শারদ সংখ্যা ২০২০ || গল্প || পারমিতা রাহা হালদার (বিজয়া)




পোস্ট বার দেখা হয়েছে
 

শেকল ছেঁড়ার লড়াই
 পারমিতা রাহা হালদার (বিজয়া)

নিশা ফাস্ট ইয়ারের ছাত্রী। নতুন কলেজে আজ তৃতীয় দিন। নিশা বরাবরই স্কুলের প্রথমা। গরীব ঘরের মেয়ে অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরে স্কুলে স্কলারশিপেই পড়াশোনা । কিন্তু কলেজের খরচ কীভাবে আসবে? তাহলে কি পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে, এগিয়ে যেতে পারবে না নিশা, একমাত্র সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার অন্ত নেই বাবা মায়ের তবু নিশা কিন্তু হার মানে নি। 

               আলোর পথ খুঁজে কলেজের পথে এগিয়ে গেলো নিশা। প্রতিদিন কলেজ ফেরৎ সে  রাত পর্যন্ত টিউশনের মাধ্যমে নিজের খরচ চালানোর ব্যবস্থা করে নিল। 

              কলেজের গেটে ঢুকতেই ধাক্কা খেলো নিশা, চমকে পিছনে তাকিয়েই "দেখে চলতে পারেন না?"বেশ ঝাঁঝালো গলায় বলেই দেখলো এক লম্বা চওড়া সুপুরুষ। ছেলেটা নম্রভাবে সরি বলে এগিয়ে গেল। ইস আজই ক্লাস মিস হবে, হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে নিশা ক্লাসের দিকে ছুটতে লাগল।  আজ কপালে দুঃখ আছে প্রভাত স্যারের প্রথম ক্লাস শুনেছি স্যার ভীষণ পাংচুয়াল, দেরি দেখে ক্লাসে ঢুকতে দিলে হয়। ক্লাসে পৌঁছাতেই ছেলেটাও ক্লাসে ঢুকল দেখে নিশা ভাবলো ছেলেটা তারমানে ওরই  ক্লাসের ছাত্র। নিশা নিজের যায়গায় বসতেই অবাক হয়ে ছেলেটাকে দেখলো, বিরক্ত স্বরে নিজের মনেই বললো কি অভদ্র, স্যারের চেয়ারে বসছে। 

                 ক্লাসের স্টুডেন্টরা দাঁড়িয়ে গুডমর্নিং স্যর বলতেই চক্ষু স্থির নিশা ফিসফিসিয়ে বললো ইনি প্রভাত স্যার?!পাশের বন্ধুটা বললো চিনিস না? স্যর  ড.প্রভাত সেন,সম্প্রতি বিদেশ থেকে  পি.এইচ. ডি করে দেশে ফিরে আমাদের কলেজ জয়েন করেছেন। 

                      কলেজ শেষে প্রভাত স্যারের কাছে এসে নিশা যেচেই সকালের ব্যবহারের  জন্য ক্ষমা চাইল।"আরে না না, আমি কিছুই মনে করি নি। তুমি ক্লাসে বেশ মন দিয়েই পড়াশোনা  করছিলে দেখে বেশ ভাল লাগল। তোমার নাম কি? কোথায় থাকা হয়?"

             আমি নিশা, বাড়ি একটু দূরেই। এখন টিউশন পড়িয়ে বাড়িতে ফিরবো।

               সেকি! এই বয়সে টিউশন? তাহলে নিজের পড়াশোনা কখন করা হয়।
   
             আমরা ভীষণ গরিব। নিজের পড়াশোনা কমপ্লিট করবো বলেই টিউশন করি। না হলে যে বাড়িতে দুবেলা হাঁড়ি চাপে না সেই বাড়িতে পড়াশোনার খরচ কীভাবে আসবে। 

               কথাগুলো বলবার সময় প্রভাত স্যর সামান্যতম বিষন্নতা দেখতে পেলো না নিশার মধ্যে, বরং মেয়েটার মধ্যে কি অসীম আত্মসম্মান দেখে মুগ্ধ হলো। আচ্ছা নিশা ফিরবে কীভাবে? বাসে যাতায়াত করো?

         না স্যর রোজ রোজ বাসের ভাড়া দেওয়ার সামর্থ্য নেই তাই হেঁটেই....

