শামসুর রাহমানের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা | এ কে আজাদ




পোস্ট বার দেখা হয়েছে



 ১৭ আগস্ট (২০০৬) কবি শামসুর রাহমানের মৃত্যু দিবসে জানাই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা

---------------------------------------------------

শামসুর রাহমানের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা

এ কে আজাদ


ব্রিটিশদের হাত থেকে ১৯৪৭ সালে একবার মুক্ত হয়ে আবার পাকিস্তানি করাল গ্রাসের মধ্যে পড়ে আমাদের এই মাতৃভূমি। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ ও বঞ্চনার ভয়াল দিনে অসহনীয় অত্যাচারে বাঙালি জাতি অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। অবশেষে ১৯৭১ সালে দেশ মাতৃকার স্বাধীনতার জন্য জেগে ওঠে বাংলার মানুষ। সে জাগরণের মহানায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার ডাকে সাড়া দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলার কৃষক, শ্রমিক, পেশাজীবী, কবি-সাহিত্যিক, ছাত্র-শিক্ষক, নারী-পুরুষ সকলেই। জাতির জাগ্রত বিবেক হিসেবে একজন কবি কি নীরব থাকতে পারেন তার স্বজাতির উত্থানে? তাই তো সে যুদ্ধে শামিল হলেন বাংলা সাহিত্যের অমর কবি শামসুর রাহমান। মুক্তিযুদ্ধকালীন দেশত্যাগ করার পরিবর্তে স্বদেশের মায়ায় থেকে গেলেন দেশের মাটিতে। দেশের সাধারণ মানুষের জ্বালা-যন্ত্রণা, ক্ষোভ-ক্রোধ, বিদ্রোহ-ঘৃণা সবই করে নিলেন নিজের। স্বদেশের মুক্তিকামী চেতনার আলোকে রচনা করলেন বেশ কিছু অমর কবিতা, সমকালীন সমস্ত বেদনাবোধ, বিক্ষোভ, উত্তাপ ও সন্তাপকে ধারণ করে কবির নিজস্ব অনুভূতির চেতনায় শানিত হলো কবির কবিতা। মুক্তিযুদ্ধের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি শামসুর রাহমান বললেন- "১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে একটি ছবি দেখে ছিলাম পত্রিকায়, রাস্তার ধারে গুলিবিদ্ধ মানুষ নিজের রক্ত দিয়ে লিখলেন সস্নোগান তার দেশের স্বপক্ষে, দেশবাসীর স্বপক্ষে, সেদিন গুলিবিদ্ধ মানুষটিকে স্বাধীনতার নকীব বলে মনে হয়েছিল আমার। এই ছবি উজ্জ্বল হয়ে ফিরে আসে আমার কাছে। এই '৭১-এর এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে আমার গ্রাম পাড়াতলিতে এক দুপুরে পুকুরপাড়ে বসে লিখে ফেললাম- 'স্বাধীনতা তুমি' ও 'তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা' কবিতা দুটি।" 


আরিফ চৌধুরী তাঁর 'মুক্তিযুদ্ধের কবিতা: রক্তের অক্ষরে অবিনাশী পঙ্ক্তিমালা' শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন_ 'মুক্তিযুদ্ধের সময়ে লেখা চেতনা জাগানিয়া কবিতাগুলো প্রকাশের প্রয়োজন দেখা দিলেও কবির জীবন বিপন্ন হতে পারে এই ভাবনা ও দ্বিধা থেকে বেরিয়ে আসার পথ দেখালেন মূলত: উর্দুভাষী বাঙালি লেখক, সমালোচক ও বুদ্ধিজীবী আবু সায়ীদ আইউব। 'মজলুম আবিদ' ছদ্মনামে তিনি কবির কবিতাগুলো প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে পুর্ণেন্দু পত্রীর প্রচ্ছদে অরুণা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয় কবির 'বন্দি শিবির থেকে' কাব্য গ্রন্থ। এই কাব্যগ্রন্থে এই কবিতাগুলো স্থান পায়। 'শামসুর রাহমানের মুক্তিযুদ্ধের কবিতা' শীর্ষক প্রবন্ধে চৌধুরী শাহজাহান লিখেছেন_ 'মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রণাঙ্গনে থাকতে পারেননি শামসুর রাহমান, তার হাতে ছিল না রাইফেল, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে কবিতা লিখে বাঙালি জাতিকে সাহসী হওয়ার মন্ত্র দিয়েছিলেন তিনি।' 


