শারদ সংখ্যা ২০২০ || গল্প || জয়দেব মাইতি




পোস্ট বার দেখা হয়েছে


 শূন্য বুকে 
জয়দেব মাইতি 

সাদাসিধে বিকাশ রায় দুর্ঘটনায় সাময়িক স্মৃতি শক্তি হারালেও কয়েক মাসের মধ্যে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে প্রায় পাঁচ বছর হলো সংসারী কিন্তু নিঃসন্তান হওয়ায় মনে শান্তি নাই। সে গিয়েছে ছয় বছর আগে দুর্ঘটনায় প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়া মেয়েটির সন্ধানে। নির্জন নদীর পাড়ে ছোট্ট ছোট্ট তিনটি আদিবাসীদের কুঁড়ে, সামনে একটি ফুটফুটে ছেলে খেলছে একা,এই পরিবেশে ছেলেটিকে বড্ড বেমানান মনে হলো,তবুও  বিকাশ তাকে জিজ্ঞ্যেস করলো  - "খোকা, এখানে কি মালতি থাকে"? 
ভেতর থেকে একটি নারী কন্ঠ ভেসে এলো - "কে আইসছেরে"? বাইরে এসে বিকাশকে আপাদ মস্তক দেখে চিনতে পেরে বাতাসি বললো - ইতত দিনে মোর দিদ্দির কথা মনে পইড়ছে হে"? 
যাকে নিয়ে এই কথা সে আড়াল থেকে চিনতে পেরেছে মানুষটিকে।

