শারদ সংখ্যা ২০২০ || ভ্রমণ || অ্যাঞ্জেলিকা ভট্টাচার্য




পোস্ট বার দেখা হয়েছে


পাহাড়ি দিনরাত্রি             
 অ্যাঞ্জেলিকা ভট্টাচার্য  

ত্রিপুরা শহরের ব্যস্ত জনপদ পেরিয়ে চলেছি অচেনা পথে । অসমান রাস্তা , পাহাড়ি পাকদণ্ডি বেয়ে ওপরে উঠছি । মাঝে মাঝে সবুজের সমারোহ দেখতে দাঁড়িয়ে যেতে হয় । আমাদের গন্তব্য  উত্তর ত্রিপুরার জাম্পুই পাহাড় । আগরতলা থেকে জাম্পুই পাহাড়  গাড়িতে যেতে সময় লাগবে সাত ,  আট ঘণ্টা ।চড়াই উতরাই পথে ধুলো উড়ছে । কোথাও মাটির ভাঙ্গা রাস্তা ,  পাহাড়ি জুমচাষের খেত । মাটির ছোট চায়ের দোকান । গলা ভিজিয়ে নেওয়া । খোয়াই , আমবাসা, মনু সব পেরিয়ে চলেছি  জাম্পুই পাহারে। পথের চা বাগানে কয়েকটা ছবি স্মৃতি হিসাবে ধরে রাখছে মোবাইল , ক্যমেরা । 
আনারসের খেতের সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষন রসনা তৃপ্তি । কয়েকজন আধিবাসি মহিলা টাটকা মিষ্টি আনারস কেটে দিচ্ছে । নুন সহযোগে ভক্ষন করতে মনে হল অমৃত , এর জন্যই দেবতা আর অসুররা লড়াই করেছিল ! একেকটা আনারসের দাম ৫ টাকা । আমাদের গাড়ির ড্রাইভার জানাল শহরে এগুলোই প্রায় ৪০ টাকায় বিক্রি হয় । সত্যি তো আমারা শহরে  এতো দাম দিয়ে যে জিনিস কিনি অথচ চাষিরা দাম পায়না সেভাবে ।
                 জাম্পুই পৌছতে দেখি আকাশের বুক থেকে আলো হারিয়ে যাচ্ছে । কিন্তু সেই হারানো আলোয় আকাশের রঙ পরিবর্তনের খেলার সাক্ষী থাকতে বেশ লাগছে । জাম্পুই পাহাড়ে একটাই সরকারি গেস্ট হাউস ।পাহাড়ের একদম মাথায় । জনপ্রাণী শূন্য অন্ধকার পাকদণ্ডীতে গাড়ি প্রায় হামাগুড়ি দিচ্ছে ।পাহাড়ের নিচে শেষ জনবহুল শহর ছেড়ে এসেছি কাঞ্চনপুর ।সেখানের বাজারে গেস্টহাউসের ম্যনেজারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল বিকেল বেলায় । সেখান থেকেই খাদ্য সামগ্রী আসে রান্নার জন্য । এখনো জাম্পুই পৌঁছতে আরও দুঘণ্টা । অন্ধকারের মাঝে হারিয়ে যাওয়া , বেশ ভালোই লাগছে । আমাদের অন্ধকারের আগেই গেস্ট হাউসে পৌঁছনর কথা । তাই ড্রাইভারের কপালে চিন্তার ভাঁজ পরেছে । পাহাড়ি উপজাতিরা একেক সময় অন্ধকারের মাঝে পথ আটকে দাঁড়ায় । সে বিষয়ে তার অভিজ্ঞতার কথা  জানিয়ে বলল -  গাড়ির সব কাঁচ বন্ধ করে দিন  । 
এ যাত্রা হারানো হল না । পথে গেস্ট হাউসের একজন কর্মীর সঙ্গে দেখ হল।  সেই পথ বলে দিল । একটু যেতেই বিশাল গেট ।বেশ বড় এবং সুব্যবস্থা সহ গেস্ট হাউসের ঘর । একটু চা বিস্কুট খেয়েই দৌড় ছাদে । এখানেই বুঝি বিস্ময় বাকি ছিল । নিচের দিকে তাকালে শুধুই প্রসস্থ অন্ধকার , দূরে পাহারের গায়ে কিছু আলো জোনাকির মতো টিমটিম করছে । একবুক টাটকা অক্সিজেন নিয়ে যখন আকাশের দিকে হাত বাড়ালাম সব তারারা যেন এখুনি আমার হাতের নাগালে এসে পড়বে । 
রাত নটাতেই খাবারের তারা পড়েছে ।পাহাড়ি মানুষেরা খুব  তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে  কিন্তু  অনেক ভোরে ওঠে  ।গরম ভাত , ডাল , ফুলকপির তরকারি , দেশিমুরগির মাংস ।পেটের ভিতর যে আন্দলন চলছিল মনে হল তার বিজয় প্রাপ্তি হল । বিছানায় পড়তেই ঘুমের দেশে । 
