শারদ সংখ্যা ২০২০ || গল্প || সমাপ্ত বিশ্বাস




পোস্ট বার দেখা হয়েছে


বড়দি
সমাপ্ত বিশ্বাস

অটো থেকে নেমে হন হন করে হেঁটে চলেছি। দিক্‌ বিদিক্‌ জ্ঞানশূন্য। এখনই হয়ত প্রেয়ারের ঘন্টা পড়ে যাবে। স্কুলের ঘড়িটা কয়েক মিনিট এগিয়ে চলে। রতন দাকে অনেকদিন বলা হয়েছে কিন্তু ঘড়িটা ঠিক করছে না। প্রেয়ার শুরু হবার পর স্কুলে ঢুকলে বড়দির মুখ ভার। শুধু কি তাই! প্রায়ই বিভিন্ন ধরনের কটু কথা শোনায়। অথচ লেট অ্যাটেন্ডেন্‌সও দিচ্ছে। রেল লাইন ক্রস করে রাস্তা ডানদিকে টার্ন নিয়েছে – শিরিষ গাছটি অতিক্রম করার মুখেই এক অচেনা কন্ঠের ডাক শুনতে পাই।
-কিরে হিমি না?
ঘাড় ঘুরিয়ে একেবারেই চিনে ফেলি। একসাথে এন.বি.ইউ তে পড়েছি। কিন্তু এই মুহুর্তে কিছুতেই নামটা মনে করতে পারছি না। পেটে আসছে মুখে আসছে না। খুবই অস্বস্তি হচ্ছে। যাহোক, অস্বস্তি সরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-কিরে কেমন আছিস? কতদিন পর দেখা! তা প্রায় এক যুগ হবে।
-হ্যা রে, ইউনিভার্সিটি থেকে বের হবার পর তো আর দেখা হয়নি। তা, তুই এখানে কেন?
-এখানে একটি স্কুলে জয়েন করেছি। দিন পনের হল।
-তাই নাকি! বাহ্‌। কোন স্কুল রে? দেশবন্ধু হাইস্কুল কি?
-হ্যাঁ হ্যাঁ
-আমাদের পাড়ারই স্কুল। তা কোথায় থাকিস?
-কোচবিহারে! এই শোন তুই তোর মোবাইল নম্বরটা আমাকে দে। আমি পরে তোর সাথে যোগাযোগ করব। লেট হয়ে যাচ্ছে। বড়দি খুব কড়া রে।
-ও, হ্যাঁ ঐ স্কুলের হেডমিস্ট্রেস খুব সুবিধার নয় রে। যা, তাড়াতাড়ি যা।
আমি ওর মোবাইল নম্বরটা নিয়ে পা চালিয়ে যাই। স্কুলের গেটে ঢুকতেই আশঙ্কার কালো মেঘ মনের মধ্যে জমতে লাগল। স্টাফরুমে ঢুকেই দেখি অ্যাটেন্ডেন্স খাতা উপরে বড়দির ঘরে চলে গিয়েছে। এখন সই করতে হলে ওখানে গিয়ে করতে হবে। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখছি দশটা পয়তাল্লিশ। দ্রুত পায়ে হেঁটে ওপরে গিয়ে সই করতে গিয়ে দেখি লাল কালি পড়ে গিয়েছে। বড়দির নিয়ম হল প্রেয়ার লাইনে উপস্থিত থাকতেই হবে নচেৎ লাল কালিতে লেট অ্যাটেন্ডেন্স চিহ্নিত হবে। সই করে বের হচ্ছিলাম। বড়দি ডাকলেন, এই হিমি শোনো, এভাবে দেরি করে আসা যাবে না।
আমি কিছু না বলে নীরব থাকি। কোন উত্তর না পেয়ে বড়দি আরো কর্কশভাবে বলতে থাকে, গত সোমবারও তোমার দেরি হয়েছিল।
-সেদিন বাস খুব কম ছিল। ইলেকশনের জন্য অধিকাংশ বাস তুলে নিয়েছে।
-সে আমি বুঝব না। দেরি হলে আর স্কুলে আসবে না।
-বড়দি, আপনি তো লাল কালি দিয়েছেন। মাসে তিনটে লেটে একটি সি.এল হবে।
এই সি.এল এর নিয়ম আমার বরের কাছ থেকে জানা।
-তোমার নতুন চাকরি। অন্য ছুটি তো নেই। সি.এল বা কয়টা পাবে। বাধ্য হয়ে কিন্তু আমাকে কড়া স্টেপ নিতে হবে -- উইদাউট পে করব। তারপর কথার স্বর একটু নরম করে বলে, তুমি তো আলিপুরদুয়ারেই থাকতে পার। কোচবিহার থাকার দরকারটা কি? তোমার হাজব্যান্ড তো এখান থেকেই কোচবিহার ডেইলি যেতে পারে।
ছবি সহযোগিতায় : উষসী রায়
কোচবিহারে আমি, স্বামী এবং তিন বছরের মেয়েকে নিয়ে ভাড়া বাড়িতেই থাকি। ওখানে বিশ্বস্ত আয়া মাসি আছে। বাচ্চাটিকে দেখভাল করে। হাজব্যান্ড চেয়েছিল আলিপুরদুয়ারেই থাকতে। বাড়িও বুকিং করেছিলাম। কিন্তু ভাল মাসি পেলাম না। তাছাড়া বড়দি স্কুল নিয়ে যত কড়া নিয়ম-কানুন করেছেন! টিফিন পিরিয়ডেও টিচারদের বাইরে বেরনোর অনুমতি নেই। বের হলেও অনেক বলে কয়ে। তাই টিফিন পিরিয়ডে এসে বাচ্চাটিকে দেখে যাব সে উপায়ও নেই। শুনলাম সারা বছর স্কুলের টাইম টেবিল