১৯৬৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত 'নিরালোকে দিব্যরথ' কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমেই স্বাধীনতার চেতনার স্বপক্ষে নিজের অবস্থানের জানান দিয়েছিলেন কবি শামসুর রাহমান। এই কাব্যগ্রন্থের 'টেলেমেকাস' কবিতায় একটি চমৎকার মিথের মাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন তিনি স্বাধীনতার জন্য তার অদম্য বাসনা। কবিতাটির মূল প্রেরণা হিসেবে তিনি পেয়েছিলেন গ্রিক কবি হোমারের মহাকাব্য 'ওডিসি'র কাহিনী। 

গডের অভিশাপে ওডিসিউস যখন সমুদ্রপৃষ্ঠে পতিত হয়, তখন বিভিন্ন দেশের রাজা তার স্ত্রী পেনেলপকে বিয়ে করে তার রাজ্য ইথাকা দখল করতে চায়। তাদেরকে ফাঁকি দেয়ার জন্য পেনেলপ একটি কৌশল অবলম্বন করেন। সে একটি কাপড় বুনছিল এবং এই বলে ঘোষণা দেয় যে_ তার কাপড় বোনা হয়ে গেলে সে নিজেই স্বয়ংবরা হবে। কিন্তু দিনের বেলায় সে যা বুনত রাতের বেলায় তা খুলে ফেলত। সুতরাং তার কাপড় বোনা আর শেষ হয় না। অপর দিকে তার ছেলে টেলেমেকাস তার পিতার প্রত্যাবর্তনের আশায় অপেক্ষা করতে থাকে। এই মিথোলজিক্যাল স্টোরির মাধ্যমে কবি শামসুর রাহমান নিজেকে টেলেমেকাস আর ঢাকাকে ইথাকা রূপে বর্ণনা করেছেন। আর পশ্চিম পাকিস্তানি শক্তিকে বিদেশি রাজাদের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ঢাকার পরিত্রাতা ওডিসিউসের জন্য অপেক্ষায় যেন কবি। তিনি লিখলেন_ 


ইথাকায় রাখলে পা দেখতে পাবে রয়েছি দাঁড়িয়ে/দরজা আগলে, পিতা, অধীর তোমার প্রতীক্ষায়।

এখনো কি ঝঞ্ঝাহত জাহাজের মাস্তল তোমার/বন্দরে যাবে না দেখা? অস্ত্রাগারে নেবে না আয়ূধ/ 

আবার অভিজ্ঞ হাতে? তুলবে না ধনুকে এ টঙ্কার? 


'বন্দি শিবির থেকে' কাব্যগ্রন্থটি শামসুর রাহমানের স্বাধীনতার প্রতি অদম্য আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলক। এই গ্রন্থের প্রত্যেকটি কবিতাই যেন স্বাধীনতাকামীদের কাছে মূলমন্ত্র হিসেবে প্রতিভাত। দখলদার পাকবাহিনীর দমন-পীড়নের বিপরীতে গ্রন্থের শিরোনামীয় কবিতাটি যেন এক বিরাট প্রতিবাদ। সেই সঙ্গে স্বাধীনতার প্রতি অকৃত্রিম আগ্রহের পরিচায়ক। তিনি লিখেছেন_ 

'অথচ এদেশে আমি আজ দম বন্ধ/এ বন্দি শিবিরে মাথা খুঁড়ে মরলেও পারি না করতে উচ্চারণ/ মনের মতন শব্দ কোনো।/ মনের মতন সব কবিতা লেখার/অধিকার ওরা/করেছে হরণ,স্বাধীনতা নামক শব্দটি/ ভরাট গলায় উদীপ্ত উচ্চারণ করে বার বার/তৃপ্তি পেতে চাই/শহরের আনাচে-কানাচে/ প্রতিটি রাস্তায়/অলিতে গলিতে রঙিন সাইন বোর্ডে, প্রত্যেক বাড়িতে/স্বাধীনতা নামক শব্দটি/লিখে দিতে চাই/বিশাল অক্ষরে।' (বন্দি শিবির থেকে) 

স্বাধীনতার প্রতি কবির যে গভীর আবেগ তাও যেন এই 'বন্দি শিবির থেকে' কবিতায় প্রস্ফুটিত। ইংরেজি সাহিত্যের বিখ্যাত রোমান্টিক কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ প্রকৃতির পরতে পরতে যেমন খুঁজে পেয়েছিলেন ঈশ্বরের উপস্থিতি, তেমনি কবি শামসুর রাহমানও যেন খুঁজে পেয়েছিলেন স্বাধীনতার মশাল। গাছের পাতায় পাতায়, পথের ধূলিকণায়, প্রেয়সীর চোখের মণিতে, উড়ন্ত পাখির পালকে, এমনকি বস্তির দুরন্ত ছেলেটার হাতের মুঠোতেও কবি যেন খুঁজে পেয়েছিলেন স্বাধীনতা শব্দটির পরশ, খুঁজে পেয়েছিলেন স্বাধীনতার আলোর প্রদীপ। 


