শারদ সংখ্যা ২০২০ || গল্প || নীলাঞ্জনা ভৌমিক




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

তটিনী তটে  
নীলাঞ্জনা ভৌমিক

                ।। ( প্রথম পর্ব )।।
বর্ণালী, পুষ্পিতা আর সোনালী তিন বান্ধবী নিজেদের মধ্যে গল্প করতে করতে পিচের রাস্তা ধরে হেঁটে চলেছে। ব্যারাক এরিয়ার রাস্তাঘাট ঝকঝকে সুন্দর। রাস্তার দুধারে ইংরেজ আমলের বিশাল বিশাল গাছ কেমন এক ছায়াঘেরা পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। এখন আকাশে আলো আঁধারি সূর্য মেঘের খেলা। সবে বর্ষা বিদায় নিয়েছে। শ্রাবণের অবিরাম ধারায় ভিজে ভিজে গাছেরা বড় উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েছে। চারিদিকে কেমন একটা সতেজতা ষোড়শীর মুখমণ্ডলের মতো। ভাদ্র এখনো তীব্রতা পায় নি। তাই মেয়ে তিনটিও বাতাসে শীতলতার আবেশ খুব উপভোগ করতে করতে এগিয়ে চলেছে -
- আই সোনালী আর কতদূর যাবি ? 
- এই আর কিছুটা, কেন রে ?
- আমি কিন্তু আর হাঁটতে পারব না বলে দিচ্ছি।
এই বলে বর্ণালী একটা শিমুল গাছের তলায় চায়ের দোকানের বেঞ্চের ওপর বসে পড়ল।বয়সটা খুব বেশি যে ওদের তা নয়। এই চৌত্রিশ- পঁয়ত্রিশ হবে। এরই মধ্যে হাঁটুতে আর্থারাইটিস বাঁধিয়ে বসে আছে। পুষ্পিতা হা হা করে উঠল-
- আই তুই এখনি বসে পড়লি কেন ? আর একটু গিয়ে একেবারে গঙ্গার ধারে গিয়ে বসব।
কিন্তু বর্ণালী আর হাঁটতে রাজি নয়। পায়ে বড্ড ব্যথা করছে। সোনালীও বসে পড়ে বলল-
- আয় তুইও বোস পুষ্পিতা। আমরা বাদলদার দোকানে এক ভাঁড় করে চা খাই।
অগত্যা পুষ্পিতাকেও বসতে হলো। অবশ্য তাতে তিন বন্ধুর কোন সমস্যা নেই। এখানে এলে ওরা এই দোকানের চা না খেয়ে যায় না। সঙ্গে বেকারির বাদাম দেওয়া বিস্কুট। একটা স্টিলের থালায় চায়ের ভাঁড় আর বিস্কুট দিয়ে বাদলদা জিজ্ঞাসা করলেন -
- কি দিদিরা আজ কতক্ষণ ?
- আজকে স্কুল ছুটি সেই সাড়ে তিনটে।
- এখন তো সবে পৌনে এগারটা। তা ডিম পাউরুটি টোস্ট খাবেন তো ?