একই। অর্থাৎ দশটা চল্লিশ থেকে চারটে তিরিশ। একমিনিট আগেও ছুটি নেই। পরীক্ষার দিনগুলোতে পরীক্ষা হয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত বসে থাকতে হয়। বছরের অনেকদিন যখন স্কুলে পঠন পাঠন নেই, তখনও কোন কাজ থাকুক বা না থাকুক, স্কুল আগে ছাড়া যাবে না। অথচ অন্যান্য স্কুলে সে বিধি নিষেধ নেই। আমার বরের স্কুলেও সে রকম। তাই দরকার পড়লে অফ পিরিয়ডে বা টিফিন পিরিয়ডে বাসায় এসে মেয়েকে দেখভাল করতে পারে। তাই আলিপুরদুয়ারে না থেকে কোচবিহারেই থাকার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু বড়দিকে এত কথা বললাম না, বলেও লাভ নেই। উনি সব সময় চেষ্টা করেন কোন স্টাফ কতটা খারাপ থাকতে পারেন। এই স্কুলে জয়েন করেই কলিগদের কাছ থেকে শুনেছিলাম, স্টাফ রুম পরিবর্তনের কথা। বড়দি যখন বুঝল যে ম্যাডামরা নীচে স্টাফরুমে খুব হইচই, আনন্দে থাকে। তখন পরদিনই বিশেষ কারন দেখিয়ে উপরে একটি ঘরে স্টাফরুম করেন। আবার কিছুদিন পর, ম্যাডামরা যখন বলল, বড়দি এই স্টাফরুমটিই বরং ভাল – বাথরুমটি খুব পরিস্কার, কোন গন্ধ নেই, আলো বাতাসে ভরপুর। ও মা! এর কয়েকদিন পরেই আবার পুরনো স্টাফরুম।
আমাকে নিরুত্তর দেখে বড়দি একটু ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। প্রকৃতপক্ষে বড়দি-র কোন কথার উত্তর দিতে মন চায় না। ওনার কোন্‌ কথাটা পছন্দ হবে আর কোন্‌টা হবে না – তা বোঝা আমার পক্ষে অসাধ্য।
-শোন তুমি বেশি বয়সে চাকরি পেয়ছ। বাচ্চা হয়ে যাওয়ার পর এই বয়সে চাকরি পাওয়া খুব কঠিন। এখনও অ্যাপ্রুভাল হয়নি। ভাল ভাবে স্কুল কর।
কথাগুলো যেন সর্তকতামূলক বার্তা মনে হল। বড়দির কথাগুলো মনে বেশ আঘাত দিল। উনি কী বলতে চান! এই বয়সে কি চাকরি পাওয়া যায় না! উনি কি কিছু অনৈতিক সংযোগের ইঙ্গিত করছেন? চারদিকে শোনা যাচ্ছে চাকরি নিয়ে যত গুজব। ঘুষ ছাড়া নাকি চাকরি আর মেলে না। উনি কি সেই রকম ইঙ্গিত দিচ্ছেন! মনটা ভীষন খারাপ হয়ে গেল। চোখ জলে ভরে উঠল। একদিকে বয়সের খোঁটা, অন্যদিকে চাকরি নিয়ে বাজে ইঙ্গিত। আত্মসম্মানবোধে খুব আঘাত পেলাম। কোন রকমে চোখের জল লুকিয়ে ওখান থেকে পালিয়ে বাঁচলাম। উনি জানেন না এই চাকরির পেছনে আমার কত ডেডিকেশান, কত পড়াশোনা, কত রাত না ঘুমিয়ে কাটানো। এর মধ্যে পি.এইচ.ডি এর কাজ চলছে। ফ্যামিলি প্লানিং হয়েছে, আবার বি.এডও করলাম। আর বি.এড করার পরই চাকরি হল। প্রায় পাঁচ বছর পরে স্কুল সার্ভিসের পরীক্ষা হয়েছে। এমন নয় যে প্রতিবারই হচ্ছে। সুতরাং চাকরি পেতে পেতে বয়সটাও অনেকটা বেড়ে গিয়েছে। উনি কি জেগে ঘুমিয়ে থাকেন! দেখতে পাচ্ছেন না রাজ্যে স্কুল শিক্ষার খারাপ অবস্থা! এই স্কুল তো বড় উদাহরণ। একটি মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্রী সংখ্যা কমতে কমতে মোট ৫০ এর নীচে নেমে গিয়েছে। শিক্ষিকা ভাগ্যিস এখানে যথেষ্ট আছে। অবশ্য দু এক বছরের মধ্যে সব সারপ্লাস হয়ে যাবে। উনি হয়তো জানেন না, আমি শেষ পর্যন্ত এক বছরে তিন তিনটে চাকরির ইন্টারভিউ ফেজ করেছি। চূড়ান্ত সফল হয়ে এখানে এসেছি। উনি জানেন না, আমার লেখা গবেষনাধর্মী বই রয়েছে- যেগুলো সারা পৃথিবীর স্কলাররা তাদের ফারদার স্টাডিজে কাজে লাগায়। জানলে হয়ত, একটু ভেবে কথা বলতেন। আমিও চাই না, এসব নিয়ে চর্চা করতে। কি হবে! হয়ত পরবর্তীতে আমার কিছু প্রজেক্টের কাজ রয়েছে- সেগুলোতে বাধা সৃষ্টি করবেন।
আমার অশ্রুসিক্ত চোখ দেখে স্টাফরুমে ভাস্বতি দি বললেন, কি রে কী হয়েছে? বড়দি কিছু বলেছেন?
