ধারাবাহিক || আলিপুর বোমা মামলা || শেষ পর্ব || অলিপা পাল




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

 আলিপুর বোমা মামলা : শ্রীঅরবিন্দ ঘোষ এর কারাকাহিনী

অলিপা পাল

শেষ পর্ব

শ্রীঅরবিন্দের কারা কাহিনী —

এক বছর স্থায়ী কারাবাসের প্রথম মূহুর্ত থেকেই শ্রীঅরবিন্দকে রাখা হয়েছিলো নির্জন কারাকক্ষে ৷ কারাকাহিনীতে তিনি লিখছেন—

 আমার নির্জন কারাগৃহটি নয় ফুট দীর্ঘ, পাঁচ ছয় ফুট প্রস্থ ছিল ৷ জানালা নেই, সামনে বৃহৎ লোহার গারদ,ঘরের বাইরে ক্ষুদ্র উঠান,পাথরের জমি, ইটের উচ্চ দেওয়াল, সামনে কাঠের দরজা ৷

এইরকম ছোট্ট ঘরে তাঁর খাওয়া থাকা নিদ্রা বিশ্রাম মলমূত্র ত্যাগ সবই করতে হত ৷ এমন ব্যবস্থা থাকায়, বিশেষত খাওয়া ও শোবার সময় অস্বস্তি ভোগ করতে হত ৷ 

শ্রীঅরবিন্দ লিখছেন—বিলাতী সভ্যতার অঙ্গবিশেষ যাকে too much of a good thing বলে ৷ আসলে আমরা কুঅভ্যাসগ্রস্ত ভারতবাসী, সভ্যতার এত উচ্চ সোপানে পৌঁছানো আমাদের পক্ষে কষ্টকর ৷

খাদ্য যা দেওয়া হত তা ছিল আতঙ্কের,মোটা চাল, তাতে মশলা থাকত তুষ, কাঁকর, পোকা,চুল প্রভৃতি দ্রব্য ৷ডাল দেওয়া হত বিস্বাদ জলো, তরকারী মেশানো থাকতো ঘাস পাতায় ৷পানীয় জলেরও কার্পণ্য ছিল ৷ তাঁকে একটা কম্বল, একটা থালা ও একটা বাটি দেওয়া হয়েছিলো ৷

শ্রীঅরবিন্দ লিখছেন—

আমার আদরের  বাটিও তদ্রূপ ৷

বাটির জাত নেই ,বিচার নেই, কারাগৃহের শৌচালয়ে যে বাটিতে নিলাম, সেই বাটিতেই মুখ ধুলাম,স্নান করলাম, কিছুক্ষণ পরে খাওয়ার সময় সেই বাটিতে ডাল তরকারি নিলাম এবং সেই বাটিতে জল পান ও  অচমান করা ৷ এমন সব কাজের উপযুক্ত মূল্যবান বস্তু ইংরেজের জেলেই পাওয়া যায় ৷

তাঁর এই বর্ণনা কষ্টভোগ করার জন্য নয় ৷মোকদ্দমার এক আসামী যে এখন দোষী প্রমাণ হয়নি তার জন্য অভাবনীয় ব্যবস্থা ৷কারাজীবনের সকল অমানুষিক অসুবিধাসত্ত্বেওশ্রীঅরবিন্দের দৃষ্টি ভঙ্গির বিশেষত্ব ছিল তিনি এই ব্যবস্থার প্রথাগত ত্রুটি লক্ষ্য করেছেন —কারা কতৃপক্ষের মানবিকতাবোধের কোন অভাব ব্যক্ত করেননি ৷কারাকাহিনীতে জেল সুপারিণ্টেণ্ডেণ্টের চরিত্রে সহমর্মিতা ও সহানুভূতি লক্ষ্য করেছেন ৷জেল সুপার মিঃ এমারসনকে বলেছেন,ইউরোপের লুপ্তপ্রায় খৃষ্টান আদর্শের অবতার ৷ সহকারী জেল ডাক্তার বৈদ্যনাথ চ্যাটার্জী ও তাঁর উপরস্থ ডাক্তার ডেলীর মধ্যে অনেক মানবিক গুনাবলী লক্ষ্য করেছেন ৷ ডেলীর মধ্যে আইরিশ জাতির উদারতা ও ভাবাবেগ দেখতে পেয়েছেন ৷ডাক্তার ডেলীর আজ্ঞানুসারে শ্রীঅরবিন্দকে কিছুদিন পরে সকালে ও বিকালে তাঁর কক্ষের সামনে খোলা উঠানে পায়চারী করার অনুমতি দেওয়া হয় ৷ তাঁকে বাড়ি থেকে জামাকাপড় ও বইপত্তর আনার অনুমতি দেওয়ায় মেশোমশায় কৃষ্ণকুমার মিত্রকে গীতা ও উপনিষদ পাঠাতে বলেন ৷