- না দাদা আজ থাক।
দাম মিটিয়ে দিয়ে ওরা তিনজন আবার উঠে পড়ল।
হাঁটতে হাঁটতে আর বকবক করতে করতে ওরা আরো কিছুটা গিয়ে বাঁ দিকে বেঁকে গেল। এদিকটা গাছপালা আরো ঘন আর কাছাকাছি। এদিকটা এলেই সোনালীর গা টা কেমন ঝমঝম করে যদিও রাস্তায় মায়েদের ভিড়। এদিকটি অনেক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল আর ব্যারাকপুর মিশন রয়েছে তাই সকাল সাতটা থেকে বিকেল চারটে পর্যন্ত মায়েদের আর স্টুডেন্টদের চলাফেরায় জায়গাটা সুন্দর লাইফফুল থাকে। রাস্তার ধারে ধারে স্কুলবাস আর প্রাইভেট কারের ছড়াছড়ি। সব দাড়িয়ে আছে। একেবারে ছুটি হলে যাবে। এই তিন বান্ধবীর মেয়েরা ব্যারাকপুর মিশনে ক্লাশ সিক্সে পড়ে। মেয়েদের স্কুলে ঢুকিয়ে দিয়ে এই তিন মা এই চত্ত্বরেই সেই বিকেল সাড়ে তিনটে পর্যন্ত থাকে আর গল্প করে। আজকেও তাই এসেছে। কোন কোন দিন রাস্তার ধারে বড় বড় গাছের তলায় কাগজ পেতে বসে পড়ে আবার কখনো হাঁটতে হাঁটতে গঙ্গার ধারে চলে যায়। আজকের ওয়েদারটা এতো সুন্দর যে ওরা ঠিক করলো গঙ্গার ধারের পার্কটাতেই বসবে। মর্ডান স্কুল পেরিয়ে মঙ্গলপাণ্ডে পার্কের দিকে একটু এগোলে একটা ভাঙাচোরা পোড়ো বাড়ি আছে। বাড়িটার চারদিকে শুধু গাছ আর গাছ। গাছের ফাঁক দিয়ে চলটা ওঠা ইটের দেওয়াল আর ভাঙা দরজা জানলা দেখা যায়। ওই বাড়িটার দিকে তাকালেই রাতের আঁধারে এই জায়গাটা কেমন লাগে ভাবলেই গা টা কেমন শিঁউরে ওঠে। ওরা তিনজন পার্কে ঢুকে একেবারে গঙ্গার ধারে একটা বড় গাছের নীচে এসে সবাই বসল। নদীর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বর্ণালীর মনটা কেমন উদাস হয়ে যায়। নৌকার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। কত কথা মনে পড়ে যায় ওর। কলকাতার জমজমাট পরিবেশে বড় হয়ে ওঠা মেয়ের আজ এই রকম নির্জন জায়গায় কোনদিন সময় কাটাতে হবে তা কি কোনদিন ভেবেছিল! বিয়ের তিনবছর আগে হঠাৎ একদিন ওর মা মারা গেলেন। বর্ণালীর বাবা কেমন যেন দিশাহারা হয়ে গেলেন। ওনার ছেলে চাকরিসূত্রে দিল্লি থাকে। বর্ণালী একদম গুম হয়ে যায়। মা ছিলেন ওর বন্ধুর মতো। মা বাবার বড় আদরের ছিল বর্ণালী। সম্বন্ধ দেখতে শুরু করলেন ওর বাবা, মা মারা যাওয়ার এক বছর পর থেকে। অনার্সটা কমপ্লিট করে এম.এ অ্যাডমিশন নিল বর্ণালী রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপরেই বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে থেকেই মাস্টার্স কমপ্লিট করার পর মেয়ে হলো। তারপর মেয়ের যখন চারবছর বয়স তখন মিশনে মেয়েকে ভর্তি করে দিল বর্ণালী। ইতিমধ্যে বর্ণালীর বাবাও মারা গেছেন, দাদা দিল্লিতে। ও একেবারে একা হয়ে গেল। মিশনে এসে সোনালী আর পুষ্পিতাকে পেয়ে ,ওদের আন্তরিক সান্নিধ্যে এসে ওর হারিয়া যাওয়া বাপের বাড়ির দুঃখটা অনেকটা ভুলতে পেরেছিল। কিন্তু যখনই নদীর ধারে এসে বসে কেন জানি না ওর বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে মা বাবার জন্যে। তাঁদের মুখের আদরের ডাক শুনতে ইচ্ছে করে আগের মতো। মাকে জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে করে," দেখ মা তোমার মেয়ে কেমন বড় হয়ে গেছে! এখন সেও মা হয়েছে!"-
- আই বর্ণালী আবার কি ভাবছিস ?
সোনালীর ডাকে চমকে ওঠে বর্ণালী-
- না রে কিছু না।
- আবার ঐসব কথা ভাবছিস !
