেয় এবং মহিলাদের বন্ধ্যত্ব ঘটায়। এ ছাড়াও এন্ডোক্রিন ডিজ়রাপটার রাসায়নিকগুলি দেহের হরমোনের কর্যক্ষমতায় ব্যাঘাত ঘটায় । প্লাস্টিক বোতলে ভরা সুস্বাদু পানীয় বা প্লাস্টিকে মোড়া প্লাস্টিকের কাঁটা চামচ দেওয়া খাবর,খেয়ে ফেলে দিয়ে ভুলে গেলেই হল!সত্যি যদি তাই হত, আজ প্লাস্টিক-মুক্ত পৃথিবী থিমের ওপর নির্ভর করে বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদযাপন হত না ৷পৃথিবীকে প্লাস্টিক মুক্তকরার জন্য একটা দিন পালন !
এটাই মানবজাতির কাছে লজ্জাজনক ৷
প্রশান্ত মহাসাগরের একাংশে ভাসমান প্লাস্টিকের তাল এখন এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে আয়তনে একটা দেশের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে সহজেই ৷
পৃথিবীর সমস্ত প্লাস্টিক মানবজাতির উৎপাদন,সমুদ্রে যত পরিমাণ প্লাস্টিক আজ ভাসছে বেশিরভাগ নদীর মাধ্যমে আসা ৷সমুদ্রের সাথে যুক্ত নদী এশিয়ায় বেশি অবস্থিত, প্লাস্টিক দূষণে উল্লেখযোগ্য নদী ইয়াংজি, ইয়েলো, পার্ল, মেকং গঙ্গা নদী। সম্প্রতি নরওয়ে উপকূলে একটি কারভার্স বিক্ড হোয়েল পাওয়া যায়, যার পেটের ভেতর ছিল প্রায় তিন ডজন প্লাস্টিকের ব্যাগ। স্পেনের সমুদ্রতটে ভেসে আসা একটি স্পার্ম হোয়েলের পেট থেকে বেরোয় একই পরিমান প্লাস্টিক।পাখিরা রঙচঙে প্লাস্টিক বোতলের ছিপি খাদ্য ভেবে তাদের ছানাদের মুখে তুলে দেয়,ফল!অন্ত্রে আটকে গিয়ে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু 
ভারতের দূষণ নিয়ন্ত্রণ  বিশেষজ্ঞরা বলেছেন উপমহাদেশে বর্ষাকালে অতিবৃষ্টির ফলে প্লাস্টিক জমে বন্ধ হয়ে যাওয়া নর্দমা দিয়ে জল নির্গত হয় না। এই কারণে 2005 সালে মুম্বই ও2015 সালে চেন্নাই বন্যায় প্লাবিত হয়েছিল। 
কলকাতাও নিরাপদ নয় ৷জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে বঙ্গোপসাগরের জল প্রতি বছর দুই মিলিমিটার হারে ফুলে উঠছে, ঘূর্ণিঝড়ও থাকছে প্রাকৃতিক নিয়মে । বঙ্গোপসাগরের গড় জল স্তর থেকে কলকাতা মাত্র 5-6 মিটার উচ্চতায় অবস্থিত, ভূমির ঢাল এত কম যে পাম্পের সাহায্য ছাড়া জল নিকাশি ব্যবস্থা কার্যকর হয় না। এত অসুবিধার সাথে যুক্ত হয়েছে আমাদের ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক যা নিকাশি নালাকে বন্ধ করে দিচ্ছে। 
তবে এখনও অন্ধকার নেমে আসেনি। কিছু দেশ যথেষ্ট সক্রিয় হয়ে উঠেছে ৷ প্লাস্টিক ব্যাগ সর্বতোভাবে নিষিদ্ধকরতে, বড় বড় সুপারমার্কেটগুলি প্রতিজ্ঞাবোধ হয়েছে যে তারা প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করবে ৷
                                       অঙ্কন লাবনী সরকার 

