প্রবন্ধ | অরিজিৎ রায়




পোস্ট বার দেখা হয়েছে



 আধ্যাত্মিকতা ও বিজ্ঞান 
 অরিজিৎ রায় 


আধ্যাত্মিকতা :- 

শ্রেষ্ঠতম জীব মানুষের চেতনা বা যাপনের একটি বিশেষ রূপকে আমরা আধ্যাত্মিকতা শব্দ বন্ধে আবদ্ধ রাখতে অভ্যস্ত। আধ্যাত্মিকতা কোনো বিশেষ ধরণের অভ্যাস নয়, বরং যাপনের এক বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষ আধ্যাত্মিকতা অর্জন করে। যে জীবের বোধ ও চিন্তা শক্তি আছে তারাই একমাত্র আধ্যাত্মিক হতে সক্ষম হয়। আধ্যাত্মিকতা মানে কোনো শ্রেষ্ঠত্বের সাধন ভজন নয়। আমার কাছে আধ্যাত্মিকতা হল আত্ম - আবিষ্কার। আধ্যাত্মিকতায় পৌঁছাতে গেলে জীবনের বেঁচে থাকার একটি বিশেষ ধরণকে রপ্ত করতে হয়। আমার আপনার বাড়ির ফুল গাছের টবগুলি যদি অবহেলায় পড়ে থাকে, জল না পায়, পর্যাপ্ত আলো, হাওয়া বা সার না পায় তাহলে কিন্তু সেই টব হয়ে উঠবে জঞ্জাল, তা সৌন্দর্য রক্ষা করবে না। তাই দরকার সেই সব ফুল গাছের সঠিক রক্ষনাবেক্ষণ। ঠিক তেমনই আপনার আমার যাপনকেও গড়ে তুলতে হবে একটি সুনির্দিষ্ট অভ্যাসে, নিয়মে এবং আচার আচরণে। যা আধ্যাত্মিকতা দাবী করে। শরীর, মন, আবেগ, শক্তি এগুলোকে বিশেষ রূপে পরিচর্চা করলে তাহলেই আপনার আমার মধ্যে আলাদা কিছু একটা ভাব বা বোধের উদয় হবে - - সেই ভাব বা বোধকেই আমরা আধ্যাত্মিকতার নামে অভিহিত করতে পারি। আপনার বিচার, বুদ্ধি, বোধের যখন সঠিক সমন্বয় ঘটে তখন জগতের সবকিছুকেই আলাদা মাত্রায় অনুভব করার শক্তি জন্মায়। তখন নিজেকে বুঝতে সুবিধা হয়, এ জগতের সাথে নিজের পারস্পরিক সম্পর্ককে বুঝতে সুবিধা হয়, নিজের ভিতরের আত্মা বা মনের শুদ্ধিকরণ ঘটে। তখন মন সবকিছুকেই আলাদা মাত্রায় অনুভব করতে শুরু করে। মানুষ যখন নিজের অভিজ্ঞতার পরিধির বাইরে বৃহৎ কিছু অনুভব করে, যা তার পক্ষে করা সম্ভব নয় তখন মানুষ তাকেই ভগবান বা ঈশ্বর রূপে জ্ঞান করতে শুরু করে। ঈশ্বরের পুরো ধারণাটা হল - নিজের থেকে বৃহৎ কিছুর অনুভব। সেটা কোনও মানুষ হতে পারে, অনুভূতি হতে পারে, প্রকৃতির কোনও দিক হতে পারে। কিন্তু এটাকে কোনোভাবেই আধ্যাত্মিক বলা যায় না এটা শুধুমাত্র জীবনের বিভিন্ন রূপ বা অভিজ্ঞতা। কিন্তু একমাত্র যখন নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা - প্রগাঢ় ও আনন্দময় হয়ে ওঠে, তখনই আমাদের মনে প্রশ্ন আসে - এর সৃষ্টি কর্তা কে? আপনি যদি উৎসুখ হয়ে জীবনের উৎস বা প্রক্রিয়াকে জানতে চেষ্টা করেন তাহলে এটা মানতে হবে যে আপনার নিকটতম সৃষ্টির নজির আপনার শরীর! এই শরীরেই প্রকৃত স্রষ্টা বন্দী হয়ে আছেন। আপনি তখনই আধ্যাত্মিক যখন আপনি নিজের মধ্যে সৃষ্টির উৎসের সন্ধান খুঁজে পাবেন। 

ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা :-  

প্রশ্নটি হল আমি কে? আমার মধ্যে যে চেতনা বসবাস করে, সেই ই কি আমি? অর্থাৎ আমার আত্মা, যা মন, দেহ, অনুভূতি, অনুভব, ইচ্ছা, আবেগ সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে, যা একান্তই আমার নিজস্ব - এ কথাই সারসত্য। এই আত্মার মাধ্যমেই কি আমরা অন্য এক জীবের ভালোলাগা বা মন্দলাগার সাথে যুক্ত হই ? অভিজ্ঞতা লাভ করি ক্রমাগত - জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি। তাহলে কি আমার চেতনা এবং আমার আত্মা এক? নাকি আত্মার সাথে বহিঃ-জগতের সাথে যে যোগাযোগ আমাদের ঘটে এবং আমরা যে অভিজ্ঞতা লাভ করি - সেই অভিজ্ঞতাই আমাদের চেতনার উৎস। সেটাই আমাদের চেতনা। ধরা যাক আমার শরীর বা শরীরের কোনও অংশ , আমি বা আমার নয়! আমার এই মনটাও আমি বা আমার নয়! তাহলে আমি কে? আমি হচ্ছি সেই আত্মা, যে শরীর এবং মনের মাধ্যমে পার্থিব এই জীবন থেকে অভিজ্ঞতা লাভ করে। আমাদের আত্মা যেন এক নির্দিষ্ট পর্যবেক্ষক, প্রতিনিয়তঃ বহিঃ-জগতের সাথে আমাদের চেতনাকে বা আমাদের মনের প্রতিটি অনুভবকে কমপেয়ার করে চলেছে। এই কমপেয়ার বা পরিমাপের মাধ্যমে আমাদের দেহ বা মনের ক্রমাগত উন্মেষ ঘটাচ্ছে এবং এই আত্মার সাথে - দেহ ও মনের যে এই নিবিড় সম্পর্ক দ্বারা আমরা প্রতিদিন শিক্ষিত হচ্ছি বা জ্ঞান লাভ করছি - সেই শিক্ষা বা জ্ঞানের জাগৃতিই হচ্ছে - আধ্যাত্মিকতা। আর এই শিক্ষা বা জ্ঞান যে লাভ করতে সক্ষম হয় - তিনিই হলেন আধ্যাত্মিক। তবে আত্মা সম্পর্কীয় অতীত বা ভবিষ্যৎ জ্ঞানের যে ধারণা তা ভিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় ধর্মীয় মতবাদ অনুযায়ী। 
ধৃ + মন =ধর্ম । 'ধৃ' অর্থ ধারণ বা গ্রহণ করা। আর মন হল অন্দরমহল বা অন্তর, বা আত্মা। অর্থাৎ ধর্মের অর্থ হল - মন যাকে ধারণ বা গ্রহণ করলে শান্তি লাভ করা যায়, অনুশাসন ক্রিয়াকে উপলক্ষ্য করে যা গ্রহণে মানুষ শৃঙ্খলাবদ্ধ হয় তাইই ধর্ম। তাই বিভিন্ন ধর্মের অনুশাসন আবার ভিন্ন ভিন্ন কিন্তু লক্ষ্য এক- শান্তি লাভ ও শৃঙ্খলাপরয়ণতা। ধর্ম ভিত্তিতে তাই আধ্যাত্মিক শিক্ষা লাভ করার পন্থা এবং উপাচার আলাদা আলাদা। আবার একই ধর্মের অন্তর্গত মানুষের বসবাসের ভৌগলিক পরিবেশ যদি ভিন্ন ভিন্ন হয় - তবে তাদের আচার, ধরণ, রুচি, জামাকাপড়, খাদ্য সবই আলাদা হয়। তাই একই ধর্মজাত মানুষেরও আধ্যাত্মিক শিক্ষা লাভ ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে ঘটতেই পারে। 
বৃহৎ অর্থে বলতে গেলে, ধর্ম শুধুমাত্র ঈশ্বর বা আল্লা যাপন নয়। যা কিছু শুভ, যা কিছু মানুষের উপকারে লাগে, যা কিছু জীব জগতের সাধন ঘটায়, যা বন্ধুত্বের পরিবেশ সৃষ্টি করে, যা ভিন্ন ভিন্ন ধর্মকে - নিজ ধর্মের সাথে এক বাক্যে পাশাপাশি বসাতে সচেষ্ট হয়, তাই - ই প্রকৃত ধর্ম। ধর্ম বলতে যা কিছু গড়াকে বোঝায়, ভাঙাকে নয়। তাই সেই অর্থে দেখতে গেলে মানুষের একটাই ধর্ম - তা হল মনুষ্যত্ব। আর মনুষ্যত্বের প্রণয়ন মানবতা। শাস্ত্র বলে, মানুষ একটি উচ্চ প্রজাতির জীব এবং এই উচ্চ প্রজাতির জীবকে নির্ণয়ের জন্য মনু লিখেছিলেন সংহিতা বা মনুস্মৃতি অর্থাৎ মানুষের বিধি বিধান সম্বন্ধীয় গ্রন্থ। এই গ্রন্থানুসারে মনুষ্য ধর্ম বিবেচিত হয় - দশটি গুণের মাধ্যমে, যে দশটি গুণ তাদের মানুষ বলে প্রমাণ করে। যেমন - ধৈর্য, ক্ষমা, সংযত ভাব, চৌর্য্যবৃত্তি পরিহার, পরিস্কার পরিচ্ছনতা, ইন্দ্রিয়গুলিকে সংযত রাখা, বুদ্ধি, সততা এবং রাগ না করা। 
অর্থাৎ বলা যায় - প্রকৃত সৎ কর্মের মাধ্যমেই ধর্মের সাধন ঘটানো সম্ভব এবং সঠিক সাধন যিনি ঘটাতে পারেন তিনিই ধার্মিক। আর প্রকৃত ধার্মিক চেতনার মাধ্যমেই এবং সঠিক চেতনা প্রণয়নের মাধ্যমে একজন মানুষ আধ্যাত্মিক হয়ে ওঠেন। তাই ঈশ্বর, আল্লা, গড ইত্যাদি মাধ্যমকে সঙ্গী করে সঠিক অনুশাসন ক্রিয়ার মাধ্যমে একজন ধার্মিক মানুষ হয়ে ওঠেন - "আধ্যাত্মিক" । আর আধ্যাত্মিক চেতনা সঠিক মনুষ্যত্ব তৈরী হওয়ার একটি অন্যতম ধাপ। তবে একটা কথা বলি - সঠিক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারলে তবেই একজন মানুষ ধার্মিক হন এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক হয়ে ওঠেন। তাই সবার আগে ধর্মনির্বিশেষে শিক্ষাটাই জীবন ধারণের মূল মহামন্ত্র। 
এরপরে বলতে হয় মানুষের বিশ্বাস বা আস্থার কথা। ঠিক এই জায়গাতে এসেই ধর্ম দুটি ভাগে প্রথমবারের মতো বিভাজিত হয়। 
          ১. আস্তিক্যবাদ 
          ২. নাস্তিক্যবাদ 
এই আস্তিক্যবাদের মধ্যেই প্রথমবারের মতো ঈশ্বরের অস্তিত্ব দেখা যায়। ঈশ্বরের বর্ণনা দিতে গিয়ে শাস্ত্র বলেছে-
      ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদম্ পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে ।
      পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে ।।
                               - বৃহদারণ্যক  উপনিষদ ।

