শারদ সংখ্যা ২০২০ || গল্প || দলছুট পাখি




পোস্ট বার দেখা হয়েছে


কালরাত্রি 
দলছুট পাখি

কুলি কামিনের ঘরের মেয়ে, কাঠ কুড়িয়ে দিন যায় তার আবার এত অহংকার! মাতব্বরদের চোখে ভালো ঠেকে না সাঁঝলির রকমসকম।

কষ্টি পাথরে খোদাই করা নিটোল চেহারা, ছোট ছোট অথচ বুদ্ধিদীপ্ত দুটো চোখ, একঢাল কোঁকড়ানো চুলে শক্ত করে বিনুনি বাঁধা। গ্রামের কেন দূর গ্রামের যে কোন মানুষেরই চোখে পড়ে সাঁঝলির রূপ। 

ইবার হুল পরবটোতে তু আর লাচবিক লাই সাঁঝলি।
 একটু জোর করেই ফুলমনি বলে কথাটা। পরবটোর পরেই তোর বিহা দিব বটে। আর কুতো দিন ওই খাতা বইটো লিয়ে ইসকুলে যাবি?

পলাশবনির জীবনযাত্রায় নতুন কিছু খুঁজে পায় না সাঁঝলি। স্বপ্ন দেখে, কলকাতার কলেজ... উঁচু বিল্ডিং... ঠান্ডা ঘর...টিভিতে দেখা, সুন্দর ব্যাগ কাঁধে অফিস...
উফফ, ভাবলেই যেন বারবার শিউরে ওঠে ও।

আমি বিহা কোরবোক লাই। মুরে দুটা ভাত দিতে তুগো এত্ত অসুবিধা হইনছে? ঠিক আছে আর আইসবক লাই তুদের ঘরটোতে। 
বলে সাইকেলটা নিয়ে স্কুলে বেরিয়ে যায় সাঁঝলি।

সারাদিন মনমরা হয়ে ক্লাসে বসে থাকে। টিফিনেও কারোর সাথে কথা বলে না। এবছর মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ও। খুব ভালো না হলেও মোটামুটি ভালোই রেজাল্ট করে আসছে এতদিন। সাড়ে চারটের ছুটির পর খুব ধীরে ধীরে সাইকেল নিয়ে বাড়ির পথেই রওনা হয় সে। রাগ তো দেখানো হয়েছে বাড়িতে, কিন্তু বাড়ি ছাড়া এখন যাবেই বা কোথায়! বাড়ি ফিরে না হয় মাকে বুঝিয়ে বলতে পারবে, আর বাপটা তো সন্ধ্যে হলেই মদ গিলে পরে থাকে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই ফিরছিল শাল সেগুনের পথ দিয়ে।
এই জঙ্গলে বিকেল গড়িয়েই রাত নামে, আর মাদলের ঢিমে তালে মহুয়া মন মাতায়...

-এই সাঁঝলি শুন...

ডাক শুনে পিছন ফিরে দেখে শ্যামল বাউড়ির বড় ছেলে আর গ্রামপ্রধানের ছেলে নিশুম্ভকে।
বুকের ভিতরে একটা চাপা ভয় কাজ করলেও ঘাড় শক্ত করে দাঁড়ায় সাঁঝলি।

-সিদিন বড় অপমানটো করছিলি বটে? তুর রূপের গুণের অহংকারটো আজ ভেইঙ্গে যদি না দিছি তো আমরা এক বাপের ব্যাটাটো লাই আছি!

-এক বাপের ব্যাটা আছিস বুঝলাম, কিন্তু কুত ব্যাটার বাপ আছিস সিটা বুল দিকি ক্যানে? সিটো যিদিন হাটে হাঁড়িটো ভেইঙ্গে দিবো সিদিন বুইঝতে পারবিক।

মনের জোর, গলার জোর ভগবান মেয়ে মানুষকে দিলেও গায়ের জোরটা অকারণেই কেন যে কম দিয়েছেন সেটা তিনিই জানেন।

পলাশবনির শাল সেগুনের লাল মাটি সেদিন আরও লাল হয়ে ওঠে সাঁঝলির রক্তে। 

প্রথম অধ্যায়ের শেষে ক্লান্ত শ্রান্ত দুর্দম অসুর দ্বয় তখন মদের নেশায় নিজেদের প্রস্তুত করতে ব্যস্ত পরবর্তী অধ্যায় জয় করার জন্য। মদের বোতল গলায় ঢালতে ঢালতে পৈশাচিক ভঙ্গিতে হাসতে থাকে দুজন।

অসুর দুটোর নির্মম অত্যাচার সহ্য করার পর কিছুটা ধাতস্থ হয়ে সাঁঝলি টলতে টলতে উঠে দাঁড়ায়। বইয়ের ব্যাগ খুলে জ্যামিতি বাক্স থেকে কম্পাসটা নিয়ে, শক্ত করে ধরে ডান হাতের মুঠোয়।
নিঃশব্দে এসে দাঁড়ায় নিশুম্ভের পিছনে...

ধুমাবতীর মতো খোলা, বিধ্বস্ত একমাথা কালো কোঁকড়া চুল নিয়ে কালরাত্রির অশনি সংকেত।
এক লাথিতে নিশুম্ভকে মাটিতে ফেলে ওর বুকের উপর বসে সাঁঝলি। কম্পাসের কাঁটাটা দিয়ে গলার নলির উপর আঘাতের পর আঘাত করতে থাকে ও। ফিনকি দিয়ে ওঠে রক্তের স্রোত। শ্যামল বাউড়ির বড় ছেলে এই দৃশ্য দেখে ছুটে পালায়।

একটু রাত বাড়তে ঘরে ফিরে সাঁঝলি। ওর রক্তে ভেজা পোশাক... দুহাতে, চোখে মুখে রক্ত... খোলা চুল...
এমন চেহারা দেখে ফুলমনি আঁতকে ওঠে। সাঁঝলির মুখে সব কথা শুনে কিছুক্ষন চুপ করে কি যেন ভাবে ফুলমনি। সাঁঝলির বাপ তখন হয়তো কোথাও মদের নেশায় ঝিম মেরে পড়ে আছে।

নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত ফুলমনি কখনো নিতে না পারলেও মেয়ের জীবনের সিদ্ধান্ত নিতে এক মুহুর্তও দেরি করে না সে।

ভোর তিনটের প্রথম ট্রেনটা যখন শহরের পথে, সাঁঝলিদের দরমার ঘরটা তখনও দাউদাউ করে জ্বলছিল...

কালরাত্রির চোখে তখন শহরের স্বপ্ন। 
মায়ের কাঁধে মাথা রেখে ট্রেনের ঝিকঝিক শব্দ তখন মহুয়ার নেশায় মেশা মাদলের তালের থেকেও যেন বেশি নেশা ধরিয়েছে...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