কবির ভাষায়: 

'অথচ ওরা জানে না কেউ/গাছের পাতায়, ফুটপাতে, পাখির পালকে কিংবা নারীর দু'চোখে/পথের ধূলায় বস্তির দুরন্ত ছেলেটার/হাতের মুঠোয়/সর্বদাই দেখি জ্বলে স্বাধীনতা নামক শব্দটি।' (বন্দি শিবির থেকে) 

'তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা' শামসুর রাহমানের বহুল আলোচিত স্বাধীনতা বিষয়ক কবিতা। মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের পারিপাশ্বর্িক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার পাশাপাশি পাক হানাদার কর্তৃক বাঙালি জাতির উপর বর্বর নির্যাতনের ইতিহাসও যেন এই কবিতাটি। কবি লিখেছেন_

তোমাকে পাওয়ার জন্য আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?/ ্ত্ত্ত তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা/সকিনা বিবির কপাল ভাঙলো, সিঁথির সিঁদুর মুছে গেলে হরিদাসীর,/ তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা, শহরের বুকে জলপাই রঙের ট্যাঙ্ক এলো/দানবের মতো চিৎকার করতে করতে,/তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,/ ছাত্রাবাস, বস্তি উজাড় হলো,/ রিকয়েললেস রাইফেল আর মেশিনগান খই ফোটালো যত্রতত্র,/ তুমি আসবে বলে ছাই হলো গ্রামের পর গ্রাম,/তুমি আসবে বলে বিধ্বস্ত পাড়ায় প্রভূর বাস্তুভিটার ভগ্নস্তূপে/দাঁড়িয়ে একটানা আর্তনাদ করল একটা কুকুর।/তুমি আসবে বলে হে স্বাধীনতা,/ অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতা মাতার লাশের উপর,/্ত স্বাধীনতা, তোমার জন্য মোল্লাবাড়ির এক বিধবা/দাঁড়িয়ে আছে নড়বড়ে খুঁটি ধরে দগ্ধ ঘরের।/ স্বাধীনতা, তোমার জন্য/হাড্ডিসার এক অনাথ কিশোরী/শূন্য থালা হাতে বসে আছে পথের ধারে,/ ্ত্ত্ত্ত- একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হতে চলেছে/ সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্য, হে স্বাধীনতা/ ্ত্ত্ত্ত্ত এই বাংলায়/তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা। (তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা) 

