সাক্ষাৎকার || ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়




পোস্ট বার দেখা হয়েছে



সাক্ষাৎকার
ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়

( প্রশ্ন ও পরিকল্পনা দেবাশীষ  ভট্টাচার্য্য,  সহযোগিতায় অরিজিৎ রায়, এবং দেবলীনা চক্রবর্তী) 
                                       ছবি অরিজিৎ রায়
ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় ,  ৯ মার্চ  ১৯৪১ সালে হাওড়া জেলার , ষষ্ঠীতলায় জন্মগ্রহণ করেন। কিশোর বয়েস থেকেই সাহিত্যসাধনা শুরু হয় তার। ছোটবেলায় এডভেঞ্চার প্রিয় ছিলেন ও বিভিন্ন জায়গায় সাধু সন্ন্যাসীর সঙ্গ করেছেন। তার গল্প উপন্যাসে ভ্রমনের ছাপ পাওয়া যায়। বর্তমানে হাওড়ার রামরাজাতলাতে নিজ বাসভবনে থাকেন এই সাহিত্যিক।
                                             ছবি দে বা শী ষ
তার সৃষ্ট জনপ্রিয়তম গোয়েন্দাকাহিনী পান্ডব গোয়েন্দা সিরিজ। ২০১৭ সালে তিনি সাহিত্য একাডেমি পুরষ্কার পান। 

প্রশ্ন :  সাহিত্যে বিভিন্ন বিভাগ থাকতে বিশেষ করে রহস্-রোমাঞ্চ কাহিনী, ভৌতিক গল্প, ভ্রমণকাহিনী এই ধরনের লেখা কেনো বেছে নিলেন?  বিশেষ কোন অনুপ্রেরণা?

উত্তর :  আমি যে কখনো লেখক হব এ সমন্ধে আমার কোন ধারণাই ছিল না ।  ছোট বেলা থেকে আমি তারাশঙ্করের খুব ভক্ত আমার স্কুলের পাঠ্য বইয়ে তারাশঙ্কর ও শরৎবাবুর লেখা ছিল । তারপর একবার বাবা-মায়ের সঙ্গে বেড়াতে গেছি আসাম কামাখ্যার মন্দিরে, বয়স তখন ১৫ , সেই পাহাড় চারদিকের জঙ্গল দেখে খুবই ভালো লাগছে , যেদিন ফিরে আসবো  সেদিন খুব মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে দেখছি চারদিক পলাশ আর শিমুল ফুলে ছেয়ে আছে আর আকাশে লাল টকটকে সূর্য অস্ত যাচ্ছে, হটাৎ মনে হলো আমি যদি লিখতে পারতাম তাহলে লিখতাম 'কে যেন লাল মুটো মুটো লাল আবির ছড়িয়ে দিয়েছে পাহাড়ের গায়ে  '।

 আমার বাড়ি আসার ঠিক দুদিন বাদে দৈনিক বসুমতিতে ছোটদের বিভাগ ডাকঘর থেকে বিজ্ঞাপন দেওয়া শুরু হয়েছে ছোটদের লেখা কবিতা ,গল্প ও  ভ্রমণ কাহিনী ওরা ছাপাবে। তখন আমি লিখলাম "কামাখ্যা ভ্রমণ কাহিনী " আমার প্রথম লেখা আর প্রথম প্রকাশিত লেখা । 
এর পর ১৯৬১ সাল জুলাই মাস আমার লেখা ছাপা হয় আনন্দবাজারে রবিবারের পাতায় একদম প্রথম পাতায় একপাশে নারায়ণ গাঙ্গুলির লেখা গল্প তারপাশে আমার লেখা । ধরনের লেখা লিখতে লিখতে তখন আমি শুকতারাতে সাধারণ গল্প , কবিতা লিখতে শুরু করলাম ।
 আমাদের দেশ ছিল বর্ধমান জেলায় নাড়ু গ্রাম সেখানে ছোটবেলা থেকে যাওয়া আসা ছিল আর দাদু - পিসির মুখে ভুতের গল্প শুনে শুনে ওই রহস্য রোমাঞ্চ লেখার প্রতি আগ্রহ জন্মালো । তখন শুকতারার সম্পাদক ছিলেন ক্ষীরদচন্দ্র মজুমদার তিনি আমাকে এই রহস্য ধারাবাহিক লেখার উৎসাহ দিলেন খুব এবং ভীষণ ভাবে আমাকে অনুপ্রাণিত করলেন ঐ রকম রহস্য রোমাঞ্চকর কাহিনীর ধারাবাহিক লিখতে ।

