শারদ সংখ্যা ২০২০ || গল্প || সংঘমিত্রা রায়




পোস্ট বার দেখা হয়েছে


অন্তরালে 
 সংঘমিত্রা রায় 

                             ।। এক।।

   বৈশাখ মাস ।গত  কয়েকদিন টানা গরমের পর গতকাল ভোর থেকে বৃষ্টি নেমেছে। বৃষ্টি নামায় অনেকটা গরম কমেছে । 

     সকাল নটা বাজে। এখন বৃষ্টি নেই । সহেলী দেবী হাসপাতালে বেরুনোর সময় ঠাকুর ঘরের দিকে চোখ পড়ল। এখন ও পূজো হয়নি দেখে তার মেজাজ বিগড়ে গেল । রমলা সামনেই ছিল তার দিকে তাকিয়ে বললেন ,  "নটা বাজে আমাদের  যাবার সময় হয়ে গেছে এখন ও পূজো দেওয়া হয়নি ? উনি কোথায় রমলা তাকে তো দেখতে পাচ্ছি না ?"

    " জানি না বৌদিমণি ঠাকুমা তো এখানে আসেননি। অন্যদিন তো এসময় তার পূজো শেষ হয়ে যায় ।  আমার ও আসতে দেরী হয়ে গেছে তাই এসেই কাজে লেগে গেছি।"

  " ঔ মহিলার না কোন দায়িত্ব জ্ঞান নেই । সারাদিন তো শুয়ে বসেই থাকেন । শুধু পূজো দিতে হয় তাও উনি পূজো দিতে পারবেন না ।এ কথা আগে জানালে ভালো হত না । আমি ঠাকুরমশাইকে খবর দিতাম। এখন কি হবে এতো বেলা অবধি পূজো দেওয়া হয়নি । আর এসব যন্ত্রণা ভালো লাগে না । পুজো না হলে বাড়ী থেকে বেরিয়ে যেন সব কাজে বাধার সম্মুখীন হই আমি !"
  " কি হয়েছে সহেলী বেরোবার সময় এতো রেগে যাচ্ছ কেন?"
  " রাগব না । তোমার মা এখনো পূজো দেননি। উনি আরাম করে ঘুমোচ্ছেন।"
      " সেকি ! মা যে কি করে না ! এই রমলা উনাকে ডেকে আন স্নান সেরে পূজোটা দিয়ে দিলে আমাদের ও যেতে ভালো লাগবে ।"
   " যাচ্ছি দাদাবাবু  ।"
    রমলা সরস্বতী দেবীর  ঘরে গিয়ে যা দেখল তারপর ছুটতে ছুটতে এসে  বলল," দাদাবাবু তাড়াতাড়ি আসেন।"
   " কেন কি হয়েছে? "
   " ঠাকুমা মেঝেতে পড়ে আছেন । তার  শরীর ঠান্ডা !"
   " কি বলছিস? "
    " উনার যা স্বভাব হয়তো গরম লাগছিল তাই বিছানা ছেড়ে মেঝেতে আরাম করে  শুয়ে আছেন।  তুই কি দেখতে কি দেখেছিস রমলা । বেরোনোর সময় যত ঝামেলা ! আজ আমাকে আবার হাসপাতাল থেকে মায়ের বাড়ী যেতে হবে !"
   " সেটাই হবে  আমরা যাই উনাকে ডেকে নিয়ে আয়।"
   " না না দাদাবাবু একবার উনাকে দেখে যাও আমার কেমন যেন ভয় করছে ।"
  " ঠিক আছে এতো করে যখন বলছিস তাহলে দেখেই যাই  ।"

    হিমব্রত বাবু সরস্বতী দেবীর ঘরে যান। সহেলী দেবী ও গজগজ করতে করতে  পিছু পিছু যান ।গিয়ে দেখেন মেঝের উপর সরস্বতী দেবী পড়ে আছেন । তার শরীর বরফের মতো ঠান্ডা, শক্ত হয়ে গেছে অনেকটা । বেশ কয়েক ঘণ্টা আগে মারা গেছেন সরস্বতী দেবী !
    
