শারদ সংখ্যা ২০২০ || গল্প || সংহিতা ঘোষাল




পোস্ট বার দেখা হয়েছে


পুনর্মিলন
 সংহিতা ঘোষাল

অনিকেত আজ কলেজের উদ্দেশ্যে একটু তাড়াতাড়ি র‌ওনা হল। দীর্ঘদিন বিদেশে গবেষণার পর ও নিজের রাজ্যে ফিরেছে গত কয়েক বছর হল। খানিকটা দেশের মাটির টানে আর খানিকটা পুরোনো কিছু খোঁজার উদ্দেশ্যে।সে যাই হোক ,ওর কলেজে রসায়নে স্নাতকোত্তর বিভাগ খোলার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়েছিল ড. অনিকেত রায়কে। লন্ডনে থাকার সময় যখন মেইল পেয়েছিল ও যে নিজের কলেজের জন্য ও নির্বাচিত হয়েছে সেদিন বেশ আনন্দিত হয়েছিল, হয়তো পুরোনো দিনগুলো আবার দেখতে চাইছিল।তাই লন্ডনে গবেষণার কাজ সমাপ্ত করে  ফিরে আসা দেশের মাটিতে। কেবলমাত্র নিজের কলেজ বলে নয়, এই বাংলার বুকে মফস্বলের কলেজে স্নাতকোত্তর বিভাগের পঠন-পাঠন শুরু হবে এবং তার দায়িত্ব সেই কলেজের প্রাক্তনীর হাতে অর্পিত হ‌ওয়ায় ও দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেয়।
      