আমি নীরব থাকায়, মিলি জোর করে চেপে ধরল। শেষে বাধ্য হয়ে বললাম। সবার মন খারাপ হয়ে গেল। যদিও সবাই ওয়াকিবহাল বড়দির আচরণ সম্বন্ধে। তবুও সকলেই বড়দিকে খুব মেনেই চলে। মন না চাইলেও ওনার ভাবনাকেই সাধারনতঃ সকলে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। তবে আমার সাথে ওনার আজকের আচরণকে কেউই ভালভাবে নিল না। সকলেই বড়দির নামে বিভিন্ন রকম সমালোচনা করতে লাগল । রেশমা বলল – ও একটা গ্রেট ফাঁকিবাজ। নিজে দিনের পর দিন স্কুলে আসবে না। বাঙ্গালোরে মেয়ের ওখানে যাবে। আর এসেই সব সিগনেচার করে দিবে। বলে কিনা স্কুলের কাজে বাইরে থাকতে হয়েছিল। আর আমাদের একটু দেরি হলেই! আর দেরিও তো হয়নি। ক্লাস শুরুর আগেই ঢুকেছে, তবুও এত কথা!
মিলি বলল - এত কথা উনি কেন শোনান? দেরি হলে লাল কালি দিবে। তিনটে লাল কালিতে তো একটা সি.এল হয়। বেশি দেরি হলে সি.এল হবে। ব্যাস এত কথা শোনানোর কী হল?
মৌসুমি দি বলেন, এরকম স্কুল ওয়েস্ট বেঙ্গলে আছে কিনা সন্দেহ হয়। প্রতি ক্লাসে স্টুডেন্ট দু’তিন জন করে। অথচ প্রতিদিন কত স্টপগ্যাপ ক্লাস করতে হয়। আবার স্টপগ্যাপে যে কোন সাবজেক্ট পড়ানো চলবে না। নির্দিষ্ট সাবজেক্টই পড়াতে হবে।
-সেদিন একটি পুরনো ছাত্রী এসেছিল। এইট পাসের সার্টিফিকেট নিতে। পবন দা সব রেডি করে দিতে চাইল। কিন্তু উনি বেঁকে বসলেন। দিবেন না। অনেকদিন ধরেই নাকি গরীব মেয়েটিকে ঘুরাচ্ছেন।
-উনি এমন একজন মহিলা যে কিনা মাতৃ যন্ত্রনা বোঝেন না। বাচ্চাটির জ্বর! সি.সি.এল চাইলাম পনের দিনের জন্য। দিলেন না। এমন নয় যে স্কুল-ভর্তি স্টুডেন্ট! ছেলেমেয়েদের ক্ষতি হবে! স্কুল থাকবে কিনা সন্দেহ। অথচ উনি এমনভাব দেখাচ্ছেন যেন.......মিলি রাগে আর কিছু বলতে পার না।
সিনিয়র নির্মলা দি বললেন, বড়দি হিমি কে কথাটা না বললেই পারতেন। মেয়েটি এই বয়সে বাচ্চা সামলে, সংসার সামলে স্কুলের চাকরিটা পেয়েছে। ওকে তো বাহবা দেওয়া উচিৎ। ওকে দেখেই তো অন্যদের শেখা উচিৎ। ধৈর্য্য, অধ্যবসয়, জেদ – যুবসমাজ বিশেষত মেয়েরা তো শিখবে এসব। ভরসা পাবে এগিয়ে যাওয়ার।
ছবি সহযোগিতায় : উষসী রায়
আরো অনেকে অনেক কথাই বলল। কিন্তু আমি জানি, কেউ আর সামনে কিছু বলতে পারবে না। সবাই খুবই সমীহ করে চলে ওনাকে। এর মধ্যে একফোঁটা ভালবাসা নেই। শুধু অ্যাডজাস্টমেন্ট। দু’জন সিনিয়র টিচার আছেন – ওনারা বড়দি, বড়দি বলে অস্থির। বড়দি স্কুলে না এলেও কোন সিদ্ধান্ত নিতে গেলে বড়দিকে ফোন, হোয়াটসঅ্যাপ । কোন কারনে হয়ত স্কুলে একজন স্টুডেন্টও আসেনি। স্কুল কখন ছুটি হবে সে সিদ্ধান্তও নিতে হলে বড়দিকে ফোন করেই নিতে হবে। বড়দি যদি বলে চারটা তিরিশ, তবে তাই ঠিক। কেউই আর দ্বিতীয়বার বলার চেষ্টা করে না।