আধ্যাত্মিক উপলব্ধি —মুক্তি পাওয়ার পর শ্রীঅরবিন্দ উত্তরপাড়া ভাষণে বলছেন—

                  তাঁকে যখন গ্রেপ্তার করা হয়,উনার বিশ্বাস বিচলিত হয়ে উঠেছিল ৷কিছুক্ষণের জন্য দ্বিধা জন্মেছিল ৷মনে মনে ঈশ্বরকে বলেছিলেন —তাঁর এমন কেন হল ?তাঁর স্থির বিশ্বাস ছিল যে উনি দেশের কাজের জন্য মনোনীত,উৎসর্গীকৃত ৷

যতদিন না সেই কাজ সম্পন্ন হয় ঈশ্বরের করুণা তাঁকে রক্ষা করবে ৷ তাঁর ভবনায় আসে, কেন তাকে আনা হল,আর এই অভিযোগে ? তিন দিন বাদে তাঁর মধ্যে বাণী শুনতে পেল—

'ধৈর্য ধরে অপেক্ষা কর ৷'তিনি শান্ত হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল জেলের নির্জন কক্ষে,ঈশ্বরের বাণীর অপেক্ষায় ৷ এখানেই তাঁর প্রথম উপলব্ধি ও শিক্ষা লাভ হল ৷কাজ ছিলো তাঁর সবচেয়ে প্রিয়,অহংবোধে ভাবত তাঁকে ছাড়া চলবে না কাজ সম্পূর্ণ হবে না ৷তাঁর অনুভব হল ঈশ্বর যেন তাকে বলছে ' যে বন্ধন তোমার ছিন্ন করার ক্ষমতা ছিল না তোমার হয়ে আমি ছিন্ন করলাম ' ৷তার পর গীতা তাঁর হাতে এল ৷ গীতা'র শক্তি যেন তাঁর মধ্যে প্রবেশ করল ৷ শ্রীঅরবিন্দের উপলব্ধি হল শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের কাছে কি দাবী করেছিলেন ৷ আর যারা ঈশ্বর অভিপ্রেত কর্মে আগ্রহী তাঁদের কর্তব্য কী ৷যে জেল তাঁকে মানবজগৎ থেকে আড়াল করে রেখেছে সেই দিকে তাকালো,দেখলেন তিনি আর জেলের উচ্চ দেওয়ালের মধ্যে বন্দী নেই,তাঁকে ঘিরে আছেন বাসুদেব ৷কারাকক্ষের বাইরে যে গাছের ছায়ায় তিনি ঘুরে বেড়াতেন দেখেন সে তো গাছ নায়,বাসুদেব ৷ লোহার গারদের জায়গায় বাসুদেব তাঁকে পাহাড়া দিচ্ছে ৷কর্কশ কম্বলে যেন কৃষ্ণের ভালোবাসা বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত ৷জেলখানার বন্দী চোর খুনী দের মধ্যে তিনি দেখতে পেতেন বাসুদেবকে ৷এদের মধ্যে এমনি একজন ছিল যাকে তিনি মনে মনে সাধুব্যক্তি বলে মানতেন—আমাদের দেশের নিরক্ষর এক চাষী,ডাকাতির মামলায় দশবছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত ৷শ্রীঅরবিন্দের মতে,আমাদের চোখে তথাকথিত ঘৃণ্য ছোটলোক বলে যাদের পরিচয় ৷ঈশ্বর যেন তাকে বললেন, এই সব লোকেদের মধ্যে কাজ করার জন্য তাঁকে পাঠানো হয়েছে ৷এই ছিলো ঈশ্বর প্রদত্ত অন্তর্দৃষ্টির প্রাথমিক পর্যায় ।

শ্রীঅরবিন্দ আরও বলেন আদালতে মামলা চলছে কেউ যেন বলছে 'আমি সকলের মধ্যে অবস্থিত এবং সকল বাক্য ও কার্যের অধিনিয়ন্তা ৷ আমার সুরক্ষা তোমাকে ঘিরে আছে,তুমি ভয় পেয়ো না, কোন ভয় দ্বিধা তোমার জন্য নয় ' ৷ শ্রীঅরবিন্দ তাকিয়ে দেখেন ম্যাজিস্ট্রেটের জায়গায় বাসুদেব বসে, নারায়ণ স্বয়ং বিচারের আসনে ৷সরকারী উকিলের দিকে তাকিয়ে দেখলো, কোথায় সরকারী উকিল ? দেখলো সেই আসনে নারায়ণ অসীন ৷

শ্রীঅরবিন্দের নিজের বক্তব্যের উপর মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন ৷শ্রীঅরবিন্দ একে বলেছেন ' বিশ্বচেতনার উপলব্ধি '(realisation of the cosmic consciousness) ৷এটি ছিলো শ্রীঅরবিন্দের দ্বিতীয় দিব্যানুভূতি ৷ প্রথমটি ব্রক্ষ্ম নির্বাণ যা তাঁর ঘটেছিল বরোদায় ৷চারটি উপলব্ধির উপর শ্রীঅরবিন্দের যোগ এবং আধ্যাত্মদর্শন স্থাপিত ৷

