শারদ সংখ্যা ২০২০ || গল্প || তনু ঘোষ




পোস্ট বার দেখা হয়েছে


অযাচিত
তনু ঘোষ

--"ভোরেই ট্রেন, তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়"
--"হ্যাঁ গো, ঘুম আসছে না। ভেতরে ভেতরে একটা উত্তেজনা হচ্ছে! "
ভোরে মনা'দা নিশান্তিকাকে মেদিনীপুর থেকে ট্রেনে তুলে দিয়ে, দুটো কেক কিনে দিয়ে জানলা দিয়ে টাটা করলো। 

ট্রেন চলতে শুরু করেছে, প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়ে শহরটাকে পিছনে ফেলে গতি নিলো আস্তে আস্তে। নিশান্তিকা প্রথম এত দূরে যাচ্ছে সেল্ফ ডিপেন্ডেন্ট হয়ে। জানালার ধারে হু-হু হাওয়া চুলগুলোকে চোখে মুখে লুটোপুটি খাওয়াতে খাওয়াতে নিয়ে যাচ্ছে একদম অচেনা অজানা একটা শহরে। নিশান্তিকার ভাবনায় কত কিছু আসছে যাচ্ছে। "এই যে সবুজে সবুজ একটা জায়গা, আমার শিকড়টা এখানে পোঁতা, আমি থাকবো কি করে ঐ রকম একটা ইঁট পাথর কয়লা লোহা লক্কড়ের শিল্পনগরীতে! " শুনেছি চারপাশে শুধুই কারখানা আর কারখানা। তার মাঝে ঐ একটা কলেজ এ, বি, এস, অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স  টেকনোলজি অ্যান্ড মেনেজমেন্ট হাতছানি দিচ্ছে অযাচিত ভাবেই। কোনো কথায় ছিলোনা, হঠাৎ স্যারের কথা মতোই এতবড় একটা ডিসিশন নিয়েছে নিশান্তিকা।স্যারের মুখে শুনেছে এমন ঝাঁ চকচকে কলেজটির কথা। যেখানে ডিসিপ্লিন আর ঝকঝকে স্মার্টনেস ছাড়া পদে পদে হোঁচট খেতে হবে টাইলসের মেঝেতে স্লিপ খেয়ে। নিশান্তিকার ওসব ভয় নেয়, মেয়েটির স্বভাব নম্র, ধীর, শান্ত আর স্মার্টনেসের জন্য অনেকেই ক্রাশ..... 

জিনসের পকেটে মোবাইলটা ভাইব্রেশন হচ্ছে, বের করে দেখে স্যার ফোন করছেন। 
--"হ্যালো স্যার "
--" তোমার ট্রেন এখন কোথায়? "
--" এই তো গোদাপিয়াশাল ছাড়লো। "
--" ওহঃ, দেখো ট্রেন আটকে যাবে, নিউজে দেখাচ্ছে...."
--" কেন? " 

নাহ্ বাড়িতে কোনভাবেই ফোন করে এই ঘটনা জানানো যাবে না। বাবার হাই প্রেসার, এমনিতেই নিশান্তিকা  বাইরে হোস্টেলে থাকে বলে চাপা টেনশন কাজ করে। আর মা তো, কোনো কথা না শুনেই ভাববে মেয়ে বুঝি..!  তার থেকে ওরা নাই বা জানলো। 

মনা দা'কে একটু জানাই, যদি কিছু ব্যবস্থা করে! ভাবা মাত্রই ফোন করলো। ও বললো, কলেজে পৌঁছোতে অনেক দেরি হয়ে যাবে, যদি আর অ্যাডমিশন না নেয়! এই একটা মানুষ, নিশান্তিকাকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। নেহাত তাকেও আজ বাড়ি যেতেই হবে, তাই একা ছেড়েছে, নাহলে নিজেই নিয়ে যেতো। 

