চেতনার আলোয় ও আলোচনায় নজরুল || অলিপা পাল




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

দিনের শুরু যেমন ভোর দিয়ে তেমনি কবিকে জানার শুরু প্রভাতী দিয়ে , লিখছেন অলিপা পাল 

    চেতনার আলোয় ও আলোচনায়                  কাজী নজরুল ইসলাম

বিংশ শতাব্দীর অন্যতম জনপ্রিয় বাঙালী কবি- জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ৷ সঙ্গীতজ্ঞ,সঙ্গীতস্রষ্টা,দার্শনিক,ঔপন্যাসিক,নাট্যকার, ছিলেন এই প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব ৷তাঁর লেখার মূল বিষয় বস্তু ছিলো মানুষের ওপর মানুষের অত্যাচার,সামাজিক অনাচার, শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ ৷ দিনের শুরু যেমন ভোর দিয়ে তেমনি কবিকে জানার শুরু প্রভাতী দিয়ে ৷ 'ভোর হলো দোর খোল'— রাত্রির অবসানে ভোরের আলো ফুটতেই ঘুমন্ত শিশুদের ডেকে চললেন নজরুল ৷তাঁর সেই ডাকে সাড়া দিয়ে,তাঁকে জানার আগ্রহ বেড়ে ওঠে ৷ তিনি মূলত শিশু সাহিত্যিক নন ৷ তারপরও শিশুদের জন্য যা লিখে গেছেন অনেক প্রতিষ্ঠিত কবি সাহিত্যিকও তা পারেননি ৷ 

কোন বিশেষ কারণ ছাড়া নজরুল কোন শিশু সাহিত্য রচনা করেননি ৷ বন্ধু আলী আকবর খাঁ—বাতিক ছিলো ছড়া লেখার ৷সে সব ছড়া কবির কাছে মর্ম পীড়ার কারণ ৷কবি বাধ্য হয়ে তার পান্ডুলিপিতে লিখেছিলেন 'লিচু চোর '৷  এই কবিতার মাধ্যমে তাঁর শিশু সাহিত্যের রচনার হাতে খড়ি ৷ কাঠবেড়ালীর সাথে খুকীর মান অভিমান চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন ৷ তাঁর ছাত্র জীবনে রচিত 'চড়ুই পাখির ছানা 'কবিতাটি স্বতন্ত্রতা লাভ করেছে৷ উপেক্ষিত একটি চড়ুই পাখির ছানাকে কেন্দ্র করে তাঁর মনে যে গভীর সহানুভূতির প্রকাশ পেয়েছে,পরবর্তী কালে তা তাঁর সাহিত্য জীবনে প্রভাব ফেলেছে ৷ উপেক্ষিত,লাঞ্ছিত, পরাধীন জনগণের ব্যথা আর্তিকে তিনি অনুভব করতে পেরেছেন ৷ বর্ধমানের অখ্যাত গ্রামে নিঃস্ব পরিবারের পিতৃহীন নজরুল পড়াশুনার থেকে জীবিকার তাগিদে অনেক বেশী ব্যস্ত ৷কখন স্কুলে পড়া, কখন গাঁয়ে লেটোর দলে গান বাঁধা ও তাদের সাথে ঘুরে বেড়ানো,কখন রুটির দোকানে কাজ করা কিংবা রেলের গার্ডসাহেবের বাবুর্চি হওয়া ৷ এই ভাবে জীবনযুদ্ধে তাঁর বড়ো হয়ে ওঠা ৷আর সারা দেশে তখন ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজের শোষণ ও শাসন ভারতবাসীর জীবন যাত্রা দুর্বিষহ করে তুলেছে ৷ উনিশ শতকের শেষদিক থেকেই শিক্ষিত বাঙালী মোহভঙ্গ হয়েছে, ইংরেজের স্বরূপ তারা বুঝতে পেরেছে৷ বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধের আন্দলনের মধ্যে তারা প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠল ৷
ছবি সংগৃহীত 