বর্ণালীর চোখদুটো জলে ভরে উঠল। কেউ কি মাবাবার কথা ভুলতে পারে না ভোলা যায়! কাল যা সত্যি ছিল আজ যেন রূপকথা মনে হয় যাকে সে আর কোনদিন ছুঁতে পারবে না। সোনালী আর পুষ্পিতা বর্ণালীর এই কষ্টের কথা জানে। ওরা তাই ওদের বাপের বাড়ির কথা কখনো বলে না বর্ণালীর সামনে পাছে ও কষ্ট পায়। সবাই বাপের বাড়ি যায় মা কাছে বাবার কাছে। কতো আনন্দ করে,ওরই শুধু যাওয়া হয় না।
  
ছবি সহযোগিতায় : উষসী রায়

                ।।(দ্বিতীয়  পর্ব )।।

- আই বর্ণালী আবার!
চোখ মুছে বলে -
- কাল রাতে মাকে স্বপ্নে দেখেছি। আমার চুল বেঁধে দিচ্ছেন।
পুষ্পিতা আর সোনালী চুপ করে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ বর্ণালী ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। সোনালী ব্যাগ থেকে একটা টিফিন বক্স বার করে বলল-
- এই দেখ আজকে তোদের জন্যে কি এনেছি!
একটা ছোট কাগজের প্লেটে তিনটে মোমো আর চিলি-টমেটো সস্ দিয়ে বর্ণালীর দিকে এগিয়ে দিল। আর দুটো প্লেটে পুষ্পিতা আর সোনালী নিল। পুষ্পিতাও একটা টিফিন কৌটো বার করল। আজ ও কাবলী ছোলার ঘুগনি এনেছে। চোখ মুছে আবার ওদের সাথে হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠল বর্ণালী। খাওয়া দাওয়া শেষ করে ওরা আবার একটা চাওয়ালার কাছ থেকে তিনটে চা নিল। কাগজের কাপটা থেকে ধোঁয়া উঠতে লাগল। খুব গরম চা। সেই ধোঁয়ায় চোখদুটো রেখে বর্ণালী আবার উদাস হয়ে গেল। শাশুড়ি কিছুতেই রান্নাঘরে নিজের থেকে কোনো রান্না করতে দেন না বর্ণালীকে। ওকে বুঝিয়ে দেন যে এই রান্নাঘরটা ওনার তাই ওনার মতেই রান্না হবে। ফলে বর্ণালী বন্ধুদের জন্য কিছুই রান্না করে আনতে পারে না। কখনো দরবেশ ,কখনো সন্দেশ, কখনো বা চিরেভাজার প্যাকেট -- এইসব দোকান থেকে কিনে আনে। আর ওর বন্ধুরাও খুব আনন্দ করে খায়। হঠাৎ সোনালী বলে ওঠে-
- ওই দেখ জোয়ার আসছে। জল কতটা উঠে এসেছে দেখ।
আরো কিছুক্ষণ ওরা নদীর ধারে বসে রইল। জোয়ারের জলে ঘাট প্রায় ভর্তি হয়ে গেল,সিড়ি দেখা যাচ্ছে না। একটা ছোট সাদা জার ব্যাগ থেকে বের করে বর্ণালী বলল -
- চল ঘাটের কাছে যাই। শাশুড়ি গঙ্গাজল নিয়ে যেতে বলেছেন।
ওরা ঘাটের কাছে এসে বসল-
- কি রে জল নে বর্ণালী!
