অনুষ্টুপ ছন্দ || কৌশিক চক্রবর্তী




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

বাংলা কবিতায় আদি বৈদিক ছন্দ "অনুষ্টুপ" , লিখছেন কৌশিক চক্রবর্তী

ভাষার বিবর্তনগত সময়গুলো ধীরে ধীরে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় প্রতিযুগে বদলেছে কবিতার কাব্য চেহারা। প্রচলিত সাহিত্যভাষার মোড়ক খুলে কবিতা হয়েছে চলতি সময় ও কথ্যভাষার জীবন্ত দলিল। এর সঙ্গে সঙ্গে বদলে বদলে গেছে ছন্দের ও ছন্দবিভাগের প্রকৃতিও। এর আগে কয়েকটি পর্বে সহজ ভাবে আলোচনা করার চেষ্টা করেছিলাম বিভিন্ন সংস্কৃত ছন্দের বাংলা কবিতায় প্রয়োগের বিষয়ে। বলেছি মন্দাক্রান্তা, তোটক ছন্দের দল বা অক্ষরের সাজ। কিন্তু সংস্কৃত কাব্যে যে ছন্দকে আদিছন্দ বা প্রথম ছন্দ হিসাবে ধরা হয় তা হল অনুষ্টুপ। সংস্কৃত কাব্যের আদিকবি বাল্মিকীর মুখ থেকে এই ছন্দ প্রথম সৃষ্টি হয় এবং তা কিছুটা ঘটনাচক্রেই। মহাকবি বাল্মীকি একদিন স্নানে চলেছেন। গাছে প্রেমে মত্ত একজোড়া ক্রৌঞ্চপাখিকে দেখে তিনি খুব আনন্দ পেলেন। কিন্তু তখনি ছন্দপতন। এক ব্যাধের তীরে হঠাৎ মৃত্যুকোলে ঢলে পড়লো পুরুষ ক্রৌঞ্চ। তার যন্ত্রণা ও নারীক্রৌঞ্চের আর্তনাদ সহ্য করতে না পেরে কিছুটা নিজের অজান্তেই সেই শোক ছন্দের আকারে বেরিয়ে আসে ঋষি বাল্মীকির মুখ থেকে। বলা হয় তাঁর এই শ্লোক থেকেই বাংলায় 'শোক' শব্দটির বিবর্তন।

"মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।

যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্।।"

এটিই সর্বপ্রথম রচিত সংস্কৃত শ্লোক হিসাবে ধরা হয়। এবার আসি এটির ছন্দ বিশ্লেষণে। এই দুটি চরণ যে বৈদিক ছন্দের চলনে বাঁধা তা হল অনুষ্টুপ। বলাই বাহুল্য, মহাকবি বাল্মীকি সম্পূর্ণ রামায়ণ এই ছন্দেই লিখেছিলেন। এমনকি মহাকবি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস রচিত মহাভারতও অনুষ্টুপ ছন্দে রচিত। সংস্কৃত কাব্যে ছন্দবিলাস বহু রকমের। আগেই বলেছি সংস্কৃতে কমবেশি প্রায় ১৫০০ রকমের ছন্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। তারমধ্যে আদি ছন্দ অনুষ্টুপ৷ অনুষ্টুপ ছন্দে প্রতি চরণ আটটি অক্ষরে বাঁধা এবং সর্বোপরি চারটি চরণবিশিষ্ট। প্রতি আট অক্ষরের পরে যতির ব্যবহার লক্ষ্যনীয়। সংস্কৃত ছন্দগণনায় প্রধান বিচার্য বিষয়টি হল শ্বাসের সময় ভেদ। অনুষ্টুপের ক্ষেত্রে প্রতি চরণে আটটি অক্ষরের সজ্জাও কিছু ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নিয়মে বেঁধেছেন বৈদিক আচার্য কবিরা। সেই অক্ষর বিভাজন নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক-