1999 সালে জাতিসংঘের যুব জলবায়ু অ্যাকশন সামিটের অংশ হিসাবে এবং পরে গ্রেটা থানবার্গ আয়োজিত জলবায়ু পরিবর্তনে অংশ নিয়েছিল ভারতীয় তরুণ আদিত্য মুখোপাধ্যায় ৷ তার কথায় মানুষ সচেতন হয় যখন শিশুরা পরিবেশকে যত্নকরার কথা বলে ।প্লাস্টিকের ব্যবহারের বিরুদ্ধে তিনি ক্যাফে এবং রেস্তোঁরা ঘুরে প্লাস্টিকের স্ট্র ব্যবহার বন্ধ করার জন্য প্রচার শুরু করেছিলেন এবং পরিবেশ জাতদ্রব্য ব্যবহার করতে তাদের রাজি করানোর জন্য উদ্যোগ নিয়েছেন। কচ্ছপের নাক থেকে প্লাস্টিকের বের করার একটি ভিডিও আদিত্য কে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। পরে তিনি এই প্রচার শুরু করেছিলেন ৷
 ডিসপোজ়েবল প্লাস্টিক অর্থাৎ  ক্যারিব্যাগ,প্লাস্টিক কাপ-গ্লাস-চামচ, প্যাকেটবন্দি জল,স্যাশে,স্ট্র ইত্যাদির ব্যবহার বন্ধ করা বা কমানো খুব কঠিন নয়।তাছাড়া বাজার করার সময় সঙ্গে একটা ব্যাগ সব সময়ে রাখলে হঠাৎ প্রয়োজনে প্লাস্টিকের প্যাকেট আমাদের নেওয়ার প্রয়োজন হয় না। 
প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ কমাতে আমাদের পুড়িয়ে ফেলার অভ্যাস আছে যা আরও ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক। কারণ সাঙ্ঘাতিক পরিমাণ বায়ুদূষিত করে,যা শ্বাসকষ্টের দরুণ asthma এমনকি ক্যানসার হওয়া অস্বাভাবিক নয় ৷ বর্জ্য পুড়িয়ে বাতাস দূষিত করাও আইনত অপরাধ ৷পুড়ে যাওয়া বর্জ্য প্লাস্টিক থেকে তৈরি মিথেন গ্যাস উষ্ণায়ণে প্রত্যক্ষ কুপ্রভাব ফেলছে।
ফেলে দেওয়া জিনিস আজ আর ফেলনা নয়৷ এই স্লোগানকে সামনে রেখে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী,আশ্রম, সমাজসেবার প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত মানুষজন ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক ক্যারি ব্যাগ, বোতল,থার্মোকলের থালা-বাটি সাধারণত  এই সকল জিনিসগুলিকে নিয়ে নানা ধরনের শিল্প সামগ্রী তারা তৈরি করছেন ৷ বোতল কেটে তৈরি করছেন ফুলদানি কিংবা ব্যাগ কেটে তৈরি করছেন ফুল৷ শিল্প সৃষ্টি হিসেবে এই বোতল বা ফুল হয়ত বিরাট উঁচু মানের নয়, কিন্তু এর নেপথ্যে থাকা মহত উদ্দেশ্য এই সৃষ্টিকে উৎকৃষ্ট শিল্পের রূপ দিয়েছে ৷ প্লাস্টিক দূষণের ভাবনা থেকে হস্তশিল্পের মুন্সিয়ানায় নতুন পথ তৈরি হয়েছে ৷
পৃথিবীতে সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকতে হলে প্রতিটি মানুষকে তার পরিবেশ সম্পর্কে যত্নবান হতে হবে,দায়িত্ব নিতে হবে পরিবেশ কে সুন্দর রাখার । প্রশাসন কে উদ্যোগ নিতে হবে মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি কঠোর আইন রুপায়ণ করা ৷ প্লাস্টিক তৈরির থেকে বর্জ্য হওয়া পর্যন্ত সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও নিয়মের মধ্যে প্লাস্টিক কে ব্যবহারের পর বর্জন করার জন্য পরিবেশ রক্ষাকরার চেতনা জাগ্রত করতে হবে প্রতিটা মানুষের ৷
 দীর্ঘমেয়াদি ও সুস্থায়ী উন্নয়নের জন্য ব্যক্তিগত স্বার্থের বদলে ভাবতে হবে পরিবেশের স্বাস্থ্যের কথা।পরিবেশের প্রাণীকুলকে ভালো রাখার জন্য ভালো রাখতে হবে প্রাকৃতিক সম্পদকে। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