আন্দোলনের এই ঢেউ মানুষের মধ্যে প্রচণ্ড নাড়া দিলো৷এই সময় সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন,সশস্ত্র সংঘর্ষে ফেটে পড়ল ৷ইংরেজও চরম প্রতিহিংসার দমনপীড়নে উদ্দাম হয়ে উঠল ৷ বাঙালী যুবকে জেলখানা ভরে গেল৷ অসংখ্য যুবক ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান গেয়ে গেলেন ৷এ যেন 'অমাবস্যার কারা' বাঙালীর জীবনকে দুঃস্বপ্নের মধ্যে বন্ধ করে রেখেছে ৷ শুরু হলো প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ ৷তাতে ভারতের প্রত্যক্ষ যোগ ছিলো না ৷ ইংরেজ তো করেছে যুদ্ধ ৷তার ফলে পরাধীন দেশে প্রভাব পড়ল অর্থনৈতিক মন্দা, বেকারী, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ৷ এই উন্মাদনার মধ্যে বেড়ে উঠেছে নজরুলের ব্যক্তিজীবন ৷ইংরেজের অর্থনৈতিক শোষণের ভয়ঙ্কর পরিনাম এক নিঃস্ব পরিবারে, যে বাড়ীতে প্রথম পুত্রসন্তানেরও নাম রাখতে হয় দুঃখী মিঞা ৷দেশের উত্তাল ঢেউ বর্ধমানের চুরুলিয়া কিংবা শিয়ারশোলের বুকেও আঘাত এনেছে ৷দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় তিনি চলে গেলেন,জীবিকা ও যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে পরবর্তী লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে ৷ যুদ্ধশিবিরে থাককালীন রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠ ও লাল ফৌজের বিজয় অভিযানের সাফল্যে,তাঁর লেখা 'ব্যথার দান' গল্পে সেই ছাপ আছে ৷লালফৌজ কথাটি 'মুক্তিসেবক সৈন্যদল' এ পরিবর্তন করেন ৷ নজরুল যখন কলম ধরেছেন তখন বাংলাসাহিত্যে অপ্রতিহত প্রভাবে বিরাজ করছেন রবীন্দ্রনাথ ৷    তিনি রাজসিংহাসন থেকে বারবার নেমে এসেছেন সাধারণ মানুষের কাছে,তখনকার জীবনের রুদ্ধশ্বাস তাকেও বিচলিত করেছে ৷  তখনকার পরিস্থিতিতে জনগনের ব্যথার কথা কবি গুরু লিখেছেন 'ঐক্যতান' কবিতায় ৷  সেই সময়ের কোন কবির কাব্যে তা পাওয়া যায়নি ৷তারা বেশির ভাগই রবি সূর্যের আশেপাশে প্রদক্ষিন করেছেন এবংবিরাট প্রতিভার কাছে হারিয়ে গেছেন ৷ সারা দেশব্যাপী যখন এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি এবং বাঙালী মন ফেটে পড়তে চাইছে প্রচন্ড বিক্ষোভে,কিন্তু সে যুগের প্রেক্ষাপটে কোথায়?দুঃখের মূল কোথায়!অত্যাচারীর স্বরূপ কি বা প্রতিবাদই বা কোথায় ?বাংলার মানুষ এই সব কথা প্রাণের গভীর থেকে বলতে চাইছে ৷ বাংলার কাব্যের এই পরিবেশে নজরুল ইসলামের আবির্ভব ৷যুদ্ধ ফেরত হাবিলদার নজরুল হয়ে উঠলেন কাজী নজরুল ৷প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তার মনে প্রচণ্ড প্রভাব ফেলেছিলো ৷দেখলেন বৃটিশের শাসন ও শোষণের নগ্ন চেহারার সাথে দেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয় ৷তার সাথে ধর্মে ধর্মে বিভেদ ,জাতপাতের কুসংস্কার ৷ সাথে রাজনৈতিক পাশাখেলা ৷ বিদ্রোহী কবিতা ছিলো তাঁর কাব্যজীবনের ইস্তেহার ৷এই কবিতার পংক্তি প্রতিটি শব্দ তাঁর বিদ্রোহী কবি সত্তার প্রাণকেন্দ্র ৷