অর্থাৎ সংক্ষিপ্তসার হল, যিনি এই বিশ্ব সংসার এর পূর্ণরূপ, তার হাতেই সবকিছু পূর্ণ হয় এবং তার মধ্যেই পূর্ণরূপ বিরাজমান। 

আধ্যাত্মিক মনের গঠন :-   

প্রকৃত আধ্যাত্মিক মানুষের শ্রদ্ধা, নিষ্ঠা এবং সমর্পণ এই তিনটি অতি উল্লেখযোগ্য কর্ম - তার নিত্য সঙ্গী। এই তিনটি কর্ম দিয়েই গঠিত তার অন্তঃকরণ। তাঁর শ্রদ্ধা - শুদ্ধ, সরল ও নির্দোষ। মানুষের মনে ও প্রাণে যে অহমাত্মক শ্রদ্ধা থাকে সেই অহমিকা-পূর্ণ শ্রদ্ধাকে করে পদাকাঙ্খা, আত্মম্ভরিতা, আত্মাভিমান, মনের হঠকারিতা, প্রাণের স্বৈরতা, ব্যক্তিগত দাবী, নিম্নপ্রকৃতির তুচ্ছ সব তৃপ্তির কামনা - সে শ্রদ্ধা অনুন্নত ধূমাচ্ছন্ন শিখা - স্বর্গলোকের দিকে তা কোনোদিনই প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠে না। এটা বুঝতে হবে ভাগবত কর্মের জন্য, ভগবৎ প্রকাশে সাহায্যের জন্য আধ্যাত্মিক মানুষ জন্মগ্রহণ করেন এবং জীবনের সরূপ - আধ্যাত্মিক মানুষ এই রূপেই মননে গ্রহণ করেন।
আধ্যাত্মিক মন সর্বদা আকাঙ্খা করে ভাগবত চেতনাগত শুদ্ধতা, শক্তি, জ্যোতি, প্রসারতা, প্রশান্তি, আনন্দ - আর সেই চেতনা আধ্যাত্মিক মননকে, প্রাণকে এবং দেহকে ক্রমাগত রূপান্তরিত ও সর্বাঙ্গসুন্দর করে গড়ে তোলে। আধ্যাত্মিকতাকে মনে প্রাণে বহণ করতে গেলে - আপন আন্তরিকতা, আপন সমর্পণ সর্বদা সত্যময় ও সম্পূর্ণ হতে হয়। যদি দান করতেই হয় তবে তা হতে হবে নিঃশেষ দান, কোনও দাবি, কোনও সর্ত, কোনও কুন্ঠা না রেখে - এক সর্বাঙ্গীন নিঃস্বার্থ দান। আধ্যাত্মিক মননের শ্রদ্ধা, আন্তরিকতা ও সমর্পণ যত পূর্ণতর হয়ে উঠবে, ততই যেন এক ঈশ্বরিক শক্তি তাকে ঘিরে রাখবে। যে শক্তি মানুষ বা জীবকূলের ভালোর জন্য, উপকারের জন্য সদা সর্বদা উন্মোচিত। 

আধ্যাত্মিকতা ও স্বামী অভেদানন্দ :

