বাংলা কবিতায় মন্দাক্রান্তা ছন্দ || কৌশিক চক্রবর্ত্তী




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

 

_________________________________
     বাংলা কবিতায় মন্দাক্রান্তা ছন্দ
                    কৌশিক চক্রবর্ত্তী   _________________________________
আজ আলোচনার বিষয়বস্তু হল বাংলা কবিতায় সংস্কৃত ছন্দ৷ যেমন মন্দাক্রান্তা, মালিনী, তোটকম্, শিখরিনী ইত্যাদি। বাংলা সাহিত্যে মূল তিন ছন্দ (স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত) বাদ দিয়ে এইসব সংস্কৃত ছন্দের প্রয়োগ বহু কবির হাত ধরে বারবার হয়েছে বহু কবিতায়৷ ছন্দ ও মাত্রার গূঢ় কচকচানি বাদ দিয়ে একটু সরল ভাবে ব্যাখ্যার চেষ্টা করলে ক্ষতি কি? আমরা জানি বাংলা কবিতায় ছন্দ প্রধানত দল বা সিলেবল নির্ভর। অর্থাৎ মুক্তদল (স্বরান্ত) ও রুদ্ধদল (ব্যঞ্জনান্ত) বিশেষে মাত্রার চলন নির্দিষ্ট। কিন্তু সংস্কৃত ছন্দে দলবিভাগ অপ্রাসঙ্গিক। বরং ধ্বনিকে গুরুত্ব দিতে এখানে দীর্ঘশ্বাস ও হ্রস্বশ্বাস অক্ষরকেই ছন্দের মূল উপাদান হিসাবে দেখা হয়৷ দীর্ঘশ্বাস অর্থাৎ অক্ষরের দীর্ঘ উচ্চারণের সময় ও হ্রস্বশ্বাস অর্থাৎ ক্ষণিকের। শুধুমাত্র শ্বাসভেদের তারতম্য ঘটিয়ে সংস্কৃত সাহিত্যে সৃষ্টি হয় বিভিন্ন ছন্দ৷ কিন্তু আমাদের উপজীব্য মোটেই সেইসব সংস্কৃত ছন্দের পাঠ নয়, আর বলতে লজ্জা নেই আমি সেসব জানিও না। আমাদের মূল আগ্রহ হল এইসব ছন্দের বাংলা কবিতায় প্রয়োগের দিকটি। যা প্রথম সার্থক ভাবে দেখিয়েছিলেন ছন্দের যাদুকর কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। সংস্কৃতের দীর্ঘশ্বাস অক্ষরকে মুক্তদল ও হ্রস্বশ্বাস অক্ষরকে রুদ্ধদলে ফেলে তৈরি করলেন আশ্চর্য এক ছন্দের মূর্চ্ছনা। তবেই না তিনি যাদুকর! যেমন ধরা যাক মন্দাক্রান্তা। সংস্কৃত সাহিত্যের এক অতি পরিচিত ছন্দ। মহাকবি কালীদাসের রচিত মেঘদূত এই ছন্দের এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ। বাংলা কবিতায় মুক্ত ও রুদ্ধদলের এক নির্দিষ্ট সজ্জা অনুসারে পরিচালিত হয় এই ছন্দের গতিপথ। কী সেই সাজ? আসছি আসছি। আচ্ছা এমন যদি একটি চরণ হয় যেখানে দলগুলো এইভাবে সাজানো থাকে - 
'ধিন ধিন ধিন ধিন / তা তা তা তা তা ধিন / ধিন তা ধিন ধিন / তা ধিন ধিন।' 
(মোট ১৭ টি দল) 
কী ভাবছেন? ছন্দ বলতে গিয়ে অযথা নাচের ক্লাস কেন শুরু করলাম? একেবারেই না৷ আচ্ছা 'ধিন' গুলো রুদ্ধদল আর 'তা' গুলো যদি মুক্তদল ধরে নেন, তবে নিশ্চয় আর বোঝার সমস্যা থাকছে না? ব্যাস মন্দাক্রান্তা রেডি। অর্থাৎ মাত্রাবৃত্ত চলনে মাত্রা গুনলে ৮+৭+৭+৫। তাই তো? কারণ আমরা জানি মাত্রাবৃত্তে রুদ্ধদল ২ মাত্রা ও মুক্তদল ১ মাত্রা হিসাবে স্বীকৃতি পায়। আচ্ছা এবার উদাহরণের জন্য ছন্দের যাদুকরেরই শরণাপন্ন হওয়া যাক৷ 
"পিঙ্গল বিহ্বল ব্যথিত নভতল, কইগো কই মেঘ উদয় হও,
সন্ধ্যার তন্দ্রার মূরতি ধরি' আজ মন্দ্র-মন্থর বচন কও;
সূর্যের রক্তিম নয়নে তুমি মেঘ! দাও হে কজ্জল পাড়াও ঘুম,
বৃষ্টির চুম্বন বিথারি' চলে যাও অঙ্গে হর্ষের পড়ুক ধূম।"
 - (যক্ষের নিবেদন / সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত)

এইবার মন্দাক্রান্তা ছন্দের নিয়মে প্রতিটি চরণের দলসজ্জা মেলানো যাক৷ যেমন ধরুন 
পিং/গল্/বিউ/হল্  /  ব্য/থি/ত/ন/ভ/তল্  /  কই/গো/ কই/মেঘ / উ/দয় /হও,
রুদ্ধ রুদ্ধ রুদ্ধ রুদ্ধ / মুক্ত মুক্ত মুক্ত মুক্ত মুক্ত রুদ্ধ / রুদ্ধ মুক্ত রুদ্ধ রুদ্ধ / মুক্ত রুদ্ধ রুদ্ধ
এবার আর একটি কবিতার অংশ উদাহরণ হিসাবে দেখা যাক -
"নির্লোভ বিপ্লব দেখেছে নাগরিক অন্য বিদ্বেষ চোখের জল
নিশ্চল প্রস্তাব এসেছে প্রদাহের, পুড়ছে জঙ্গল অনর্গল।
সন্ধের দরজায় ঝোলানো সহবত ধার্য লেনদেন সেসব দিন
হারজিত্ নস্যাৎ অযথা দাবানল ফিরছে বিশ্বাস যা সৌখিন" 
- (হারজিত/ কৌশিক চক্রবর্ত্তী)

একই নিয়মে এই কবিতাতেও দলের সজ্জা মেলালেই মন্দাক্রান্তার নিয়মে বাঁধা যাবে। এভাবেই দল বা সিলেবলের তারতম্যের ফারাক তৈরি করে বাংলা কবিতায় প্রয়োগ করা হয় বিভিন্ন সংস্কৃত ছন্দ। আবার কখনো গল্পের ছলে আলোচনা করা যাবে অন্য কোনও ছন্দ নিয়ে। অবশ্যই আমার জানা থাকলে। আজ তবে এটুকুই। যদি কেউ মন্দাক্রান্তায় দু একটি চরণ লিখেই ফেলেন, তবে কিন্তু পড়বার অপেক্ষায় রইলাম।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