        কোনো চিন্তা নেই  তুমি আমার গাড়িতে বসো আমি তোমাকে পৌঁছে দেব বলে স্যর আশ্বাস দিলো নিশাকে।
   
       "না স্যর সেটা মনে হয় শোভনীয় হবে না।বুঝতেই পারছেন কত কিছু গুঞ্জন উঠবে। আপনি আমার শিক্ষক আর আপনার গাড়ি চেপে বাড়ি গেলে কেউ সেটা ভালো চোখে দেখবে না। আমার হাঁটার অভ্যাস আছে স্যর, হেঁটেই চলে যাবো অসুবিধা হবে না। আপনার দেরি হচ্ছে বাড়ি ফিরতে আপনি বরং এগিয়ে যান"-বিনয়ের সঙ্গে বলল নিশা।

          "দেখো নিশা কে কি ভাববে সেটা ভেবে কোন দিনই কোন কাজ আমি করিনা।  কারণ আমি জানি সমালোচকরা আছেই সমালোচনা করার জন্য। আমি তোমার শিক্ষক হিসেবে আদেশ করছি ভাবতে পারো, তুমি গাড়িতে ওঠো।"

               নিশা গাড়িতে বসলো। গাড়ি ছুটতেই   নিশা ও প্রভাত নিজেদের মধ্যে আরো ভালোভাবে আলাপ সেরে নিল। 

        এখানেই নামিয়ে দিন স্যর। আপনার সাথে কথা বলতে বলতে কখন এতটা পথ এসে গেছি বুঝতেই পারিনি। ওয়ান্স এগেন থ্যাংক ইউ স্যর আপনাকে। সামনের সরুগলিটা দিয়ে একটু এগোলেই আমাদের বাড়ি। একদিন আপনাকে আসতে হবে যদি আপনার কোন দ্বিধা না থাকে। 

             আরে নিশ্চয়ই আসবো নিশা। দ্বিধা আবার কিসের। গাড়ি স্টাট করে এগিয়ে গেলো প্রভাত।  
   
        সময় গতিতেই চলতে লাগল সাথে নিশা- প্রভাত, শিক্ষক ছাত্রী সম্পর্ক। গন্ডির মধ্যেই ওরা ভালো বন্ধু হয়ে উঠল। এই সেদিনের আলাপ এখন ভাবলেই অবাক হয় দুজনে।

               তিন বছর কেটে গেল, কলেজে নিশার গ্র্যাজুয়েশনে প্রথম স্থান।  কলেজে প্রত্যেকেই গর্বিত নিশার জন্য। প্রভাত কনগ্রাচুলেট জানিয়ে বললো তোমাকে এখনও অনেক দূর এগাতে হবে। 

              উজ্জ্বল আকাশের বুকে মেঘ জমেছে, নিশা থমথমে দেখে বুঝতে পারলো প্রভাত। তিন বছরের মিষ্টি সম্পর্ক একে অপরকে বুঝবে এটাই তো স্বাভাবিক। কি চিন্তা করছো নিশা? কীভাবে নিজের স্বপ্ন পূরণ করবে ভাবছো তো? লড়াকু নিশা ঠিক পারবে বিশ্বাস রাখো নিজের প্রতি। 

            কি সুন্দর করে প্রভাত স্যর বোঝে আমাকে। কিন্তু অন্য কারণেও আমি  বিষন্ন সেটা কি বুঝতে পারছে স্যার।  হয়তো আজকের পরে স্যরের সাথে আর দেখাই হবেনা, কেন এতো মিস করছি স্যর কে? মনের মধ্যে তোলপাড় হচ্ছে নিশার। "স্যর আজ মা আপনাকে বাড়িতে ডেকেছে আসবেন?"

                      "নিশ্চয়ই আমি যাবো। তাছাড়া এখন থেকে আমার এই মিষ্টি ছাত্রী কাম বান্ধবীকে দেখতে ইচ্ছা হলে বাড়িতেই তো যেতে হবে। তাই তো নিশা!"

          নিশা খুশি, দুজনে গাড়িতে বসে গল্পে  ভেসে বাড়িতে পৌঁছালো। পৌঁছাতেই বাড়িতে  ভিড় দেখে ছুটে বাড়ির ভেতর ঢুকতেই দেখে বাবা অসুস্থ। নিশা বাবা বলে ডাকতেই বাবা  তাকালো। বাবা কলেজে প্রথম হতে আমি  পেরেছি। তোমার স্বপ্ন পূরণ করেছি আমি।  তুমি খুশি না? বাবা আস্তে করে নিশার মাথায় হাত রেখে শেষ বিদায় নিল। মা বলল, আমরা যে ভীষণ গরিব তোকে পড়াবার সামর্থ্য নেই এই দুঃশ্চিন্তায় তোর বাবা...   

