শারদ সংখ্যা ২০২০ || গল্প || জয়া চক্রবর্তী সোমা




পোস্ট বার দেখা হয়েছে


সৌম্য'র জন্য
 জয়া চক্রবর্তী সোমা

আজ স্বস্তিকার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন। আজ বারো বছরের অপেক্ষা শেষে তার জীবনের স্বপ্ন সত্যি হতে চলেছে। বাইরের বসার ঘরে ওই যার হাসির শব্দ পাচ্ছেন ওই সৌম্য। ওই মানুষটিকে আজ বারো বছর ধরে ভালবাসে স্বস্তিকা।  তখন স্বস্তিকার বয়স ছিল ষোলবছর। 
সদ্য মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। সেই সময়ে বাড়িতে জানাজানি হয়ে গিয়েছিল সৌম্য আর তার ভালোবাসার কথা। স্বস্তিকাদের পাড়ার একদম শেষের দিকের যে বাড়িটা, তখন সেখানে সৌম্য আর তার বিধবা মা থাকত। স্বস্তিকাদের দোতলা বাড়ির ছাদে দাঁড়ালে একটা কোনা দিয়ে  দেখা যেত ওদের টিনের চালের বাড়ির বারন্দাটা।
স্বস্তিকা খোলা হাওয়ায় পড়া মুখস্থ করার অজুহাতে ছাদে দাঁড়িয়ে কত সময় ওই বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকত তা আজ মনে পড়লেও হাসি পায়।সৌম্য কিন্তু স্বস্তিকার এই ভালো-লাগা বুঝত না। স্বস্তিকাকেই বোঝাতে হয়েছিল। বড় আলবোলা ছিল ও। কোন কিছু গুছিয়ে রাখতে পারতো না। ছবি নিয়ে ভীষণ পাগল ছিল।আর ওর তুলির টান, রঙের খেলা, তুলি হাতে নিয়ে তন্ময় চোখে কাগজের দিকে তাকিয়ে থাকা পাগল করে দিয়েছিল স্বস্তিকাকে।
ছবি সহযোগিতায় : উষসী রায়
সৌম্যদের অবস্থা ভালো ছিল না।মায়ের উইডো পেনশানের ক'টা টাকা আর সৌম্যর আঁকার টিউশানির মাইনেতে চলত ওদের কোনমতে।সৌম্যর মা স্বস্তিকাকে খুব ভালোবাসতেন।স্বস্তিকার মাও ভালোবাসত সৌম্যকে।সৌম্য স্বস্তিকাকে আঁকা শেখাতে এলে এটা ওটা রান্না করে খাওয়াতেন।কিন্তু ভালোবাসা এক জিনিষ আর মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেবার কথা ভাবা আরেক।
স্বস্তিকার বাবা মেয়ের বিয়ে দেবেন কোন ডাক্তার ইঞ্জিনীয়ার নিদেন পক্ষে বড় ব্যবসায়ীর সাথে সেটাই তো স্বাভাবিক। তা নয় কোথাকার কে এক আত্মভোলা চালচুলোহীন শিল্পী।সে নাকি হবে স্বস্তিকার পানিগ্রাহী।মেনে নেওয়া যায়??!
সৌম্যও এই একই কারণে প্রথমে ফিরিয়ে দিয়েছিল স্বস্তিকাকে।বলেছিল -"আমি চালচুলোহীন ভবঘুরে শিল্পী।আমার টাকা নেই তোমাকে সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে রাখার মত।আমার সাথে গাঁটছড়া বাঁধলে তুমি কষ্ট পাবে স্বস্তিকা।" স্বস্তিকা কোন কথা শোনে নি। জলভরা চোখে দিনের পর দিন গিয়ে বসে থেকেছে।অবশেষে হার মেনেছে সৌম্য।
তারপর একদিন অগোছালো লোকটার কাঁধের ঝোলা থেকে অন্যমনস্কতায় পরে যাওয়া স্বস্তিকার চিঠি স্বস্তিকার দিদির হাতে পরে বাড়িতে সব জানাজানি হল।বাবা তো রেগে আগুণ।যথারীতি সৌম্যকে ডেকে চূড়ান্ত অপমান করেছিলেন তিনি সেদিন।বলেছিলেন -"কোন যোগ্যতায়, কোন স্পর্ধায় তুমি আমার মেয়ের দিকে হাত বাড়াও।নিজেই তো মায়ের পেনশানের টাকায় খাও।প্রেম করতে লজ্জা করে না। নাকি স্বস্তিকে বিয়ে করে বড়লোক হবার স্বপ্ন দেখছ।" ফর্সা মুখ লাল হয়ে উঠেছিল সৌম্যর। বলেছিল-"কাকু স্বস্তিকে আমি সত্যিই ভালোবাসি।" ব্যঙ্গের সুরে বাবা বলেছিল -"তা কি করতে পারো ওর জন্য? প্লিজ 'মরে যেতে পারি' মার্কা ছেঁদো ফিল্মি ডায়লগ আমায় দিও না। তোমার মত ওয়ার্থলেসের জীবনের কানাকড়ি মূল্য নেই।" সৌম্য বলেছিল -"না কাকু। আমি বাঁচতে পারি ওর জন্য কারণ ওকে সঙ্গে নিয়েই আমি বাঁচার স্বপ্ন দেখি। তাই আজ আমি আপনাকে একটা কথা দিলাম কাকু। আপনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আশীর্বাদ করে আমাদের বিয়ে দেবেন। সেই দিনটার অপেক্ষায় থাকবো আমি। তার আগে স্বস্তির ধারে কাছে আসবো না আমি।" বাবার ঠোঁটে ফুটেছিল ব্যাঙ্গের হাসি। 