ডাঃ  হিমব্রত  সেনের মাতৃবিযোগের খবরটা মুহূর্তেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। তাদের প্রতিবেশীরা অনেকেই এলেন ,  উনার কলিগরা  , ভাইদের   কলিগরা মোটকথায় যারা যারা জানতে পেরেছেন সবাই তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসেছে । বাড়ীর সামনে  উনাকে শুয়িয়ে রাখা হয়েছে । এতো লোক আসছে তাদের ভিতরে জায়গা হবে না তাই।

     হিমব্রত  বাবুর মা সরস্বতী দেবী তেমন কেউকেটা ছিলেন না । নিতান্ত সাদামাটা ঘরোয়া মহিলা । বয়স পঁচাত্তর এর কাছাকাছি হবে । যারা তাকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে এসেছে তারা অনেকেই তাকে চেনে না এমনকি দেখেওনি  শুধু  হিমব্রতবাবুর মা  উনি, উনার বাকী দুই ছেলে ও বিশিষ্ট জন সেই সুবাদে উনাকে শ্রদ্ধাঞ্জলি  জানাতে এসেছে !

    কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল সরস্বতী দেবী যেখানে থাকতেন সেখানে দুজন ডাক্তার থাকেন । হিমব্রত আর উনার স্ত্রী  সহেলী দেবী। কিন্তু তারপরও একাঘরে  ছটফট করতে করতে রাতে মারা গেছেন সরস্বতী দেবী । মনে হয় অনেক রাতেই মারা গেছেন । কিন্তু বেলা নটা পর্যন্ত কেউ ওদিকে যাননি তার খোঁজ ও করেনি।

     কিন্তু মৃত্যুর পর লোকদেখানো কত আয়োজন ?  খবরটা ছড়িয়ে পড়তেই  লোকজনদের ভিড় হচ্ছে ।  উনার বাকী দুই ছেলে , তাদের  স্ত্রী , ছেলেমেয়েরা   খবর পেয়েই ছুটে এসেছে ।

     সরস্বতী দেবীর  তিন ছেলে, এক মেয়ে ।
 বড় ছেলে হিমব্রত  ডাক্তার উনার স্ত্রী সহেলী দেবী  ও ডাক্তার । তাদের এক মেয়ে সেও মেডিকেল কলেজে পড়ছে । মেজ ছেলে দেবব্রত পুলিশ অফিসার তার স্ত্রী  জুঁই হাউস ওয়াইফ তাদের এক ছেলে আর ছোট ছেলে পুণ্যব্রত ইঞ্জিনিয়ার তার স্ত্রী রোজা ও ইঞ্জিনিয়ার সে অবাঙালি , তাদের এক মেয়ে । আর উনার এক মেয়ে সুচেতা স্কুল টিচার ওর বরও স্কুল টিচার । তারা বর্ধমানে থাকে । তাদের ডাকনাম যথাক্রমে হিমু , দেবু , পুনু আর সুচি। 

দর্পণ শারদ সংখ্যা ২০২০( অঙ্কন উষসী রায়)

সত্যি মানুষের জীবন বড় বিচিত্র ! দেশভাগের পর সরস্বতী দেবীর বাবা, ঠাকুরদা এদেশে আসেন । তখন তার বয়স দশ বছর ।ও দেশে তাদের অবস্থা ভালো ছিল কিন্তু এদেশে আসার পর তাদের অবস্থা অনেকটা খারাপ হয়ে যায় ।