     আসলে অনিকেতের জন্ম ও বড় হ‌ওয়া গ্রামে।কলেজ বলতে এই মফস্বলের কলেজ, বাড়ির সবচেয়ে কাছের এবং বাড়ি থেকে যেতে বাসে দেড় ঘণ্টা সময় লাগত। বাসের সংখ্যাও খুব কম,এক থেকে দেড় ঘণ্টা পর একটি করে বাস। তাই কলেজে পড়তে যাওয়া বেশ কষ্টকর ছিল।তার সঙ্গে দারিদ্রতা ছিল নিত্যসঙ্গী। তাই গ্রাম বাংলার ছাত্রছাত্রীদের কথা ভেবে এই গঠনমূলক কাজের কান্ডারী হতে এক মুহুর্ত দ্বিধাবোধ করেনি।
কলেজে যোগদানের পর ল্যাবরেটরি তৈরী, রসায়ন বিভাগের নিজস্ব গ্রন্থাগার তৈরী সব কিছু নিজের হাতে করেছে ও। ধীরে ধীরে এই কলেজ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সারির কলেজের জায়গায় স্থান করে নিয়েছে। সেই রসায়ন বিভাগে আজ প্রথম পুনর্মিলন উৎসব। খানিকটা অনিকেতের উৎসাহ এবং নতুন প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের প্রবল ইচ্ছাশক্তির জন্য আয়োজন করা সম্ভব হয়েছে।এই উৎসবের আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য হল প্রাক্তনীদের কাছ থেকে রসায়নকে ভালো লাগার নতুন রসদ খোঁজার চেষ্টা এবং প্রাক্তন ও নতুনের মেলবন্ধন।
  দেখতে দেখতে গাড়ি কলেজে পৌঁছালো ঠিক সময়ে। গাড়ি নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে অনিকেত যখন নিজের বিভাগীয় ভবনের দিকে এগোচ্ছে তখন অবাক হয়ে গেল।কি সুন্দর করে সাজিয়েছে ছাত্রছাত্রীরা। সত্যি ভাবলে অবাক হতে হয় এরা বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হয়েও শিল্পকলায় এত দক্ষ। নতুন প্রজন্ম সত্যি অনেক এগিয়ে।
       সময় এগোনোর সাথে সাথেই বিভিন্ন শিক্ষা বর্ষের প্রাক্তনরা এসে গেল। নতুনের সাথে পুরাতনের পরিচয় হল পুষ্পধারায় ও মিষ্টিমুখে।একে একে সবার পরিচয় পর্ব শেষে কেউ নাচ,গান, আবৃত্তি করে নিজেদের আনন্দ সকলের সাথে ভাগ করে নিল।কেউ আবার রসায়ন বিভাগের অভিজ্ঞতা সকলের মাঝে ছড়িয়ে দিল।সব মিলিয়ে যেন আনন্দের পরিবেশ। এইদিনে ছোটরা যেমন বড়দের কাছ থেকে অনেক কিছু জেনে পূর্ণ হতে চাইছে, ঠিক তেমনি বড়রা অভিজ্ঞতার কলস উজাড় করে দিতে চাইছে নতুনদের মধ্যে। তবু অনিকেতের মন উদাস হয়ে আছে। প্রত্যেক প্রাক্তনকে অতি যত্নে নিমন্ত্রণপত্র পাঠিয়েছিল,তার মধ্যে ওর ব্যাচের সবাই এসেছে কিন্তু সে তো এল না।এর মধ্যে তপন এসে জড়িয়ে ধরে বলল,"তুই ডাকলি আর না এসে পারলাম না।"
-"খুব ভালো লাগলো রে।"
-"হুম, তবে ডিপার্টমেন্ট তো চেনা যাচ্ছে না।কত মজা করেছি বলে।"
-"তবে আমরা যা পাইনি ওদের দেওয়ার চেষ্টা করছি।"
-"খুব ভালো।"
দেখতে দেখতে অসীম, শৌর্য,তনুশ্রী, মৌমিতা,নগেন, দেবর্ষি এমনকি বিদেশ থেকে কৌশিক, সুমন‌ও চলে এল কিন্তু সে তো এল না। তবে কি সে আজ‌ও অভিমানী রয়ে গেছে? সুমন আর কৌশিককে দেখে ওদের দিকে এগিয়ে গিয়ে খুব নিম্নস্বরে অনিকেত বলল,"তালপাতারসেপাই যে এখন সুমো ম্যান ,হলি
কীভাবে?"
-" আর বলিস না সারাদিন বার্গার,স্যান্ড উইচে মুখ ডুবিয়ে থাকা আর বসে কাজ করার ফল।"
তিনজনে খুব জোরে হেসে উঠলো।
     হঠাৎ করে তখনই কানে এল ডিপার্টমেন্টের খুব কাছে একটি গাড়ির শব্দ। অনিকেত দোতলার জানালা দিয়ে দেখল গাড়ি থেকে নেমে একজন ভদ্রমহিলা উপরে আসছেন। ওনার কালো চুলে সদ্য রূপোলী লেখা দেখা দিয়েছে। সিল্কের শাড়ি পরিহিতা, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, চুল ঘাড় পর্যন্ত সব মিলিয়ে ভদ্রমহিলাকে বেশ বুদ্ধিদীপ্ত মনে হল।একটু এগিয়ে আসতে কৌশিক ও সুমন , তনুশ্রী, মৌমিতা কলরব করে উঠলো শুধু অনিকেত ছাড়া। মোটা ফ্রেমের চশমার আড়ালে থাকা চোখ দুটো বড় চেনা। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শুধু বদলে গেছে অবয়ব।সবার মাঝে এগিয়ে এলো মহুয়া মিত্র, কলকাতার একটি কলেজে রসায়নের বিভাগীয় প্রধান। অনিকেত তখন বারবার খুঁজে দেখার চেষ্টা করছে কলেজের মুহূর্তগুলো, মাথায় দুই দিকে বিনুনি করে ঢিলেঢালা পোশাকে কলেজে আসা মেয়েটিকে যে সব সময়  হাসিখুশি থাকতে। কিন্তু আজ যেন বড়‌ই ধ্যান গম্ভীর। বন্ধুদের সাথে কথা বলার সময় অনিকেত বারবার লক্ষ্য করল ছাত্রছাত্রীরা মহুয়াকে লক্ষ্য করছে।আর দেখবে নাইবা কেন।রসায়নে কাজে লাগিয়ে পরিবেশ বাঁচানোর অভিযান শুরু তো মহুয়া মিত্রর হাত ধরে। আজকাল ছেলেমেয়েরা সব খবর রাখে। তৃতীয় বর্ষের সুমন্ত্রা খানিক নিজে থেকে এগিয়ে এসে কথা বলল ,"হ্যালো ম্যাম ,আপনি মহুয়া মিত্র না?"
-"হুম।"
-" আপনার কথা অনেক পড়েছি। আমরা আপনার কাজ সম্পর্কে শুনতে চাই যদি একটু বলেন।"
-" ঠিক আছে অবশ্যই বলব।তোমরাই তো আমার শক্তি।" 
দর্পণ শারদ সংখ্যা ২০২০ ( অঙ্কন উষসী রায়)