দেখতে দেখতে স্কুলে যোগদান তিন মাস হয়ে গেল। এখনও বেতন হয়নি। অ্যাপ্রুভালটা আটকে আছে। টাকা পয়সার সমস্যা হলেও স্টাফদের মাসিক চাঁদা থেকে আরম্ভ করে অন্য সব কনট্রিবিউশনও করতে হয়। স্কুলের একজন অস্থায়ী আয়া আছে। আমাদের দেওয়া টাকাতেই তার বেতন হয়। উনি স্টাফদের জন্য নানা ফরমাস শুনে  কাজ করেন। স্টাফরুম পরিস্কার করেন, জল আনেন, চা কফি করেন, অনেক সময় ম্যাডামদের জন্য রান্না করেন। তবে বেশিরভাগ কাজ বড়দির জন্য। বড়দিকে দিনের মধ্যে সাত/আটবার কফি খাওয়াতে হয়, ওনার অনেক ব্যক্তিগত কাজও করতে হয়। তাছাড়া বিদ্যালয়ের গ্রুপ ডি রতন দাও যেন তার কেনা গোলাম। আর রতন দাও বেশ চতুর। সেও শুধু বড়দির কথাতেই চলেন। অন্যান্য স্টাফদের খোঁজ খবর নেবার দায় তার নেই যেন। এমন কি মিড ডে মিল রান্নার যে দু’জন মহিলা আছেন, বড়দি তাদেরও রেহাই দেন না। মাঝে মাঝে বাড়ি থেকে কলার মোচা বা শাক নিয়ে আসেন ওদের দিয়ে কেটে নেওয়ার জন্য। প্রতিদিন মিড ডে মিল চেখে দেখবেন। নামেই চেখে দেখা। আসলে বাড়িতে রান্না বান্না বেশি করেন না লোকের অভাবে। তাই মিড ডে মিল দিয়েই চালিয়ে দেন। মাসিকে দিয়ে সাত/আটবার কফি বানিয়ে উদর পূরন করেন। শুনলাম ম্যাডামরা যদি কখনও খান এবং যদি তার কানে পৌঁছায়, তবে চরম হেনস্থা হতে হয়। তাই কেউ কখনও সেদিকে যায় না। একবার রতন দা একটা ডিম খেয়েছিল। কিভাবে যেন উনি জেনেছিলেন, প্রচন্ড অপমান করেছিলেন রতন দাকে। আর একবার স্কুলের সরস্বতী পূজোয় কিছু পাঁপড় বেঁচে গিয়েছিল। পবন দা কয়েকদিন পরে ঐ পাঁপড়গুলো মিড ডে মিলের ঘরে পাঠিয়েছিল যাতে মেয়েগুলো খেতে পারে। অনেকগুলো পাঁপড় ছিল জন্য মিড ডে মিলের মহিলা দু’জন স্টাফরুমে এসে সবাইকে পাঁপড় ভাজা দিয়ে গিয়েছিল। পবন দাও নিয়েছিল। ওমা! মুখে দিবে এমন সময় বড়দি হাজির। পাঁপড়ের ইতিহাস জেনেই এসেছিলেন। আর এসেই বকাবকি --  ‘আপনারা কি কোনদিন খান না!’ পবন দা এত উৎসাহ উদ্দিপনা নিয়ে পাঁপড়ের আয়োজন করেছিল। বড়দির কথাতে ভীষণ আহত হল। সেই থেকে আর কেউ কখনও ওমুখো হয় না।
সেদিন ছিল সোমবার। জলপাইগুড়িতে আমার বাপের বাড়ি। ওখানে ছিলাম আগের দিন। মেয়ে ছিল বাবার সাথে। ভোরবেলা বারভিষাগামী বাসে চেপে আলিপুরদুয়ারের চৌপথিতে নেমে আবার অটো করে স্কুলের মোড় অব্‌দি পৌঁছাই। পাঁচ/সাত মিনিট লেট হয়েছিল। আদতে লেট নয়। ওনার হিসেবে লেট। দশটা পঞ্চাশের আগেই পৌঁছেছিলাম। বাড়িতে মা রুটি ভেজে দেয় সাধারনতঃ। ঐদিন মায়ের অসুস্থতার কারনে তা