শারদ সংখ্যা ২০২০ || গল্প || নবনীতা সই




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

কাজ
নবনীতা সই 

বেশ বৃষ্টিতে আজ পুরো জ্যাম৷ মাঘ মাসে এমন বৃষ্টি বাবার জন্মে দেখিনি আমি৷ দৌড়ে লাস্ট ট্রেন টা পেলাম৷ লেডিসে উঠে আরও ভয় ভয় লাগছিলো৷ ফাঁকা প্রায়৷ দু জন ঘুমাচ্ছে চাদর মুড়ি দিয়ে, আর দু চারজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে৷ কিছু ছেলে লেডিসে বসে আছে৷ কোন গার্ড নেই যে অভিযোগ করবো৷
চুপচাপ জানালার গিয়ে বসে পড়লাম ৷ বিরাটী আসার আগেই পুরো ফাঁকা হয়ে গেলো৷ জড়োসড় হয়ে বসে রইলাম৷ বাবা কে ফোন করে স্টেশনে আসতে বলে দিলাম ৷

 ছ সাত জন ছেলে ওপাশে গান করছিলো৷ কিছুক্ষন পর বুঝলাম ওরা কিন্নর মানে যাদের আমরা হিজড়া বলি৷ কেমন যেন ভয়টা নেমে গেলো বুক থেকে৷ কেন জানিনা, হয়ত ওরা পুরুষ নয় বলে৷ 
হাসি পেলো, একটি নারী সবসময় তার জীবনে সার্থক একজন পুরুষ কে প্রার্থণা করে কিন্তু তাকেই অন্য পরিবেশে ভয় পায়৷ 

গান শোনার জন্য হোক বা ভয় কাটাতে আমি নিজে গিয়েই বসলাম ওদের কাছে৷ সবাই মিলে বেশ গল্প জুড়ে দিলো৷ 
কোন চিন্তা করবে না দিদি, আমরা আছি৷ কোথায় নামবে গো?
বারাসাত ৷ 
বাড়ি কোথায় ?
কাছেই , স্টেশনে বাবা কে বলেছি আসতে৷ 
আচ্চা খুব ভালো , নইলে আমরা দিয়ে আসবো, কোন চিন্তা নেই ৷
না না বাবা আসবে৷ 
তোমরা কোথায় যাবে?
আমরা সব বনগাঁ যাবো৷ আজ আমাদের ছুটি৷ সবাই মিলে ঘুরতে গিয়েছিলাম ৷ আসার সময় কি বৃষ্টি ৷
হ্যাঁ আমারও দেরী হলো৷ জ্যামে গাড়ি আটকে ছিলো৷ 
কি কাজ করো দিদি?
আমি চাকরী করি অফিসে৷ হেলথে৷ 
তোমরা?
আমরা গান করি , টাকা চাই  ৷
সন্ধ্যা  ছটা কুড়ির বনগাঁ লোকাল ধরে সোজা উল্টোডাঙ্গা যেতে হয়৷ মা আমাদের রাতের ভাত রান্না করে দেয়৷ ট্রেনে থেকে নেমে সোজা অটো করে বড় বস্তি৷ সেখানে ছজন আগে খেয়ে নি, তারপর তৈরী হই৷ আমার সাথে , রতন, বিশু, রাজা, ঘনা সবাই যায়৷ ছজন আজ ছ বছর এই কাজ করছি৷ সেজেগুজে ছজন বেরিয়ে পড়ি৷  সোজা দিল্লী রোড৷ 
প্রথম প্রথম খুব লজ্জা লাগতো৷ এখন আর লাগেনা৷ পোড়া দেশে চাকরী কোথায়? যখন ট্রেনে দেখি কত ভালো ভালো ছাত্ররা সব চাকরীর পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছে , না চাকরী হয় না কিছু৷ সেখানে আমরা তো আগাছা৷
 আমার বাবা মা আমি এমন বলে , ট্রেনে ফেলে চলে গিয়েছিলো৷ বিশুর বাবা মা নেই ৷
 মা আমাদের এক জায়গায় করেছে৷ মা আগে বড় দলের মাসি ছিলো৷ তখন আমাকে পেয়েছিলো ট্রেনে৷ বিশুকে কোলকাতার রাস্তায়, ছজন কে কোথা কোথা থেকে এক জায়গায় করেছে মা ৷ পড়াশুনা করাতে পারেনি ৷
আর পারলেও হয়ত আমরা স্কুলে যেতাম না৷ কিন্তু না খাইয়ে রাখেনি৷ এখন আমরা কাজ করি৷ দল করেছি নিজেদের৷ 
 আমাদের মা বাড়িতে থাকে, গাঁয়ের বাড়িতে শান্তিতে থাকে৷ মা কোলকাতা আসতে চায়না৷
ও মাসি ও হিজড়া কথাটা আর মায়ের ভালো লাগেনা৷ 
শুনেছি মা নাকি খুব ভালো বাড়ির ছেলে ছিলো মানে ঐ আর কি কিন্নর না কি বলেন আপনাদের ভদ্দরলোকের সমাজ৷ সেই ছক্কা৷ 
পড়াশুনা শিখেছিলো মা৷ মায়ের বাবা চেয়েছিলো , একমাত্র ছেলে অনেক অনেক বড় ডাক্তার হবে৷ কিন্তু যে সময় জানতে পারেন, তার ছেলে ঠিক ছেলে নয় তখন তিনি মা কে বাড়ি থেকে দুরে হোস্টেলে পাঠিয়ে দেন৷ সেখানেও অনেক অনেক কথা শুনেও মা পড়াশুনা করতো৷ কিন্তু প্রিন্সিপাল বের করে দিলো ৷ সব বাচ্চারা তাকে নালিশ করেছিলো৷ মা আর বাড়ি ফিরে যায়নি৷ না তার বাবা এসেছিলেন নিতে৷ সেখান থেকে ঘুরে ঘুরে আজ বয়স কালে  বনগাঁ থাকে মা৷ 
দর্পণ শারদ সংখ্যা ২০২০ ( অঙ্কন উষসী রায়)