 এই কথাগুলো বলে ও মাপা হাসি হাসল। অনিকেত ভাবল কত পরিবর্তন ,মহুয়া মাপা হাসি হাসল। বন্ধুদের সাথে দ্বিপ্রাহরিক আহার শেষ করে ডিপার্টমেন্টের মঞ্চে উঠে মাইকটা টেনে নিল কাছে।এই এক ওর অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য ,কথা দিলে কথা রাখবে।সুমন্ত্রাকে দেওয়া কথা পালনের জন্য ও প্রস্তুত। সুন্দর ভাবে বোঝাতে শুরু করল ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে রাতে ঘুমানোর আগে পর্যন্ত রসায়ন কীভাবে যুক্ত এমনকি ঘুমের মধ্যে রসায়নের কারিকুরি বর্তমান।তাই এই বিজ্ঞান কাজে লাগিয়ে সুস্থ সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্নজাল বোনা যায় তা সুন্দর ভাবে গল্পে ছলে উপস্থাপন করলে। অনিকেতের মনে হচ্ছিল আজ থেকে তেইশ বছর আগে যখন রসায়নের জটিল তত্ত্ব ওকে বিভ্রান্ত করত ঠিক তখনই মহুয়া সুন্দর ভাবে ওর মনে আজকের মতো রসায়নের প্রতি ভালো লাগা তৈরী করেছিল। যে ভালো লাগা ওর ভালোবাসাও বটে। সেই তেইশ বছর আগের  মহুয়া যেন ওর সামনে।আর নতুন শিক্ষার্থীদের সাথে অনিকেত আজ নতুন করে রসায়নে ভালোবাসতে শিখল। মহুয়ার বক্তব্যের পর অনিকেত ধন্যবাদ জ্ঞাপন করল এবং অনুষ্ঠান শেষে সবাই মিলে ছবি তুলে এই মুহূর্তকে ফ্রেম বন্দী করার পর একে একে ফিরে গেল নিজের জায়গায় ঠিক পরিযায়ী পাখির মতো। ডিপার্টমেন্টের বাকি কাজ সেরে অনিকেত যখন বাড়ি ফিরল তখন প্রায় রাত দশটা হবে। দুপুরে খাওয়া দাওয়া বেশি হয়েছিল তাই বিস্কুট ও জল খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