- হ্যাঁ নিচ্ছি।
- তুই জারটা আমাকে দে আমি এনে দিচ্ছি।
সোনালী জারটা নিয়ে জোয়ারের জল ভরে এনে বর্ণালীর হাতে দিয়ে বলল-
-  এই নে। তোর পায়ে ব্যথা না!তুই কেন ভরতে যাচ্ছিলিস যদি পড়ে যেতিস।
কৃতজ্ঞতায় চোখ ভরে গেল বর্ণালীর।
বেলা আড়াইটে নাগাদ ওরা উঠে পড়ল।ফেরার পথে ওদের চোখ আবার ঐ পোড়ো ভাঙাচোরা বাড়িটার দিকে চলে গেল। বেলা পরে এসেছে। রোদের উজ্জ্বলতা মেঘে ঢাকা পড়ে গেছে। বৃষ্টি নামতে পারে। জায়গাটা কেমন যেন অন্ধকার অন্ধকার লাগছে। হঠাৎ ওরা তিনজন থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। পোড়ো বাড়িটার একটা ভাঙা দরজা ধরে একজন দাঁড়িয়ে আছে আর ওদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। বর্ণালী বলে উঠল -
- দাঁড়িয়ে পড়লি কেন ? তাড়াতাড়ি পা চালা। 
সোনালী আর বর্ণালী এগিয়ে গেল। ওদের মধ্যে পুষ্পিতা মেয়েটা একটু ডানপিটে-
- আরে দাঁড়া  না একটু। দেখি না ভদ্রমহিলা কি বলছেন। নিশ্চয়ই কোনো অসুবিধায় পড়েছেন !
এই বলে পুষ্পিতা একটু এগিয়ে গিয়ে বলল-
- মাসিমা কিছু বলছেন ?
প্রায় পঞ্চাশ- বাহান্ন বছরের লম্বা গড়নের এক ভদ্রমহিলা ওদের কাছে এসে দাঁড়ালেন। বিষ্মিত তিন বন্ধু একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল-
- আপনি কোথায় থাকেন ?
ভদ্রমহিলা হাত দিয়ে পোড়ো বাড়িটার  দিকে দেখিয়ে বলল-
- ঐ বাড়িতে।
- আর কে থাকেন আপনার সাথে ?
- আমি আর আমার ছেলে আর ওর মাসিও থাকে।
ভদ্রমহিলার মাথাভর্তি সিঁদুর দেখে সোনালী বলল-
- আর আপনার স্বামী ?
- উনি আমাদের সাথে থাকেন না।
- কেন ?
- উনি ওনার প্রথম স্ত্রীর সাথে থাকেন।
- সে কি! আপনি বিয়ে করলেন কেন তাহলে ?
- আমি বিয়ের আগে জানতাম না যে উনি বিবাহিত।
- তা আপনি এইরকম একটা জায়গায় থাকেন কেন ?
- কি করব মা। আর কোন জায়গা নেই আমাদের। 
- কেন মাসিমা আপনার স্বামী কি আপনাদের কোনো দায়িত্ব নেন না ?
- প্রথমে আমরা ব্যারাকপুর স্টেশনের কাছে একটা ভাড়া বাড়িতে থাকতাম। ওখানেই আমার ছেলে হয়। আমার স্বামীও থাকতেন আমাদের সাথে। 
- তারপর কি হল ?
- বছর পাঁচেক ভালোই ছিলাম। আমাদের খাওয়া-পড়া- থাকার কোনো অসুবিধা হয় নি। কিন্তু হঠাৎ করে একদিন উনি কাজের শেষে রাতে আর বাড়ি ফিরলেন না। 
- উনি কোথায় কাজ করতেন ?
- আমাকে বলতেন সোদপুরের একটা পাম্পের কারখানায়। ম্যানেজার ছিলেন।
- তারপর আপনি কি করলেন ?
- সারা রাত ছেলে কোলে করে বসে রইলাম যদি উনি ফেরেন এই আশায়। দিন সাতেক কেটে গেল উনি কিন্তু ফিরলেন না। তখন ওনার একটা ফটো নিয়ে ওনার অফিসে গেলাম। ওখানে ফটো দেখে বলল এই  নামে ঐ অফিসে কেউ কাজ করে না।
- আপনার স্বামীর নাম কি ?
- দেবপ্রিয় চৌধুরী।
- তারপর !
