কল্লোল-এ সমাহিত উৎপল দত্ত | আর্য চ্যাটার্জী




পোস্ট বার দেখা হয়েছে
                                          ছবি সংগৃহীত


কল্লোল-এ সমাহিত উৎপল দত্ত

আর্য চ্যাটার্জী


বেলুড় বিদ্যামন্দির কলেজে (রামকৃষ্ণ মিশন) সবে ভর্তি হয়েছি তখন, ইংরেজি সাম্মানিক স্নাতক স্তরে প্রথম বর্ষ । হোস্টেলের জীবন বড় কঠিন ওখানে। বাইরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন প্রায়। কিন্তু ১৯৯৩ সালের আজকের দিনটায় হস্টেলের সব পাঁচিল ভেঙ্গে ঢুকে পড়েছিল একটা খবর -- উৎপল দত্ত চলে গেলেন, ইহলোক ত্যাগ করে। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে মাথার ক্যামেরায় ভেসে উঠল, দেসদিমোনাকে ওথেলো-র হত্যা করার দৃশ্য, ‘আগন্তুক’, ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’, ‘গোলমাল’ আরো কত কি, যা আ র তৈরী হবে না।

২০২০ তে অভূতপূর্ব কোভিড-দশায় আমরা সবাই আমাদের নিজেদের দেশে গত কয়েকমাসে যত ইন্দ্রপতন দেখেছি, তাতে এই রকমের মৃত্যুসংবাদ বোধহয় মোটামুটি গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। সে রকম কিছু মৃত্যু অদূর ভবিষ্যতে ঘটলে আমরা শুধু ভাবব ‘আবার…!’ এবং তার পর দু-তিন দিন মজে থাকব ফেসবুকে তাঁদের হারানোর দুঃখের প্রকাশে, স্মাইলি ও RIP (rest in peace) লিখে। তাই আজ উৎপল দত্তের তিরোধান দিবসে তাঁকে স্মরণ করা নিতান্ত এক পানসে ব্যাপার লাগতেই পারে। আসলে কি জানেন, তাঁর মত মানুষের ব্যাপ্তি ঠিক তাঁর সারাজীবনে একশো-র ওপর সিনেমায় অভিনয় বা ক’টা নাটক তিনি করেছেন ওই পরিসংখ্যান দিয়ে মাপা যাবে না। অভিনয়ের যে ভিত তিনি গড়ে গিয়েছেন, স্টেজে এবং স্ক্রিনে, তার ওপরেই বোধহয় বহুতল গড়ে উঠছে আজও।

                          ছবি সংগৃহীত


যেমন  ধরুন, দেশ স্বাধীন হল ১৯৪৭ সালে। উৎপল দত্ত তখন সবে বালক থেকে কিশোরে পরিণত হয়েছেন। কিন্তু সেই মানসিক গঠন অন্যান্য কিশোর দের থেকে এতটাই এগিয়ে যে স্বাধীনতার আড়ালে একই বছরে তিনি স্থাপন করলেন ‘দ্য শেক্সপীরিয়ণস’ নামে নাটকের গ্রূপ।নিজে রাজা তৃতীয় রিচার্ড-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন ঊইলিয়ম  শেস্কপিয়্যরের ‘Richard III’ নাটকের অসামান্য উপস্থাপনায়। এক দানে নজর কাড়লেন ওই বয়েসে ‘শেক্সপীরিয়্যণ থিয়েটার কোম্পানী’-র। কর্ণধার জিওফ্রে ও ল্যরা কেণ্ডাল ওই অসামান্য প্রতিভাকে নিজেদের দায়িত্বে টেনে নিয়ে বিকাশ ঘটালেন তাঁর। ‘Othello’- তে ওথেলোর ভূমিকায় যা ঘটালেন, কেঁপে গেল সব। ভূমিকম্প হল স্টেজে। ভারত-পাকিস্তানে চলতে লাগল শো-এর এর পর শো। যখন ‘সপ্তপদী’ তৈরী হল ১৯৬১ সালে, উত্তম-সুচিত্রা জুটি-তে, তাতে ‘ওথেলো’ অংশ-টিতে আমরা এই জুটিকে অন-স্ক্রিন দেখে থাকলেও, ওথেলোর ভয়েস ডাব করা হল উৎপল দত্ত ও জেনিফার কেণ্ডাল-এর কণ্ঠে। না হলে বোধ হয় ওই দৃশ্য এমন চিরকালীন হয়ে যেত না, বাঙ্গালী মনে। পরিচালক অজয় কর এটা করার জন্য দ্বিতীয় কোনো উপায়ের কথা ভাবেন নি। 

