শারদ সংখ্যা ২০২০ || গল্প || মাস্টারদা




পোস্ট বার দেখা হয়েছে


প্রবাদের অর্থানুসন্ধানে...
 মাস্টারদা


"কানা উঁচু মধ্যে নিচু
     ঘন ফেলে পা
মা ভালো তার ঝি ভাল
     বা রে মাঝি বা।"

মহাকবি কালিদাস একবার নৌকোয় চেপে কী যেন একটা কাজে রওয়ানা দিয়েছেন রূপসী কোন দূর গাঁয়ে। বাঙালির চিরায়ত স্বভাবের মধ্যে সেই পরদাদাদের কাল থেকে ভালো কোন কাজে আপনজনের পরামর্শ জেনে নিয়ে কাজ করার চল এখনও আছে। আর পণ্ডিত লোক হলে তো কথাই নেই। শুধু পরামর্শ, পরামর্শ আর পরামর্শ দাও।
কালিদাসের মতো মহাপণ্ডিতের সাক্ষাতে পরামর্শ চাইবে না তা কি করে হয়।

নৌকা কিছুদূর যাবার পর একজন পণ্ডিতমশাইকে বলল:
"হাতে কিছু বাড়তি পয়সা জমে। কিন্তু বুঝলে কি পণ্ডিত মশাই! যা হয় আর কি...প্রতিবারই ওই এ-কাজ ও-কাজ করে খরচ হয়ে যায়। তো এবার ভাবলুম ভালো দেখে খানিকটে জমি কিনে রাখিনে ক‍্যানো? কিন্তু আমি তো এ বিষয়ে বলতে গেলে এই এক্কেবারে বকলম। জানেনই তে, জানাশোনা নেই বললেই চলে। আপনি যদি একটু বাতলে দিতেন "কেমন ভূমি উত্তম হইবে" তবে বড়ই কৃতার্থ হই।"

পণ্ডিত মশাই কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু আরেকজনের কথা তাকে থামতে বাধ্য করল। প্রৌঢ় লোকটা ধীরে অথচ দীপ্ত ছোঁয়ায় বললে:

"আরে পণ্ডিতমশাই যে! যাক বাবা বাঁচা গেল। সবি ঠাকুরের কেরপা, সবই। নইলে এমন দিনে এমন দর্শণ... আহা! কার কপালে জোটে! 
মেয়ের বিয়েতে একটা গরু যৌতুক না দিলি ক্যামনে হয়, কন? কিন্তু জাত-পাত তো চেনা দায়। কোন জাত-বেজাতের গরু না জানি কিনতে হতো।" আহ্লাদে গদ গদ হয়ে করজোড় ললাট ছুঁইয়ে বললে, "যাক যাক, একটা হিল্লে হলো। কোন জাতটা পালনের ঠিক উপযুক্ত হবে? সেইটে এখন শুধু বলুন।"

পণ্ডিতমশাই বুঝলেন তার জন্য আরো প্রশ্ন অপেক্ষা করছে। এত সহজে ছাড় পাবেন না। হলও তাই।

কাঁচানো ধুতি-পাঞ্জাবি পরা, বগলে ছাতি ধরা, মাথায় সাদা-কালো চুলে ভরা লোকটা বলল: 

"বড় বিপদে আছি মশাই। উদ্ধার করুন। কী যে কলিকাল পুড়িছে ভালো-মন্দে তো আজকাল ভগবানও ধন্দে পড়ে যাচ্ছে! দিনের বিলায় যে মা লক্ষ্মী হুয়ি ঘরে ঢুকচে রাতে সে কালনাগিনীর রূপ ধুরি সব তছনছ কোরছে। গেল মাসে আমাগো গেরামের বাঞ্চারাম ব্যাপারির ছেলি শিবুর বিয়ে হুলো, আজ শুনলুম সে মেয়ে নাকি আরেক ঘরকরা। সেখানে নাকি একটা ছেলিও আছে। রাতদিন ননদ-শাশুড়িতে, জায় জায়... পুরো গেরামে ছিঃ ছিঃ পড়ি গেছে। আপনেরে আর কী কব, সে কি মুখ!" 

হয়রানির ছাপ স্পট হয়ে ওঠে বক্তার মুখে। "এ সব ভেবি ছেলের বউ খুঁজতি খুঁজতি তাই হয়রান হুয়ি পড়িছি। কী ভেবি কী-না নে'সি! ভগবান জানেন! বড় বিপদে আছি মশাই, কিছু যদি বুদ্ধিসুদ্ধি দেন।"__নিরুপায়ের সুর শোনা যায় তার কণ্ঠে।

"ও... তুমরা তো সব আচো নিজিগে নিজিগে ঝামেলা নে। এদিকে যে মাঝি বেটা নোকো বা'আর কাজে ফাঁকি দিচ্চে। সেদিকে তো কেউ খেয়াল কচ্চাও না।"___ পেছনের থেকে কেউ একজন চেঁচিয়ে বললে।

পণ্ডিতমশাই দেখলেন, সত্যি মাঝি বেটা অনেক ফাঁকি দিয়েছে। নৌকা সেভাবে এগোয়নি। এমন চললে গন্তব্যে পৌঁছুতে ঢেএএর দেরি হয়ে যাবে। তাই আর কথা না বাড়িয়ে বললেন:

"কানা উঁচু মধ্যে নিচু..."(যে জমির চারপাশ উঁচু, মাঝে নিচু। জমিতে পানি থাকে সে জমি চাষের উপযোগী, ফলন বেশি। সুতরাং যার জমি কেনা দরকার সে এমন জমি কিনবে।)

"ঘন ফেলে পা..."(ঘন ঘন পা ফেলে চলা গরু ফিবছর বাচ্চা দেয়, দুধও হয় পর্যাপ্ত পরিমাণে। পুষতে হলে এমন গরুই আদর্শ।)

"মা ভালো তার ঝি ভাল..."(মেয়ে মার আচরণ পায়। মা ভালো হলে মেয়েও ভালো। যে বিবাহের পাত্রী খুঁজছে তার উচিৎ হবে মেয়ের মার চরিত্র জেনে কনে নির্বাচন করা।)

"বা রে মাঝি বা।" (মাঝি আর হেলা করিসনে দ্রুত বেয়ে পার করে দে।)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