কিন্ত এ কাজ কেন করো?

জানি জানি বলবেন, আজকাল কত সুযোগ সুবিধা , সেই গুলো কোথায় বলবেন? আগে পাবে সংখ্যালঘু , তারপর হাজার জাত পাত ঘুরে আমাদের জন্য কি থাকে?কে ভাবে? তাই এই কাজ করি৷ সারারাত কাজ ভোরবেলা ফাস্ট ট্রেন ধরে সোজা বাড়ি ৷ স্নান করে খেয়ে দেয়ে ঘুম৷ দুপুরে খেয়ে আড্ডা দিয়ে আবার ট্রেন ধরি৷ 
এভাবেই কেটে যাবে জীবন৷ কেউ কোনদিন ভালোবাসবে না৷ কোনদিন কেউ বাবা বা মা বলে ডাকবে না৷ আমাদের ভাই নেই বোন নেই ৷ নিজের মা বাবা মুখ ফিরিয়ে নেয়, কোনদিন ভেবেছেন কতটা যন্ত্রণা হয়? 
আমরা টাকা চাই , গাড়ির কাঁচের কাছে আমাদের হাততালি আপনারা দেখেন কিন্তু আমাদের কষ্ট গুলো দেখা যায়? চুরি ডাকাতি তো করছি না৷

জানি, তবুও বলবো আপনারা এই কাজ ছেড়ে দিন৷ সবাই মিলে কিছু করুন৷
আপনি দেবেন কাজ?
আমি?
হ্যাঁ দিদি, বছর বছর নেতা মন্ত্রী এসে কত কিছু বলে যান, আমরা ব্যবসা করলে আপনারা সেই দোকান থেকে জিনিস কেনেন না৷ আমরা স্কুলে থাকলে আপনারা নিজেদের ছেলে মেয়ে পাঠাবেন না৷ অনেকে আমাদের স্পর্শ করলে স্নান করে জানেন?
না মানে...
কোন মানে নেই দিদি৷ আমাদের কাজ দিন , একশ দিনের কাজ গুলো আমরা পাই না৷ দেবেন দিদি কাজ?
স্টেশন চলে এসেছিলো আমি নেমে গেলাম৷ কানে তখনও বাজছিলো, দিদি কাজ দেবেন?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