শারদ সংখ্যা ২০২০ || গল্প || সিদ্ধার্থ সেনগুপ্ত




পোস্ট বার দেখা হয়েছে


হঠাৎ এক নিশীথে
 সিদ্ধার্থ সেনগুপ্ত

।।১।।

 -“ মিনু, ও মিনু, এখনও পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিস? বেলা যে গড়িয়ে এল। বলি এতো ঘুমালে তো গতরে বাত ধরবে! মুটিয়ে গেলে আর কি জমিদার বাবুর তোকে মনে ধরবে? তখন তো এই আমাদের মতো হাজারটা খদ্দেরের বেবুশ্য হয়ে পচবি। নে ওঠ এবার। গা-হাত-মুখ ধুয়ে একটু স্নো-পাউডার মেখে নে দেখি চট্‌ করে।”

যার উদ্দেশ্যে কমলার এত কথা বলা, সেই মিনতি ওরফে মিনুর মধ্যে কিন্তু কোনরকমের চাঞ্চল্যই দেখা গেল না। সে ধীরে ধীরে ঘুম জড়ানো চোখ দুটো মেলে চারধারটা দেখল।

-“উফ্‌ মাসী, তুমি এই ভর সন্ধেবেলায় এত চেল্লামেল্লি জুড়ে দাও না, কী বলব! এখনও বাবুর আসতে ঢের দেরী। সবে তো সন্ধে! জমিদার বাবুর আসতে আসতে সেই রাত!”

-“তা হোক্‌, তুই না হয় একটু তাড়াতাড়িই সেজে নিলি। তাতে তো আর তোর সোনার অঙ্গ কালি হয়ে যাবে না। আমাদের এই পাড়ায় ক’টা মেয়ের বল্‌ তো তোর মতো বরাত হয়! এতো বড় বংশের জমিদার। ইচ্ছা করলে তোর মতো হাজারটা মেয়েমানুষ পুষতে পারত। সে তো তা করে নি, উল্টে তোকে তার ঘরের বউ করে নিয়ে  যাচ্ছে। কি কপাল রে তোর মাইরি!” মিনতিকে থামিয়ে খর্‌খর্‌ করে বলে ওঠে কমলা।