                         ছবি সংগৃহীত

কেণ্ডাল-রা ভারত ছেড়ে চলে গেলেন বটে। কিন্তু নাটকের দল উঠল না। উৎপল দত্ত নতুন করে ঢেলে সাজালেন দলকে। নতুন নামকরণ হল – ‘Little Theatre Group’ (LTG)। পরের তিন বছর ধরে চলল টানা অভিনয়। বার্নার্ড শ্য’, ইবসেন, গর্কি, রবীন্দ্রনাথ- কেউ বাদ গেলেন না। কাজের প্রসার ব্যপ্ত হতে হতে এমন জায়গায় পৌছাল যে, আবার নতুন করে ভাবতে বসলেন উৎপল। সিদ্ধান্ত হল, যে তাঁরা একটি সিনেমা প্রোডাকশন হাউস খুলবেন এবং তার থেকেও বড় কথা এবার থেকে তাঁরা শুধু বাংলা নাটকই করবেন।

বাংলার গ্রামে গঞ্জে নাটকের বিস্তার ছিলই, ‘গণনাট্য সংস্থা’-র হাত ধরে। উৎপল দত্ত আজীবন তার সদস্য ছিলেন। তাই এবারে দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে নাটক ও অভিনয়-কে ছড়িয়ে দিতে উদ্যোগী হলেন তিনি ও তাঁর দল। বামপন্থী ভাবধারায় গঠন করলেন ‘Indian People’s Theatre Association’। লিখতে লাগলেন ‘Epic Theatre’। কয়েক বছরেই বুঝলেন, ভাবধারা অক্ষুণ্ণ রেখেই, যে কাজের গণ্ডী সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। শেক্সপীয়্যর-এর পরে যদি তাঁর ভাবগুরুর কথা বলতে হয়, নিঃসন্দেহে তিনি হলেন বার্টোল্ড ব্রেশট। তাই IPTA ছেড়ে শুরু করলেন নিজের নাটকের দল, আবার। শুনলে অবাক হবেন, কলকাতায় কিন্তু তখন ‘ব্রেশট সোসাইটি’ নামে একটি সংস্থা ছিলই ১৯৪৮ সাল থেকে, যার কর্ণধার ও সভাপতি ছিলেন সত্যজিৎ রায় স্বয়ং। ব্যাস। ঝিলমিল লেগে গেল উৎপল দত্তের নাট্যদর্শনে। ব্রেশট-এর ভাবধারায় নতুন করে দীক্ষিত হলেন তিনি। বুঝলেন ‘Epic Theatre’ ভারতীয় সমাজে খুব একটা চলনসই কিছু হবে না। ব্রেশট-এর কাছ থেকে সবথেকে বড় শিক্ষা তিনি পেলেন একটি বিষয়ে যে নাটকের দর্শক কিন্তু প্রতিটি নাটকের সহ-নাট্যকার ও লেখক। Group Theatre তাঁর হাত ধরে পেল নতুন মোড়। মনে হল ১৯৪৭ সালে যে স্বপ্ন নিয়ে তিনি শুরু করেছিলেন, তা  বাস্তবায়িত হল, এতদিনে, অন্য রূপে,সজ্জা্ বিন্যাসে ও বিস্তারে।