ছবি সংগৃহীত 
'আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি ৷' 

তখনকার জনজীবন নরকের সমান ৷ মানুষের সেই যন্ত্রণা তাঁর লেখার বিষয় বস্তু ৷পাথরের মত বুকে চেপে থাকা কষ্ট উড়িয়ে ফেলে শান্ত হবেন সেই দিন—
'যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না/অত্যাচারীর খড়গকৃপাণ ভীমরণভূমে রণিবে না ৷'
ভেঙে ফেলা শুধু ধ্বংসের জন্য না ৷ অবহেলিত দেশকে উপড়ে ফেলে নতুনকে সৃষ্টি করতে চান ৷ শুরুতে 'চির উন্নত শির' বীরকে সম্বোধন করেই তাঁর সত্তার প্রকাশ৷এখানে 'আমি' কখনই তিনি নিজে নন ,'আমি' হল প্রতিবাদে মুখর যুবসমাজ ৷'ভাঙার গান' আলোচনা প্রসঙ্গে তাঁর উক্তি—'ঐ নতুন করে গড়ার আশাতেই তো যত শীঘ্র পারি ভাঙি ৷'তিনি কখনই ভবিষ্যতের 'নবী' হওয়ার ইচ্ছা মনে জন্ম দেননি ৷তিনি বর্তমানের কবি, ভবিষ্যতের কাছে তাঁর একটাই প্রার্থনা ৷
'যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটী মুখের গ্রাস/যেন লেখা হয় আমার রক্তলেখায় তাদের সর্বনাশ ৷' 
'ফরিয়দ' কবিতায় ঈশ্বরের কাছে নালিশ জানাতে জানাতে জনগণের দরবারে হাজির হয়েছেন৷ সেই পরিস্থিতিতে মানুষের দুঃখ যন্ত্রনা হাহাকার তাঁকে বিরক্ত করেছে,রাগিয়ে দিয়েছে,উত্তেজিত করেছে ,এই রাগে ক্ষোভে আগুনের ভাষায় লিখেছেন৷ ভারতবাসীর আচরণ তাঁকে আঘাত করেছে, তাঁর মনে হয়েছে ভারত বাসী জাতপাত ধর্ম অধর্ম কুশিক্ষা নিয়ে আছে ৷তাই তিনি লিখেছেন 
'এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে...,তেত্রিশ কোটি ভেড়া ও ছাগল চরিতেছে দিবানিশি ৷'
বৃটিশের অত্যাচার যখন কোন দিক দিয়েই কমছে না ৷তিনি লিখলেন—
'ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ,চায় দুটোভাত একটু নুন ৷ 'মা'র বুক হতে ছেলে কেড়ে খায়, মোরা বলি বাঘ খাও হে ঘাস! হেরিনু, জননী মাগিছে ভিক্ষা ঢেকে রেখে ঘরে ছেলের লাশ৷'
 অর্থাৎ বৃটিশ অত্যাচারী পুলিশ মায়ের বুক থেকে ছেলেদের কেড়ে খুন করছে ৷অত্যাচারের ভয়ে প্রতিবাদ করা যাবে না ৷ফলে ছেলের লাশ গোপন করে সন্তানহারা মা ভিক্ষে করছে ৷ 'আমার কৈফিয়ৎ' কবিতায় তিনি বিক্ষোভ ও জ্বালার কারণ খুঁজতে গিয়ে বুঝেছেন,এর প্রতিকার শুধুমাত্র একার দ্বারা সম্ভব না ৷সবাই একহয়ে নতুন দেশ গড়তে হবে ৷বলেছেন—'রক্ত ঝরাতে পারি না তো একা—' আজকাল রবীন্দ্রনাথ নজরুল সুকান্ত কে,এক সারিতে বসিয়ে আলোচনা হয় ৷ কারণ এই নয় ,সমান মাপের কবি—গুণ ক্ষমতা কিংবা কাব্যশিল্পে ৷ নজরুল বা সুকান্ত কখনোই রবীন্দ্রনাথের বিচিত্রমুখী কাব্যশিল্পের সমান পর্যয়ের নন ৷ তবুও তিন জনকে একই সারিতে রেখে আলোচনার কারণ বাংলা সাহিত্যে ঐতিহাসিক বিবর্তন ৷ রবীন্দ্র নাথের ষাট বছরে নজরুল এসেছেন সাহিত্য জগতে ৷বরীন্দ্র নাথের মৃত্যু যখন হয়েছে,নজরুল শারীরিক ভাবে অসুস্থতার কারণে সাহিত্য থেকে বিদায় নিয়েছে ৷এর পর সুকান্তের আবির্ভাব ৷ রবীন্দ্রনাথের 'আমি' অবশ্যই ব্যক্তি ৷ 'আমি'কে তিনি মানুষ,প্রকৃতি জগৎ সংসার থেকে শুরু করে শেষ অবধি বিশ্ব মুখী করে তুলেছেন ৷ কবি গুরু মানুষের প্রতি কখনোই বিশ্বাস হারাতে পারেনি ৷মানুষের প্রতি অন্তহীন ভালোবাসা তাঁকে 