চমৎকার চিত্রকল্পের অবতারণা। সেই সঙ্গে বাংলা আর বাঙালির আবেগ অনুভূতিকে ধারণ কবিতার পয়ারে। এ সম্মিলন যেন নতুন এক বাংলাদেশের আগমনী বার্তা। কবিতার এ লাইনগুলো পাঠকের চোখের সামনে উপস্থাপন করে এক রক্তাক্ত জনপদের। পাক হানাদার বাহিনীর অবর্ণনীয় এবং অকল্পনীয় নির্মম নিষ্পেষণের জাজ্বল্যমান এক দস্তাবেজ যেন 'তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা।' পাক দখলদার বাহিনী স্বাধীনতাকামী মানুষের বুকের রক্তে কিভাবে যে রঞ্জিত করেছিল বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহমান নদীর পানি, সকিনা, হরিদাসীর মতো কত মহিলার স্বামীকে যে হত্যা করেছিল তারা, কত মায়ের কোল যে খালি করেছিল, কত মানুষকে যে করেছিল ভিটে মাটি ছাড়া, নিরস্ত্র বাঙালিকে হত্যা করতে মেশিনগানের কত গুলি যে ফুরিয়েছিল, কত মানুষের বাড়িঘর দিয়েছিল আগুনে পুড়িয়ে, তার ইয়তা নেই। করুণ এবং হৃদয় বিদারক এক চিত্রকল্পের উপস্থাপন করেছেন কবি, যখন তিনি বলেছেন_ কুকুরের আর্তনাদের কথা। ভেঙ্গে চুড়ে নিঃশেষ করে দেয়া, বুলডোজার চালিয়ে বিধ্বস্ত করে দেয়া, আর আগুনের লেলিহান শিখায় দাউ দাউ করে পুড়িয়ে দেয়া বাস্তুভিটায় দাঁড়িয়ে একটা প্রভুভক্ত কুকুর তার মনিবের ফিরে আসার প্রতীক্ষায় বাতাসের দিকে তাকিয়ে আর্তনাদ প্রকাশের যে ইমেজারির উপস্থাপন করেছেন কবি, তা বাংলা সাহিত্য কেন বিশ্বসাহিত্যেই যেন বিরল। পাকহানাদার বাহিনীর বুলেটে ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত বাবা-মার লাশের উপরে অবুঝ শিশুর রোদনের ভার যেন সইতে পারে না এই ধরিত্রী। ওই শিশুটির কান্নার সঙ্গে যেন কেঁদে ওঠে পুরোপৃথিবী, পুরো মানবসভ্যতা, এমন মর্মস্পর্শী সরল বর্ণনাধর্মী কবিতা যেন অতি সহজেই হয়ে ওঠে সাধারণ পাঠকের, সাধারণ মানুষের। আর প্রেরণার আলোকবর্তিকা হয়ে স্বাধীনতার পক্ষে পথ দেখিয়েছে মুক্তিকামী জনতাকে। বোধ করি, সে কারণেই কেবল স্বাধীনতার জন্যই একজন সন্তানহারা মা ভুলে যান সন্তান হারানোর শোক, একজন বিধবা নারী ভুলে যান প্রিয়তম মানুষটিকে হারানোর অকৃত্রিম মর্মবেদনা। এমনকি পথের পাশে দাঁড়িয়ে ভিক্ষারত ভিক্ষুকও ভুলে যায় ভিক্ষার প্রয়োজনীয়তা। কেবল স্বাধীনতা চাই, কেবলই স্বাধীনতা, কেবলই স্বাধিকার। আর কোনো স্বপ্ন নেই, আর কোনো সাধ নেই, নেই কোনো চাওয়া পাওয়ার হিসাব। সুতরাং স্বাধীনতাকে তো আসতেই হবে। উড়াতেই হবে লাল-সবুজের পতাকা। কবির চোখে স্বাধীন সার্বভৌম একটা বাংলাদেশই যেন সব নয়, পুরোবিশ্বকেই তিনি দেখতে চান শোষণ-বঞ্চনা মুক্ত পৃথিবী হিসেবে। নিষ্পেষণের যাঁতাকলে অতীষ্ট জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশাও যেন কবির কবিতায়। তাই তো তিনি লিখেছেন_ 'একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হতে চলেছে'। এত ত্যাগ তিতিক্ষার পরাকাষ্ঠা যে জাতি প্রদর্শন করতে পারে সে জাতির কাছে স্বাধীনতাকে ধরা দিতেই হবে_ এমন আত্মবিশ্বাসী উচ্চারণ কবির ভাষায়_ 'তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা।'


যে কবিতা শামসুর রাহমানকে স্বনামে করেছে উদ্ভাসিত, যে কবিতার নাম জুড়ে গেছে শামসুর রাহমানের নিজের নামের সঙ্গেই, সেটি হলো 'স্বাধীনতা তুমি'। সম্ভবত: স্বাধীনতা বিষয়ক এই কবিতাটিই সবচেয়ে বেশি পঠিত। শামসুর রাহমানের মৌলিক কবি-প্রতিভা প্রকাশে এটি একটি বিরাট মাইলস্টোন। স্বাধীনতাকামী বাঙালি মানসে 'স্বাধীনতা তুমি' এক বিশাল আবেগ, অন্যরকম অনুভূতি। কবিতাটি পুরো চিত্রকল্প নির্ভর। দৈনন্দিন বাঙালি জীবনের ইতিহাস ঐতিহ্য আর গ্রামীণ জীবনাচার থেকে তুলে আনা এবং বাছাই করা উপমা উৎপেক্ষা আর চিত্রকল্পের মিহি বুননে এ যেন ধারণ করেছে বাঙালির স্বাধীনতা চেতনার পোস্টার। মুক্তিপাগল মানুষের আবেগময় সস্নোগানের নামই যেন হয়ে উঠেছে 'স্বাধীনতা তুমি'। 