অনুষ্টুপ ছন্দে আটটি অক্ষর বা দলের (বাংলা কবিতায় দল শব্দটি ব্যবহৃত হয়) মধ্যে পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম অক্ষরে ব্যবহার একেবারে নিয়মে বাঁধা। বাকিগুলো দীর্ঘশ্বাস, হ্রস্বশ্বাস যা খুশি হতে পারে। সাধারণত ষষ্ঠ অক্ষরটি প্রতি চরণে গুরু(দীর্ঘ) এবং পঞ্চম অক্ষরটি লঘু (হ্রস্ব)। আর সপ্তম অক্ষরটি দ্বিতীয় ও চতুর্থ চরণে লঘু অর্থাৎ হ্রস্বশ্বাস। প্রথম ও তৃতীয় চরণে এর কোনও নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। অর্থাৎ -

- / - / - / - / তা / ধিন / - / -

- / - / - / - / তা / ধিন / তা / -

- / - / - / - / তা / ধিন / - / -

- / - / - / - / তা / ধিন / তা / -

'-' চিহ্নগুলোর অর্থ হ্রস্ব বা দীর্ঘশ্বাসের (বাংলা ছন্দে রুদ্ধ ও মুক্তদল) কোনও নিয়ম নেই। আর 'তা' ধ্বনিতে দীর্ঘশ্বাস বা মুক্তদল ও 'ধিন' ধ্বনিতে হ্রস্বশ্বাস বা রুদ্ধদল বোঝানো হল। এবার উদাহরণ দেখা যাক -

"ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে 

সমবেতা যুযুৎসবঃ।

মামকাঃ পান্ডবাশ্চৈব 

কিমকুর্বত সঞ্জয় ॥"

 - শ্রীমদ্ভাগবত গীতা

ধর / ম / ক্ষে / ত্রে / কু(লঘু) / রু:(গুরু) / ক্ষে / ত্রে

স / ম / বে / তা / যু(লঘু) / যুৎ(গুরু) / স(লঘু) / ব

মা / ম / কা: / পান্ / ড(লঘু) / ব:(গুরু) / শ্চৈ / ব

কি / ম / কুর‍্ / ব / ত(লঘু) / সন্(গুরু) / জ(লঘু) / য়

আগেও বলেছি বাংলা কবিতায় সংস্কৃত ছন্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে ছন্দের যাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লঘু অক্ষরকে রুদ্ধদল ও গুরু অক্ষরকে মুক্তদলে উপস্থাপনা করেছিলেন। 

যদিও অনুষ্টুপ ছন্দ বাংলা কবিতায় সেভাবে ব্যবহার কখনোই খুবএকটা হয় নি। কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের নিয়ম মেনে যদি দুলাইন তৈরি করা যায় তবে তা নিছক মন্দ হবে কি? যেমন -

"সন্ধ্যা বাড়ছে গোপন পাড়ের

ভাঙছে শরীর নিয়মমাফিক 

মাঝের কৈশোর আঁচড় হাতড়ায়

বাঁধছে শৈশব অপর সে'দিক"

এবার নিয়ম মেনে দেখুন তো। মিলিয়ে নিন অনুষ্টুপের নিয়মে -

সন্ / ধা / বাড় / ছে / গো (মুক্ত) / পন্ (রুদ্ধ) / পা / ড়ের

ভাঙ / ছে / শ / রীর / নি (মুক্ত) / য়ম (রুদ্ধ) / মা (মুক্ত) / ফিক

ঠিক এই নিয়মেই আরও দুটি চরণ। ওটা আপনাদের মিলিয়ে দেখার জন্য রেখে গেলাম। 

আর হ্যাঁ, অনুষ্টুপের প্রয়োগ বাংলা কবিতায় আনার লোভ সামলাতে না পেরে  এই চারটি চরণ এখনি লিখলাম। আমার কোনও কবিতার অংশ নয়। আপনারাও যদি চেষ্টা করেন, তাহলে কিন্তু অবশ্যই পড়াবেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