আধ্যাত্মিকতা প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলে চলে আসে - স্বামী অভেদানন্দের - "মরণের পারে" বইটির কথা, যেখানে দৈহিক মৃত্যুর পরের কথা বলা হয়েছে। স্বামী অভেদানন্দ বলেছেন - "জন্ম - মৃত্যুর অতীত আত্মসত্তার রহস্যকথা, জন্ম-মরণশীল মায়সক্ত মানুষকে শোনানোর জন্য। অধিকাংশ মানুষের বিশ্বাস যে, মৃত্যুর পর মানুষের সত্তা বা অস্থিত্ব থাকে না - শূন্যেই তা বিলীন হয়, কিন্তু প্রকৃত কথা তা নয়। মানুষ ও সকল প্রাণী জন্মগ্রহণ করে যে যার সংস্কারকে বা কর্মফলকে নিয়ে, ভোগভূমি সংসারে কিছুদিন তারা কর্মফল ভোগ ক'রে আবার নতুন সংস্কার বা কর্মফল সৃষ্টি করে, তারপর ভোগের শেষে আবার পৃথিবীলোক থেকে বিদায় নেয়। " স্বামী অভেদানন্দ মহারাজ বলেছেন - সেই বিদায় কিন্তু চিরদিনের জন্য নয় - ক্ষণিকের জন্য, আর এই বিচ্ছেদ ও মিলন অনন্তকাল ধরেই চলতে থাকে, প্রবৃত্তির বা বাসনা-কামনার পথে থাকলে, কিন্তু নিবৃত্তির পথে গেলে মিলন, - বিচ্ছেদ, - খেলায় শেষ হয়, তখন একমাত্র ব্রাহ্মস্থিতি বা আত্মস্থিতি। তখন জন্ম - মৃত্যুহীন আত্মার, যা অবিকৃত ও পরিশুদ্ধ রূপ সর্বব্যাপক ও সর্বাণুশ্রুতি শাশ্বত পরমসত্তা - তাতেই প্রতিষ্ঠিত থাকে সকল মানুষ ও সকল প্রাণী। মৃত্যুলোক ও মৃত্যুর অতীত লোকের প্রশ্ন তখন আর থাকে না, থাকে একমাত্র অমরাত্মার অমৃতময় সত্তার কথা। স্থিতি ও প্রকাশ তখন একই সঙ্গে থাকে, আর দেশ কাল নিমিত্তের কোন চিহ্ন তখন থাকে না। 
এই হচ্ছে আধ্যাত্মিকতা। জীবনের শোরগোলের মাঝে দাঁড়িয়ে জীবনকে উপলব্ধি শুধু নয় - অন্তঃরাত্মার কথা, মরণের পরের জীবনকে ছুঁয়ে দেখা। যা চিরসত্য, যা অবিকৃত, যা চির অবিনশ্বর আত্মার সরূপ - তাকেই যেন জীবনের এ-পার থেকে ছুঁয়ে দেখা, উপলব্ধি করা। আর সেই জ্ঞান সমগ্র মানব জাতির মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। সে জ্ঞান সকলের জন্য নয়, সে জ্ঞান বিরাসক্ত মানুষের জন্য, নির্লোভ, চিন্তাশীল দার্শনিকের জন্য। 
এবার আসি বিজ্ঞানের কথায়। আধ্যাত্মিকতার সাথে কি কোনও ভাবে বিজ্ঞান সম্পর্কযুক্ত ! ধর্ম অর্থাৎ যা ধারণ করার মাধ্যমে আমরা শান্তিলাভ করতে সক্ষম হই - সেই ধর্ম কি সত্যিই বিজ্ঞানের সাথে যুক্ত ! যুক্তি নির্ভর জ্ঞান কি ধর্মের ক্ষেত্রে খাটে! নাকি বিশ্বাসটাই মূলমন্ত্র ! 