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তার অমৃত রচনা সম্ভার বাংলা ভাষাভাষী মানুষকে কেবল নয়, বিশ্ব সাহিত্যকেও করেছে সমৃদ্ধ। সে সাহিত্য-ভুবন যেমন অমর, অজর, বার্ধক্যহীন চিরসবুজ ও আবেগময়ী, বাঙালিদের কাছে স্বাধীনতাও যেন তেমনি দূতিময়। আবার বাংলা সাহিত্যের আরেক মহীরুহু বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের যে অমলিন মহান ব্যক্তিত্ব, অনবরত সৃষ্টি মুখর যে কাব্যময়তা, আর নতুন সৃষ্টির সুখানন্দে তার যে প্রেরণা ও উল্লাস, সেই অনুভূতির অনুরণনই যেন স্বাধীনতার চেতনা। সেই সঙ্গে অন্যায়, অবিচার, স্বাধীনতাহীনতা আর অমানবিকতার বিপরীতে কাজী নজরুলের যে বিদ্রোহী অবস্থান তাও যেন স্বাধীনতাকামী বাঙালি বিপ্লবের এক যুগান্তকরী অনুপ্রেরণা। আর ব্যক্তি নজরুলের বাবরি দোলানো বিদ্রোহ-বিপ্লব ও প্রেমময় অভিব্যক্তির প্রতীক যে বিরল কেশদাম, তাও যেন স্বাধীনতাকামী বাঙালি বিপ্লবের এক যুগান্তকারী অনুপ্রেরণার বাণী এবং সাহসের সমাচার শোনায় মুক্তিযোদ্ধার কানে। এমন অনুভূতি জড়ানো হৃদয়ের প্রকাশ শামসুর রাহমানের বিপ্লবী কলমে: 

"স্বাধীনতা তুমি/রবি ঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান/ স্বাধীনতা তুমি কাজী নজরুল-/ ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ/ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা্ত-" (স্বাধীনতা তুমি)

বাঙালি জাতির যে আবেগ অনুভূতি আর অধিকার আদায়ের আন্দোলন প্রথমেই নড়ে তুলেছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ভিত্তি, সেটি হলো '৫২এর ভাষা আন্দোলন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সেই ঝাঁঝালো সস্নোগান- 'রাষ্ট্রভাষা_ বাংলা চাই, বাংলা চাই' আজো যেন বাঙালির স্বাধীনতা চেতনার মূলমন্ত্র। আর সেটারই চমৎকার কাব্যিক রূপ দিলেন শামসুর রাহমান_ 

'স্বাধীনতা তুমি/শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারি উজ্জ্বল সভা/ স্বাধীনতা তুমি, পতাকা শোভিত সস্নোগান মুখর ঝাঁঝালো মিছিল।" (স্বাধীনতা তুমি) 

গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানসিক স্বাধীনতার চেতনানির্ভর জীবনাচারকে স্বাধীনতার চেতনা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন কবি শামসুর রাহমান। একজন কৃষক অনেক কষ্ট করে জমি চাষ করেন, ধান রোপণ করেন, পানি সেচেন, জমির পরিচর্যা করেন, এরপর যখন অগ্রহায়ণ মাস আসে, ফসলের মাঠ ভরে যায় পাকা ধানে, কৃষকের মুখে দেখা দেয় সুখের হাসি। এসুখ যেমন অকৃত্রিম, প্রাণবন্ত, স্বাধীনতার সুখও যেন সে রকমই। কবির ভাষা_ 'স্বাধীনতা তুমি/ ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি।' 

গ্রামীণ জীবনে গ্রীষ্মকালে প্রচ- তাপদাহ থাকে। সে সময়ে ছেলে মেয়েরা দীর্ঘক্ষণ ধরে পুকুরে নেমে সাঁতার কাটে, জলকেলিতে মেতে ওঠে, তখন কোন দুরন্ত কিশোরী বাধাহীনভাবে, নির্ভয়ে এবং আয়েশী ঢঙে যেমন সাঁতার কাটে, স্বাধীনতাও যেন তেমনি। স্বাধীনতা পেলে মানুষের কোনো সংকোচ থাকে না, থাকে না কোনো বাধা-বিপত্তি। মানুষের মনে থাকে সুখ ও শান্তি। তাই তো কবি লিখেছেন_ 'স্বাধীনতা তুমি/রোদেলা দুপুরে মধ্য পুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার।' 

আবার স্বাধীনতা মানে কেবল ভীরুতা বা লাজুকতা নয়। এ যেন এক আত্মপ্রত্যয়, নিজস্ব শক্তির জানান। কবির ভাষায়_ 'স্বাধীনতা, তুমি মজুর যুবার রোদে ঝলসিত দক্ষ বাহুর গ্রন্থিলর পেশি।' স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধারা যখন অন্ধকারে লুকিয়ে থাকে হঠাৎ আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য এবং শত্রুর উপর অতর্কিত হামলার প্রস্তুতির জন্য। তখন তাদের চোখ থেকে যেন জ্বলজ্বলে তারার মতন ঠিকরে পড়ে আলো। সে আলোতে প্রছন্ন থাকে স্বাধীন দেশের স্বপ্ন, মুক্ত স্বাধীন পতাকার স্বপ্ন, নিজের মতন করে বাঁচার অধিকারের স্বপ্ন। মুক্তিযোদ্ধার চোখের এমন ঝিলিকই যেন দেখতে পেয়েছেন কবি শামসুর রাহমান- 'স্বাধীনতা তুমি/অন্ধকারে খাঁ খাঁ সীমান্তে মুক্তিসেনার চোখের ঝিলিক।'