প্রশ্ন : আপনার অমর সৃষ্টি " পাণ্ডব গোয়েন্দা " সম্পর্কে কিছু যদি বলেন ।

 উত্তর : এই ভাবেই পান্ডব গোয়েন্দা লেখা আমার শুরু । লেখায় এই নামটা করা হয়েছিল কারণ আমি ওই দেশের বাড়ি থেকে একটা পোষা কুকুর এনেছিলাম সে ছিল আমাদের এক সাথী । রেল লাইনের ধারে
 বা আসেপাশে আমরা বন্ধুরা মিলে ঘুরতে যেতাম আর ওই কুকুর পঞ্চুকে নিয়ে। ক্ষীরদবাবুই আমাকে  ওই পঞ্চুকে নিয়ে লিখতে সাহস জোগালেন । তখন আমি পাঁচ বন্ধুর এই সিরিজের নাম রাখি 
 প্রথমে ' পঞ্চ পান্ডবের অভিযান ' কিন্তু সেটা নিয়েও আমার সংশয় ছিল যে হয়ত লোকে এটাকে মহাভারতের কোন কাহিনী ভাববে তাই আবার নিজেই হেড ওর টেল টসের মাধ্যমে নাম রাখলাম 'পান্ডব গোয়েন্দা ' ।

                                            ছবি সংগৃহীত 

প্রশ্ন :  ছাপা অক্ষরে কার্টুন / কমিক্স বিশ্বজুড়ে একটা সময় বিপ্লবের অংগ তথা শিশুসাহিত্যের বিশেষ দিক বলে বিবেচিত হতো। কিন্তু বর্তমান ইন্টারনেট সোসাল মিডিয়ার যুগে আপনার কি মনে হয় কোথাও এই প্রয়াসগুলো হারিয়ে যাচ্ছে? ?

উত্তর : বাংলা কাটুন বা কমিক্স এর ছড়াছড়ি খুব না থাকলেও হারিয়ে যাচ্ছে তা বলা যায় না ।  তবে বলা যায় জমির উর্বরতা কমে গেছে  কারণ এখন সেই শৈল চক্রবর্তী নেই , নারায়ণ দেবনাথ বয়েসের ভারে মূহ্যমান তো সেই কারণে শুকতারা , আনন্দমেলা , টিনটিন এসবের জনপ্রিয়তা আগের থেকে হ্রাস পেয়েছে কিন্তু হারিয়ে যায় নি ।  

প্রশ্ন : আপনি বেশ কিছু ভ্রমণ কাহিনী লিখেছিন , যা পাঠকের মন ছুঁয়েছে। ভ্রমণ কাহিনী সাহিত্যের ক্ষেত্রে কতোটা প্রভাবশালী একটু যদি বলেন।

উত্তর : লেখকের লেখার ওপর নির্ভর করে ভ্রমণ কাহিনী সাহিত্যধর্মী হবে নাকি শুধুমাত্র বিষয়মূলক হবে । যেমন উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় , প্রবোধ সান্যাল এঁদের ভ্রমণ কাহিনী পুরোপুরি সাহিত্যধর্মী । কিন্তু বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় যে সমস্ত ভ্রমণ বিষয়ে লেখা বেরোয় তা পুরোটাই বিষয়ভিত্তিক বা তথ্যভিত্তিক ।
অতএব ভ্রমণের মধ্যে রসবোধ ও তথ্য বিষয় যদি সঠিকভাবে উপস্থাপিত করা যায় তা অবশ্যই সাহিত্য হয়ে ওঠে । 

প্রশ্ন : আপনার পরবর্তী কাজ সম্পর্কে যদি কিছু বলেন।

 উত্তর : পরবর্তী কাজ বলতে আলাদা কিছু নয় ,  বই যেমন প্রকাশিত হচ্ছে তেমনই হবে আর পত্র - পত্রিকায় যে ধারাবাহিক প্রকাশিত হয় সেভাবেই হচ্ছে ।

প্রশ্ন : বিশ্ব সাহিত্যে বাংলা রহস্য রোমাঞ্চ সাহিত্যের পরিচয় কতোটা বলে মনে করেন?  