সৌম্য আর দাঁড়ায় নি। বেরিয়ে গিয়েছিল। তারপর স্বস্তিকা খবর পেল ওরা নাকি এখানকার ভাড়াবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে।স্বস্তিকা শেষবারের মত লুকিয়ে দেখা করেছিল সৌম্যর সাথে।চোখের জলে গাল ভাসিয়ে বলেছিল -"আমাকে এভাবে ছেড়ে কেন চলে যাচ্ছ তুমি?" সৌম্য বলেছিল -"ছেড়ে যাচ্ছি কে বলল? আমি যে তোমার বাবাকে কথা দিয়েছি।আমি আসবোই। তুমি অপেক্ষা করবে না?" দাঁতে দাঁত চেপে স্বস্তিকা বলেছিল -"করবো।" 
ছবি সহযোগিতায় : উষসী রায়
সেই অপেক্ষার আজ অবসান।সৌম্য আর ওর মা এসেছে আজ বিয়ের কথা বলতে। দিদি এসে আয়নার সামনে বসা স্বস্তিকার কানের কাছে মুখ এনে বলে-"বাব্বা তুইই দেখালি। বারো বছর উইথওউট কনট্যাক্ট এত্ত প্রেম। যাই বলিস সৌম্য কিন্তু আরো হ্যান্ডসাম হয়েছে।ওই দাড়ি গোঁফের জঙ্গল, কাঁধে ঝোলার ওই ক্যবলা ক্যবলা লুকটা আর নেই।" স্বস্তিকাও হাসে।কিন্তু নিজের মুখটা আয়নায় দেখে নিজেই টের পায় সে হাসিতে যেন প্রাণ নেই। কানে আসে সৌম্য তার বাবাকে ওর ব্যবসার কথা বলছে। ইনভেস্টমেন্ট , টার্নওভার, প্রফিট  শব্দগুলো ছেঁড়া ছেঁড়া কানে আসছে স্বস্তিকার। একটু আগে স্বস্তিকার সঙ্গে যখন কথা হল তখনও সৌম্য বলছিল -"আমি কথা দিয়েছিলাম স্বস্তি দেখ আমি রেখেছি। এখন তোমার বাবার কোম্পানির চেয়েও বড় কোম্পানি আমার। ইন্ডিয়ার মার্কেটে যে কটা ব্রান্ডেড আর্টস গুডের কোম্পানি আছে আমি তাদের একজন।তুমি খুশী নও?" স্বস্তিকা বিহ্বল চোখে বলেছিল -"আর্টস গুড? আর ছবি? ছবি আঁকো না তুমি? " সৌম্য বিষন্ন হেসে বলেছিল -"নাঃ, সে পাগলামী গেছে।শেষ ছবি যেটা তোমায় মডেল করে আঁকছিলাম, আজো অসম্পূর্ণই রয়ে গেল।" 
কি এক যন্ত্রণায় চোখ জ্বালা করে ওঠে স্বস্তিকার। মনে হয় সৌম্যকে আজ হাতড়ে হাতড়েও কেন খুঁজে পাচ্ছে না সে? তুলি রঙের সেই মানুষটার কাছে এখন সেগুলো শুধুই সামগ্রী? বাবা পরিবার সবার কাছে সৌম্য আজ সমাদৃত। শুধু হেরে যাচ্ছে স্বস্তিকার অপেক্ষা।এত বছরে যত সম্বন্ধ সে ফিরিয়ে দিয়েছে তাদের পাত্রদের গলার স্বর উচ্চারণ শব্দের সাথে আজ এত মিল কেন সৌম্যের গলার স্বর শব্দ উচ্চারণে।
দাদা বৌদি দিদি জামাইবাবু বাবা মা বিয়ের দিন ঠিক করছে বসার ঘরে। কানে আসে স্বস্তিকার। নিজের গালে গড়িয়ে পরা উষ্ণ জলের ধারা মুছে নেয় স্বস্তিকা। নাঃ, এভাবে সে হেরে যাবে না। যে অগ্নি পরীক্ষা সে দিয়েছে তার চেয়েও বড় অগ্নিপরীক্ষা তার জন্য অপেক্ষা করে আছে। সৌম্য চিরকালই এরকম। একটা সময় ছবি ওর পাগলামী ছিল। তারপর স্বস্তিকা ওর পাগলামী হয়ে উঠেছিল। আর এখন কেরিয়ারই ওর পাগলামী। স্বস্তিকাকেই আবার ওকে ফিরিয়ে আনতে হবে ওর ছবির কাছে। একদিন শুধু স্বস্তিকার জন্য রঙ তুলি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে মানুষটা। স্বস্তিকাই তার অসম্পূর্ণ ছবি শেষ করাবে। সে যে কথা দিয়েছিল সে অপেক্ষা করবে সৌম্যর জন্য...সেই আপনভোলা ঝোলা কাঁধের ক্যবলা ক্যবলা সৌম্য'র জন্য।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