এই এমন একটা মায়াবী জঙ্গল, সবে সোনালী আলো চারিদিক ঢাকছে, এক একটা গাছের মাথা দুর থেকে পাহাড়ের ওপর রোদ পড়লে যে সৌন্দর্য তার থেকে কোনো অংশে কম নয়। লাল মাটির উঁচু উঁচু ঢিবি গুলো দেখে মনে হচ্ছে গিরিমাটিতে আগুন লেগেছে। বুনোঝোপ মাঝে মাঝে নড়ে উঠছে, কোনো বুনো শুয়োর বোধহয় চ্যাঁচামেচি শুনে নিরাপদ বাসস্থানের দিকে সন্তান সমেত চলছে। পাখিগুলোর কোনো হেলদোল নেই, মানবসমাজের কোনো ঘটনাই ওদের চক্ষুগোচর হচ্ছে না। নিজেদের জগতে, উড়ছে, এ ডালে ও ডালে বসছে, কত কাজ তাদের। সবে মিনিট চল্লিশ ট্রেনটি চলেছে, এখনো হকার ওঠার জায়গায় আসেনি, তাই মানুষ জন নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলি করছে। কম্পার্টমেন্টটাতে বেশ লোকজন আছে। ভাগ্যিস "ল্যান্ডমাইন দিয়ে রেখেছিলো লাইনে। " তাই এতটা সৌন্দর্য দেখার সৌভাগ্য হলো। তখন মাওবাদীদের রমরমা সময়, প্রতিদিন হেডলাইনে মাওবাদীদের হাতে নিহত হওয়ার খবর থাকতো। নিউজে দেখাচ্ছে, বাঁকুড়া গামী সব ট্রেন আটকে থাকবে, যতক্ষণ না বোমস্কোয়াড থেকে লোক এসে মাইন নিষ্ক্রিয় করছে। স্যার তো এটাই বললেন। 

নিশান্তিকা জানলা দিয়ে গভীর জঙ্গল পর্যবেক্ষণ করতে করতে ব্যাগটাকে একটু ভালো করে চেপে ধরে বিনিদ্র রাতের আলসেমি কাটাতে হেলান দিয়ে দুই চোখ মুদ্রিত করলো। ভুলে গেল এই জগৎ সংসার, সম্পর্কের মায়া, দায়িত্ব, কর্তব্য, নিজের লক্ষ্য। দুটো চোখের পাতায় খেলে বেড়াচ্ছে আবছায়া মেঘ রোদের কাটাকুটি। ব্যাগের মধ্যে যে নিশান্তিকার অস্তিত্ব ভরা, তার একটা গোটা জগৎ , সে দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। 

--"এই যে ছাড়ছে ছাড়ছে! "
সবার হৈ-হৈ করাতে নিশান্তিকার ঘুম ভেঙে গেল। রিস্ট ওয়াচে দেখলো, ঘণ্টা দুয়েক কেটে গেছে। "এতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম! " একটা হাই তুলে, ব্যাগটা সিটে রেখে টয়লেটে চলে গেল! অবাক একটা মেয়ে। ঐ ব্যাগে সারাজীবনের অর্জিত মার্কসসিটের ফাইল, আইডেন্টিটি, সাথে আশি হাজার লিকুয়িড ক্যাস রয়েছে। একবারো ভাবেনি, ব্যাগটা নিয়েই টয়লেটে যেতে হয়। এটাই বা জানবে কি করে, ঐ অতটুকু টয়লেট, একটা মানুষ ঠিক করে ধরে না, আবার একটা ব্যাগ। সালটা ছিলো দু'হাজার এগারো, তখনো সংসারে এত লোভ আসেনি বোধহয়। বিশেষ করে মফস্বল এলাকায় ট্রেনে উঠে চুরি, ডাকাতি, হাতসাফাই খেলার এতটা রমরমা হয়নি। মানুষের মুখে লেগে থাকতো মায়ার ছাপ, অন্তরে বিরাজিত হতো নিষ্পাপ বাচ্চা মেয়ের মিষ্টি সুঘ্রাণ। ফিরে আসতেই এক ভদ্রলোক বললেন, "আমি খেয়াল রেখেছিলাম তোমার ব্যাগটার, তবে আর কখনো এভাবে ছেড়ে রেখে যেও না। ব্যাগ সাথেই রাখতে হয়। " নিশান্তিকার এই একটা শিক্ষা অজানা মানুষটির থেকে। 

অভিজ্ঞতার পর অভিজ্ঞতা নিয়ে নিশান্তিকা চলেছে কলেজের উদ্দেশ্যে। মনা দা ফোন করছে, বাড়ির কাজ মিটিয়ে আসছে। ফেরার সময় রাত্রি হয়ে যাবে, একা তো তাই..... 