উত্তর : এক্ষেত্রে একটা বড় সমস্যা হতে পারে অনুবাদ , অনুবাদ সাহিত্য কম বা না থাকার কারণে বিশ্বের দরবারে বাংলা কবিতা - গল্প - রহস্য রোমাঞ্চ এসব পৌঁছানো ও সমাদর পাওয়া মুস্কিল হয়ে উঠছে । যদি ইংরেজি ভাষায় সঠিক ভাবে যদি অনুবাদ করা হয় তবেই বাংলা সাহিত্য বিশ্বের দরবারে পৌঁছতে পারবে , গৃহীত হবে । 

প্রশ্ন :  বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দিতে বর্তমান কবি লেখক এবং যারা বাংলা ভাষার জন্য লড়ছেন তাদের প্রধান কর্তব্য কি হতে পারে বলে আপনার মনে হয়।

উত্তর: যারা বাংলা ভাষার জন্য লড়ছেন তাদের উচিত আরও বেশি করে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠা । তা গল্প , উপন্যাস , কবিতা ছোট লেখা বা যাই হোক না কেন তা প্রভাবশালী হতে হবে পাঠকের কাছে , অর্থাৎ কলমকে আরো শক্তিশালী হতে হবে ।
যেমন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় , সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তারপর সমরেশ মজুমদার এই সময়ের বাংলা সাহিত্যের তথা বই পড়া বা বিক্রির যে টান ছিল সেটা এখন আর নেই । তবুও বলবো এখনও বইমেলায় লোকে লাইন দিয়ে বই কিনে নিয়ে যান , প্রচুর বই বিক্রি হয় । তবে এ সময়ের অনেক কবি সাহিত্যিক আছেন যাঁরা সুনীল - সমরেশের মতোই জনপ্রিয় যেমন প্রচেত গুপ্ত , সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় । এমন আরো বেশ কিছু নাম আছে যাঁরা আমাদের বাংলা সাহিত্যের আশার আলো , এই ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন অবশ্যই । 
 তবে প্রচারের আলোয় আসতে বা পরিচিত হতে গেলে কবি ও লেখককে যথেষ্ট চেষ্টা ও পরিশ্রম করতে হবে । আমার মতে ,
 " মরে ভুত হবে , না মরে ভুত হবে না " মানে লড়াই চালিয়ে যেতেই হবে নিজের জায়গা তৈরী করার জন্য । আমি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবারে বড় হয়েছি , ওনার সাথে ছোটবেলায় বনে - বাদাড়ে ঘুরে বেড়াতাম । উনি একটা কথা বলতেন যে , বাঙালির ছেলে হাতে কলম ধরলে তার লেখা হবেই । আমি তাঁর শিষ্য হয়ে ওই একই কথা বলি সকলকে আর তার সাথে একটু যোগ করেও দি যে কপাল বলেও কিছু একটা আছে যেটা আমাকে পরিচিত ও বিখ্যাত করতে পারে । যেমন আমি নিজের কথাই বলি , আমি কোন রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের সাথে যুক্ত বা তদবির না করেও একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছি আবার রবি ঠাকুর ভুতের গল্প না লিখেও কিন্তু তিনি নোবেল পেয়েছেন আর আমি এত রহস্য - রোমাঞ্চ ভৌতিক গল্প লিখেও পাই নি নোবেল কারণ আমার যোগ্যতা নেই কবি গুরুর মতো । তিনি নোবেল পাওয়ারই যোগ্য , তিনি বিশ্ব কবি । 
                                                ছবি সংগৃহীত 
প্রশ্ন : শিশুসাহিত্যের প্রতি বর্তমান লেখক পাঠকদের ভালোবাসা অনেক টাই ক্রমহ্রাসমান। এক্ষেত্রে আপনার মতামত ।