   জন্মের পর যে মেয়ের নাম ঠাকুমা সরস্বতী রেখেছিলেন  সে কোনদিন  স্কুলে যায়নি নিজের নামটাও লিখতে পারেন না । ওদের বাড়ীতে মেয়েদের লেখাপড়ার চল ছিল না। চেহারা ততটা ভালো নয় কিন্তু গায়ের রং ফর্সা ছিল তার । উনারা বর্ধমানে বাড়ী  করেছিলেন । চোদ্দ বছর বয়সে কলকাতায় বিয়ে হয় ব্যবসায়ী সত্যব্রত সেনের সঙ্গে ।ওদের পরিবারের ছেলেরা ব্যবসায়ী,   একান্নবর্তি পরিবার  ছিল সব মিলিয়ে লোকজন কুড়ি জন। বাড়ীতে মেয়েদের কোন ব্যাপারে কথা বলার কোন অধিকার নেই । ওদের পরিবার ছিল পুরুষ প্রধান । মেয়েদের স্থান ছিল অন্দরমহলে ।ওরা  শুধু ঘরের কাজ করবে বাচ্চা সামলাবে , ছেলেদের চাহিদা মতো খাবার, জিনিসপত্র সময়মতো যোগান দেবে।এর বাইরে কোন ব্যাপারে মেয়েরা কোন মত খাটাতে পারবে না । সারাক্ষণ ঘোমটার আড়ালে থেকে নিজের কাজ করে যাবে । সংসারে সরস্বতী দেবীর শাশুড়ির কোন কোন  ব্যাপারে  কথা বলার অধিকার   নেই । তার মাথার উপরে উনার শাশুড়ি ছিলেন । 

   সরস্বতী দেবী এতো বড় সংসারে এসে ঘাবড়ে গেলেন । উনার বাপের বাড়ীতে লোকজন কম থাকায় বিশেষ কাজকর্ম করতে হয়নি উনার মা , ঠাকুমা মিলে সব কাজ সামলে নিতেন । তিনি কোন কাজ করতে গিয়েই ভুল করতেন কখনও জিনিস ও নষ্ট হতো । তবে তখন তিনি পাশে পেয়েছিলেন  তার শাশুড়ি মাকে । বৌমার ভুলগুলো তিনি লুকিয়ে রাখতেন , কখনও নিজের উপর দোষ নিতেন আর কাজ শিখিয়ে দিতেন। শ্বশুরবাড়িতে ঔ একজনকেই  নিজের মতো করে পেয়েছিলেন সরস্বতী দেবী । কিছুদিনের মধ্যেই উনার কাছে সংসারের সব কাজ শিখেছিলেন । 

    স্বামী সত্যব্রত বাবুকে কখন ও তিনি নিজের মতো করে পাননি । সত্যব্রত বাবু খুব বদমেজাজি ও ছিলেন । পান থেকে চুন খসলেই তার হাত উঠে যেত ।সরস্বতী দেবী খুব ভয়ে ভয়ে থাকতেন । সারাদিনে সরস্বতী দেবীর সঙ্গে একটা ও কথা বলতেন না শুধু রাতে বিছানায় দু একটা  কথা হত । এভাবেই তিনি তিন ছেলে,  এক মেয়ের জন্ম দেন ।

   উনার ছেলেরা লেখাপড়ায় খুব ভালো ছিল , গায়ের রং ফর্সা ছিল দেখতে সুন্দর ছিল  কিন্তু সুচেতা পড়াশোনায় ততটা  ভালো নয় মাঝারি গোছের ছাত্রী গায়ের রং শ্যামলা, ছোটখাটো দেখতে ছিল । সেই কারণে ছোট থেকেই তার সঙ্গে  ভাইদের একটা বৈষম্য ছিল । তাকে তারা খুব একটা ভালোবাসত না। তারা সুচেতাকে তাদের বোন মনে করত না । সুচেতা   এসব বুঝতেন তাই সেও ভাইদের পাশে খুব একটা যেত না । সরস্বতী দেবী ছোট থেকেই ছেলেদের কিছু বলার সাহস পেতেন না ।