মালতি কালো-সুন্দরী। কালো পাথরে খোদাই করা নিখুঁত গড়নের সাঁওতাল রমণী। সেদিন ময়ূরাক্ষীর স্বচ্ছ আধ ডোবা ঠান্ডা পাথুরে জলে শরীর ডুবিয়ে পরিমার্জনে সারাদিনের ক্লান্তি দুর করার সময় পশ্চিমের ডুবন্ত সূর্যের আলোর ছোঁয়ায় তাকে অপূর্ব দেখাচ্ছিলো। 
প্রায় সর্বক্ষণের সাথী ভাইয়ের বউ বাতাসি বললো - "সত্যি দিদি,তু আর ইকবার বিহাট কর,তুকে কি সোন্দর লাইগছে বটে, ই জন্য মরদগুলান তুহার পানে তাকাইন মরে, উহাদের কুন দূষটা দ্যাখিলাই বাপু"। কথাটা বলে বাতাসি হিহি করে হেসে উঠলো। 
মালতি বললো - " লোকে কয় ইকটা মরদকে ত বি-হার রাতে খাইছি, ইকখন উ দিক পানে ডর লাগেরে বহু, তার লিগ্যা ত ইখানে লদীটাতে আসি - শরিলডার জ্বালা জুড়হাই"।
হঠাৎ মালতি বুঝতে পারে নদীর জল বাড়তে শুরু করেছে,নিরাভরণ শরীরটাতে কোন রকমে কাপড়টা জড়িয়ে উঠতে উঠতে বললো - "ই বহু তাড়াতাড়ি উঠনা কেনে ডেমপে জল ছাইড়ছেরে, ইকখনই উঠ মরহাই যাবি কেনে"। 
দুজনে কোন ক্রমে পাড়ে উঠে ফিরে তাকাতে নজরে এলো মানুষের মতো কিছু একটা ভেসে আসছে। মালতি দেখা মাত্র অপেক্ষা না করে জলে ঝাঁপ দিয়ে কোন রকমে পাড়ে টেনে তুলে  
দেখলো প্যান্ট শার্ট পরা বাবুটার তখনো প্রানটুকু থাকতে ও পারে। উপুড় করে শুইয়ে পিঠের উপর বসে দুদিকে চাপ দিতেই হুড় হুড় করে মুখ দিয়ে জল বেরোতে শুরু করেছে, অল্প সময়ের মধ্যেই মানুষটা কেশে উঠতে মালতি তাকে ক্ষিপ্র হাতে চিৎ করে পেটের দুপাশে হাঁটু মুড়ে বসে বুকে হালকা হালকা চাপ দিতে পেটের বাকি জলটুকুও বেরিয়ে এলো। মুখের মধ্যে মুখ ঠেকিয়ে বার কয়েক নিজের পেট ভরে নেওয়া বাতাস ভরে দিতেই লোকটির ধীরে ধীরে শ্বাস প্রশ্বাস শুরু হতে মালতির মুখে দারুন কিছু পাওয়ার হাসি ফুটে উঠেছিলো।
এতক্ষন বাতাসি অবাক হয়ে সব লক্ষ্য করছিলো, হঠাৎ নজরে এলো তার ননদীর শরীরে কাপড় নাই, বাবুটা তখনো চোখ বন্ধ কর পড়ে আছে,খুব ধীরে বুকটা ওঠানামা করছে। বাতাসি ফিসফিস করে বললো - "ই দিদি, তুহার কাপড় কুতথায়"? 
মালতি এবার নিজেকে দেখে চমকে উঠলো - বুঝতে পারলো জলের পাকে কাপড়টা চলে গিয়েছে। লজ্জায় ঝটপট বাতাসীর আড়ালে গিয়ে 
তার সায়া আর ব্লাউজটা পরে নিয়ে বললো - "ইকখন কি করবি বটে, ই বাটে ইখন কে বা আইসবেক,  বাপট ভাইট ইখন ত ঘর ফিরেকলাই, উহার ত হুঁশট আসেকলাই, তু ইক কাম কর - উহার পায়ের দিকটা ধর কেনে, মু উহার ছাত্তিটর কাছে বুকে জড়াইন ধরছি"। 
অনেক কষ্টে দুজনে একটু দূরে তাদের ঘরের দাওয়ায় এনে শুইয়ে নিজে কাপড় পরতে গিয়ে বাতাসীকে বললো ছাগীটা র দুধ দুয়ে গরম করে  আনতে। দুধ হালকা গরম হলে বুকের উপর হেলান দিয়ে বসিয়ে একটু খাওয়ানোর চেষটা করলো।বুঝতে পারলো শরীরে বল পেতে সময় লাগবে। বেশ কিছুক্ষণ বুকে ধরে বসার পর লোকটির থুতনি নাড়িয়ে ডাকলো - "বাবু, ই বাবু, মর দিকে তাকা কেনে, তু কুথা থিকে আইসছিস রে"? মানুষটা তাকে জড়িয়ে ধরে জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে লাগলো। মালতির সরল মনটা  মোচড় দিয়ে উঠলো। মাথার চুলে আলতো হাত বোলাতে গিয়ে বুঝতে পারে মাঝে মাঝে ফুলে আছে, নিশ্চয়ই জলের পাকে নদীর পাথরে আঘাত লেগেছে। একটু পরে মালতির বাবা ও ভাই কাজ থেকে ফিরে এলো। সব দেখে শুনে বললো - তারা রাস্তায় শুনেছে শহর থেকে আসা পিকনিক  পাটির একজন ড্যামপের জল ছাড়ায় তলিয়ে গেছে কিন্তু এখন তাদের ঠিকানা পাবে কোথায়, রাত্রি কাটলে না হয় খোঁজ নেয়া যাবে। অনেক রাত পর্য্যন্ত সবাই জেগে এক সময় খেয়ে শুয়ে পড়লো। মুখটার দিকে তাকালে বড্ড মায়া হয়, মালতি খেতে গেলনা, বুকে ধরে বসেই থাকলো। মাঝরাতে মানুষটা চোখ মেলে মালতিকে দেখে কিসের যেন ভয়ে তাকে আরো জড়িয়ে ধরলো। মালতি বললো - "ভয় কিডা, ই ত মু তুকে জড়াইন আছি, তুমমি কুথা থিকা আইছ, তুমহার নাম ট কি"? লোকটি তার মুখের দিকে কেমন ভাবে তাকিয়ে আবার জড়িয়ে ধরলো।
মালতি ভাবে খুব ভয় পেয়েছে, মাথায় লাগার কারনে হয়তো কিছু মনে করতে পারছেনা। 
ভোর হলো, বাড়ির লোকজন উঠে এসে  জানতে চায় কিছু বলেছে কিনা। মালতি বলে - "কুছু মনে করতে লারছে'। 
বেশ কয়েকটা দিন মালতির কাজে যাওয়া বন্ধ বাবুর দেখভাল করতে গিয়ে। মানুষটা মালতিকে  তার আপনজন ভাবতে শুরু করেছে, সব সময় পাশে পাশে ঘুরে বেড়ায়, যেন চোখে হারায়।মালতির ও খুব ভালো লাগে,কতো সময় পাশে বসে হাতে হাত নিয়ে জানতে চেষ্টা করে তার আগের কথা। লোকটি নীরবে ঘাড় নাড়ে। রাতে মাথায় হাত না বুলিয়ে দিলে ঘুমোয় না,মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। এমন ই এক রাতে  মালতি নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি, সমর্পণ করেছে নিজেকে সরল মনে বয়সের কোন অদৃশ্য টানে। ভাইয়ের বউ বাতাসি মেয়ে মানুষ বুঝতে পারে ওদের গভীর টানের কথা।
একদিন দুপুরের দিকে কয়েকজন শহরের লোক খোঁজ পেয়ে এসে দেখলো তাদের বন্ধু বিকাশ একটি আদিবাসী যুবতীর বুকে মাথা রেখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা বলল - "কিরে বিকাশ চিনতে পারছিসনা? তুই বেঁচে আছিস জেনে খুব ভালো লাগছেরে,আমরা তো আশা ছেড়েই দিয়ে ছিলাম, খোঁজ খবর করতে এসে একটু আগে শুনলাম একজন আদিবাসী মহিলা তোকে নদী থেকে তুলে বাঁচিয়েছে"। 
বাতাসি বললো - "উকে লিয়ে যে বসে আছে মালতি,  মোর দিদদি ট আছে, উহাকে উ ই ত  বাচাইনছে,বাবুটা তো কুছু মনে করতে লারছে! কুথা বুলে দ্যাখ কেনে"। 
অনেক কথা বলার পরও তারা কোন জবাব না পেয়ে হাত ধরে তুলতে যেতে মালতি কে সে আরো জোরে জড়িয়ে ধরে। মালতি ধীরে ধীরে তাকে ধরে দাঁড় করিয়ে বললো - "বাবু তুহার শহরের লিজের মানুষজন আইসচে, তু উহাদের সাথে ফিরাইনযা, মন টাইনলে আবার  আসবিখন"। কষ্টে  মালতির বুক ফেটে যাচ্ছিলো। 
হঠাৎ বিকাশ বলে উঠে - "কেন যাবো,আমি ওদের চিনিনা জানিনা,তুমিতো আমার, আমাকে তুমি  ভালবাস, তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবনা"। বিকাশের বন্ধুরা জোর করে মালতির বাহু মুক্ত করে তাদের বন্ধুকে নিয়ে চলে গেলো। 
মালতি দু চোখ ভরা জল নিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে উঠেছিলো - "ভাগিং-কুশি-আমা! মু তুহাকে ভাললবাসি"! 