     পরীক্ষা পাশের আনন্দ বাবার চিতার সাথে পুড়ে ছাই হয়ে গেল। বাবা হঠাৎ করে চলে যাওয়ায় মা ভেঙে পড়লো। পাড়া প্রতিবেশীরা বললো, মেয়েদের এতো পড়াশোনা করার দরকার কি? এবার বিয়ে দিয়ে দাও । মাথা ব্যথা পাড়ার লোকেদের বেশি ছিল। শুধু কথাতেই নয় কাজেও করে দেখালো। নিশার মাকে একপ্রকার বুঝিয়ে এক দ্বোজবরের সাথে বিয়ে ঠিক করেও ফেলল। 

             আমার মেয়ের জন্য এইরকম পাত্র চাই না আপনারা আসতে পারেন।মায়ের ,নিশার প্রতিবাদে কত যে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য!কেন তোমার মেয়ের জন্য রাজপুত্র আসবে নাকি! দুবেলা দুমুঠো খেতে পাও না তাও আবার চাঁদ ধরার সখ! নিশার মা কোন রকম ভাবে রাজি না হওয়ায় নিশা কে জোর করেই বিয়ের পিড়িতে বসানো হলো।

               নিশা ইতিমধ্যেই প্রভাত কে ফোনে সবটুকু জানিয়েছে। প্রভাত এসে নিশার বিয়ে আটকায়। পাড়ার লোকেরা প্রভাত কে নিয়ে নিশার প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করে সমালোচনা করলে প্রভাত নিশা কে বিয়ে করবে জানায়।

              সমস্ত দায়িত্ব নিয়ে নিশা কে এই লগ্নেই বিয়ে করলো প্রভাত। কিন্তু আমাদের সমাজ কি এতটাই মানবিক, উচ্চ-নীচের ভেদাভেদ অত্যাধুনিক যুগেও কি পরিবর্তন হয়েছে? উচ্চ শিক্ষিত বনেদী পরিবারের ছেলে প্রভাত, তার স্ত্রী হবে একটা অতি দরিদ্র হা  ঘরের মেয়ে সেটা মেনে নেওয়া সম্ভবই ছিল না প্রভাতের পরিবারের। তাই বিয়ের পরে বৌ নিয়ে প্রভাত বাড়িতে পৌঁছালে দরজা থেকেই বিদায় নিতে হয় নবদম্পতিকে। প্রভাত বাড়িতে থাকার অনুমতি পেত যদি নিশা কে তার জীবনসঙ্গীনি থেকে বহিষ্কৃত করতো । বড়োঘরের ছেলে দেখে ফাঁসিয়ে বিয়ে করেছে এই আপবাদও নিশা কে দেওয়া হলো।  না, প্রভাত কোন রকম অন্যায় প্রস্তাব মেনে নেয়নি।  নিশার হাত আমৃত্যু ধরে রাখবে এই বদ্ধপরিকর প্রভাত।  

             কিছুদিন নিশার বাড়িতে থাকার পর প্রভাত ফ্ল্যাট কিনে নতুন সংসার সাজালো। প্রভাত নিশা কে ভর্তি করে দিল ইউনিভার্সিটিতে । দেখতে দেখতেই কয়েক বছর পার হয়েছে সাথে নিশার পড়াশোনা ।  নিশা এখন অন্তঃসত্ত্বা । নিশার বিধবা মা এখন নিশাদের বাড়িতে থাকে।  সুখে দুঃখে  যেকোন লড়াই তে প্রভাত কে পাশে পেয়ে নিশা এখন ভীষণ সুখি। একে অপরকে ছাড়া জীবন অসম্পূর্ণ।  নিশার শুধু একটাই আশা ওর সন্তানের টানে যদি প্রভাতের পরিবারের সদস্যরা ওদের বিয়েটা মেনে ওদের কাছে টেনে নেয় তাহলে ওর জীবনের সমস্ত আকাঙক্ষা পূরণ হয়ে যাবে।  ওর জন্যই  প্রভাত নিজের পরিবারের থেকে দূরে সরে গেছে এই ভাবনা নিশা কে কুঁড়ে খায়  অপরাধীর মতো ।