  ছেলেমেয়েরা একটু  বড় হওয়ার পর সরস্বতী দেবীর পরিবারকে আলাদা করে দেওয়া হয় । কিন্তু সত্যব্রত বাবু এতোদিন ভাইরা , বাবার উপর ভর করে ব্যবসা চালিয়েছেন  আলাদা হওয়ার পর তিনি ব্যবসায় ততটা মনোনিবেশ করতে পারছিলেন না । তার উপর  তিনি  মদ্যপ ছিলেন । ফলে আস্তে আস্তে তার ব্যবসা নষ্ট হতে থাকে । তিনি তখন খুব রেগে থাকতেন। সংসারে পাঁচজন লোক তার উপর ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা । সরস্বতী দেবী তখন নিজেই সংসারের হাল ধরেছিলেন । তিনি কি কাজ করবেন লেখাপড়া জানেন না । কিন্তু ঘরের কাজ ভালো জানেন। তাই শাশুড়ির পরামর্শে বাড়ীতে বসে বড়ি , আচার, সন্দেশ এসবের অর্ডার রাখতেন । আর এসব করেই তিনি তখন সংসারের হাল ধরেছিলেন  এবং কিছুদিন পর নিজের কিছু  গয়না স্বামীর হাতে দিয়েছিলেন ব্যবসাটাকে নতুনভাবে দাঁড় করানোর জন্য । গয়না বিক্রির টাকায় সত্যব্রত বাবুর  ব্যবসা ভালোভাবে আরম্ভ হলেও  সরস্বতী দেবী উনার কাজ বাদ দেননি । সংসার সামলে বাড়িতে বসে উনি এসব কাজ করে গেছেন । তিনটে ছেলে মেয়ে পড়াশোনার অনেক খরচ, তার উপর বদমেজাজি মদ্যপ স্বামী । যদিও পরে সত্যব্রত বাবুর ব্যবসা ভালো ভাবে চলছিল কিন্তু এতো কিছুর পরও সংসারে সামান্য ত্রুটি হলেও তিনি তার জন্য সরস্বতী দেবীকেই দোষতেন , নোংরা কথা বলতেন , গালিগালাজ করতেন । কিন্তু সরস্বতী দেবী কখনও স্বামীর খারাপ কথার উত্তর দেননি বা প্রতিবাদ করেননি। তিনি একটা কথাই জানতেন মেয়েদের যত কষ্টই হোক তাদের জায়গা স্বামীর বাড়িতে । বিয়ের পর অন্য কোথাও থাকাটা সম্মানের নয়। তাই যেখানে সারাজীবন থাকতে হবে সেখানে বিরোধ করে কি লাভ !  তার কাছে  যত যন্ত্রণাই হোক না কেন নীরবে থাকাটাই সম্মানের ছিল । যন্ত্রণা সবসময় চেপে রাখতে হবে মেয়েদের বাইরের লোক জানলে তা খুব লজ্জার !

দর্পণ শারদ সংখ্যা ২০২০( অঙ্কন উষসী রায়)

                           ।। দুই।।

   এভাবেই কেটে যায় বেশ কয়েক বছর ।সরস্বতী দেবী তিন ছেলেই যোগ্য হয়েছে । সবাই নিজের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছে। তবে সবাই কলকাতায় রয়েছে । হিমব্রত বাবু বাড়ী করেছেন বাকিরা   ফ্ল্যাটে  থাকে । সময় বদলে গেছে  উনার  ছেলেদের সংসার এখন মহিলাদের কথাতেই চলে  ।সত্যব্রত বাবু এখন ও পুরানো  বাড়ীতেই  আছেন। প্যারালাইস হয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন।তার ব্যবসা ও বন্ধ হয়ে গেছে । তখন তার পাশে সরস্বতী দেবী আর সুচেতা ছাড়া কেউ নেই । ছেলেরা খোঁজ ও করে না , দেখতে ও আসে না। অথচ এই ছেলেদের নিয়ে একদিন তিনি খুব অহংকার করতেন । তখন তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর জীবনে আসল শুভানুধ্যায়ী কে ?  ক্ষমা ও চেয়েছিলেন তিনি সরস্বতী দেবীর কাছে  । তখন তাদের চলত সরস্বতী দেবীর রোজগার আর সুচেতার কয়েকটা টিউশনিতে।সত্যব্রত বাবু উনার দোকান বিক্রি করে দেন  উনার চিকিৎসা জন্য । সেই টাকা দিয়ে উনার চিকিৎসা ও মৃত্যুর পর শ্রাদ্ধ সেই টাকাতেই হয়। উনার ছেলেরা এসে শুধু নিয়ম পালন করেছিল। সরস্বতী দেবীর ছেলেরা যত  যোগ্যই হোক না কেন ওরা সত্যব্রত  বাবুর মতো হয়েছে। তিনি সারাজীবন সরস্বতী দেবীর সেবা, সাহায্য নিয়েছেন কিন্তু কোনদিন তাকে যোগ্য সম্মান দেননি। তার  ছেলেরা ও প্রয়োজনের সময় মায়ের সাহায্য নিয়েছে এখন  প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে তাই মায়ের সঙ্গে তারা যোগাযোগই  রাখছে না ।