ছবি সংগৃহীত 
মানবজীবনের জয়গান গাইতে উৎসাহিত করেছে ৷ সুকান্ত এখানেই ভাবনার জগতে সংগঠিত ৷সুকান্ত 'আমি' ভাবনার একাকীত্বে কখনই আবেগপ্রবণ হয়নি ৷শাসন-শোষণ অত্যাচার —সুকান্ত লেখার মধ্যদিয়ে সংগঠিত প্রতিবাদের পর্যায় নিয়ে গেছে ৷ সুকান্তর ভাবনায় দ্বিধার মুক্তি হয়েছে ৷ সুকান্ত রবীন্দ্র নাথকে নিয়ে এসেছেন লেখায়,যখন নিজের বিশ্বাসের শক্ত মাটিতে দাঁড়িয়েও ঘটনাকে কাব্যে রূপ দিতে পারছেন না —রবীন্দ্রনাথ পারতেন সুকান্তর মনভাবকে সঠিক ভাবে প্রকাশ করতে ৷ সে কোন রবীন্দ্রনাথ? নতুন রবীন্দ্র নাথ কে সুকান্ত বলেছেন—'এবার নতুন রূপে দেখা দিক রবীন্দ্রঠাকুর,বিশ্বাসের স্বপ্ন চোখে কন্ঠে গণসঙ্গীতের সুর ৷' নজরুলের মানুষের প্রতি ভালোবাসা এতই আবেগপ্রবণ যে পাঠককে ব্যকুল করে আবার দিশেহারাও করে ৷ কবি নিজেও দিশেহারা হয়ে যান ৷ ভাঙনের মধ্যেদিয়ে নতুনকে গড়ে তোলার আবেগে,অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে উদাহরণ আনেন আবেগের উন্মাদনা কেটে গেলে তিনি বুঝতে পারেন কত একা ৷ নজরুল রবীন্দ্রগোষ্ঠীর নন,তাঁর অনুসারীও নন ৷আবার সেই সময় যারা আধুনিক কবি তাদের দলেও তাঁর ঠাঁই নেই ৷এই দুই বিপরীত মেরুর মধ্যপথে তাঁর বাসভূমি ৷ রবীন্দ্রনাথ ,নজরুল, সুকান্তকে নিয়ে বাংলাকাব্যে ভাবের প্রকাশ সম্পূর্ণতা পেয়েছে ৷নজরুল অন্য দুজনের মাঝখানে সেতুর মত বাংলা কাব্যে জায়গা করে নিয়েছেন ৷ সাম্যবাদী সাহিত্যে তিনি সাম্প্রদায়িক বিভেদ,ধনী দরিদ্রের বিভেদ,নর নারীর বিভেদ প্রভৃতি সামাজিক অসাম্যের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদ করেন ৷ নজরুলের জন্ম মুসলিম পরিবারে,কিন্তু সংস্কৃতিগত দিক দিয়ে তিনি হিন্দু মুসলিম কোনোটাই নয় ৷দুই সমাজের প্রতি ছিলো তাঁর সমান শ্রদ্ধা ও ভাবনা ৷মনের দিক থেকে তিনি কোন ধর্মাশ্রয়ী ছিলেন না ৷তিনি ছিলেন শুধুই বাঙালী ৷তিনি লেখেন—
'হিন্দু না ওরা মুসলিম ?ঐ জিজ্ঞাসে কোনজন,কান্ডারী!বলো, ডুবিছে মানুষ,সন্তান মোর মোর ৷' 
এর সমাধানে বললেন—'মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান ৷' একসময় তিনি অভিসারী হলেন সুরের আকাশে ৷যে কবি দাঁড়িয়ে ছিলেন রণক্ষেত্রে ৷ শিকলভাঙার গান ,ছাত্রদলের গান, কত গান বাঙালীকে মাতিয়ে,ভরিয়ে,নাড়িয়ে দিয়েছিলো ৷ সেই তিনিই গাণ্ডীব মাটিতে ফেলে বাঁশি হাতে তুলে নেন?এ প্রশ্ন আজও থেকে যায় ৷বিষয়,ভাষা, শব্দ,সুর,তাল সব কিছুই পাল্টে যায় ৷ তবে কি বিদ্রোহী কবি রণক্লান্ত !