-“হুঁ......সে হয়ত খানিকটা ঠিকই বলেছ। নইলে আমাদের মতো মেয়েদের তো সাত ঘাটের জল খেয়েই পেট চালাতে হয়। নিজেদের শত শরীর খারাপ সত্ত্বেও সেই শরীর দিয়ে অন্যদের শরীরের আগুন নিভাতে হয় আমাদের। তোমাদের তো দেখি। সাত রাজ্যের কুলি-কামিনদের বিকৃতি মেটানো। ভদ্দরলোকদেরও তো কম দেখলাম না। এক একজনের এক এক রকমের ভোগের কায়দা। এই তো সেদিন পাশের বাড়ির সুলেখাকে দেখলাম, কোন এক মুশ্‌কো মতো লোককে বেশী টাকার জন্য ঢুকিয়েছিল ঘরে। সেই বজ্জাতটা সারা রাত ওর সাথে কী না করেছে, পুরো নিংড়ে নিয়েছে ওকে। পরের দু’দিন বিছানা থেকে উঠতে পারে নি ও। কী রক্ত মা গো! শিউরে উঠেছিলাম দেখে। জানো তো মাসী আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, আমরা যেন এক অন্য দুনিয়ার মানুষ। রাতের বেলাটাই আমাদের কাছে দিন, আর বাইরে যখন দিনের আলো, আমাদের এখানে তখন সবাই ঘুমে অচেতন। নাঃ! তার চেয়ে বরং এই ভালো। একটা সংসার তো পাব। আমার সংসার করার খুব শখ গো মাসী। দেখ আমি খুব ভালো বৌ হব।”
-“আচ্ছা আচ্ছা হয়েছে অনেক, তুই যা এখন তাড়াতাড়ি কলতলায়, তৈরী হয়ে নে, রাত নামতে আর তো বাকী নেই বেশী।” তাড়া দেয় কমলা।
-“হ্যাঁ, এই যাই।” মিনতির চলে যাওয়ার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে কমলা।
                            কতই বা বয়স হয়েছে মিনুর। এই সবে ঊনিশে পড়বে। এরই মধ্যে ও কত্তকিছু বুঝে ফেলেছে। আর বুঝে না ফেলারই বা আছেটা কি! এই বেশ্যা পাড়ায় মেয়েগুলো জন্মানোর পর থেকেই তো সব হায়না শকুনদের জিভগুলো থেকে লালা ঝরে। কখন ওগুলো বড় হবে, সব ক’টা মিলে ছিঁড়ে খাবে। কম তো দেখল না কমলা। এই একটা ব্যাপারে সব ব্যাটাছেলেগুলো সমান, সে ভদ্দরলোকই হোক বা ছোটলোক। ও যে কি করে এই এতোগুলো বছর মিনুকে আগলে রেখেছে, তা ওই জানে। ভাগ্যিশ্‌ জমিদারবাবুর চোখে পড়েছিল মিনু। নইলে ও আর কতদিন আগলে রাখতে পারত কে জানে! লোকে কম তো টাকার লোভ দেখায় নি ওকে। কিন্তু ও চায়নি ওদের পাড়ার আর বাকী সবার মতো একটা অভিশপ্ত জীবন পাক মিনু। পড়াশোনাও তো শিখেছে মিনু অল্পস্বল্প। আর লোকদেরও বা দোষ দেবে কী কমলা, আগুনের খাপরার মতো রূপ এই মেয়ের। নইলে জমিদার বাবুর মতো পোড় খাওয়া লোকেরই বা চোখ পড়বে কেন এই মেয়ের উপর! প্রায় পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই জমিদার রাজশেখর রায় এখনও অকৃতদার। যদিও তাতে তিনি নারীসঙ্গ থেকে বঞ্চিত নন একেবারেই। বরং নারীসুধা পান করার আদিম বাসনা তাঁর মধ্যে একটু বেশী পরিমাণেই উগ্র। এ পাড়ায় এনার নিয়মিত নিত্য আসা যাওয়া। আবার দরকারে ফরমাশ মতো মেয়েও পাঠাতে হয় তাঁর  বাগানবাড়িতে। এহেন রাজশেখরের নজরে একদিন পড়ে গেল মিনতি। মিনতিকে একবার দেখেই আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারেন নি জমিদারমশাই। নিজেই কমলার কাছে মিনতির জন্য টাকা বায়না করতে এসেছিলেন। তবে এক্ষেত্রে দেখা গেল, কমলা অনঢ়। মিনতিকে পেতে গেলে বিয়ে করতে হবে জমিদারবাবুর, রক্ষিতা হবে না ওর মিনু। তাও মৃদু দু-একবার আপত্তি করেছিলেন রাজশেখর, তা কি করে হয়! বেশ্যা বাড়ীর মেয়ে জমিদার গৃহিণী হতে পারে না কি! কমলা  কিন্তু তার জেদে অটল। ভালো বাড়ির মেয়ে মিনতি। ওদের মতো দেহ বেচা ঘরের নয়, ওকে বিয়ে না করলে জমিদারবাবু ওকে কোনোদিনই পাবেন না। শেষ পর্যন্ত রাজশেখর রায়কে রাজী হতে হয়েছিল। কমলার জেদের কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছিলেন উনি। আর না মেনে উপায়ও ছিল না তাঁর, কামানলে জ্বলছেন তিনি তখন। কমলা সেদিন রায়মশাইয়ের কাছ থেকে বিয়ের প্রস্তাব শুনে সত্যি সত্যিই খুব খুশী হয়েছিল। যদিও জমিদারবাবুর বয়সটা মিনুর তুলনায় অনেকটাই বেশী, প্রায় সাতচল্লিশ-আটচল্লিশ। তা হোক্‌ গে, ওদের পাড়ায় থাকার পরেও যে মিনুর বিয়ে হচ্ছে, এই ঢের! ও তো আর ওদের পাড়ার বাকী মাসীদের মতো মিনতির মাসী নয়, বাপ-মা হারা এই মেয়েটাকে সেই কাশী থেকে বুকে করে এই শোভাবাজারে নিয়ে এসেছিল কমলা। সে কতদিন আগের কথা। সেবার কমলারই এক বাবু নিয়ে গেছিল ওকে কাশীতে, না তীর্থ করাতে নয়, ইয়ার বন্ধুদের সাথে ওকে নিয়ে ফুর্তি করতে। সেই প্রথম কমলার বাইরের জগৎ দেখা, আর সেই শেষ। এই এত্তগুলো বছরে আর কোনদিন এই বাড়ির চৌহদ্দি ছেড়ে ও আর বেরোতে পারে নি কোথাও। সেই কাশী থেকে ফেরার পথে ট্রেনে এক মহিলার সাথে আলাপ। দেখে ভালো ঘরের বলেই মনে হয়। কোলে বছর দেড়েকের শিশু। সেদিনকার ঘটনা আজও যেন কমলার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে। চোখ বুজলেই দেখতে পায় ও। ট্রেন ছাড়তে তখনও মিনিট দশেক দেরী। কমলার সেই বাবু প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে। কমলা একা সীটে বসে। একসময় সেই মহিলা বাচ্চাটাকে কমলার কোলে দিয়ে একটু দেখতে বলে ব্যাগটা সীটে রেখে জল আনতে প্ল্যাটফর্মে নেমে গেল। কমলা তো বসেই আছে। হঠাৎ ট্রেন ছাড়ার হুইসল্‌ কানে গেল ওর। মহিলার ফেরার নামই নেই। ভয় পেয়ে ও তাড়াতাড়ি দরজা দিয়ে বাইরে গলা বাড়িয়ে অনেক খোঁজে মহিলাকে। কোথায় কী! মহিলার টিকিটিও দেখতে পেল না ও। এদিকে ওর বাবুও ফিরে এসেছে।  ব্যাপার দেখে কমলাকে এই মারে তো সেই মারে! কার না কার পাপ! ফেলে রেখে দিতে বলল ষ্টেশনে। না, পারে নি কমলা সেদিন ওই দুধের শিশুকে ফেলে দিতে। মাতৃস্নেহে বুকে আঁকড়ে ধরেছিল বাচ্চাটিকে। সেই দেড় বছরের শিশুই আজকের এই ঊনিশের মিনু। যদিও মিনু ওকে মাসী বলে, তবুও কমলা মনে মনে ওকে ওর মেয়ে বলেই মানে। এখন ভাবে কমলা, ভাগ্যিশ! মিনু এসেছিলো ওর জীবনে। কমলার জীবনের ঊষর মরুভূমিতে এই মিনুই তো একমাত্র মরূদ্যান। ওদের এই বেশ্যাপল্লীতে যতটুকু পড়ানো যায়, কমলা ততটুকু পড়িওছে মিনুকে। কিন্তু মিনুকে আর বেশীদিন ঘরে রাখতে চায় না ও। চারিদিকে ছেলেছোকরার দল সারাক্ষণ ছোঁকছোঁক করে। কমলারও বয়স হচ্ছে। ও আর কতোদিন আগলে রাখতে পারবে মিনুকে জানে না। তার চেয়ে এই ভালো! হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজে কমলার চিন্তায় ছেদ পড়ে। “রাত হয়ে গেছে! জমিদারবাবু এলেন বোধ হয়, মিনুটা যে কী করে এখনও!” ভাবতে ভাবতে দরজা খুলতে যায় কমলা।
ছবি সহযোগিতায় : উষসী রায়