        সুচেতা সবসময় ভাইদের কাছে অবহেলিত। তারা সবাই সায়েন্স নিয়ে পড়েছে সুচেতা আর্টস নিয়ে পড়েছে । সত্যব্রত বাবু মৃত্যুর পর সরস্বতী দেবী বুঝলেন কেউ সুচেতার বিয়ের ব্যবস্থা করবে না । সুচেতা বাংলা  অনার্স নিয়ে    বি , এ  পাশ করে নিজের চেষ্টায় প্রাইমারী স্কুলে একটা চাকরি যোগাড় করে । সরস্বতী দেবী তখন তাকে বললেন," ভাইয়েরা কেউ তোর বিয়ের ব্যবস্থা করবে না । তুই নিজে কাউকে পছন্দ করে বিয়ে করে নে। না হলে আমি শান্তিতে মরতে  পারব না।"

  সুচেতা তাই করেছিল । ওর সহকর্মী সজল মাঝিকে বিয়ে করে ।সরস্বতী দেবী নিজের যা  সম্বল ছিল তা দিয়ে ওকে  মন্দিরে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। এ নিয়ে ছেলেরা অনেক কথা শোনায় সরস্বতী দেবীকে। উনি নাকি মেয়েকে ঠিকমতো শিক্ষা দিতে পারেননি। তাই সুচেতা একটা ছোটলোককে বিয়ে করেছে। 

   সরস্বতী দেবী স্বামীর মতো  ছেলেদেরও ভয় পেতেন ।  উচ্চ শিক্ষিত ছেলেদের অশিক্ষিত মা তিনি তাই গলা উঁচু করে কথা বলতে পারেননি। তার বউমারাও  উচ্চ শিক্ষিত । একদিন   আবেগের বশে  দেবব্রতকে বলে ফেলেছিলেন, " কত কষ্ট করে তোমাদের মানুষ করেছি তাই তোমরা আজ এতো বড় চাকরি করতে পারছ। তোমাদের মানুষ করতে গিয়ে নিজের দিকে কখনও তাকাইনি।"

   বিদ্রূপাত্মক হাসি হেসে সে বলেছিল," কি এমন আর করেছ ভালোভাবে খেতে দাওনি, তেমন  কিছু পাইনি আমরা । আমার শাশুড়ি মা কত টাকা খরচ করে উনার মেয়েকে মানুষ করেছেন আর আমি ছেলের পিছনে জলের মতো টাকা খরচ করছি। কোন অভাব রাখিনি তার। আমরা পড়াশোনায় ভালো ছিলাম বাবা টাকা খরচ করেছেন তাই ভালো ভালো চাকরি পেয়েছি , বড়দা ডাক্তার হয়েছে ।"

   এরপর  আর কোনদিন কিছু বলেননি ছেলেদের । এই কথাগুলো শুনার পর নিজেকে অপরাধী মনে হত যে ছেলেদেদের তিনি  চাহিদামতো জিনিসপত্র দিতে পারেননি।আজ তারা রোজগার করছে তাই তিনি ও তাদের কাছে কিছু চাইবেন না। অনেক কষ্ট হলেও না। উনার একটাই চিন্তা সুচেতার বিয়ে হয়ে গেছে, তার বর খুব ভালোমানুষ । তার মেয়েকে খুব সুখে রাখবে ।এখন  যেন তার কোন অসুখ বিসুখ না হয় । শরীরে কষ্ট হলে ও চেপে রাখেন কাউকে কিছু বলেন না। তার জন্য ছেলেদের টাকা খরচ না হয়  চট করে মরে যেতে পারলেই তিনি  মুক্তি পাবেন এটাই তিনি ঠাকুরের কাছে  প্রার্থনা  করতেন ।