এমনিভাবে স্বাধীনতাকে কবি বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় মেধাবী ছাত্রের শাণিত ভাষণ, চায়ের দোকানের মুক্ত আলোচনা, কাল বোশেখীর মত্ত ঝাপটা, শ্রাবণে অকূল মেঘনার উন্মত্ত বুক, পিতার কোমল জায় নামাজের উদার জমিন, উঠানে ছড়ানো মায়ের শুভ্র শাড়ি কাঁপন, বোনের হাতের নম্র পাতায় মেহেদীর রঙ, তারার মতন জ্বলজ্বলে রাঙা পোস্টার, গৃহিণীর ঘন খোলা চুল, খোকার রঙিন কোর্তা, খুকীর তুলতুলে গালে রৌদ্রের খেলা ইত্যাদির সাথে তুলনা করেছেন। নানা জীবনাচার ও প্রকৃতির সঙ্গে স্বাধীনতার অস্তিত্বের অনুভূতিই প্রকাশ করেছেন কবি। মানুষের কথা বলার অধিকার, চলাফেরার অধিকার, অবাধ বিচরণ, সর্বোপরি মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার অধিকারের কথাই বলেছেন কবি। বাগানের মধ্যে কোকিল যেমন স্বাধীনভাবে গান গায়, মুক্ত বাতাসে বটের ঝিলিমিলি পাতা যেমন মনের আনন্দে দোল খায়, একজন কবি তার খাতায় নিজের আবেগ অনুভূতি ও অভিব্যক্তি প্রকাশের যেমন অধিকার রাখেন, স্বাধীনতাও তেমনি মানুষের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করে। বোধ করি, সে কারণেই শামসুর রাহমান লিখেছেন_ 

'স্বাধীনতা তুমি/বাগানের ঘর, কোকিলের গান/ বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা/যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা।' (স্বাধীনতা তুমি)

এছাড়াও ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন যোদ্ধাদের উদ্দীপনামূলক বহু কবিতা লিখেছেন শামসুর রাহমান। 'গেরিলা', 'প্রতিশ্রুতি' 'উদ্ধার' প্রভৃতি মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক প্রেরণাদায়ী কবিতাবলি। 

'কুকুর' কবিতায় শামসুর রাহমান প্রকাশ করেছেন পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে সীমাহীন ঘৃণা। তিনি লিখেছেন_ 

"সমস্ত শহরে সৈন্যরা টহল দিচ্ছে, যথেচ্ছ করছে গুলি/দাগাচ্ছে কামান এবং চালাচ্ছে ট্যাংক যত্রতত্র/মরছে মানুষ পথে-ঘাটে-ঘরে, যেন প্লেগবিদ্ধ রক্তাক্ত ইঁদুর/আমরা ক'জন শ্বাসজীবী ঠাঁয় বসে আছি সেই কবে থেকে।/ অকস্মাৎ কুকুরের শাণিত চিৎকার কানে আসে/যাই জানালার কাছে, ছায়া প্রায়।/সেই পথের কুকুর দেখি বারংবার তেড়ে যাচ্ছে/জলপাই রঙ একটি জিপের দিকে/জিপে সশস্ত্র সৈনিক কতিপয়।/ভাবি, যদি অন্তত হতাম আমি/পথের কুকুর।" 

এমনিভাবে বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই যে শামসুর রাহমানের পঙক্তিমালায় নকশী কাঁথায় সেলাই করা সূতোর মতন স্বাধীনতার চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। মুক্তিযোদ্ধদের উৎসাহ উদ্দীপনা প্রদানের পাশাপাশি যুদ্ধকালীন দেশের করুণ অবস্থাও ফুটে উঠেছে শামসুর রাহমানের কবিতার পয়ারে। 'বন্দি শিবির থেকে' কাব্যগ্রন্থের ভূমিকাংশে শামসুর রাহমান লিখেছেন_ 'সুদীর্ঘ নয় মাস আমরা যে পরিবেশে বাস করেছি, তাকে কাফকার জগৎ বললে কিছুই বলা হয় না। উৎপীড়ন, হত্যা এবং সন্ত্রাস আমাদের চারপাশে রচনা করেছিল এক ভয়ঙ্কর তমশাচ্ছন্ন ও বিভীষিকাময় পটভূমি। আমরা তৃষিত হয়ে পড়েছিলাম এক ঝলক আলোর জন্য। 