আর হয়নি। সোমবার আবার আমি নিরামিষ খাই। বাইরে খুব বাধ্য না হলে খাই না। আয়া মাসিকে বললাম, আমাকে একটু আলুসেদ্ধ দিয়ে ভাত ফুটিয়ে দিও। মাসি বেশ খুশি মনে ব্যবস্থা করতে লাগল। আসলে ওনাকে এজন্যই রাখা হয়েছে। কিন্তু এই দায়িত্ব তাকে খুব বেশি পালন করতে হয় না। তাই মাঝে মাঝে দায়িত্ব পেলে খুব তৎপর হয়ে ওঠে। ওনার রান্নার মাঝখানে বড়দির ডাক পড়েছিল হয়ত দু’একবার। দেরি করে যাওয়াতে কৈফিয়ত চেয়ে জানতে পারেন হিমি ম্যাডামের জন্য রান্না হচ্ছে। পরদিন মৌসুমিদিকে ডেকে নিয়ে বলেন, ‘এভাবে একজনের জন্য তো রান্না করা যাবে না। গ্যাস নষ্ট হচ্ছে’।
-এজন্যই তো মাসিকে রাখা হয়েছে।
-তাই বলে একজনের জন্য রান্না কেন? চার/পাঁচজন খেলে তবুও হয়। তাছাড়া মাসিরও তো অন্য কাজ থাকে। একজনের জন্য তো উনি নন।
-হিমি তো ডেইলি খাচ্ছে না। মাসে দু’একবার – যদি ও জলপাইগুড়ি থেকে আসে।
-ও তো মিড ডে মিল খেতে পারে।
মিড ডে মিল নিয়ে অতীতের অভিজ্ঞতার কথা মৌসুমি দি ভালই জানে। তবে বলে, ও তো সোমবার নিরামিষ খায়। তাই মিড ডে মিলও খাবে না। দোকানের খাবার আনিয়েও খাওয়া যাবে না।
-ওসব আমি জানি না। ওকে বলবে ব্যবস্থা করতে।
এসব কথা শুনে আমার অন্তরাত্মা ব্যথিত হয়ে উঠল। এ কোন নীচ মনা মহিলার সাথে কাজ করছি। আমি তো এমনি খাচ্ছি না। রীতিমত মাসিক চাঁদা দিচ্ছি। ওর মধ্যে গ্যাসের টাকাও রয়েছে। তাছাড়া চাল, ডাল, তেল, লংকা, আলু কেনার টাকাও দিচ্ছি। আর আয়া মাসিকে তো এজন্যই রাখা হয়েছে।
মিলি বলল – উনাকে যে দিনে সাত/আটবার মাসি কফি বানিয়ে দিচ্ছেন! আমাদের টাকা দিয়ে মাসিকে রেখে ওনার খিদমত খাটার জন্য তো মাসি নন।
বিনতা দি বললেন – আসলে ব্যাপারটা কি জানিস, কয়দিন আগে উনি প্রস্তাব দিয়েছিলেন, স্কুলে দুপুরের খাবার রান্না হোক। সবাই বাড়ি থেকে দুধ কর্নফ্লেক্স খেয়ে আসব। আর স্কুলে এসে কব্জি ডুবিয়ে খাব। কিন্তু আমরা কেউ তো ওনার প্রস্তাবে সায় দেই নি। সে রাগেই হয়ত.......
মিলি বলল, ‘ওনার বাড়িতে কেউ নেই। মেয়ে বাইরে থাকে, রান্নার মাসি এখন নেই। তাই এখানেই কর্ম্মটি সারতে চেয়েছিলেন’।
ভাস্বতি দি বললেন, ‘আমাদের তো বাড়িতে রাধঁতেই হয়। বাড়িতে আরো লোকজন আছে। ওনার মত তো নই’।
আমি বললাম , ‘ ওনার স্বামী কী খেতেন তাহলে?’
-ওনার স্বামী খুব সহজ সরল। উনিও একটা স্কুলের হেডমাস্টার। ওনার স্কুলে হয়ত রান্না বান্না হয় নয়তো মিড ডে মিল খান। আয়া মাসি মাঝখানে এসে বললেন, বড়দি যা বলে বলুক আমি আপনাকে রান্না করে দিব।
আমি তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বললাম, সেটা কি ঠিক হবে?
