বাংলা কবিতায় || মালিনী ছন্দকৌশিক চক্রবর্ত্তী




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

বাংলা কবিতায় মালিনী ছন্দ, কলমে , কৌশিক চক্রবর্ত্তী

নিয়মিত লিখছি বাংলা কবিতায় সংস্কৃত ছন্দের প্রয়োগের বিষয়ে। আগে আলোচনার মাধ্যমে তুলে ধরেছিলাম মন্দাক্রান্তা, তোটক, অনুষ্টুপের মত জনপ্রিয় সংস্কৃত ছন্দগুলো। আরও কয়েকটি অতি প্রচলিত ছন্দ নিয়ে লিখব বলে মনস্থির করেছি। জানিনা পারব কতটা। কিন্তু চেষ্টা করতে ক্ষতি নেই। 

বলতে গেলে ছন্দ কোথায় নেই? হাঁটায় ছন্দ, খাওয়ায় ছন্দ আবার কথা বলাতেও ছন্দ। আগেও বলেছি ছন্দ একটা তালের বোধ, চলনের ঢঙ। অনেকেই আজকাল বলেন কবিতা ছন্দে লেখার কোনও প্রয়োজন নেই। ছন্দ নাকি কবিতাকে বেঁধে রাখে। এ কোন যুক্তি আমি বুঝি না। গাড়ি চালাতে গেলে সবসময় সব গিয়ারের প্রয়োজন না পড়লেও যেমন গিয়ারের প্রয়োগ জানা প্রয়োজন, সঠিক সময়ে ব্রেকে পা খানা পৌঁছানোর কৌশল শেখা প্রয়োজন, ঠিক তেমনই কবিতার ক্ষেত্রে ছন্দবোধ। কবিতাকে ছন্দে বাঁধতে হয় না। ছন্দই হল কবিতার মুক্তি। আদিকবি বাল্মীকির মুখ দিয়ে প্রথম নিঃসৃত শ্লোক অনুষ্টুপ ছন্দে বেরিয়েছিল। তাঁকে ভেবে চিন্তে পংক্তিদুটিকে ছন্দে বাঁধতে হয় নি। যাই হোক, ছন্দের ওকালতি ছেড়ে ফিরে আসি আলোচনায়। আজ আর একটি সংস্কৃত ছন্দের অক্ষরসজ্জা নিয়ে যতটা সহজ করে পারা যায় আলোচনা করা যাক। ছন্দটির নাম মালিনী। আমরা এর আগে দেখেছি মন্দাক্রান্তার প্রতি চরণে ১৭ অক্ষর থাকে। ঠিক তেমনই মালিনী ছন্দের প্রতি চরণ ধরে রাখে ১৫ টি অক্ষরকে। প্রত্যেকটি সংস্কৃত ছন্দের মতোই এরও অক্ষরের সজ্জা নির্দিষ্ট। যেমন- 

তা / তা / তা / তা / তা / তা / ধিন / ধিন  (যতি)

ধিন / তা / ধিন / ধিন / তা / ধিন / ধিন।।

'তা' অর্থে মুক্তদল আর 'ধিন' অর্থে রুদ্ধদল। অর্থাৎ ছন্দের যাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের শিখিয়ে যাওয়া নিয়মে সংস্কৃত অক্ষরের লঘু অক্ষরকে মুক্তদল ও গুরু অক্ষরকে রুদ্ধদল ধরে নিলে বাংলা কবিতায় মালিনী ছন্দের স্বরূপ ঠিক এমনই দাঁড়ায়। দেখলেই বোঝা যাচ্ছে সম্পূর্ণ চরণে ১৫ টি অক্ষর বা দলের সজ্জা স্পষ্ট। এবার আসা যাক যতির বিষয়ে। যতি অর্থে ছেদ। সংস্কৃত ছন্দশাস্ত্র অনুযায়ী মালিনী ছন্দের প্রথম যতি অষ্টম অক্ষর বা দলের পরে হয়। অর্থাৎ ১৫ অক্ষরের চরণে ৮ম অক্ষরের পর সামান্য থামতে হয়, আর এটিই হল মধ্যযতি। এরপর পূর্ণযতি চরণের শেষে। অর্থাৎ ১৫ টি অক্ষরের পরে। আমারই লিখিত একটি কবিতার অংশ তুলেই বিশ্লেষণ করে দেখা যাক -

এখনো নামেনি সন্ধ্যার স্তব্ধতার দৃপ্ত বন্ধন

পুড়িয়ে দিয়েছ সেই রূপ ধ্বস্ত তার অণুসিঞ্চন। 

নিভেছে যেখানে শৈশব, খর্ব সেই নীল স্বরূপ দান

ঝরেছে পাতারা রাত্রির, বিস্মরণ সব শিরস্ত্রান।।

অর্থাৎ দলভেদ করে যদি প্রথম চরণটি বিশ্লেষণ করা যায়, তাহলে দেখা যাবে -

এ / খ / নো / না / মে / নি / সন্ / ধার  (যতি)

স্তব্ / ধ / তার‍্ / দৃপ্ / ত / বন্ / ধন্। 

অর্থাৎ -

মুক্ত / মুক্ত / মুক্ত / মুক্ত / মুক্ত / মুক্ত / রুদ্ধ / রুদ্ধ (যতি)

রুদ্ধ / মুক্ত / রুদ্ধ / রুদ্ধ / মুক্ত / রুদ্ধ / রুদ্ধ।

এই হল মালিনী ছন্দের বাংলা কবিতায় প্রয়োগের কৌশল। মহাকবি কালিদাস তাঁর অভিজ্ঞানম্ শকুন্তলম্ কাব্যে এই ছন্দের বহুল প্রয়োগ করেছিলেন। আগেও বলেছি, ছন্দের যাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলা কবিতায় এইসব প্রাচীন ছন্দের প্রয়োগের কৌশল যেভাবে অতি সরল ভাবে শিখিয়ে দিয়ে গেছেন, তার ঋণ কখনোই শোধ করবার নয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