বিজ্ঞান ও তার রকমভেদ :-  

বিশ্বের যা কিছু পরীক্ষাযোগ্য, যাচাইয়ের উপযুক্ত, পর্যবেক্ষণযোগ্য, নিয়মতান্ত্রিক গবেষণা ও  সেই গবেষণালব্ধ জ্ঞান-ভাণ্ডারের নামই বিজ্ঞান। 
ল্যাটিন শব্দ "সায়েনটিয়া" (Scientia) থেকে ইংরেজি সায়েন্স শব্দটির উৎপত্তি। যার অর্থ হচ্ছে জ্ঞান। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান শব্দের অর্থ বিশেষ জ্ঞান। দীর্ঘদিন ধরে পরীক্ষা নিরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার ফলে কোন বিশেষ বিষয়ে প্রাপ্ত ব্যাপক ও বিশেষ জ্ঞানের সাথে জড়িত ব্যক্তিকে বলা হয় বৈজ্ঞানিক বা বিজ্ঞানবিদ। 
বিশেষ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে বিজ্ঞানীরা জ্ঞান অর্জন করেন এবং প্রকৃতি ও সমাজের নানা মৌলিক বিধি ও সাধারণ সত্য আবিষ্কারের চেষ্টা করেন। বর্তমান বিশ্ব এবং এর  উন্নতি নিয়ন্ত্রিত হয় বিজ্ঞানেরই মাধ্যমে। 
বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মূলত দুটি বিজ্ঞান - ১. সামাজিক বিজ্ঞান ২. প্রাকৃতিক বিজ্ঞান। পদার্থবিজ্ঞান (physics), রসায়ন (chemistry), এবং জীববিদ্যা (Biology) ইত্যাদি সকল বিজ্ঞান - প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের অন্তর্গত। এছাড়া মানুষের আচার, ব্যবহার এবং সমাজ নিয়ে যে বিজ্ঞান, তা সমাজ বিজ্ঞানের অন্তর্গত। তবে সকল বিজ্ঞানকেই সুনির্দিষ্ট পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের মাধ্যমে অবশ্যই প্রমাণিত হতে হবে। আর একই শর্তের অধীনে যে বৈজ্ঞানিকই গবেষণা করুক না কেন তার ফলাফল একই হতে হবে। অর্থাৎ খুব সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায় বিজ্ঞানভিত্তিক পরীক্ষণের ফলাফল কখনও পরিবর্তিত হতে পারে না। 
গণিত (Mathematics) অবশ্যই বিজ্ঞানের একটি অংশ। অর্থাৎ প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান এবং গণিত এই তিনটি শ্রেণির সম্মিলিত ভাগই হচ্ছে বিজ্ঞান। গণিত হল আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞান আর প্রাকৃতিক ও সামাজিক বিজ্ঞান হল পরীক্ষামূলক বিজ্ঞান। গণিতের সাথে এই দুই বিজ্ঞানের সাদৃশ্য - বৈসাদৃশ্য দুটোই রয়েছে। গণিত একদিক থেকে পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কারণ দুই ক্ষেত্রেই একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে পদ্ধতিগত অধ্যয়ন করে। আর বৈসাদৃশ্য হচ্ছে - পরীক্ষণমূলক বিজ্ঞানে পরীক্ষণের মাধ্যমে প্রমাণ করা হলেও গণিতে কোনও কিছু প্রতিপাদন বা নির্ণয় করা হয় আগের একটি সূত্রের উপর নির্ভর করে। গণিত, সেই আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞান, যার মধ্যে পরিসংখ্যান এবং যুক্তিবিদ্যাও পড়ে, অনেক ক্ষেত্রেই পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে এই গণিত বিশেষ ভূমিকা রাখে। তাই পরীক্ষণমূলক বিজ্ঞানের উন্নতি ঘটাতে গেলে আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞানের প্রসার আবশ্যক। কিভাবে কোনও মানুষ কাজ করে (প্রাকৃতিক বিজ্ঞান) বা কিভাবে মানুষ চিন্তা করে (সামাজিক বিজ্ঞান) তাই আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞান ব্যাখ্যা করে। 

বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতা :-   

বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার সম্পর্ক যে নিবিড় _এই বার্তা নিয়ে প্রতিবছর ২০০৪ সাল থেকে "অল ইন্ডিয়া সায়েন্স অ্যান্ড স্পিরিচ্যুয়াল কোয়েস্ট" (এ আই এস এস কিউ) সারা পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন জায়গায় তাদের সম্মেলন সংগঠিত করে চলেছে। দেশের বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের একাংশের উদ্যোগে গঠিত "ভক্তি বেদান্ত ইন্সটিটিউট" ও ২০০৫ সাল থেকে এই সম্মেলন করে আসছে। দিল্লি টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটি, বেঙ্গালুরু ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স, বারাণসী আই আইটি, খড়্গপুর আই আই টি ইত্যাদি জায়গায় বিভিন্ন সময়ে এই সম্মেলন সংগঠিত হয়েছে। 
আধুনিক বিজ্ঞানের উপর আমরা এখন পুরোপুরি নির্ভরশীল হলেও বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডের অনেক রহস্যই আজ অবধি আমাদের কাছে অজানা। নৈতিকতার দ্বারা যে সমাজ পরিচালিত হোত, তা এখন তার মূল্যবোধ হারাচ্ছে। সামাজিক দূর্বলতা বাড়ছে, আত্মহত্যার প্রবণতা ছাত্র ও যুবদের মধ্যে বাড়ছে, মানসিক চাপ নিতে না পারার উদাহরণ প্রতিনিয়তঃ বাড়ছে, পৃথিবী জুড়ে দেখা দিচ্ছে হিংসা ও অপরাধ প্রবণতা। প্রযুক্তিবিদ্যার প্রতিষ্ঠানের পড়ুয়াদেরও মানসিক অস্থিরতা এখন যথেষ্ট। সেইসব চাপ কমাতে কিভাবে "আধ্যাত্মিকতা" সাহায্য করতে পারে তা নিয়ে এখন এই সব সম্মেলনে প্রতিবছর কার্যপ্রণালী নির্ধারণ করা হচ্ছে। সাথে সাথে বিজ্ঞানের উন্নতি সাধনে কিভাবে আধ্যাত্মিকতাকে ছড়িয়ে দেওয়া যায় তা নিয়েও আলাপ আলোচনা চলছে। একজন গবেষক কিভাবে আধ্যাত্মিকতাকে সঙ্গী করে গবেষণার কাজকে আরো সুষ্ঠভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন সে বিষয়ে ভাবনা চিন্তা চলছে। যোগাসনকে কিভাবে মূল স্রোতে ফিরিয়ে এনে আধ্যাত্মিকতার মাধ্যমে মনোসংযোগ বাড়ানো যায় তা নিয়েও সংকল্প গঠন করা হচ্ছে। ২০১৫ এর খড়্গপুর আই আই টি'র সম্মেলনে এনার্জি সায়েন্সর এক এমটেক পড়ুয়া বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন _"এটা ঠিকই যে আমাদের পড়াশোনার চাপ থাকে এবং থাকবে। সেই চাপ কাটানোর সহজ উপায় আধ্যাত্মিকতায় মনোনিবেশ করা। বিজ্ঞানকে জয় করতে গেলেও একটি শক্তিকে বিশ্বাস করতে হবে। বিশ্বাস থাকলে অন্ধকার পথে হেঁটেও গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব।"