   সুচেতার বিয়ের পর ভাইয়েরা বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে টাকা তারা ভাগ করে নেয় । বোন আর মায়ের ভাগে কিছুই জুটল না। তাদের  বউরা চেয়েছিল সরস্বতী  দেবীকে  বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিতে কিন্তু হিমব্রত বাবু  বুঝলেন এতে তাদের বদনাম হবে । তাই তিনি ঠিক করলেন সরস্বতী দেবী একমাস করে একেক ছেলের কাছে থাকবেন । মোটকথায় একমাস পর তার ঠিকানা বদলাতে হবে । আবার দু মাস পর ঘুরে সেই ঠিকানায় চলে আসতে হবে । তিনি ছিলেন এক যাযাবরের মতো যার কোন স্থায়ী ঠিকানা ছিল না । তিনি যখন যে ছেলের কাছে থাকবেন তার পরিবারের কোন ব্যাপারে কথা বলতে পারবেন না । একদিন তিনি কি একটা ব্যাপারে  রোজাকে বলায় সে বলল,"তোমার কোন পেনশন নেই, রোজগার নেই ।তাই কোন কথা বলার অধিকার তোমার নেই । আমার মা কতো টাকা পেনশন পান। ফ্রিতে খেতে দিচ্ছি এই ঢের। সারাক্ষণ বসে না থেকে একটু শরীর নাড়াচাড়া করো। কাজ করলে শরীর ভালো থাকে।"
   তিনি যখন যেখানে থাকতেন সেখানে পূজো দেওয়া আর টুকিটাকি এটা ওটা কাজ করতেন। কিন্তু তিনি মনে মনে চাইতেন এখন যদি তার বড়ি ,আচারের ব্যবসা থাকত তাহলে ভালো হত। কিন্তু যে পরের বাড়ীতে আশ্রিত তার উপর সবাই উচ্চ মানের মানুষ সেখানে তিনি এসব কথা বলতে পারবেন কি করে!ছেলে বউরা তার সঙ্গে খুব একটা কথা বলত না, সুচেতা মাঝে মাঝে মাকে দেখতে আসত । কিন্তু ভাইদের বাড়ীতে তার অপমান ছাড়া কিছুই জুটত না। তবু ও সে আসে মাকে এটা ওটা দিয়ে যেত , টাকা দিত কিন্তু তার বর কখনও আসেনি। কিন্তু সে শাশুড়ি মাকে নিজের কাছে নিয়ে রাখার কথাও বলেছে ।সরস্বতী দেবীর ইচ্ছে থাকলেও যাননি । তিনটে ছেলে থেকে যদি তিনি মেয়ের বাড়ীতে গিয়ে থাকেন তাহলে তার সম্মান যাবে সেই সঙ্গে ছেলেদেরও যাবে । কিন্তু ভাবতেন মেয়ে, জামাইয়ের কাছে থাকলে তিনি খুব ভালো থাকবেন ।ছেলেদের বাড়ীতে   তিনি নিজের কাজ সেরে কাজের লোকদের সাথে একটু কথা বলতেন আর নিজের ঘরে বসে থাকতেন।লেখাপড়া জানেন না তাই বইও পড়তে পারতেন না । এটা নিয়ে তার মনে খুব আফশোস হত। ভাবতেন সুচেতাকে বললে হয়তো তাকে লেখাপড়া শেখাতে কিন্তু মেয়ের কাছে লেখাপড়া শেখার কথা লজ্জায় বলতে পারেননি।
দর্পণ শারদ সংখ্যা ২০২০( অঙ্কন উষসী রায়)

                        ।।  তিন ।।

    সরস্বতী দেবীর কদিন ধরে তার বুকে ব্যথা, মাথা বেশ ঘুরত।চলাফেরা করতে খুব কষ্ট হত। তিনি ডাক্তার ছেলের বাড়ীতে আছেন ভয়ে কিছু বলেন না কারণ তার কোন রোজগার নেই একথা তিনি অনেকবার শুনেছেন তার কোন রোজগার নেই তাকে খেতে দিচ্ছে তাঁরা এই ঢের। তাই ভয়ে বুকে ব্যাথার কথা কাউকে বলেননি ।
    সেদিন রাতে তার প্রচন্ড বুকে ব্যথা শুরু হয়। যন্ত্রণায় উঠতে গিয়ে বিছানা থেকে নীচে পড়ে যান। পাশে কেউ নেই ডাকার মতো কাজের লোকেরা নীচে থাকে মেঝেতে ছটফট করতে করতে একসময় তার প্রাণ চলে যায় । মৃত্যুর আগে একফোঁটা জল ও পাননি। তিনি যেভাবে মরতে চেয়েছিলেন ভগবান তার ইচ্ছে পূরণ  করেছেন ।