।।২।।

                        রাত পোহালেই মিনুর বিয়ে। মিনতি, কমলার আদরের মিনু কাল চলে যাবে তার স্বামীর ঘরে। এই রাতে কমলার চোখে কিছুতেই ঘুম আসবে না। আজ থেকে প্রায় বছর আঠারো আগে এইরকমই এক রাতে মিনু এসেছিল কমলার জীবনে। তার পর থেকে কমলার এক্কেবারে হাড়-মাসে জড়িয়ে ছিল মিনু। ওকে ছাড়া থাকবে কী করে কমলা, ভেবে পায় না। কমলার সামনে পড়ে আছে একটা খোলা চিঠি। কয়েকটা লাইন শুধু লেখা  তাতে।

“আর পারলাম না। তিন বছর ধরে বাড়ির লোকের অনেক লাঞ্ছনা সয়েছি। বুঝে গেছি, সে আর আসবে না। আমার শরীরটাকে নিয়ে খেলার শখ তার মিটেছে। অল্প বয়সের ভুলের মাশুল এই মেয়ে। এই পেটের শত্তুরটার জন্য মরতেও পারি নি এতোদিন। কিন্তু আর না। অনেক হয়েছে। আর বাঁচতে চাই না আমি। শুধু বাচ্চাটার একটা গতি করতে পারলেই...... মা হওয়ার যে কী জ্বালা!”