       সকালে উঠে ব্রাশ করতে করতে ফ্ল্যাটের বারান্দায় থাকা গাছে জল দেওয়া অনিকেতের নিত্যকর্ম।তারপর ধোঁয়া ওঠা কফি নিয়ে ল্যাপটপ খুলে বসলো। হঠাৎ চোখে পড়ল মহুয়া মিত্রর থেকে একটা মেইল।কফির কাপে আলতো চুমুক দিয়ে পড়তে লাগলো----
প্রিয় অনি,
      এই নামে আজ‌ও তোকে ডাকি। হয়তো অবাক হবি কাল তোর সাথে কথা বলিনি বলে । আসলে একুশ বছর আগে শীতের পাতাঝরা বিকালে সূর্যাস্তের বিদায়ী আলোয় তোকে বিদায় জানিয়েছিলাম,তাই আজ‌ও সেই দূরত্ব পেরোতে বারবার বাধা পাচ্ছিলাম। তবু সব বাধা পেরিয়ে তোকে কথাগুলো আজ লিখেই ফেললাম। কলেজের তৃতীয় বর্ষে যখন স্কলারশিপ পেয়ে বাইরে পড়তে যাওয়ার চিঠি এলো স্যারেরা তোকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু তুই বারবার ইতস্ততঃ বোধ করছিলি বাইরে পড়তে যেতে। জানি সেইদিন তুই কী বলবি বলে ক্যান্টিনের পুকুর পাড়ে আম গাছের তলায় ডেকেছিলি।এই তিন বছরে তুই যত মনের কথা বলতিস তার জায়গা ছিল আম গাছের তলা।জানিস আজ‌ও কলেজে গিয়ে আম গাছটা দেখতে ভুলিনি। সেদিন তুই জিজ্ঞেস করেছিলি "মৌ তুই খুশী তো?"আমি বলেছিলাম"খুব"।আর একরাশ কান্নাকে বাষ্প হতে দিয়েছিলাম। সেদিন যদি বলতাম যাস না , তুই খুশী হতিস কিন্তু আজকের ড. অনিকেত রায়কে পেতাম না যা আমি দেখতে চেয়েছিলাম। তাই মায়া বাঁধনে আর বাঁধতে চাই নি। সময়ের স্রোতে সব কিছু ভাসিয়ে দিয়েছি। কিন্তু তুই যত দূর গিয়েছিস সবটুকু আমার লক্ষ্যে আছে। বিদেশে তোর পুরস্কার পাওয়া আমাকে গর্বিত করেছে। তোকে না পাওয়ার মাঝে অনেক কিছুই পাওয়া আমার হয়েছে। তারপর তুই দেশে ফিরে যখন মহান কাজে ব্রতী হলি তখন আমার ভালোবাসা প্রগাঢ় হয়েছে। সত্যি তোর মত আরো অনেক মানুষের প্রয়োজন গ্রামীণ বাংলায় বিজ্ঞানকে ছড়িয়ে দিতে।আজ যখন ডিপার্টমেন্টে গিয়ে তোর পরিশ্রমের ফসল চাক্ষুষ করছিলাম তখন বারবার মনে হচ্ছিল সেদিন যদি কান্না বাষ্প না হতো আজকের কচিকাঁচাদের মুখে এত হাসি দেখতে পেতাম না। রসায়নের ব‌ই, যন্ত্রপাতি যা কিছু দরকার তুই পরম যত্নে সাজিয়ে দিয়েছিস ওদের জন্য ঠিক যেমন দায়িত্বশীল পিতা সন্তানের জন্য অর্জিত সম্পদ রেখে যায় সেই রকম।আর আমার ভালোবাসা থাকনা অন্তরালে, বন্ধু হয়ে বিদায় নিয়েছিলাম তবে বন্ধুত্ব থেকে ভালোবাসার কত পথ যে একাই হেঁটেছি সেটা আজ‌ও জানি না। তবে সেই পথ না হয় একাই হাঁটলাম আরো বহু দূর।
       ভালো থাকিস, ভালো রাখিস।
                                                   ইতি-
                                               তোর মৌ
অনিকেতের দক্ষিণের বারান্দায় তখন মিঠে রোদের হাসি। মনের চাপা কষ্ট ল্যাপটপের মাধ্যমে প্রতুত্তরের মেইলে উঠে এল---
প্রিয় মৌ,
     কোনো কথা না বলেও তোর চোখ দুটো সব কথা বলেছিল সেদিন। বিদেশে থাকলেও তোর খবর আমি রেখেছি সব সময় । সেদিন বুঝেছিলাম তুই কী চাস আমার থেকে।আজ যখন দেওয়ার সময় এসেছে আহ্বান জানালাম তোকে। তুই এলি, তবে আজ‌ও তোকে ছাড়া অসম্পূর্ণ আমি। কোথায় যেন অপূর্ণতা গ্রাস করে।তোর মত‌ই আমিও একা এতটা পথ চলেছি। কিন্তু বাকি পথ আর নয়। রেলগাড়ি চলার জন্য যেমন দুটি পাত আবশ্যক তেমনি এই জীবন গাড়ি এগিয়ে নিয়ে যেতে তোকে বড় প্রয়োজন।হবি আমার সঙ্গী? অপেক্ষায় রইলাম।
        অনেক ভালোবাসা সহ,
                                                      ইতি-
                                                  তোর অনি

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