    সকালে সারে পাঁচটার অ্যালার্ম বাজতেই ধরফর করে উঠেছি । কিছুই যে মিস করতে চাইনা ।পুলওভার গায়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি ছাদে উঠে এলাম ।অনেক উৎসাহী মানুষের ভিড় সেখানে দেখতে পেলাম  ।  অন্ধকার কেটে যাচ্ছে কিন্তু পাহাড়ের গায়ে কুয়াশার আস্তরণ । দূরে পাহাড়ের পিছন থেকে ঘুম ভেঙ্গে উঠবে সূর্য দেব । কিন্তু অনেকেই জানাল আশা কম , মেঘ জমেছে ।অনেকে নিজের ঘরে আবার ঘুমতেও চলে গেল ।  
একটু মনটা খারাপ হয়ে গেল এত দূর থেকে ছুটে এলাম , নিরাশ করবে তুমি জাম্পুইএর আকাশ !প্রকৃতির কোলে পশু পাখি কারোর ডাক পর্যন্ত শুনতে পেলাম না । গেস্ট হাউসের মধ্যে কয়েকটা দেশি মুরগি ককরকক করে চলেছে । স্থানীয় একটি ছেলের মুখেই শুনলাম , উপজাতিরা একটাও পশু পাখিও অবশিষ্ট  রাখেনি।  
  ছটা বাজতে দশ । আকাশের রঙ পরিবর্তন হচ্ছে ।সে আসছে , সে আসছে । আইমোরা ভাঙতে ভাঙতে স্টেজে উঠে পড়ছে । আর উৎসাহী ক্যমেরা  সেই মুহূর্ত বন্দী করছে ।কিছুক্ষনের মধ্যেই পাহারের গায়ের কুয়াশা কেটে গেছে । সবুজের সমারোহে মিঠে রোদের খেলা শুরু হয়েছে । বয়স্ক একজন কাছে এসে বললেন – কেমন দেখলে ? – অসাধারণ । - সে টাইগার হিল থেকে দেখ আর কন্যাকুমারি থেকেই  দেখ , জাম্পুই পাহাড়ের সূর্যোদয় বেশ আকর্ষক । প্রতিবছর একবার আশি । ক্যমেরাটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিচে নামার সময় বললেন – বাঙ্গালির ধৈর্য বড় কমে যাচ্ছে । আর সবজান্তা ভাবটা যদি একটু কমাতো তবে অনেক কিছু প্রাপ্তি ঘটত । সূর্যদেবও  মনে হয় সম্মতি জানাচ্ছেন ।
জাম্পুই মূলত বিখ্যাত কমলালেবুর জন্য । কিন্তু আসার পথেও কিছুই চোখে পরেনি । আমাদের ড্রাইভার জানাল মিজোরাম বর্ডারে যাওয়ার পথে কমলা দেখা যেতে পারে । সেই উদ্যেশ্যে গাড়ি ছোটালাম ।সামনেই  পাহাড়ি ঢাল বেয়ে নেমে গেছে একটি পাহাড়ি গ্রাম । সেখানে প্রতিসপ্তাহে বৃহস্পতিবার হাট বসে । বিভিন্ন ধরনের ফল , সবজি , আনাজ পাতি, জামাকাপড়  কি নেই সেখানে । এটাই গোটা জাম্পুই পাহাড়ের একমাত্র বাজার । তাই জাতায়তের পথে ভীষণ ভিড় হয়েছে । পথে পড়ল লাইট হাউস ।সেখান থেকে দিগন্ত বিস্তৃত পাহাড়ের আভিজাত্য । পাশে পাশে মিলিটারি বেস ক্যাম্প  । 
কিছুদুর যাওয়ার পথে আবার একটা পাহাড়ি গ্রাম ।বাঁশ দিয়ে হাতে বানানো হুঁকো টানছেন এক প্রবীণ । আমরাও মিঠে রোদ গায়ে মেখে একটু হুঁকোর স্বাদ নিলাম । প্রায় আরও একঘণ্টা যাওয়ার পর পৌঁছলাম মিজোরাম বর্ডার । সেনাদের কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা । ওটাই ভারতের শেষ সীমানা তারপর মায়ানমার । কিন্তু পথে দু একটা ছাড়া কোথাও সেভাবে কমলা লেবু দেখা হল না ।আশা করেছিলাম মুন্নার পাহাড়ের মত পথের দুধারে গাছ ভর্তি কমলালেবু দেখব ।  বরং জামীর চোখে পড়ল । একদম কমলালেবুর মতো দেখতে । ভুল করে কয়েকটা তুলেছিলাম । কিন্তু এগুল এখানে ডালের সঙ্গে খায় । বলা চলে গন্ধরাজ লেবুর বিকল্প   । তবে প্রচুর কলা গাছ ।এখানে তাই রাস্তার প্রতি হোটেলেই কাঁচকলার তরকারী ।  