- ছেলে তো কেঁদে কেঁদে অস্থির। ঘরে যা ছিল শেষ হয়ে এলো। হাতের টাকাও ফুরিয়ে গেল। বাড়ি ছাড়তে হলো। 
- আপনার বাপের বাড়ি চলে যেতে পারতেন।
- আমার যে কেউ নেই মা। ছোটবেলায় মাবাবাকে হারিয়ে মামার বাড়িতে মানুষ হয়েছি। দিদা মারা যেতেই  মামারা আমার বিয়ে দিয়ে দিল।
- কোন খোঁজ খবর না নিয়েই !
- ওরা জেনেশুনেই দিয়েছে।
- সে কি !
- হ্যাঁ মা। পরে খোঁজ করে করে সব খবর পেলাম। আমার স্বামী একটা সিনেমা হলের মালিক ছিলেন। পরে ঐ হলটা চলতো না বলে রেস্টুরেন্ট করেছেন।
- তাহলে তো ওনার অনেক পয়সা।
- হ্যাঁ মা। ওনার প্রথম স্ত্রী জানতে পেরে ওনাকে আটকে দেয়।
- আপনি এখানে থাকেন কেন ?
- মিশনের মহারাজের কাছে সব কথা বলাতে উনি এখানে থাকতে দেন আর আমাদের সব খরচ মিশন থেকেই আসে। আমার ছেলেও মিশনেই পড়ে পাশ করেছে। মহারাজ আর স্কুলের স্যারেরা আমার ছেলেকে খুব ভালো  বাসেন।
- এখন আপনার ছেলে কি করে ?
 
ছবি সহযোগিতায় : উষসী রায়

         ।। (শেষ পর্ব )।।

- বেলঘরিয়া রামকৃষ্ণ মিশন শিল্পপীঠ থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে সোদপুরে একটা পাম্প কোম্পানিতে অ্যাসিস্টেন্ট ইঞ্জিনিয়ার পদে আজ ছয় বছর হলো চাকরি করছে। তিনবন্ধুর মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। বর্ণালী বলল-
- আপনি অন্য কোথাও গিয়ে থাকতে পারেন ?
- হ্যাঁ মা এবার যাবো। যে মহারাজ আমাদের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি আজ মাস ছয়েক আগে দেহ রেখেছেন। আর আমাদের কে দেখবে!
সোনালী বলল-
- সেই মহারাজের নাম কি ?
- নিত্যানন্দ মহারাজ।
- আরে উনিই তো ব্যারাকপুর মিশনের প্রতিষ্ঠাতা!
- হ্যাঁ মা ওনার মতো মানুষ হয় না।
- আপনার এখানে থাকতে ভয় করে না ?
- তা করত না যে তা নয়। প্রথম প্রথম খুবই ভয় করতো। আমাদের সাথে মহারাজ আর একজন দুঃস্থ মহিলাকে   থাকতে দিয়েছিলেন। আজো উনি আছেন আমাদের সাথে। আমার ছেলের মা আর মাসি ছাড়া দুনিয়ায় আর কেউ নেই। 
- এখন কোথায় যাবেন কিছু ঠিক করেছেন ?
 - হ্যাঁ মা। আমার স্বামী আমাকে বেশ কিছু গয়না গড়িয়ে দিয়ে ছিলেন। কতো টাকাপয়সার টানাটানি গেছে কিন্তু কোনো অবস্থাতেই আমি সেই গয়নায় হাত দিই নি। গত বছরে সেই গয়না বিক্রি করে ছেলের জন্যে স্টেশনের কাছে দেড় কাঠা জায়গা কিনেছি। মহারাজ সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ঐ জায়গার দলিল ওনার  কাছেই রেখে দিয়েছিলাম। উনি মারা যাবার কিছুদিন আগে আমাকে দলিলটা দিয়ে দেন। আমার ছেলে লোন নিয়ে ঐ জমিতে একটা ছোট বাড়ি করেছে।
- খুব খুশি হলাম মাসিমা। ভগবান আপনাদের মঙ্গল করুন।
- হ্যাঁ মা,ভাগ্যিস কি মনে করে একটুকরো জমি কিনেছিলাম। জমিটা আমার নামেই আছে। পরে ছেলের নামে করে দি। তাই অফিস থেকে লোন নিতে আমার ছেলের কোনো অসুবিধা হয় নি।
- রেজিস্ট্রেশনে তো অনেক টাকা লাগে। কোথায় পেলেন ?