তাঁর শান্ত হওয়ার শর্ত তো তখন পূরণ হয়নি ৷ ভাবনার জগতে স্থির হতে না পারলে,জীবনের অভিজ্ঞতায় স্থির বিন্দুতে নিজেকে আবদ্ধ করতে না পারলে—উত্তেজনা ও উন্মাদনার শেষে নেমে আসে ক্লান্তি,হতাশা,বিষাদ ও অবসাদ ৷ সে সময় ইসলামী,মুর্শিদী সারাফতি, গান লিখছেন আবার শ্যামাসঙ্গীত কালীকীর্তন গুলিও লিখছেন ৷ পরবর্তী কালের বিষণ্ণতা সত্ত্বেও দারিদ্র্য,অসাম্য,বিদ্রোহ,সর্বহারা, পথহারা নজরুল বাঙালীর চিরকালের নজরুল ৷বাঙালী তাঁকে রোমান্টিক কবির আসনের থেকে বিদ্রহী কবির আসনে বেশী পূর্ণতা দিয়েছে ৷ একুশ শতকের মহামারির আক্রমণে বিপন্ন দেশ,মহাদেশ,মানবজাতি ৷ মহামারির বিরুদ্ধে লড়াই আর এক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ৷সংক্রমণের চূড়ায় দাঁড়িয়ে যুদ্ধ যেন উপত্যকায়৷ বিশ্বযুদ্ধের বোমা যেন কোয়ারেন্টাইন৷ মহামারীর সময়ে দিক ভ্রান্ত মানুষের অবস্থা,প্রবল ভাবে বোঝা যাচ্ছে অর্থনীতি বা রাজনীতির চেয়েও বেঁচে থাকা বড়৷ বাঁচার জন্য মানবীয় সম্পর্কের পতন দ্রুততর৷ ক্ষতবিক্ষত পৃথিবী জুড়ে মহামারি যুদ্ধের কালো থাবা ৷এই অভূতপূর্ব প্রতিকূল পরিস্থিতি দরিদ্র মানুষের অর্থ ও খাদ্য নিরাপত্তায় চরম আঘাত হেনেছে ৷ গত শতকের যুদ্ধে বদলে গিয়েছে বিশ্ব ৷ছোঁয়াচে মহামারি হয়তো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ৷এ যেনো উপনিবেশবাদের করাঘাতে ছিন্নভিন্ন হওয়া নিঃস্ব বিশ্ব কিংবা মনে হয় এক মৃত্যুর উপত্যকা ৷ এই কঠিন পরিস্থিতিতে চেতনায় ধ্বনিত হয় কাজী নজরুল ইসলামের 'মানুষ'কবিতা— 'জীর্ণ-বস্ত্র শীর্ণ-গাত্র, ক্ষুধায় কন্ঠ ক্ষীণ   ডাকিল পান’,‘দ্বার খোল বাবা, খাইনি ক’ সাত দিন!’  সহসা বন্ধ হ’ল মন্দির, ভুখারী ফিরিয়া চলে, তিমির রাত্রি, পথ জুড়ে তার ক্ষুধার মানিক জ্বলে!' অদৃশ্য মহামারির প্রভাব আজকের সাহিত্য জগতেও ৷সাহিত্য,জীবনেরই অংশ ৷লেখক কবি কলম ধরেছেন সাহিত্যকে কিছু দেওয়ার তাগিদে ৷
ছবি সংগৃহীত 
মহামারি হয়ে ওঠে দানবীয় শক্তির অত্যাচারের প্রতীক৷মানুষের অসাবধানতার ফলে সৃষ্ট বিপর্যয়—রোধ করতে,নিজেকে রক্ষা করতে, মানুষেরই চেষ্টা অব্যাহত থাকবে ৷ সাহিত্যের পাতায় বর্তমান কবি সাহিত্যিক গণের প্রচেষ্টা অমর হয়ে থাকবে উত্তরসূরীর জন্য ৷ করোনা আক্রান্ত কিংবা আক্রান্ত না হয়েও গৃহবন্দি থাকা সৃজনশীল মানুষেরা নিভৃতে সৃষ্টি করে যাচ্ছেন ভবিষ্যতের সাহিত্য ৷ বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে মন চলে যায় কবি নজরুলের সেই বিখ্যাত লাইনে যা আজকের উপযোগী, আজকের সাবধানবাণী— 'পাপ'কবিতা —'এ পাপ-মুলুকে পাপ করেনি করেনিক’ কে আছে পুরুষ-নারী?' অথবা, 'তুমি শুয়ে রবে তেতালার পরে, আমরা রহিব নিচে, অথচ তোমারে দেবতা বলিব, সে-ভরসা আজ মিছে!'(কুলি মজুর)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