মৌসুমি দি বললেন, তাছাড়া তো তোর অন্য উপায় নেই। এতক্ষন না খেয়ে থাকবি? বাইরের খাবারও খাবি না সোমবার! আমি নীরব থাকি। সত্যই আমি কোন উপায় দেখতে পাচ্ছি না। জলপাইগুড়িতে আমাকে যেতেই হবে। কারন ওখানে আমার বড় সন্তান আমার পুত্র থাকে দাদু-দিদার কাছে। আমার বুকভাঙ্গা হাহাকার ওর জন্য। পাঁচ বছরের ছেলেটি মা–বাবা ছাড়া থাকে। নিজে স্কুলে যায়, নিজে পড়ে, নিজে আর্টে যায়, অ্যাবাকাসে যায়, নিজে তাইকোন্ড যায় – সব নিজে নিজেই করে। পাড়ার টোটোকাকু বিশ্বেশ্বর ওর একমাত্র সঙ্গী। বিশ্বেশ্বরের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। শুধু টাকা দিলেই কি এরকম দায়িত্ববান ভাল মানুষ মেলে! বিশ্বেশ্বর ওকে কত গল্প শোনায়, মাঝে মাঝে পড়ার বাইরে টোটো নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ওকে চকলেট কিনে দেয়, ছেলে আখের রস পছন্দ করে জন্য আখের রস খাওয়ায়। ছেলে আমাকে সব গল্প করে। বিশ্বেশ্বরকে আমি সেজন্য কিছু টাকা দিতে গেলে ও নেয় না। সত্যই কত গরীব, অথচ কত উদার, কত ভালবাসা! আর বড়দি কত ধনী, কত টাকা আর কত নীচ মন! দু’টাকার গ্যাসের হিসেব করতে বসেছে। আমি ভাবছি এরপর রান্না করতে দিলে গ্যাসের জন্য মাসিক চাঁদা ছাড়াও আরো অতিরিক্ত দশ/পাঁচ টাকা ধরিয়ে দেব!
আরো কয়েকটা মাস কেটে গেল। ইতিমধ্যে আপ্রুভাল পেয়ে গিয়েছি। বেতনও চালু হয়েছে। এরিয়ার বিলটা সাবমিট হয়েছে। ধীরে ধীরে একটা অধিকারবোধ তৈরি হয়েছে। প্রায় ছাত্রীশূন্য বিদ্যালয়ে মাঝে মাঝে খুবই খারাপ লাগে। বিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের আনন্দ পুরোপুরি পেলাম না। তবুও হাতে গোনা ঐ কয়েকজন ছাত্রীকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে পাঠদানের চেষ্টা করি। ওরাও আমাকে পেয়ে ভীষণ আপ্লুত হয় দেখেছি। আমি কখনও স্কুলে না গেলে মেয়েগুলো নতুন ম্যাডামের খোঁজ করে। মৌসুমি দি বলেন, হিমি তুই সফল। এই মরুভুমিতেও ফুল ফোটাতে পেরেছিস।
শুনে বেশ ভাল লাগে। ছাত্রীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত ভালবাসা সত্যই মুল্যবান মনে হয়। আমি ওদের সাথে পড়াশোনার বাইরে বিভিন্ন বিষয় নিয়েও আলোচনা করি। কর্মমু খী শিক্ষার বিষয়ে উৎসাহ দেই। স্বপ্ন দেখাই। ইতিমধ্যে ক্লাস টেন এর কয়েকটি মেয়ে এসে জানিয়ে গিয়েছে মাধ্যমিক পরীক্ষার পর ওরা কেউ সেলাই, কেউ কম্পিউটার, কেউ পার্লার, কেউ বা আই.টি.আই এর বিভিন্ন কোর্সে ভরতি হবে। ওদের কথা শুনে মনটা উৎফুল্ল হয়। সত্যিই তো কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমেই তো ওরা ওদের ভাগ্য বদলাতে পারবে! ওদের বাবা মা কেউ মানুষের বাড়িতে কাজ করে, কেউ রাজমিস্ত্রির জোগানদার, কেউ চায়ের দোকানদার, কেউ বা দিনমজুর। মনে মনে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি ওদের মনোকামনা পূর্ণ হোক।
বিদ্যালয়ে সব ভাল লাগার মাঝে শুধু একটিই কাঁটা বড়দির রূঢ় ব্যবহার। উনি কেন এমন করেন আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না। অথচ বছর পঞ্চাশের বড়দিকে দেখলে মনে হবে বয়স আরো দশ বছর কম। কত ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন চেহারা! বব কাট চুলে হাল্কা কালারের পাটভাঙ্গা তাঁতের শাড়িতে উনি অনন্যা। শুধু ব্যবহারটা যেন কেমন! আবার মাঝে মাঝে সকলের সাথে এত গলে গলে কথা বলেন যে মনে হয় ওনার মত শিশু হৃদয়ের মানুষ খুব কমই আছেন। আবার পরক্ষনেই বস্তির কালচার। সত্যই বিচিত্র! তাই আমি ওনার ভাল কথা বা মন্দ কথা কোনটাতেই বিশেষ গুরুত্ব দেই না। উনিও হয়ত সেটা টের পান।