      পাহাড়ে ওঠার পথে পেয়েছিলাম শেষ শহর কাঞ্চনপুর । আবার নামার সময় পেলাম । ট্রেকার বোঝাই করে জাম্পুই পাহাড় থেকে কাঞ্চনপুরে অনেকেই কাজে আসে আবার দিনের শেষে ফিরে যায় ।  পাহাড়ি জীবন খুব কঠিন তার মধ্যেই সংগ্রাম করে বেঁচে থাকা । একটার পর একটা পাহাড় পেরিয়ে যাচ্ছে । পড়ন্ত বেলায় পাহাড়ি বাঁকে বাজার বসেছে । পাহাড়ি মানুষ জুমচাষ করে কতো কিছু ফলিয়েছে না দেখলে বিশ্বাস হয় না । অনেক কিছু দেখিনি নামও শুনিনি যেমন – খাক্লু , বিরনি চাল, গোলাপের কুড়ির মতো চুকুই ফল ।  এছাড়া জংলি থোর , কচু , নামনা জানা ফুল , শুঁটকি মাছ, গুগলি নয়  মাঝারি সাইজের শামুক বলা চলে । এখানের  বিশেষত্ব অবশ্যই বিভিন্ন ধরনের শুঁটকি । স্বাদেও অতুলনীয় ।
কিছু স্বাদ থাকে মনের অগোচরে । যা চোখ বন্ধ করে অনুভব করতে হয় । জাম্পুই পাহাড়ের স্বাদও তেমনই । এ স্বাদের ভাগ হবে না ।   
      অনেকটা পথ নেমে এসেছি এবার ঊনকোটির নিকটতম শহর কৈলা শহর । সেখানে সরকারি গেস্ট হাউসে রাত্রিবাস । হাল্কা একটু শীত করছে । গেস্ট হাউসের ঘরে চা আর পাকোড়া খেতে খেতে একটু জিরিয়ে নেওয়া কাল ভোরেই যেতে হবে ঊনকোটির বিস্ময় দেখতে ।অন্ধকারে আর ব্যল্কনিতে যাওয়া হয়নি ।সকালে উঠেই দেখলাম গেস্ট হাউসের ঠিক পিছনে কাঁটা তারের বেড়া , ওপাড়ে বাংলাদেশ । কতোটুকু ব্যবধান !
        পাহাড় জঙ্গল ভেদ করে  ঊনকোটির   সিঁড়ি বেয়ে যখন সেই দীর্ঘ , প্রাচীন শিব মূর্তির সামনে দাঁড়ালাম তখন খুঁজছিলাম তার রহস্য ।ঊনকোটির অর্থ হল এক কোটি থেকে একটি কম । এনিয়ে নানা গল্প আছে । শিবের অভিশাপে নাকি ঊনকোটির প্রস্তর মূর্তির জন্ম । আবার একরাতের মধ্যে কোটি থেকে একটি কম মূর্তি তৈরি করতে পেরেছিলেন বলেও এমন নাম মনে করা হয় । কিন্তু কবে কতবছর আগে কে বানিয়েছে সঠিক ভাবে জানা যায় না । তবু অনুমান করা হয় তৃতীয় শতাব্দীতে এটি সৃষ্টি হয়েছে ।কিন্তু কি অসম্ভব সুন্দর সেই সব স্থাপত্য ! 
পার্বতীর কোলে গনেশ , শিব পার্বতীর যুগ্ম মূর্তি ।  দুঃখে বিষয় এখানে কোন গাইড নেই ।  বই পড়ে কিছুটা রিসার্চ করে গেলে ভালো হয় । সঙ্গে অবশ্যই জল আর বিস্কুট রাখা ভালো । সিঁড়ি ভেঙ্গে ক্লান্ত হয়ে পড়লে একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার চলা । ওপরে একজন সাধু থাকেন সেখানে মন্দিরে পুজো করেন ।ওখানেই একটি ঘরে কিছু উদ্ধার হওয়া  প্রস্তর মূর্তি । সাধুমহারাজ বললেন এখানে আরও না জানি কতো মূর্তি আছে , সব এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি ।   মাঘীপূর্ণিমাতে মেলা বসে , খুব ভিড় হয় ।  এর পর কোন সিঁড়ি নেই । কিছুটা মেঠো পাহাড়ি পথ আর অসংখ্য প্রজাপতি ।রংবেরঙের প্রজাপতি দেখে চোখ জুড়িয়ে যায় ।এখানে সুনির্মল আকাশ । উপর থেকে দেখা যাচ্ছে ঘন জঙ্গল  ভরা পাহাড়ের মাথা ।কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে প্রকৃতির ধ্যান করা যায় । 
          ত্রিপুরা শহরের রাজধানী আগরতলায়  ফিরে আসতে আসতে মনে পড়ছিল পাকদণ্ডীর পথে ফেলে আসা দুটি দিন । 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