- সবই মহারাজের অসীম কৃপা। বড় দয়ার শরীর ছিল মহারাজের। উনিই সেই টাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে ছিলেন।
পুষ্পিতা বলল-
- আপনার স্বামীর মুখোমুখি হননি আর কোনদিন ?
- নাহ্ কি হবে! জেনেশুনে আমাদের যখন অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছেন আর সেই পাঁক ঘেটে কি লাভ ! আর আমাদের বিয়ের রেজিস্ট্রেশন হয় নি। আমাকে উনি অস্বীকার করতেই পারতেন। সে টা সহ্য করতে পারতাম না। তার চেয়ে যে কয়েকটা বছর উনি আমাদের সাথে থেকেছিলেন তাই যথেষ্ট। তার স্মৃতির আনন্দটুকু সম্বল করে এই পর্যন্ত তো এলাম। আমি এতেই খুশি। তাছাড়া ঐ জমিটুকু তো ওনার দেওয়া গয়না দিয়েই কিনেছি। তাই আর আমি যাই নি। আর তাছাড়া আমাদের মাথার ওপর মহারাজের আশীর্বাদ আছে এই আমার অনেক পাওয়া।
- ভগবান মাথার ওপর আছেন মাসিমা। 
- ঠিকই বলেছ মা। 
- আপনি আমাদের আজ ডাকলেন বলে এতবড় একটা জীবনের সংগ্রামের কথা আমরা জানতে পারলাম।
- আমি তোমাদের প্রায়ই এখানে দেখি তাই তোমাদের সাথে কথা বলার খুব ইচ্ছে করল।
- আপনি আর কতদিন এখানে আছেন ?
- সামনের মাসেই চলে যাব মা।
- আচ্ছা মাসিমা আমরা যখন এখানে আসব আপনার সঙ্গে নিশ্চয়ই দেখা করবো।
- আচ্ছা মা। 
- আপনি ভালো থাকবেন মাসিমা। 
- হ্যাঁ মা তোমরাও ভালো থেকো।
হঠাৎ বর্ণালী জিজ্ঞাসা করল -
- আপনি সিঁদুর পড়েন কেন ?
- উনি যে এখনো বেঁচে আছেন।
- যে আপনাকে এতবড় ধোঁকা দিল আপনি তার নামে এখনো সিঁদুর পড়েন কেন মাসিমা ?
- আমার কাছে বিয়েটা তো মিথ্যে ছিল না।
শ্রদ্ধায় তিন বন্ধুর চোখমুখ ভরে উঠল। বর্ণালী অবাক হয়ে গেল।এই ভদ্রমহিলার কষ্টের কাছে ওর কষ্ট তো কিছুই না! বর্ণালীর স্বামী সবসময় ওর পাশেই থাকেন।ওকে খুব খেয়াল রাখেন। শাশুড়ি একটু মেজাজি হলেও ওর স্বামী আর শ্বশুড়মশাই খুব ভালো মানুষ। বর্ণালীকে দুজনেই খুব ভালোবাসেন। কিন্তু এই ভদ্রমহিলার স্বামী তার স্ত্রী এমনকি তাদের ছেলেটারও কোন খোঁজ রাখেননি। ভাসিয়ে দিয়ে চলে গেছেন। মনে মনে বর্ণালী ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিল যে ও অন্তত এই অবস্থায় পড়ে নি।
 ওরা ওনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে স্কুলের পথে পা বাড়াল। সময় হয়ে আসছে। এখনি ছুটির ঘন্টা বাজবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