উত্তর : শিশু সাহিত্য বলে এখন আর কিছু নেই , শিশু সাহিত্য ছিল সেই সময় যখন যোগীন্দ্রনাথ সরকার ,  উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর সময় । আমার মতে  লীলা মজুমদারও শিশু সাহিত্যিক নন কারণ উনি  ছোটদের লেখক কিন্তু শিশুদের লেখক নন । 
এখানে শিশু ও কিশোর বয়েসের জন্য লেখাকে পার্থক্য করতে হবে । শিশুদের লেখা হলো যেমন -  "চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে " বা  " আতা গাছে তোতা পাখি " অথবা "খোকা যাবে মাছ ধরতে " এই সমস্ত লেখা বোঝায় কিন্তু লীলা মজুমদার বা সত্যজিৎ রায় অথবা আমার লেখা পান্ডব গোয়েন্দা কি শিশুদের বোঝার মতো লেখা ? এগুলো একটু বড় মানে কৈশোরের লেখা যারা এই লেখাগুলোকে একটু বুঝতে পারবে নিজেদের সাথে একাত্ম করতে পারবে । তাই আমি নিজেকেও শিশু সাহিত্যিক বলতে রাজি নয় । 
আর যুগের উন্নতির সাথে সাথে বাচ্ছাদের মানসিকতারও পরিবর্তন হচ্ছে তারা আর ওই ধরণের কাল্পনিক মানে রূপকথার গল্প ,পক্ষীরাজ ঘোড়া এসব নিতে পারছে না । কারণ ওদের আশেপাশে সবকিছু বদলাচ্ছে , শিক্ষা পদ্ধতি বদলেছে তাই শিশু সাহিত্যের পরিধিও ক্রমশ বাড়ছে ।
                                                    ছবি সংগৃহীত 

 প্রশ্ন : নবীন লেখক ও কবি দের জন্য আপনার বার্তা।

উত্তর : নবীনদের ক্ষেত্রে আমি বলতে চাই  যে তারা যাই লিখুক তা যেন নিয়ম , ব্যাকরণ জেনে বুঝে লিখুন । কবিতার ক্ষেত্রে ছন্দ শিখে , জেনে তারপর লিখুন । যারা প্রথম লিখছেন তারা লিখে বাড়ির কাউকে বা বড়দের পড়ে শোনান ।আসল হলো যে কোন লেখার সময় লেখাতে বিষয়টি যেন পরিষ্কার হয় মানে বোধগম্য হয় । অন্যের কাছে সহজবোদ্ধ 
হয় । এটুকুই বলার।

প্রশ্ন :  বর্তমান বাংলা ভাষা চর্চা সাহিত্যে কতোটা সুদূরপ্রসারী?
বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ ইংরেজি মাধ্যমের উপর। 

উত্তর :   এখন যে হারে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা ও শিক্ষা সেক্ষেত্রে  বাংলা চর্চা করা সকলের ক্ষেত্রে একটু অসুবিধে হলেও নিরাশ হওয়ার কিছু নেই বলেই মনে করি । কারণ অনেকেই আছেন যারা নিজের মাতৃভাষা নিয়ে চর্চা করে , বই পড়ে , লেখে অর্থাৎ চেষ্টা বা অভ্যাস করলেই এই মাতৃভাষার যে গুণ তা টানবেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে । 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

4 মন্তব্যসমূহ

  1. অনেক শ্রদ্ধা সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার প্রাপ্ত সাহিত্যিক শ্রী ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় মহাশয়কে।

    উত্তরমুছুন
  2. এত সুন্দর শিক্ষামূলক আলোচনা পড়লে সমৃদ্ধ হওয়া যায় বৈকি 🙏🌹

    উত্তরমুছুন
  3. সাক্ষাৎকার। ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়
    খুব ভালো লাগলো। বর্তমান লেখক কবিদের স্বকীয় লেখালেখির ক্ষেত্রে মনোবল বৃদ্ধি করার জন্য এই সাক্ষাৎকার পর্ব নিঃসন্দেহে একটি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করবে বলে আমার বিশ্বাস।
    দর্পণের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই।

    উত্তরমুছুন