ব্যস্‌, এইটুকুই। আর কিছু লেখা নেই। না নাম, না ঠিকানা, কিচ্ছুটি না। নয় নয় করেও কয়েক’শ বার পড়েছে এই চিঠি কমলা। মিনুর মায়ের লেখা। সেদিন রাতে ট্রেনে মিনুর মায়ের ফেলে যাওয়া ব্যাগের মধ্যে ছিল এই চিঠি, কিছু টাকা আর একটা আংটি। মিনুর কাছে কিচ্ছু গোপন করেনি কমলা। সব বলেছে। পাশে শুয়ে থাকা ঘুমন্ত মেয়ের মুখের দিকে তাকায় ও। চোখদুটো জলে ভরে ওঠে। কাল চলে যাবে মেয়েটা। বিয়েবাড়ি বলে কথা! অনেক কাজ। যদিও পুরোটাই প্রায় জমিদারবাবুর টাকায় হচ্ছে। নইলে ওর সাধ থাকলেও আর সাধ্য কতটুকু! তাও ও মিনুকে গলায় একটা হার বানিয়ে দিয়েছে। এর চেয়ে বেশী কিছু দেবার সামর্থ্য যে নেই! শুধু মনে মনে ঈশ্বরকে ডাকে, “ঠাকুর দেখো, আমার মিনু যেন সুখী হয়। বড় সরল আমার এই মিনু।” এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে পূব দিগন্ত লাল হতে আরম্ভ করেছে, কমলা তা খেয়ালই করে নি।

                     আজ রায়বাড়িতে মহা সমারোহ। এতোদিন বাদে জমিদারবাবু বিয়ে করতে রাজি হয়েছেন। উৎসব না হলে হয়! যদিও পাত্রীর পরিচয় গোপন রাখা হয়েছে। সবাই জানে পাত্রী খুব গরিব, মা-বাবা নেই। মাসীর কাছে মানুষ। একজন অনাথাকে উদ্ধার করছেন জমিদার রাজশেখর রায়। কমলা আর মিনতিকেও সেভাবে শিখিয়ে পড়িয়ে রেখেছেন রায়মশাই। ওদেরকে সকালেই নিজের বাগানবাড়িতে এনে তুলেছেন উনি। বিয়ে ওখান থেকেই হবে। চারিদিকে দৌড়াদৌড়ি, হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে যেন! জমিদারবাবুর বিয়ে বলে কথা! এত্ত ব্যস্ততা, আলোর রোশনাই, জমকালো ব্যাপার-স্যাপার দেখে কমলা আর মিনুর যেন চোখদুটোই ধাঁধিয়ে যায়। “দেখ মিনু, কত ভাগ্য তোর, নইলে এইরকম বাড়িতে এসে পড়িস!” মিনুর থুতনিটা দু’আঙ্গুল দিয়ে তুলে বলে কমলা। গলাটা তার বুজে আসে। বাইরে তখন পূর্ণোদ্দমে সানাই বেজে চলেছে। গোধূলি লগ্নে বিয়ে। দিবাকর অস্তমিত হবার সাথে সাথেই বর বেশে আটচল্লিশ বছরের জমিদার রাজশেখর চললেন ঊনিশবর্ষীয়া মিনতিকে বিয়ে করতে ওনারই বাগানবাড়ীতে। তাঁর আর তর সইছে না। মদনদেবের পঞ্চবাণে তাঁর মন তখন ক্ষতবিক্ষত। কতক্ষণে মিনতিকে একা কাছে পাবেন ভেবে ভিতরে ভিতরে ছট্‌ফট্‌ করছেন উনি।

                  গভীর রাত তখন। বিয়েবাড়ির কলকোলাহলও স্তিমিত হয়ে এসেছে। ঘরে তখন শুধু মিনতি আর রাজশেখর রায়। রাজশেখর ধীরে ধীরে মিনতির মাথার ঘোমটাটা খুলে ফেললেন। মিনুর চোখের সামনে যেন একটা গাঢ় অন্ধকারের যবনিকা নেমে এল। ওর মনে হচ্ছে ওকে যেন খাবলে খেয়ে নিতে চাইছে মানুষটা। ঠোঁটদুটো যেন ছিঁড়ে যাবে, জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে অনাঘ্রাত এই শরীরটা। “উঃ” বলে ওর ঠোঁটদুটো হাত দিয়ে চেপে ধরে মিনতি। “আলোটা তো নিভিয়ে দিন আগে!” নারীর সহজাত লজ্জায় কঁকিয়ে বলে ওঠে মিনু। কিন্তু রাজশেখর রায় তখন পশুর থেকেও অধম। পাগলের মতো মিনুর হাতদুটো টেনে সরাতে গিয়েই চম্‌কে যান! উন্মাদের মতো চিৎকার করে ওঠেন।