তিনি সাধনায় এমনি গভীরভাবে লিপ্ত ছিলেন যে,অন্য বন্দিদের স্বাভাবিক হাসিঠাট্টা,খেলাধূলা,ও কথাবার্তায় ছিলেন সম্পূর্ণ উদাসীন ৷এই সকল যুবকদের দেখে তাঁরমনে হত প্রাচীন ভারতের উন্নতমনা অসীম সাহসী পুরুষ ,যারা কোন সৎকার্যে পুনরায় ফিরে এসেছেন ৷উত্তরপাড়া ভাষণে এদের তিনি সম্বোধন করেছেন, 'অসীম সাহসী যুবকবৃন্দ' বলে ৷

নরেন গোঁসাই এর হত্যাকাণ্ডে জেলে নিরাপত্তা আরও কঠোর হয় ৷ তাকে পুনরায় নির্জনকক্ষে স্থানান্তর করা হয় ৷কিন্তু তিনি তখন সাধনায় এমনি মগ্ন যে নির্জনকক্ষ হয়ে উঠল আশ্রম বিশেষ৷ এই সময় তাঁর অতিপ্রাকৃত উপলব্ধি ঘটে ৷ তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল ,প্রায় দুই সপ্তাহকাল নির্জন কারাকক্ষে বিবেকানন্দের উপস্থিতি ও উপদেশ ৷ শ্রীঅরবিন্দ বলছেন বিবেকানন্দের উপস্থিতি তাঁকে,সকল বস্তুতে সৎচেতনার দর্শন করায় ৷

এরপর উল্লেখযোগ্য ঘটনা হয়েছিল চিত্রকলা বিষয়ে মূল্যায়ন ক্ষমতা ৷ ভাস্কর্য সম্বন্ধে সামান্য জ্ঞান থাকলেও চিত্রকলা সম্পর্কে ছিলেন অজ্ঞ ৷ধ্যান করার সময় কারাকক্ষে দেওয়ালে কয়েকটি চিত্র দেখতে পেলেন ৷

আশ্চর্য জনক ভাবে তাঁর মধ্যে শিল্পীর দৃষ্টি খুলে গেল এবং তাঁর চিত্রকলার জ্ঞান পূর্ণ হল ৷ তাঁর মতে এর মধ্যে প্রযুক্তিগত খুঁটিনাটি বাদ দিতে হবে ৷

একবার তাঁর সাধনকালে মনে হয়েছিল, হঠাৎ তিনি দেখলেন মাটি থেকে বেশ উঁচুতে তিনি উঠে গেছেন ৷

আর একবার ঊর্ধ্ব বাহু অবস্থায় ধ্যান করতে করতে তিনি ঘুমিয়ে পড়েন ৷ কারারক্ষী বাইরে থেকে এ দৃশ্য দেখে ভয় পেয়ে সংবাদ দেয় যে তিনি মারা গেছেন ৷একবার এগারোদিন উপবাসের মাধ্যমে তিনি পরীক্ষা করেছিলেন কিরূপ আধ্যাত্মিক উন্নতি তাঁর লাভ হয় ৷ যদিও ১০পাউণ্ড ওজন তাঁর কমে যায়,কিন্তু সাস্থ্যেল কোন ক্ষতি হয়নি ৷ এই সময় তিনি মাথার উপর এক ঘড়া জল তুলতে পারতেন যা অন্য সময় পারেননি ৷

আরেকটি অসাধারণ ঘটনা, এই সময় তাঁর চুল সবসময় চকচক করত ৷তাঁর এক সহবন্দী সাহস করে প্রশ্ন করেছিলেন, ' আপনি কি চুলে তেল মাখেন '?শ্রী অরবিন্দ তাকে অবাক করেদিয়ে বলেন,' না, আমি বর্তমানে স্নানই করি না ৷আধ্যাত্মিক সাধনার মাধ্যমে শারীরিক পরিবর্তনের  মধ্য দিয়ে আমি এখন চলেছি ৷আমার চুল শরীর থেকে প্রয়োজনীয় তেল সংগ্রহ করছে ' ৷

এই সকল প্রকৃতি সম্পর্কে বিজ্ঞানের যুক্তি আমাদের অজানা ৷ এটাও আমাদের জানানেই  কাল্পনিক গল্প হিসাবে গণ্য হবে কিনা  ৷শ্রীঅরবিন্দের জেলখানার অভিজ্ঞতার ঘটনাবলী নিজের ভাষায় তুলে ধরলাম নীরদবরণের কলম থেকে তথ্য সংগ্রহ করে ৷ নীরদবরণ শ্রীঅরবিন্দর এক শিষ্য,যিনি ১৯৩৮ -১৯৫০ সাল পর্যন্ত শ্রীঅরবিন্দের সাহিত্য সম্পর্কিত কাজের একজন সেক্রেটারি এবং তাঁর পরিচর্যাকারীদের মধ্যে একজন ছিলেন ৷

           ( সমাপ্ত)


প্রথম পর্ব পড়ুন ...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