               প্রভাত কে নিশা বলল,"আমাদের সন্তান এই পৃথিবীতে আসলে ওর পরিবার কে তুমি নিজে যে খবর দেবে। খবরটা জানার অধিকার ওনাদেরও আছে।"

               না নিশা আজ পর্যন্ত যারা তোমাকে স্বীকার করে নেয়নি, কোন যোগাযোগ রাখেনি  তাদের আমাদের সন্তানের কথা জানবার কোন অধিকার নেই। 

               না প্রভাত এই ধরনের ভাবনা পাপ। যতই হোক ওনারা তোমার মা বাবা তোমার পরিবার।  তুমি আমার এই ইচ্ছাটুকু রেখো, কথা দিচ্ছি তোমার কাছে জীবনে আর কিছু চাইবো না। 

         তুমি শুধরাবে না নিশা, বেশ আমি কথা দিচ্ছি আমাদের সন্তানের পৃথিবীতে আসার খবরটা পেলেই আমি নিজে গিয়ে খবর দেবো বাড়িতে, তারপর আমি সন্তানের মুখ দেখবো। 

                    সময় মতো ভূমিষ্ঠ হলো নিশা প্রভাতের সন্তান। নিশা কে দেওয়া কথা রাখতে প্রভাত নিজের বাড়িতে পৌঁছালো। 
কি ব্যাপার তুমি এই বাড়িতে পা রেখেছো? 
বাবা আজ আমার মেয়ে জন্ম গ্রহণ করেছে , তোমার বৌমার ইচ্ছাতেই খবরটা দিতে আসলাম। কি বলছ মেয়ে হয়েছে? আর এই দুঃসংবাদ কিনা তুমি দিতে এসেছো। যদি আমাদের বংশধর আসতো তাও একটা কথা ছিল।  তুমি  আমাদের কোন আশাই পূরণ করলে না। তোমাকে নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন ছিল।  কিন্তু আমার মেয়ের কি দোষ বাবা? মেয়ে নিয়ে আমরা কি করবো প্রভাত। 

         বেশ কিছুক্ষণ কথাকাটির পর প্রভাত রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়ি স্টার্ট করে হসপিটালের দিকে রওনা হলো। কিন্তু কোন দুর্যোগ বলে আসেনা। প্রভাত শান্ত প্রকৃতির ছেলে, সচরাচর মাথা গরম করতে কেউ দেখেনি। কিন্তু আজকের ঘটনায় প্রভাত বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠল। অন্যমনস্ক হয়ে গাড়ি চালাচ্ছে আর ভাবছে তার নিজের পরিবার এই ধরনের মানসিকতা রাখে। কন্যা শিশুর জন্ম নিয়ে এখনো এই ধরনের নীচ ধারনা ছিঃ। 

        হঠাৎ প্রচন্ড এক শব্দে রাস্তার লোক জড়ো হলো। একি মাথাটা পুরো ফেটে চৌঁচিড় হয়ে গেছে তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নামিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। কেউ একজন বলে উঠলো বডি হয়ে গেছে, প্রাণ নেই। পুলিশ এসে প্রভাত কে হসপিটালে নিয়ে গেল কিন্তু স্পট ডেথ জানালো ডাক্তার। 

                   প্রভাতের গাড়ি কে একটা ভারী ট্রাক পিশে চলে গেছে কিন্তু দোষটা প্রভাতের সাক্ষী দিলেন চাক্ষুষ অনেকেই। কেশটা ডিসমিশ হয়ে গেল। 

              স্বপ্নে সাজানো নিশা প্রভাতের সংসার আচমকা দমকা হাওয়ায় তাসের  ঘরের মতো ভেঙে গুড়িয়ে গেল। মেয়ের ভূমিষ্ঠ হওয়ার খবর জানলেও মেয়ের মুখ দেখার সৌভাগ্য হলো না প্রভাতের এই অপরাধের বোঝা নিশা নিজের কাঁধে চাপিয়ে নিল। খবর পেয়ে এই প্রথমবার শ্বশুর বাড়ির  সদস্যরা এসে হাজির হলো ফ্ল্যাটে। প্রভাতের কাজের দিন আর কেউ এলোনা। শ্মশানে শেষকৃত্য সম্পন্ন করেই বিদায় নিলেন। বরং যাওযার সময় এই মর্মান্তিক ঘটনার জন্য সম্পূর্ণ ভাবে পুত্রবঁধূ ও তার সদ্যজাত অশুভ  কন্যাই দায়ী বলে দাবি করলেন। 