প্রাচীনকাল থেকে পৃথিবীতে নানা ধরণের সমস্যা আমরা প্রত্যক্ষ করে এসেছি। যুগ যুগ ধরে যুদ্ধ, সংঘাত, জাতিভেদ ও সামাজিক মর্যাদাজনিত বৈষম্যে এব্য পারস্পরিক বিবাদে সমাজ ভুগছে। কিন্তু আমাদের পূর্বপুরুষরা জীবন সম্পর্কে অন্যরকম দৃষ্টিভঙ্গি পোষন করতেন। তাঁরা তিনটি জিনিস সম্পর্কে জাগরুক ছিলেন - মানবজাতি, প্রকৃতি ও অদৃশ্য শক্তি যা তাদের সামঞ্জস্যপূর্ণ রূপে ঐকবদ্ধ করে রাখে। জীবন সম্বন্ধে তাঁদের দৃষ্টি শুধুমাত্র ব্যক্তিবিশেষ এবং প্রকৃতির স্থূল অস্তিত্ব হিসাবে ধরতো না। তাঁরা বিশ্বাস করতেন এক শক্তি প্রকৃতি এবং সমস্ত জীবের ভিত্তি - এক অদৃশ্য শক্তি যা সমস্ত প্রাণীকে প্রকৃতির সাথে যুক্ত করে। এই শক্তিকে তাঁরা জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে মনে করতেন। বিশ্বাস করতেন সমস্ত প্রকৃতি এবং ব্রহ্মান্ডের সমস্ত জীব নানা আকার ও আকৃতির মুক্তোর মতো সৃষ্টির একসূত্রে গাঁথা। তাঁরা পারস্পরিক সহমর্মিতা ও সমবেদনার প্রতি গুরুত্ব দিতেন। আধুনিক জীবনের দিকে এখন তাকালে দেখা যায় বিজ্ঞান ও প্রাচুর্য্যে ভরা এই সমাজ - কিন্তু তাও আমরা এক গভীর দুঃখে নিমজ্জিত, সহমর্মিতা, সমবেদনা প্রকাশ, একে অন্যের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া - এগুলো থেকে বহুদূরে পর্যবসিত হয়েছি। বর্তমানে মানবজাতি শুধুমাত্র বিজ্ঞান ও টেকনোলজির উপর দাঁড়িয়ে যুদ্ধবিদ্যা ও অস্ত্র শিক্ষা করে চলেছে। যা মানুষের কাছে একদিন অভিশাপ হয়ে নেমে আসবে। তাই এই সময়ে দাঁড়িয়ে মনে হয় - সচেতন, সুশৃঙ্খল, সমবেদনা মনোভাবাপন্ন একাত্মতা চর্চার মাধ্যমে আধ্যাত্মিকতার কোনও না কোনও একটি স্তরে পৌঁছানোর জন্য সচেষ্ট হওয়া উচিত। না তার মানে শুধু ঈশ্বর সাধনা নয়, মনটাকে একাগ্রভাবে কেন্দ্রীভূত করে সঠিক সৎ পদচারণার মাধ্যমে আধ্যাত্মিকতার প্রাঙ্গনে প্রবেশ করা উচিত - যা মানব সভ্যতাকে নতুন করে উজ্জীবিত করবে। এক পথ হারানো মানুষ সঠিক দিশা খুঁজে পাবে। পরবর্তী প্রজন্মকেও সঠিক দিশা দেখাবে । 
না বিজ্ঞান মনস্কতার সাথে আধ্যাত্মিকতার কোনো বিরোধ নেই। একজন বিজ্ঞান মনস্ক মানুষ আধ্যাত্মিকতার ধ্বজাধারী নাও হতে পারে, তার চলন যদি সঠিক হয় তবে আধ্যাত্মিকতা নামক ঔষধের কোনো প্রয়োজন দেখিনা। কিন্তু সামাজিক ভাবে, রাজনৈতিক ভাবে, ধার্মিক ভাবে, বিজ্ঞানমনস্ক ভাবে, যুক্তিবাদী হিসেবে, বুদ্ধিজীবী হিসেবে একজন মানুষের যদি মরাল দিক থেকে পদস্খলন ঘটে, এবং সমাজকে ভুল বার্তা দেয়, আগামী প্রজন্ম যদি তার কাছ থেকে ভুল শিক্ষা গ্রহণ করে তবে তার বা সেই বিপথগামী মানুষের আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া যাপনের মাধ্যমে তাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে সমাজকে এই বার্তাই দিতে হবে যে _আধ্যাত্মিকতা হল সহজ সাধু জীবনযাপনের জন্য একটি অনন্য অভ্যাস। যা মানুষকে তার কাজের সাথে সাথে সামনের সারিতে তুলে আনবে। কারণ কোথাও একটা জায়গায় মানুষ তার রোজকার একঘেঁয়ে কাজের সাথে সাথে একটু শান্তিও খোঁজে - সেই শান্তির লক্ষ্যে সেই চঞ্চল মানুষকে আধ্যাত্মিকতার আলোয় শিক্ষিত করতে হবে। 