         ছবি সংগৃহীত


সাউথ পয়েন্ট স্কুলের ইংরেজী ভাষার শিক্ষক – এটা ছিল তাঁর আত্মার টান। ত্যাগ করেন নি সেটা, এত কাজের ভিড়েও। কারণ তাঁর জীবনের আদর্শে কোথাও জোরালো ভাবে ছিলেন হেনরী লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। ইয়ং বেঙ্গল মুভমেন্টের কথা বলতে গিয়ে ডিরোজও তো এসেই যান। তার সাক্ষ্য রেখে গিয়েছেন উৎপল দত্ত, তাঁর ডিরোজিও-র ভূমিকায় অভিনয়ে, ‘ঝড়’ সিনেমাটিতে।মাইকেল মধুসূদন দত্তের নাম ভূমিকায় অভিনয় আমদের কাছে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও মহান অভিনেতা উৎপল দত্ত, দুই দত্তের অসামান্য সেতুবন্ধন, চিন্তার রূপরেখায়। ভারতের নৌ-বিদ্রোহ নিয়ে তাঁর নাটক ‘কল্লোল’ এমন ঢেউ তুলল, যে তৎকালীন কংগ্রেস সরকার তাঁকে জেলে বন্দী করতে বাধ্য হল। জেলে বসেই জেলের মধ্যে নাটকের অভিনয় হল, নতুন লেখা নাটক ‘লৌহমানব’-এর। লেখা হল ‘টিনের তলোয়ার’ বার্নার্ড শ্য এর ‘Pygmalion’ এর অনুসরণে। ১৯৭০ এ তিনটি নাটক ব্যান্-ড হল সরকারী উদ্যোগে - ‘ব্যারিকেড’, ‘দুঃস্বপ্নের নগরী’ ও ‘এবার রাজার পালা’। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭-এ ভারতে যখন ‘ইমার্জেন্সি’ তখন কিছুর তোয়াক্কা না করেই উৎপল দত্ত অ্যান্টি-এশট্যাবলিশমেন্ট ও গভর্ন্যান্স আক্রমণ শানিয়ে গেলেন, একনাগাড়ে, বুক ঠুকে ‘ম্যাকবেথ’ স্টেজ করে। 

এ হেন ব্যাক্তিকে ঠেকিয়ে রাখা সত্যিই দায়! বিপ্লব ছড়াল বাংলার যাত্রাপালা অবধি। বামপন্থী ভাবধারায় আর্দ্র সে সব সৃষ্টি ছড়িয়ে পড়ল বাংলার দিক-বিদিকে। কেউ আটকাতেই পারল না। কারণ, তিনি নিজে অভিনয় করতে লাগলেন, লাগাতা্র, সেই সব যাত্রাপালায়। 

ছবি সংগৃহীত


সিনেমার জগতে তাঁর অবদান আমাদের অনেকটাই জানা। সে ‘গোলমাল’ হোক, বা ‘হীরক রাজার দেশে’ বা ‘আগন্তুক’, তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য কেউ আরও ভাল কেউ করতে পারতেন বলে কেউ বিশ্বাস-ই করতে পারব না আমরা।‘পার’ ও ‘পদ্মানদীর মাঝি’-তেও অসামান্য তিনি। হেন স্বনামধন্য পরিচালক নেই, যাঁদের কাজ তাঁর হাত না ধরলে অসম্পূর্ণ থেকে যেত। সত্যজিৎ রায় নিজে,মৃনাল সেন, গৌতম ঘোষ, জেমস আইভরি, ঋত্বিক ঘটক, হৃষিকেশ মুখার্জী, বাসূ চ্যাটার্জী, শক্তি সামন্ত – কে নেই সেই তালিকায়! তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে জাতীয় পুরস্কার তো আর এমনি এমনি পান নি!

শেষে উনি চলে যাওয়ার পরেও ‘The Last Lear’ নামে ঋতুপর্ন ঘোষ একটি সিনেমা তৈরী করে শ্রেষ্ঠ ছবি হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পান। সিনেমার গল্প ছিল একজন শেক্সপীয়্যর-পাগল অভিনেতা কে নিয়ে।

বলাই বাহুল্য যে, তিনি কে! 


তথ্যঃ আন্তর্জাল ও উইকিপিডিয়া

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

3 মন্তব্যসমূহ