                       নিশা এখন দিশেহারা, এই সদ্যজাত মেয়ে কে কিভাবে মানুষ করবে , সংসার কিভাবে চলবে ভেবেই পাচ্ছে না। কলেজ থেকে সমস্ত স্টাফ এলেন, প্রিন্সিপাল  জানালেন প্রভাতের জায়গায় তোমাকে চাকরিটা দেওয়া হলো নিশা। তুমি উচ্চ শিক্ষিতা আমার বিশ্বাস তুমি সবটুকুই সামলে নিতে পারবে। 

         "পারবো স্যর আমাকে যে পারতেই হবে। আমি এখন থেকে আমার মেয়ের মা ও বাবার  ভূমিকা একসাথে পালন করবো।"

      প্রভাত আর নিশার ভালোবাসার স্মৃতি তাদের মেয়ে, আদরের মেয়ের নাম রাখলো স্নেহা। স্নেহা দিম্মা ও মায়ের আদরে বড়ো হলো। কোন দিনই বাবার অভাব বুঝতে পারলো না। বাবার কথা বলতেই মা ওকে বলতো আমিই তোর বাবা। স্নেহা আর কোন প্রশ্ন করতো না। নিশার গর্ভজাত নিশার মতোই লড়াকু হলো। 

            হায়ার স্টাডি করার পর এই বছর ওকালতি কমপ্লিট করে রীতিমতো প্র্যাকটিস শুরু করে দিল স্নেহা। সাথে উকিল মেয়ে এক উকিল বন্ধুর সাথে হৃদয় আদান প্রদান করে ফেলল। রূপসী, শিক্ষিতা, উচ্চ পরিবারের মেয়েকে কোন পরিবার কি অপছন্দ করতে পারে। তবে বিয়ের প্রস্তাবে এখনি রাজি নয় স্নেহা। নিজের কেরিয়ার আগে ভালোভাবে গড়ে তুলবে তারপর বিয়ে করে সংসার করার কথা ভাববে স্পষ্ট জানিয়ে দিল স্নেহা। 

       নিশা এখন মেয়ের যেকোনো ডিসিশনে  বিশেষ একটা হস্তক্ষেপ করে না। মেয়ে বড়ো হয়েছে এখন নিজের জীবনের দায়িত্বও  নিজের । তবে মেয়ে যদি কোন পরামর্শ চাইতো মায়ের কাছে অবশ্যই পরামর্শ দিতো মেয়ে কে। তবে শাষণ করা নয় বলতে উচ্ছৃঙ্খলতা কে প্রশয় দেওয়া নয়। বাড়িতে একটা নিয়মে চলত সবাই ।  

            ওকালতির কাজে মাঝে মধ্যেই স্নেহাকে সারাদিন বাইরে থাকতে হয়। আজকাল আদরের মেয়ে কে সেইভাবে কাছে পায়না নিশা।  ব্যাস্ততার জীবনে আস্তে আস্তে মা ও মেয়ের মধ্যে একটু একটু করে দূরত্ব তৈরি হতে শুরু করে। প্রভাত যাওয়ার পর স্নেহার মুখ চেয়ে ভালো থাকতেই হয়েছিল নিশা কে। ছোট্ট থেকেই স্নেহার মূখের হাসি নিশার সমস্ত ক্লান্তি দূর করতো। আজকাল স্নেহার মায়ের ক্লান্তি বোঝার সময় টুকুও নেই। নিশা কষ্ট পেলেও কোন দোষ দেয়না মেয়ে কে কারণ সে বোঝে মেয়ে বড়ো হয়েছে তারও কাজের খুব চাপ। মেয়ে কে বড়ো করে তোলাই তো তার উদ্দেশ্য ছিল। এবার সময় মতো চার হাত এক করতে পারলেই ব্যাস তার ছুটি। 

           দুই বছরের মধ্যেই স্নেহা ওকালতিতে বেশ নাম করে। সৌমেনের বাড়ি থেকেও এখন বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে।  এই ক'বছরের প্রেমে স্নেহা আর সৌমেন দুজন দুজনের চরিত্রের সাথে বেশ পরিচিত। স্নেহা এবার বিয়েতে মত দিল। 