শিক্ষক মহলে এক নামে সকলেই চেনে দেশবন্ধুর হেডমিস্ট্রেসকে। সকলের ধারনাই নেগেটিভ ওনার সম্বন্ধে। আমার ধারনা স্কুল উঠে যাবার ভয় ওনার মধ্যে কুরে কুরে খায়। উনি চেষ্টা করছেন, স্কুলটাকে বাঁচাতে। তাই ছাত্রী না থাকা সত্ত্বেও এত নিয়ম, এত অনুশাসন। তিনি হয়তো দেখাতে চান সকলকে দেশবন্ধুর স্কুলের শৃঙ্খলা। এটাও ঠিক জেলার ডি.আই থেকে শুরু করে বিকাশ ভবন পর্যন্ত ওনার ভাল যোগাযোগ। নয়তো স্কুল অনেকদিন আগেই ব্ল্যাকলিস্টেড হত। বরং এই ছাত্রীহীনতার মাঝেও, একজন নতুন শিক্ষিকা পেয়েছে এই স্কুল। তার এই অদৃশ্য ক্ষমতার জন্য কেউ তাকে ঘাটাতে সাহস পায় না। আর এই সুযোগে দিনকে দিন তিনিও ঔরঙ্গজেবের ছোট বোন হয়ে উঠছেন।
স্কুলে যোগদানের পর অনেকগুলো অনুষ্ঠান পেয়েছি। সরস্বতী পূজো, বসন্ত উৎসব, রবীন্দ্র জয়ন্তী, বিশ্ব পরিবেশ দিবস, স্বাধীনতা দিবস। প্রত্যেকটি অনুষ্ঠান ব্যাপকভাবে পালিত হয়েছে। সবার উপস্থিতি বাধ্যতামুলক। বসন্ত উৎসবে স্কুল সাজানোর দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। রঙ্গীন কাগজের মালা বানানো শিখিয়েছি ছাত্রীদের । দু’দিন ধরে ওদের নিয়ে অনেক মালা তৈরি করেছি। কিন্তু অনুষ্ঠানের দিন আমার জ্বর জ্বর ভাব হল। বড়দিকে জানালাম। বড়দি উপদেশ দিলেন প্যারাসিটামল খেয়ে স্কুলে আসতে। স্কুলে গিয়েও বসে থাকব সে উপায় নেই। বড়দি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তদারকি করলেন আমার স্কুল সাজানোর।
ছবি সহযোগিতায় : উষসী রায়
বনশ্রীদির কিছু মনস্তাত্বিক সমস্যা রয়েছে। নিয়মিত ঔষধও নিতে হয়। আসলে তার একমাত্র ছেলে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন। সেই ভয়ে দ্বিতীয় সন্তান নেওয়ার আর ঝুঁকি নেননি। আলিপুরদুয়ারে ছেলের শিক্ষার কোন সুযোগ নেই। তাই বাধ্য হয়েই কলকাতায় রেখে তার পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেজন্য মাঝে মাঝেই তাকে কলকাতা ছুটতে হয়। ছেলের কথা ভাবতে ভাবতে তিনিও মানসিক রোগীতে পরিণত হয়েছেন। প্রাপ্য ছুটি প্রায় তার শেষ। বড়দির ভীষণ ক্ষোভ বনশ্রী দি-র উপর। এবার কলকাতা গিয়ে প্রায় মাসখানেক আছেন। বড়দি একদিন সবাইকে তার রুমে ডাকলেন।
আমরা ওনার রুমে গিয়ে জানলাম, স্টাফ কাউন্সিলের মিটিং। প্রথমেই সকলের সিগনেচার করিয়ে নিলেন। আলোচনার একমাত্র বিষয় বনশ্রীদি। বললেন- বনশ্রী, যেভাবে ছুটি নিচ্ছে তাতে বিদ্যালয়ের ক্ষতি হচ্ছে। তাছাড়া ও মেডিক্যাল আনফিট – বিদ্যালয়ের পড়ানোর মত অবস্থায় নেই। ওকে প্রথমে শোকজ তারপর প্রয়োজন হলে সাসপেন্ড করব।
বড়দির কথা শুনে আমরা খুব ব্যথিত হলাম। ওনার নির্মমতার সীমা খুঁজে পেলাম না। বনশ্রীদি যে ভয়ঙ্কর সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন, আমরা কলিগ হিসাবে ওনার পাশে থাকব – ওনাকে ভরসা জোগাব এটাই স্বাভাবিক! আর বড়দি কিনা ওনাকে সাসপেন্ডের কথা ভাবছেন! এমন নয় যে বনশ্রীদি অনৈতিকভাবে বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকছেন। উনি ওনার প্রাপ্য ছুটি সি.এল, এম.এল, সি.সি.এল, কমিউটেড লিভ, এমনকি উইদাউট পে লিভ নিচ্ছেন। আর বড়দি তো ব্যক্তিগত কাজে ছুটি নিলেও সেগুলো অফিসিয়াল ডিউটি হিসাবে দেখাচ্ছেন। সত্যিই ডাইনি হৃদয় একটা!