শেষপর্যন্ত নিশান্তিকা স্বপ্নপূরণের সোপানে দাঁড়িয়ে। আর আধাঘন্টার মধ্যে লাস্ট অ্যাডমিশন কমপ্লিট হয়ে যাবে । কলেজ গেটের গার্ড সব বুঝিয়ে দিয়েছেন, দ্বিতলের বামদিকের প্রথম রুমটাই অ্যাডমিশন অফিস, গ্রাউন্ড ফ্লোরের ডানদিকে ব্যাঙ্ক। রিসেপশনিস্টের কাছে এন্ট্রি নিয়ে নিতে হবে। এই তো এন্ট্রি স্লিপ, হাতে নিয়ে নিশান্তিকা সোপানের পর সোপান এগিয়ে চলেছে।ঐ তো দেখা যাচ্ছে অফিসটা। আর কয়েকটা সিঁড়ি।একজন ছেলে হঠাৎ করেই পিছন থেকে জিজ্ঞেস করলেন, "আপনিই নিশান্তিকা রায় ? " 
--" যথারীতি হ্যাঁ " বলেই পরের সিঁড়িতে পা বাড়াতেই মনে হলো ছেলেটা ইচ্ছে করে ধাক্কা দিলো। 

নিশান্তিকাকে কলেজের মেডিক্যাল রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। সারাদিনের না খাওয়া, মনের মধ্যে ভয় তাই একটু সেন্সলেস হয়ে গেছিলো। পায়ে চোট লাগার জন্য ক্রেপ ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিলো ডাক্তার। "আমার অ্যাডমিশন!  অফিস বন্ধ হয়ে গেল নাকি! আমার ব্যাগ? " 

--" তোমার অ্যাডমিশনের জন্য নাম এন্ট্রি করে রেখেছি, সেই সকাল থেকে। আর অপেক্ষা করছিলাম তোমার আসার জন্য। ডক্টর সুভাষ চক্রবর্তী আমাকে ফোনে সবটাই জানিয়েছেন। "
ডাক্তার বললেন, "ইনিই তোমার ডিপার্টমেন্টের হেড।" 
নমস্কার করতেই উনি বললেন--" এই যে একা একা এইরকম একটা দুঃসাহসিক ট্রেন জার্নি করে এলে, এমন সাহসী হয়েই এগিয়ে চলো। "
ঐ রিসেপশনিস্ট ভদ্রমহিলাটি ব্যাগটা এগিয়ে দিলেন। নিশান্তিকা আস্তে আস্তে অফিসে গিয়ে অ্যাডমিশন হলো। জানতে পারলো, ঐ একটাই সিটি ছিলো। আমি যদি মিস্ করতাম তাহলে সেই ছেলেটি অ্যাডমিশন নিতে পারতো। নিশান্তিকার কাছে পরিষ্কার হলো ব্যাপারটা। এই জন্য সিঁড়িতে......! যাক, শেষ ভালো যার সব ভালো তার । সত্যিই এমন ট্রেন জার্নির দুঃসাহসিক অতীত ফেলে অবশেষে..... 

মনা দা'কে ফোন করে সবটা বললো, সেও জানালো আর ঘন্টাখানেকের মধ্যে বাঁকুড়া স্টেশনে পৌঁছোবে। ফেরার জন্য আবার ট্রেন ধরলো নিশান্তিকা। পাকাপাকি ভাবে আসবো এই শহরটাতে, ফিসফিসিয়ে বলে গেল নিশান্তিকা। 

কিছু লোক অ্যাক্সিডেন্ট নিয়ে আলোচনা করছে। মন দিয়ে শুনছে নিশান্তিকা। বাঁকুড়া মেডিকেলে নিয়ে আসা হয়েছে, এসব । এইবার নিশান্তিকার মনে কু ডাকতে শুরু করেছে। 

বাঁকুড়া স্টেশনে পৌঁছেই মনা দা, মনা দা কোথায়? মোবাইলে রিং হচ্ছে না কেন? নট রিচেবল্ । এদিক ওদিক করতেই কেটে গেছে মিনিট কুড়ি। হঠাৎ মনা'দার কল। 
--আপনি কি নিশান্তিকা বলছেন? 
-- হ্যাঁ 
-- যার মোবাইল উনি, অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছেন... ! 
-- কি! 

হঠাৎ করেই একটা মেয়ে কিভাবে যেন বড় হয়ে যায়, পরিস্থিতি আর সময় মানুষকে শিক্ষা দেয়। নিশান্তিকা গোটা মেডিকেল তন্নতন্ন করে....। 

ঐ তো, মনা দা'কে বেডে দিয়েছে। মনা দা!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