**********************************

লেখা সূত্র : আন্তর্জাল, "মরণের পারে" - স্বামী অভেদানন্দ, "মা" - শ্রী অরবিন্দ (শ্রী অরবিন্দ আশ্রম, পন্ডিচেরী)।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

5 মন্তব্যসমূহ

  1. সত্যি এই লেখাটা লিখতে যে তুমি অনেক অনুসন্ধান আর তথ্য খুঁজে পড়ে লিখেছো সেটা বোঝা যাচ্ছে লেখাটা পড়ে 👏👏👏👌👌🙏

    দুর্দান্ত লিখলে !!

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. হ্যাঁ সত্যিই এ লেখাটা লিখতে অনেক তথ্য ঘাঁটতে হয়েছে। যেহেতু আমি আস্তিক নই, তাই কোন অ্যাঙ্গেলে লেখাটা লিখব, সেটাও অনেক ভাবতে হয়েছে। ধন্যবাদ বন্ধু ।

      মুছুন
  2. শিক্ষা জীবনের ধর্মের মূল মন্ত্র তা পুঁথি গত নাও হতে পারে ৷
    আত্মার মৃৃত্যুনেই জামা বদলানোর মত শরীর বদলায়

    আমার জন্ম বহু যুগ আগে মৃৃত্যুও তাই, আমি কেবল প্রতিলিপি মাত্র....

    পরিশ্রমের ফসল এই পাঠে সমৃৃদ্ধ হলাম

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. অনেক ভালোলাগা অলিপা পুরোটা পড়ার জন্য। এক অপূর্ব কমেন্ট করলে।

      মুছুন
  3. বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিক বিষয়ক গুরুত্বপূর্ন তথ্য অনবদ্য ৷
    খুব ভালো লাগলো ৷

    উত্তরমুছুন