এমন অনেক কিছু নিষ্ঠুর আচরণ অহরহ ঘটে গিয়েছে। সেগুলোর হিসেব করতে গেলে খেই হারিয়ে ফেলব। শুধু একটা কথা মনে আসে – বড়দি আমার জীবনের একটা বড় অভিজ্ঞতা! এত সুন্দর আবার এত কুশ্রী!
দেখতে দেখতে দু’বছর কেটে গেল। ইতিমধ্যেই বিদ্যালয়ের দুই সিনিয়র শিক্ষিকা ভাস্বতি দি এবং নির্মলাদি অবসর নিয়েছেন। ছাত্রীসংখ্যা কমতে কমতে কুড়িতে এসে ঠেকেছে। মাঝে মধ্যেই বিদ্যালয় ছাত্রীশূন্য থাকে। জেলার বিদ্যালয়গুলোতে সারপ্লাস শুরু হয়ে গিয়েছে। আমাদের মিলি, মৌসুমি দি সারপ্লাস হয়ে শহরের অন্য স্কুলে গিয়েছে। এর মধ্যেই নতুন অর্ডার এসেছে – আমাদের বিদ্যালয় আর থাকছে না। শুধুমাত্র হেডমিস্ট্রেসকে আপাতত রেখে বাকি শিক্ষিকাদের অন্য বিদ্যালয়ে বদলি করা হবে। সবাই সুবিধামত বিদ্যালয় খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমিও এই সুযোগে ডি.আই স্যারকে বিশেষভাবে অনুরোধ করে, আমাদের বাচ্চাদের কথা বলে জলপাইগুড়ির একটা স্কুলে ট্রান্সফারের ব্যবস্থা করতে বললাম। উনি হঠাৎ, সদয় হয়ে রাজি হয়ে গেলেন। ওদিকে জলপাইগুড়ির ডি.আই আমার হ্যাজব্যান্ডের বন্ধুর খুব ঘনিষ্ঠ। সুতরাং সেখানেও বিশেষ সহযোগিতা পাওয়ার আশ্বাস পেলাম।
মাসখানেকের মধ্যেই আমরা যে যার নতুন স্কুলে চলে যাচ্ছি। সকলের ভীষণ মন খারাপ। এতদিনের এই বন্ধন হঠাৎ এভাবে আলগা হয়ে যাবে – ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে। বিদায়ের সুর বাজতে না বাজতেই সকলের মধ্যে ভালবাসার টানটা আরো বেশি করে প্রকাশ হতে লাগল। কেউ কেউ আবার একে অন্যকে জড়িয়ে কান্না করছে। আমার চোখ ভিজে যায় কান্না দেখে। আমরা প্রত্যেকেই বিদ্যালয়ের ফিস্টের আয়োজন করলাম। একজন অন্যজনকে গিফট্‌ দিলাম। যদিও বিদ্যালয় ত্যাগ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে শেষের দিকে। বড়দির মধ্যে আর চঞ্চলতা দেখি না। ওনার কড়া শাসন, রাগান্বিত মুখাবয়ব, একনায়কতান্ত্রিক মনোভাব সব উদাও। চেহারায় বিধ্বস্তের ছাপ ফুটে উঠেছে। সেদিন বিকেলে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরব বলে স্টাফরুম থেকে বের হয়েছি। দেখি গেটের পাশে আমগাছটির নীচে বাঁধানো জায়গাটিতে বড়দি গালে হাত দিয়ে বসে রয়েছেন। হঠাৎ মনটা হু হু করে উঠল। বড়দির একি চেহারা হয়েছে! সত্যি কথা বলতে কি আমি বড়দির মুখের দিকে খুব তাকাই না। আজকে ওনাকে দেখে হাল ভাঙ্গা মাঝির কথাই মনে পড়ছে। উনি অনেক চেষ্টা করেছিলেন স্কুলটাকে বাঁচানোর। সেজন্যই হয়ত এত বিধি নিষেধ, এত অনুশাসন! পুরো শহরবাসীকে এবং প্রশাসনকে জানান দিতেন তার এই কর্মপন্থার মাধ্যমেই। বিদ্যালয়কে বাঁচানোর জন্য তিনি নিরুপায় হয়েই হয়ত এমনভাবে বিদ্যালয় চালাতেন। ওনার আচরণকে কোন সময়েই মেনে নিতে পারিনি। আজ বুঝতে পারছি, বিদ্যালয়কে বাঁচানোর জন্যই তিনি নিজেকে বদলে ফেলেছিলেন। আজকে শেষ লগ্নে এসে বড়দিকে দেখে প্রথমবারের জন্য মমত্ববোধ জেগে উঠল। বড়দিকে ডেকে দুটো কথা বলতে চাইলাম কিন্তু পারলাম না। গেট পেরিয়ে এগিয়ে চললাম- পেছনে পড়ে রইল একরাশ গন্ধরাজ ফুলের অনুভূতি – দূর থেকে যা অনুভব করা যায় না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