-“কে, কে তুমি? এই আংটি কোথা থেকে পেলে? কে দিয়েছে তোমায়? বলো, বলো” মিনতিকে ধরে বিকারগ্রস্তের মতো ঝাঁকাতে থাকেন।

-“এটা আমার মায়ের আংটি। মাসীর কাছে ছিল। আজ মাসী পড়িয়ে দিয়েছে আমায়। কেন কী হয়েছে?” অবাক গলায় হাঁপাতে হাঁপাতে কোনরকমে বলে মিনু।

-“কী হয়েছে!” ফ্যাল্‌ফ্যাল্‌ করে চেয়ে থাকেন রাজশেখর।

কী বলবেন উনি! এই আংটির মাঝে মীনা করা ‘আর’ লেখাটা যে তাঁর নিজেরই নামের আদ্যক্ষর। কী করে বলবেন পার্বতীর কথা! কী ভাবে বলবেন যে আজ থেকে প্রায় বাইশ-তেইশ বছর আগে কাশীতে একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ের ধর্ম নষ্ট করার আগে তাঁর নিজের বংশের এই মূল্যবান আংটিটি মেয়েটিকে পড়িয়ে দিয়েছিলেন। মেয়েটির বিশ্বাস অর্জনের জন্য ওকে গান্ধর্ব মতে বিয়ে করতেও বাধ্য হয়েছিলেন। অনেক মিথ্যে স্তোক বাক্যে ভুলিয়েছিলেন উনি মেয়েটিকে। বুঝিয়েছিলেন এখন আপাততঃ বিয়েটা এভাবে হোক্‌, কাউকে কিছু জানাবার দরকার নেই। মাসখানেক পরে রাজশেখর বাড়ি গিয়ে বাবাকে বলে ধুমধাম করে জমিদারগিন্নী করে ওকে নিয়ে যাবে। সরলমনা মেয়েটি ওঁকে বিশ্বাসও করেছিল। তারপর একদিন মোহ ঘুচে গেলে কাশীতে মেয়েটিকে ফেলে পালিয়ে এসেছিলেন রাজশেখর রায়, আর খোঁজও নেন নি। ওঁর জীবনে আসা আরও অন্যান্য অনেক মেয়ের মতোই এই মেয়েটিও একসময় কালের অতলে তলিয়ে যায়। নাঃ, পুরোপুরি হয়ত তলিয়ে যেতে পারেনি পার্বতী। কারণ এই একটা মেয়েকে বাগে আনতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল রাজশেখরকে। শেষ পর্যন্ত মিথ্যে বিয়ের নাটক করে ভোগ করেছিলেন উনি পার্বতীকে। কাশীতেই আলাপ পার্বতীর সাথে। কাশীর মন্দিরের এক পুরোহিতের মেয়ে পার্বতী। জমিদারি সেরেস্তার কী একটা কাজে ওঁর বাবার হুকুমে সেবার কাশী যেতে হয়েছিল রাজশেখরকে। আর সেখানেই এক রাতে মন্দিরে আরতির সময় প্রথম দেখা পার্বতীকে। সেই দেখাতেই পাগল হয়ে উঠেছিল তখনকার দুর্দম, ব্যভিচারি, লম্পট রাজশেখর রায়। মেয়ে সে অনেক দেখেছে। তবে পার্বতীর মতো রূপ...... না এই জীবনে আর দেখেন নি উনি। কিন্তু এ কী! তাঁর সেই পাপবিজড়িত পুরনো অতীত এতোগুলো বছর বাদে আজকের এই রাতে আগুনের মতো জাজ্জ্বল্যমান হয়ে তাঁর সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে যে! ফুলশয্যার খাটটা যে শ্মশানের চিতার মতো দাউদাউ করে পুড়ছে। খাট পোড়ার চিড়্‌চিড়্‌ আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন রাজশেখর, ধূমের কটূ গন্ধে ঘরটা যেন ভরে যাচ্ছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে জমিদারমশাইয়ের। 