নীরন্ধ শ্বাস রোধকারী সেলের ভেতর বন্দি যেমন ব্যাকুল হয়ে থাকে এক ফোটা আলোর জন্য, ঠিক তেমনি। ঘরের দরজা জানালা বন্ধ, শিশুরা নিশ্চুপ, ফৌজি জিপের গর্জন, ট্রাকের ঘর্ঘর, বুটের শব্দ, আগুন, আর্তনাদ, আমরা এই নিয়ে ঢাকায় ছিলাম। তখন আমরা প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করতাম। সবসময় মনে হতো কেউ যেন দরজায় কড়া নাড়ছে। ঘুমের ভেতর চিৎকার করে উঠতাম কোনো কোনো রাতে। বধ্যভূমির ধারে বেঁধে রাখা জীবজন্তুর অনুরূপ আমরা আতঙ্ককে জেনেছি নিত্যসঙ্গী বলে, এমন কোনো দিনের কথা মনে করতে পারি না যেদিন হত্যা কিংবা ধরপাকড়ের কোনো না কোনো খবর কানে না আসত।' তাঁর কবিতাতেও এমনই নিষ্ঠুর সময়ের বিবরণ: 

'কখনো নিঝুমপথে হঠাৎ লুটিয়ে পড়ে কেউ গুলির আঘাতে।/ মনে হয় ওরা গুলিবিদ্ধ করে স্বাধীনতাকেই/দিন-দুপুরেই জিপে একজন তরুণকে কানামাছি করে নিয়ে যায় ওরা/মনে হয় চোখ বাঁধা স্বাধীনতা যাচ্ছে বধ্যভূমিতে/বেয়োনেটবিদ্ধ লাশ বুড়িগঙ্গায়, কি শীতলক্ষ্যায় ভাসে/মনে হয়, স্বাধীনতা লখিন্দর যেন, বেহুলা বিহীন জলের ভেলায় ভাসমান।'

'প্রাত্যহিক' কবিতায় তিনি লিখেছেন_ 

সত্যের বল্যাৎকার দেখে/ নিরাপরাধের হত্যা দেখেও কিছুতে মুখ পারি না খুলতে।/ বুটের তলায় পিষ্ঠ সারাদেশ/বেয়োনেটবিদ্ধ যাচ্ছে বয়ে রক্তস্রোত কত যে মায়ের অশ্রুধারা।

'এখানে দরজা ছিল' কবিতায় কবি লিখেছেন_ এখানে দরজা ছিল, দরজার ওপারে মাধ্বীলতার একান্ত শোভা।/ 'এখন এখানে কিছু নেই, কিছু নেই।/ শুধু এক বেকুব দেয়াল, শেল খাওয়া, কেমন দাঁড়ানো একা/ কতিপয় কলঙ্কিত ইট আছে পড়ে ইতস্তত।' 

'তুমি বলেছিলে' কবিতায় পাকহানাদারদের বিভৎসতার দৃশ্য এমন_ 

'দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছে ঐ নয়াবাজার/আমাদের চৌদিকে আগুন/গুলির ইস্পাতি শিলাবৃষ্টি অবিরাম/তুমি বলেছিলে_ 'আমাকে বাঁচাও'/ অসহায় আমি তাও বলতে পারিনি।' 

অর্থাৎ যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের নির্মম নিষ্ঠুর ঘটনাবলি শামসুর রাহমানকে করে তুলেছিল বড় অস্থির। বাংলাদেশই যেন কেবল রক্তাক্ত হয়নি, রক্তাক্ত হয়েছিল কবির অন্তরও। তাই তো মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শাণিত হয়েছে শামসুর রাহমানের কবিতাবলি। পাকহানাদার দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সাজিয়েছেন রক্তিম পঙক্তিমালা। উৎসাহের অনলে তা দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের হৃদয়ে। দেশের জন্য লড়েছেন কলমের তরবারি হাতে। শুধু তাই নয়, যুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশের নানা অনিয়ম, অনাচার, অবিচার আর মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক মূল্যায়ন না হওয়ায় এবং পক্ষান্তরে স্বাধীনতা বিরোধীদের আস্ফালন দেখে স্তম্ভিত হয়েছেন কবি। লিখেছেন ক্ষোভের অনলবর্শী পঙক্তিমালা। যে আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যুদ্ধ করেছিল বীর বাঙালি, তার প্রতিফলন যেন হয়নি, তার প্রিয় স্বদেশ যেন দুঃসময়ের মুখোমুখি। এই দুঃসময়ের কারণ যেন রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অসুস্থ সমাজ ব্যবস্থা। যুদ্ধোত্তরকালের দাঙ্গা হাঙ্গামা, প্রতিদিনের মর্মান্তিক ঘটনা, রাজনৈতিক নেতাদের চরিত্রহীনতা যেন এক সাগর রক্তের বিনিময়ে কেনা স্বাধীনতাকেই করেছে প্রশ্নবিদ্ধ। তাই তো ক্ষুব্ধ কবি লিখেছেন_ 