           দুই বাড়ি থেকে পাকা কথা সেরে বিয়ের দিন ঠিক হলো। বাড়িতে বিয়ের তোড়জোড়, স্নেহা বেশ কিছুদিনের জন্য ছুটি নিয়েছে। বিয়ে বাড়ি তাই কিছু কাজের লোক নিযুক্ত করে নিশা। স্নেহাও ঘর গুছানোর কাজে সাহায্য করছে দিম্মা ও মাকে।  নিশাও কলেজ থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে আসে। 

              ঘর গোছাতে গোছাতে একদিন স্নেহা মায়ের ঘরের ড্রয়ারটা খুললো। একটা বেশ পুরনো ডাইরি। স্নেহা হাতে নিয়ে এবার ডাইরির পাতাগুলি ওল্টাতে শুরু করলো। মায়ের হাতের লেখা, তারমানে মা ডাইরি লেখে আমি এতো বছরে সেটা জানতেও পারিনি। এবার ডাইরির পাতার গোছানো অক্ষর গুলো স্নেহা মন দিয়ে পড়তে লাগল।  কিছুক্ষণ পরেই স্নেহার চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় জল চিবুক বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। মায়ের জীবনের সংঘর্ষ আজ স্নেহা কে মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিল। মায়ের কাছে জোর করে কখনো তার জীবনের কথা জানতে চাইনি, এতটা সংঘর্ষ ও কেউ করতে পারে? পিছনের পাতা ওল্টাতেই লেখা অক্ষর গুলো পড়ে নিজেকে অপরাধী মনে হলো। যে মা আমার পৃথিবীতে আসা নিয়ে এতো অপমানিত হয়েছে এতো কষ্ট পেয়েছে , যার পুরো পৃথিবীটা শুধু আমাকে ঘিরে, নিজের জগত নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম সেই মাকে আমি সময় দিইনি। মা আমার জন্য একাকিত্ব বোধ করেছে কিন্তু মুখ ফুটে নিজের কষ্টের কথা একবারও বলেনি। ডাইরির পাতায় লেখা কিছু অক্ষর বারবার খোঁচা বেঁধে বুকে বিঁধছে ," প্রভাত তোমার মেয়ে কে আমি মানুষ করে তুলতে পেরেছি। আমি মা ও বাবা দুজনের ভূমিকা পালন করেছি। কিন্তু জানো প্রভাত আজকাল স্নেহা কে খুব অচেনা লাগে। আমি আজকাল আমাদের স্নেহা কে খুঁজে পাইনা ওর মধ্যে।আগের মতো মা বলে জড়িয়ে ধরতে ওর যেন কুন্ঠা বোধ হয়। আসলে বড়ো হয়ে গেছে কিনা তাই হয়তো। তবে মেয়েটাও খুব পরিশ্রমী ঠিক তোমার মতো কাজের পাগল। মেয়েটা দূরে সরে যাচ্ছে দেখে কষ্ট হচ্ছে ঠিকই  সাথে আনন্দও হচ্ছে ও বড়ো মাপের মানুষ হতে পেরেছে বলে"। আবার এক পাতায় লেখা, "আজ তোমার মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেল, আমাদের ছেড়ে চলে যাবে এবার। এবার আমি মুক্ত, সম্পূর্ণ একা। কিন্তু একটাই কষ্ট আমাদের মেয়ে কে আমরা নিজের হাতে সম্প্রদান করতে পারবো না। স্নেহা যখন আমার পেটে ছিল তুমি বলেছিলে আমার মতো একটা ফুটফুটে মেয়ে যেন হয়। আমরা পড়াশোনা শিখিয়ে নিজেরা  হাতে করে ওর বিয়ে দেব। আমরা দুজনে মিলে বিয়ের সব কাজ করবো। প্রভাত তুমি তোমার মেয়ের মুখ না দেখেই আমার উপর সম্পূর্ণ দায়িত্ব দিয়ে চলে গেলে। আর আমি মা হয়ে মেয়ের বিয়ের কোন শুভ কাজে হাত দিতে পারবো না, আমি অশুভ যে। এর থেকে বেশি যন্ত্রণা জীবনে আর কি হতে পারে? আজ প্রথমবার বৈধব্য দশার জন্য আমার কষ্ট হচ্ছে"।