-“তোমার মা কোথায় এখন? উনি কী কাশীতে থাকতেন?” হিমশীতল যান্ত্রিক স্বর রাজশেখরের।

-“মাসীর কথা শুনে মনে হয় মা আর বেঁচে নেই। সম্ভবতঃ আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু কাশীর কথা আপনি জানলেন কী করে? আপনি কী আমার মাকে চিনতেন?” দুর্বোধ্য বিস্ময়ে প্রশ্নটা করে মিনতি। জমিদারবাবুর হাবভাব দেখে আর মাসীর কাছে শোনা ওর মায়ের গল্পটা মিলিয়ে ওর মধ্যেও যেন একটা সন্দেহ উঁকিঝুঁকি মারছে। কিন্তু সেটা ভাবলেও......... ও শিউরে উঠল। এ কী ভয়াবহ অভিশপ্ত রাত নেমে এলো ওর জীবনে! তবে কী! 

-“আত্মহত্যা! আর তোমার বাবা?” চিন্তাজাল ছিঁড়ে প্রশ্নটা ওর কানে গেল।

-“জানি না। মাসীর কাছে শুনেছি বাবা কাশীতে মাকে ফেলে চলে যায়। আর ফিরে আসে নি।” সন্দেহটা আস্তে আস্তে মিনতির মাথায় সত্যি হয়ে বসে যাচ্ছে যেন।

-“কাশীতে ফেলে চলে গেছে!” গলাটা কেঁপে ওঠে রায়মশাইয়ের। একদৃষ্টিতে খানিক্ষণ মিনতির দিকে তাকিয়ে থাকেন উনি। তারপর উদ্‌ভ্রান্তের মতো ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যান।

মিনতি পাথর। ওর যা বোঝার বোঝা হয়ে গেছে এতোক্ষণে। সন্দেহের সেই বিষটায় মিনতির সারা শরীর অবশ তখন। হঠাৎ কানে একটা গোলমালের শব্দ ভেসে আসে। চারিদিকে সবাই খুব চ্যাঁচামেচি করছে। লোকজন ছোটাছুটি করছে। কয়েকবার ওর নিজের নামটাও কানে গেল ওর। ও শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে ওর সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাড়ির কাজের মেয়েটা খুব কাঁদছে আর কী যেন একটা বলছে। কী বলছে ও! মিনু কিছু শুনতে পাচ্ছে না কেন? ভালো করে শোনার চেষ্টা করল ও। কী বলছে ও, জমিদারবাবু ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে মারা গেছেন। তা মিনু কী করবে! তিনমহলা বাড়ীর ছাদ থেকে লাফালে কেউ বাঁচে না কী আর! মারা তো যাবেই। কী বোকা এরা সব! ওতো উঁচু থেকে লাফ দিলে বাঁচবে কী করে? এইটুকুও জানে না এরা! ভেবেই ওর খুব হাসি পাচ্ছে। কিন্তু সবাই যে কাঁদছে। কিন্তু কই ওর তো কান্না পাচ্ছে না। ওর যে হাসি পাচ্ছে খুব! আর চাপতে পাচ্ছে না হাসি। মিনতি হেসেই ফেলল। ও মা! কারা আবার বলছে নতুন বৌ পাগল হয়ে গেছে। নতুন বউ, মানে ও...... পাগল! আরও জোরে জোরে হাসি পাচ্ছে ওর। ও না কী পাগল! এই বাড়ির বউ ও! তাহলে মেয়ে কে! ওরা কিচ্ছু জানে না। কী মজা! হাসতে হাসতে পেটটাই বুঝি ফেটে যাবে এবার! এ কী, ওকে আবার কারা ধরতে আসছে? বলছে পাগলা গারদে দেবে! যা, যা দূর হয়ে যা সব চোখের সামনে থেকে। যত্তসব জঞ্জাল, যাঃ পালা। মিনতি সারা ঘর দৌড়াতে থাকে। “ধর্‌ দেখি তো আমায়!” খাটের উপর লাফাতে থাকে মিনু। এদিকে নীচে সেই সময় তখন জমিদার রাজশেখর রায়ের মৃত শরীর খাটে তুলে চাদর দিয়ে ঢাকা হচ্ছে আর ওদিকে উপরের ঘরে তখন তাঁরই সদ্য পরিণীতা বিধবা কন্যার হাসির লহরিতে রাতের অন্ধকার খান্‌খান্‌ করে তিনমহলা প্রাসাদ থেকে থেকে কম্পিত হচ্ছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