'যৌবন দুর্ভিক্ষ-বিদ্ধ/ দাঙ্গা হাঙ্গামায় ভাঙে দেশ/এদিকে নেতার কণ্ঠে নির্ভেজাল/ স্বদেশি আকুতি ভাষা খোঁজে, আদর্শের ভরাডুবি/মহাযুদ্ধ শেষে মঞ্চ তৈরি, কে হবে নায়ক তবে? করি তার স্তুতি!' (আত্মজৈবনিক: দুঃসময়ের মুখোমুখি) 

প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা দেশ ও জাতির দ্বারা দুর্ভাগ্যজনকভাবে নিগৃহীত হলেও, সার্টিফিকেট ব্যবসার মাধ্যমে অনেকেই সেজেছেন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধ না করেও পুনর্বাসিত হয়েছে অনেকেই। অথচ অনেক মুক্তিযোদ্ধাই এখনো করছে মানবেতর জীবন-যাপন। অথচ পাকহানাদারদের যারা দোসর ছিল, রাজাকার, আলবদর ছিল, এদেশীয় স্বার্থান্বেষী এজেন্ট ছিল, যারা যুদ্ধের সময় লুটতরাজ করে রাতারাতি হয়েছে কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক। তারাই সগর্বে পেয়েছে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা। তাই তো ক্ষোভে দুঃখে শ্লেষ প্রকাশ করেছেন কবি। ব্যাঙ্গাত্মক কবিতার পয়ারে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেছেন_ রাজাকার হওয়াই যেন ভালো ছিল। সুতরাং মহান প্রভু যেন সেই ঘৃণিত রাজাকারই বানিয়ে দেন তাঁকে। ব্যাঙ্গাত্মক শব্দের দ্যোতনায় শামসুর রাহমান ধারণ করেছেন নষ্ট সময়কে। তিনি লিখেছেন_ 

'হে পাক পরওয়ারদেগার, হে বিশ্বপালক/আপনি আমাকে লহমায় একজন তুখোড় রাজাকার করে দিন।/তাহলেই আমি দ্বীনের নামে/ দিনের পর দিন তেলা মাথায় তেল ঢালতে পারব অবিচল/গরিবের গরিবী কায়েম রাখবো চিরদিন/আর মুক্তিযোদ্ধাদের গায়ের চামড়া দিয়ে/ ডুগডুগি বানিয়ে নেচে বেড়াবো দিগ্বিদিক/আর সবার নাকের তলায় একনিষ্ঠ ঘুণপোকার মতো/ অহর্নিশ কুরে কুরে খাবো রাষ্ট্রের কাঠামো অবকাঠামো।' 

(একটি মোনাজাতের খসড়া: দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে)। 


পরিশেষে, একথা বলা যায় যে, কবি শামসুর রাহমান যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জ্বালা, যন্ত্রণা, ক্ষোভ, ক্রোধ, ঘৃণা প্রভৃতিকে যেমন নিজের করে নিয়েছিলেন, তেমনি পাকবাহিনীর অত্যাচার নিপীড়নের মর্মান্তিক ঘটনাবলিও ধারণ করেছিলেন হৃদয়ের নিভৃত কন্দরে। আর তার বহির্প্রকাশ যেন আমরা খুঁজে পাই তার কবিতার পরতে পরতে। শুধু যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের মর্মবেদনাই কবি ধারণ করেননি তার কবিতার আকাশে, সেই সঙ্গে যুদ্ধোত্তর কালের বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাহীনতার বিপক্ষেও ছিলেন সোচ্চার। 

কাব্যচর্চার প্রথম দিকে শামসুর রাহমান অসম্ভব রোমান্টিক ছিলেন। সে সময়ে নারী, প্রকৃতি, প্রেম ইত্যাদি তার কবিতায় ঝঙ্কৃত হলেও পরবর্তীতে গণআন্দোলন, স্বদেশ ও স্বাধীনতার চেতনা, অভ্যুত্থান, যুদ্ধোত্তরকালীন বাংলাদেশে কবির অভিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান তার কবিতাকে করেছে ঋদ্ধ ও সুখপাঠ্য। শামসুর রাহমানের রচনা সম্ভারের একটা বিশেষ অংশই দখল করে আছে বাঙালি জীবনের অবিস্মরণীয় মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

3 মন্তব্যসমূহ