উনার শ্রাদ্ধ কিভাবে হবে তা নিয়ে তিন ভাই বউরা আলোচনায় বসেছে হিমব্রত বাবুর  ব বাড়ীতে । এ যেন কোন গভীর বিষয় নিয়ে চুলছেড়া বিশ্লেষণ ।  দেবব্রত বলল, " আমি কিন্তু বেশী টাকা দিতে পারব না কদিন পর জুঁইর ভাইয়ের বিয়ে।ওদের হানিমুন করতে বিদেশ যাবে । জুঁইর ইচ্ছে ট্রিপটা আমি দিই। "
   " হ্যা বড়দা আমরা সব প্লেন করে রেখেছি। তার মধ্যে এই ঝামেলা পড়ে গেল । উনি আর মরার সময় পেলেন না ।" - জুঁই বলল ।
   " এসব বললে তো হবে না । আমাদের উনার শ্রাদ্ধ বড় করে করতে হবে ।নইলে সোসাইটিতে আমাদের  ইজ্জত থাকবে না ।" - হিমব্রত বাবু বললেন ।
   "  তা ঠিক । কিন্তু বড়দা আমি ও বেশী দিতে পারব না । আমরা ফরেন টুরে যাব মায়ের শ্রাদ্ধের পরই । আমাদের অনেক দিনের প্লেন।"- পুণ্যব্রত বলল ।

    " হা বড়দা  আমাদের অনেক টাকার দরকার আছে । সামান্য কিছু দেব বেশী পারব না ।"- রোজা বলল ।
   " তোমরা সবাই এভাবে পিছিয়ে গেলে আমি একা কি করব ।"
   " আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে । আমরা  উনার গয়না বিক্রি করে শ্রাদ্ধ করতে পারি । তাহলে তো কাউকে বেশী কিছু দিতে হবে না ।" - জুঁই বলল ।
  " এসব কোথায় পাবে উনি সবকিছু মেয়েকে দিয়ে দিয়েছেন ।"- সহেলী বলল ।
   " কি এই এক মেয়ে হয়েছে এতো লোভী ! দেখলেই গা জ্বলে যায় । আচ্ছা উনার বিক্রি করার মতো আর কিছুই নেই ।" - দেবব্রত বলল। 
  " না কি আর থাকবে । আগে স্বামীর  উপর এরপর ছেলেদের উপর বসে বসে আয়েশ করে খেয়েছেন। রোজগার তো কিছুই করেনি জীবনে । শুধু দুটাকার আচারের ব্যবসা ছাড়া।" 
     
   "  আমার কাছে আরেকটা আইডিয়া এসেছে।  উনার বাপের বাড়ী থেকে আধভিগা জমি পেয়েছিলেন সেটা তো পরে আছে সেটা বিক্রি করে দিলে উনার শ্রাদ্ধের টাকার জোগাড় হয়ে যাবে । আমাদের  কারো টাকা লাগবে না । শ্রাদ্ধ শান্তি  মিটে গেলে   মাছ স্পর্শে বেশী লোকজন বলার দরকার নেই । আমরা নিজেরাই করে নেব। এরপর আমরা সবাই মিলে একটু জমিয়ে  পার্টি করব। তার জন্য সেই টাকা থেকে টাকা রেখো। এই কদিন তো নিরামিষ খেতে খেতে প্রাণ যাবে।"

  " জুঁই খুব ভালো আইডিয়া দিয়েছ কিন্তু অল্প সময়ে জমি বিক্রি করা কি সম্ভব এখন কে বর্ধমান যাবে  ! আর শোন  স্মরণসভার আয়োজন করতে হবে । নইলে মান থাকবে না।" - হিমব্রত বললেন ।
   
    " তোমাদের  কাউকে টাকা দিতে হবে না ।আমি জমি বিক্রি করে টাকা নিয়ে এসেছি । সেই টাকা দিয়ে মায়ের  শ্রাদ্ধ কর না হয় নিজেদের  মধ্যে ভাগ করে নে সেটা তোদের ব্যাপার ! আর যে মানুষ বেচে থাকতে একটু ও শান্তি পায়নি মৃত্যুর পর তার লোক দেখানো শ্রাদ্ধ করার কি দরকার !"   