এতদিন পর মানুষটাকে দেখতে পাবে ভাবতে পারেনি মালতি, স্মৃতির পাতায় একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে মালতি বাইরে বেরিয়ে আসতে বাতাসি বললো -"তূহার স্বপন বেটার বাপ গ দিদদি, চিনতে পারিস লাই"? 
মালতি চোখ দুটো বড়ো করে বললো " উঃ, থামবি বটহে"। বিকাশের দিকে ঘুরে মালতি বললো - "কুছু বুলবেন কি"? 
বিকাশ বললো সে এসেছে তার প্রাণ বাঁচিয়ে দেওয়া মহিলাকে কিছু দিয়ে যেতে।
মালতি বললো - "মরদের থিককান মুদের যিটা পাবার তু তো মুকে  দিয়েছিস বাবু"। কুঁড়েঘরে 
যেতে যেতে বললো - "যদি পারিস উ বাচ্চাটকে উহার বাপের নামটা বলে যাবি,মু আর কুছু চাইলাই"।
বিকাশ বুঝতে পারে ওই সুন্দর বালকটির পিতা সে নিজেই, স্মৃতি হারানো দিনগুলোতে আরো একটি অমূল্য জিনিস এখানে ফেলে গিয়েছে। 
বিকাশ খুব খুশি হলো, ঈশ্বর এভাবেই হয়তো তার অপূর্ণ ইচছা পূর্ন করেছেন। ধীর পায়ে ছেলেটিকে কোলে তুলে নিয়ে হাতে কয়েক হাজার টাকা দিয়ে বললো - "স্বপন, আমি বিকাশ রায় তোমার বাবা, আমি মাঝে মাঝে নিশ্চয়ই আসবো, তুমি লেখাপড়া করবে, মাকে বোলো তোমাদের সব খরচ আমি দিয়ে যাবো"। 
মালতি ঘরের ভেতর বাতাসীকে জড়িয়ে আনন্দে অশ্রু মোচন করতে করতে বললো -- "মারাংবুরু আচছে রে বাতাসী"! 
                               -- 0 -- 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