পোস্ট বার দেখা হয়েছে
স্বপ্নের উড়ান
সুমনা সেনগুপ্ত
তুন্না সারারাত এপাশ ওপাশ করে কাটিয়ে দেয়, তৃষাও মেয়েকে বুঝতে দেয় নি সেও জেগে রয়েছে। পুরোনো অ্যালবাম টা সাথে নিয়েই শুয়েছিল তুন্না, বুকে জড়িয়ে রেখে ....
তৃষা ব্যানার্জি একটি বেসরকারি স্কুলের শিক্ষিকা। আপাততঃ এখন তার পরিচয় সে একজন সিঙ্গেল মাদার। তুন্না পৃথিবীর আলো দেখার আগেই ডঃ সন্দীপন ব্যানার্জী আন-অফিসিয়ালি তৃষা কে ডিভোর্স দেয় তার মায়ের বাধ্য ছেলের পরিচয় দেওয়ার জন্য! কেননা শ্রেণীগত বিভাজনের গোঁড়ামী তার মায়ের কাছে এই আধুনিক সমাজেও যথেষ্ট স্পষ্ট। তৃষারা ছিল কায়স্থ আর ওরা ব্রাহ্মণ! তেলে জলে মোটেই মিশ খায় না!
তুন্নার জন্মের সময়েই হার্টে একটা ফুটো ধরা পরে, চাইল্ড স্পেশালিস্ট ডঃ নন্দিনী পাঁচ বছর ধরে ট্রিটমেন্ট করে এইমাসেই অপারেশনের তারিখ ঠিক করেছেন। যথেষ্ট ব্যয় সাপেক্ষ এই অপারেশন তবুও প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে লোন ও গয়না বন্দক দিয়ে দু'লক্ষ টাকা তৃষা শেষ পর্যন্ত যোগার করেছে, কেননা ওই ভার বহন করা পদবীর মানুষটার জন্য বাপের বাড়িতেও সে অতিরিক্ত। সুতরাং তুন্না'ই তার জীবনের সব কিছু!
তুন্না সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই নিজেই তৈরী হয়ে নিয়েছে, কেননা ও হসপিটাল থেকে ফিরেই যে দূ্গ্গা ঠাকুর দেখতে যাবে সামনেই পুজো। চারদিনের চার'রকম জামা কেনা তার কমপ্লিট মায়ের সাথে। নতুন হিল তোলা জুতোটাও বাক্সে গুছিয়ে রেখেছে। ও তো হসপিটালে চেক আপে যাচ্ছে, বিদেশী এক ডাক্তার তাকে দেখতে চেয়েছেন, তাই তার সাথে দেখা করেই সে ফিরে আসবে পাশের ফ্ল্যাটের আঙ্কেলকে বলে টাটা বলে গটগট করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে নীচের তলার সবার সাথে কথা বলছে! তুন্না জানে না ওর অপারেশনের কথা।
তৃষা কে ভরসা দেওয়ার মতো কেউ নেই, অগত্যা ফ্লাটে তালা দিয়ে সেও নেমে ট্যাক্সি খোঁজ করতে লাগলো! ট্যাক্সি নিয়ে তুন্নার সব প্রয়োজনীয় জিনিস ও তার নিজের কিছু ব্যবহার করার মতো লাগেজ নিয়ে রওনা দিল হসপিটালের উদ্দেশ্যে। ট্যক্সির সিটে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে ভাবতে লাগল আজ সন্দীপন যদি তার পাশে থাকতো তাহলে হয়তো এতটা একাকিত্ব বোধ তার হতো না। তুন্না ফিরে পূজোয় কোন জামাটা কোন দিন পড়বে, কোন হেয়ারব্যান্ডটা সে ম্যাচিং করে পড়বে এই নিয়ে বক বক করেই চলেছে। হসপিটালের সামনে এসেই তৃষার মনটা যেন কেমন উদাস হয়ে গেল। তুন্নাকে সুস্থ্য করে নিয়ে যেতে পারবে তো সে!
রিসেপশানের ,সব ফরর্মালিটিস কমপ্লিট করে চাইল্ড ওয়ার্ডে পৌঁছে গেল সে তুন্নাকে নিয়ে । সকাল সাতটায় অ্যাডমিশন আর সন্ধ্যা সাতটায় ওটি! খুব তাড়াতাড়ি করেই হসপিটাল ডিপার্টমেন্ট সব টেস্টের জন্য প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে! তুন্নার হার্টের কান্ডিশান খুবই খারাপ কি হবে এই ভাবনার ,তার চোখে মুখে প্রকাশ পেলেও মেয়েকে উৎসাহ ও সাহস যুগিয়েই চলেছে! ডঃ নন্দিনীও চলে এসেছেন, তৃষাকে বললেন ভরসা রাখুন যিনি অপারেশন টা করবেন তিনি ডাক্তার নয় একপ্রকার ভগবান বলতে পারেন।
তুন্নাকে ওটির ড্রেস পড়ানো হচ্ছে ও তৃষার চোখ জলে ঝাপসা হয়ে আসছে ! ট্রলিতে করে তুন্নাকে ওটিতে নিয়ে যাচ্ছে তৃষা কিছুতেই ঠিক থাকতে পারছে না আর! তুন্না ট্রলিতে শুয়ে বলছে মাম্মা এই তো দু'মিনিট যাবো আর আসবো এই বোকা মেয়ে কাঁদে নাকি ,ঠিক যেমন টা করে তৃষা তুন্নাকে বোঝায়! ওটি রুমের ভেতরে চলে গেল তুন্না, তৃষা একা ওটির বাইরে দরজাটাও বন্ধ হয়ে গেল শুধু ওটির ওই ছোট্ট আলোটাই ভরসা!
অপারেশন রুম থেকে এক নার্স তৃষার ব্লাড গ্রুপটা জানতে চাইলে মিল হলো না! তুন্না ও পসেটিভ, তৃষা এবি পসেটিভ। রক্তের যোগার করতে হবে কি করবে তৃষা ! তুন্নার অপারেশন এখনও চারঘন্টা চলবে তৃষা ব্লাড ব্যাংক থেকে দু'ব্যাগ রক্ত নিয়ে আসতে বেশ সময় লেগেছে ,আসলে ব্লাড গ্রুপটা খুব রেয়ার ! "ওটি ততক্ষণে কমপ্লিট" তৃষা প্রায় একপ্রকার দৌড়েই ওটি রুমের দিকে ছুটতে থাকে, পৌঁছে গিয়ে দেখে তুন্নার একহাতে ব্লাড ও একহাতে স্যালাইন, ট্রলিতে করে তুন্নাকে বেডে নিয়ে যাচ্ছে ওয়ার্ডবয় ! ডঃ নন্দিনী তৃষাকে বলেন, ম্যাডাম আপনাকে আগেই বলেছিলাম আমাদের ডাক্তার বাবু ভগবান, দেখুন রক্ত আসতে দেরী হওয়াতে , নিজেই রক্ত দিয়েছেন এখন তুন্না আউট অফ ডেঞ্জার! ভগবানকে একটা প্রণাম করতে গিয়ে তৃষা দেখে সন্দীপক শুয়ে আছে! সন্দীপক তৃষার হাতটা ধরে বলে মেয়ে আমার হসপিটাল থেকে নিজের বাড়ীতে যাবে তৃষা আর ফ্লাটে নয়!
0 মন্তব্যসমূহ