   সবাই চেয়ে দেখল সুচেতা এসেছে । দেবব্রত বলল ," এই তো পাতি দিদিমণি এসে গেছে এসেই জ্ঞান দিতে শুরু করে দিয়েছে ।এই তোকে এখানে আসতে কে বলেছে? "
    " আমি এখানে আসতে চাইনি । শুধু মা আমাকে ফোনে  কয়েকমাস  আগে  বলেছিলেন উনার কদিন থেকে শরীর ভালো যাচ্ছে না যদি কিছু হয়ে যায় তাই আমি যেন উনার শেষ সম্বল জমিটা বিক্রি করে দিই । উনার শ্রাদ্ধ যেন সেই টাকাতেই হয়। যাতে তোদের কিছু উনার শেষ কাজে না লাগে। তোরা এতো শিক্ষিত এতো কিছু জানিস মায়ের মৃত্যুর খবরটা ও আমাকে দিলি না।"
  " তাহলে তুই কি করে জানলি দিদিমণি ?"
  " খবরের কাগজ থেকে জেনেছি  ডাক্তার হিমব্রত সেনের মাতৃবিয়োগের খবর । তাই মাকে কাল থেকে ফোনে পাচ্ছিলাম না।"
   সুচেতার হাত থেকে খবরের কাগজ নিয়ে জুঁই দেখল সেখানে শুধু  হিমব্রত সেনের নাম লেখা ।
  " একি বড়দা তুমি আমাদের নাম ছাপালে না উনি কি আমাদের কেউ ছিলেন না ।"
  " শ্রাদ্ধের খবর ছাপানোর সময় সবার নাম দেব চিন্তা করো না ।"
 " আমার নাম দিস না বড়দা । আমার লোক দেখানো মাতৃভক্তির দরকার নেই । বেচে থাকতে উনাকে যতটুকু শান্তি দিতে পেরেছি  এতেই আমার শান্তি ।" 
   " বাবা বাংলা মিডিয়ামের প্রাইমারী স্কুলের দিদিমণির কত বড় বড় কথা ! তোর দেখছি খুব মুখ বেড়েছে আজ !"
   " এতোদিন মায়ের দিকে চেয়ে তোদের সব অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করেছি। তোদের কথা শুনে মনে হচ্ছে তোরা কোনদিন স্কুলে যাসনি ।এমনিই লেখাপড়া শিখে বড় বড় চাকরী পেয়েছিস। আরে এই পাতি দিদিমণিরা যদি না থাকত তাহলে তোদের  মতো শিক্ষিতরা তৈরী হতো না । যাকগে  তোদের সঙ্গে আমার আর কোন কথা নেই, তোরা মায়ের সঙ্গে যা করেছিস তোদের ছেলেমেয়েরা যেন তাই করে তোদের সঙ্গে । পাঁচ লাখ টাকা রাখ আমি চলে যাচ্ছি । "
    " এতো কম টাকা আর কিছু পেলি না । না বাকী টাকা নিজে রেখে দিয়েছিস।"
   " ঠিক বলেছিস ছোড়দা অনেক টাকা পেয়েছি। বাকিটা আমি রেখে দিয়েছি। আমিও তোদের মতো বড়লোক হতে চাই ।"

    সুচেতা চোখের জল ফেলতে ফেলতে বেরিয়ে গেল । সেই টাকা দিয়ে দিয়েই সরস্বতী দেবীর শ্রাদ্ধ হয়েছিল ।

    বাইরে থেকে সবাই সরস্বতী দেবীকে খুব সুখী মনে হত। তিনি নিজেও তা বুঝাতেন সবাইকে  । কিন্তু এতো  সুখের অন্তরালে তিনি সারাজীবন  কত দগ্ধ হয়েছেন তা মনে হয় শুধু  ঈশ্বরই জানেন ! 

  সমাপ্ত ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