      ডাইরিটা শেষ করে ছুটে যে মাকে জড়িয়ে কেঁদে ফেললো স্নেহা । কি হয়েছে রে মা কাঁদছিস কেন? সব মেয়েদের একদিন শ্বশুর বাড়ি যেতে হয় রে মা, শুধু আমার কপালে সে সুখ আসেনি। তুই মন খারাপ করিস না বলে মা মেয়ে একে অপরকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলল। 

           বিয়ের নেমন্তন্নে প্রভাতের পরিবার বাদ পড়লো না। নিশা বলল কেউ আসুক বা না আসুক তাদের বাড়ির মেয়ের বিয়ে তাদের জানানো উচিৎ। তারাই ঠিক করবেন  আশীর্বাদ করবেন কিনা। নেমন্তন্ন করতে
নিশার সাথে স্নেহা গেল প্রথমবার নিজের পরিবারের সাথে দেখা করতে। সবাই স্নেহা কে কথা দিল বিয়েতে আসবে। 

         ভোরের আলো ফোঁটার আগে থেকেই বিয়ের কাজ শুরু। সানাইয়ের সুরে সুখ-দুঃখ যেন বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে।  অতিথিরা সবাই এসে গেছি। প্রভাতেরই এক ভাই আব্যদ্বিপ পড়লো দায়িত্ব নিয়ে। গায়ে হলুদের সময় স্নেহা ডাকলো মা কে হলুদ মাখানোর জন্য। বিধবারা শুভ কাজে হাত দিতে পারেনা স্নেহা, এইসব এয়োস্ত্রীরা করে। কিন্তু মা হলুদ না মাখালে সেও হলুদ মাখবে না জানিয়ে দিল স্নেহা। নিশা এসে মেয়ের গায়ে হলুদ ছোঁয়ালো। 

            আসল গোল  বাঁধলো শুভলগ্নে বিয়ের আসরে। সম্প্রদানের সময় স্নেহা বললো কাকাই তুমি উঠে যাও, এই জায়গার অধিকার শুধুমাত্র আমার মায়ের। মা আমাকে সম্প্রদান করবে। 

            স্নেহার কথায় চারিদিকে হৈ চৈ পড়ে গেল। বিধবাদের শুভ কাজে থাকার অধিকার নেই তাছাড়া শাস্ত্রমতে মহিলারা কন্যাদান করেনা। এই নিয়ম আচার বিরুদ্ধ,এইটা সম্ভব নয় । তুমি অন্যায় আবদার না করে বিয়ের পিঁড়িতে বসো।

             মা আমার সম্প্রদান না করলে আমি বিয়ে করবো না। বাবার অবর্তমানে যদি মা একাই বাবা ও মার ভূমিকা নিয়ে সন্তান কে বড়ো করে তুলতে পারে তবে সম্প্রদান কেন করতে পারবে না।  এতে দোষ কোথায় তোমরা বোঝাও আমাকে। 

           তোর মা বিধবা, অশুভ। কোন অশুভ নারী শুভ কাজে হাত দিলে সব পন্ড হয়ে যায়। তার আর্শীবাদ বিয়ের পরে তোর অভিশাপ হয়ে যাবে। তোরও মায়ের মতোই কপাল পুড়বে। 

        মায়ের আশীর্বাদ কখনো অভিশাপ হতে পারে না। আজ মায়ের জায়গায় যদি বাবা বেঁচে থাকতো তাহলে কি তোমরা এই একই কথাগুলো বলতে? সমাজে পুরুষ ও নারীর ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা নিয়ম কেন? যেখানে সন্তান পালনে দুজনের অবদানই সমান। কেউ এই উওর দিতে পারো আমাকে? বিধবারা কখনই অশুভ হতে পারে না।  আমাদের সমাজ তাদের অশুভ বলে মাত্র। আর কতদিন সবাই চোখ বন্ধ করে এই সমস্ত কু-সংস্কার বিশ্বাস করে চলবে। 

         স্নেহার নিয়ম বিরুদ্ধ আচরণে সবাই অসন্তুস্ট হলো। নিশা বোঝালেও মায়ের আদেশ মানলো না স্নেহা। বিয়ের আসর সবাই পরিত্যাগ করলো। সৌমেন কিন্তু স্নেহার হাত ছাড়লো না। নিশা সম্পদান করে সৌমেনের
হাতে তুলে দিল আদরের মেয়ে স্নেহা কে। সানাই বাজলো নতুন সূর্যোদয়। সংঘর্ষ শুরু হলো নতুন পথে নতুন রূপে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