শারদ সংখ্যা ২০২০ || আলোচনা ও ইতিহাস || ড:বিরাজলক্ষ্মী ঘোষ




পোস্ট বার দেখা হয়েছে


"মাতৃ আরাধনা"
ড:বিরাজলক্ষ্মী ঘোষ

মধু কৈটভবিধ্বংসি বিধাতৃ 
বরদে নম:।
রূপং দেহি জয়ং দেহি যশ দেহি
দ্বিষো জহি।।
হাওড়া সালকিয়ার প্রাচীন পরিবার গুলির অন্যতম ঘোষ পরিবার।এই পরিবার এর আদি পুরুষ স্বর্গীয় শ্রী রামসুন্দর ঘোষ 1860 সনে হুগলীর আগাই গ্রাম থেকে ব্যাবসার উদ্দেশ্যে শালিখা আসেন।তখন এই নামই প্রচলিত ছিল।পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীন জেলা গুলির মধ্যে হুগলী ছিল অন্যতম। স্বর্গীয় শ্রী রামসুন্দর ঘোষ এর পূর্বপুরুষ গণ হুগলী জেলার বাসিন্দা ছিলেন।যাইহোক রামসুন্দর পুত্র স্বর্গীয় শ্রী উত্তম চরণ ঘোষ ছিলেন তুখোড় ব্যবসায়ী।তিনি নিজ গুনে ব্যাবসার শ্রী বৃদ্ধি করেন এবং প্রায় ছয় বিঘা জমির উপর নিজের বসত বাড়ি ও কাছারী বাড়ি নির্মাণ করেন।দুটি বাড়ির আজও সমহিমায় দন্ডায় মান।একটির প্রবেশ পথ উত্তম ঘোষ লেন।যেটি পূর্বে কাছারী বাড়ি হিসাবে ব্যবহার হতো ব্যবসার কাজে।এই পাড়া টি তাঁর নামেই নামাঙ্কিত।অপর টি যেটি বসত বাড়ি বা ঠাকুর বাড়ি অর্থাৎ যেখানে দুর্গা দালান ও নাট মন্দির অবস্থিত তার প্রবেশ পথ বেনারস রোড।
স্বর্গীয় শ্রী উত্তম চরণ ঘোষ এর তিন পুত্র।মধ্যম পুত্র শ্রী কানাইলাল ঘোষ ছোটো বেলা থেকেই মূর্তি তৈরি করতে পারতেন নিপুণ হস্তে। শোনা যায় তারই বদান্যতায় 1884 সনে শুরু হয় মাতৃ আরাধনা।
প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য যে উত্তম পুত্র গৌর হরি ঘোষ যিনি কানাইলাল ঘোষ এর কনিষ্ঠ ভ্রাতা ছিলেন তার সঙ্গে বেলুড় মঠের বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ছিল।এছাড়াও স্বামী অভেদানন্দ যখন বেলুড় মঠের সংস্রব ত্যাগ করেন তখন তিনি এই ঘোষ বাড়িতেই এসে আশ্রয় নেন এবং তাঁরই বদান্যতায় এখানে রামকৃষ্ণ আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়।তাঁরই হাতে দীক্ষা নেন সুধন্য মুখার্জি (চিৎসরূপানন্দ স্বামী) এবং জানকীনাথ বন্দোপাধ্যায়।এই জানকী বাবুই ছিলেন পরিবারের আধ্যাত্মিক গুরু।সেই কারণেই দুর্গা পূজা শুরু হয় বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত মতে এবং শাক্ত নিয়মানুসারে।
ঘোষ বাড়িতে মাতৃ আরাধনা শুরু হয় মহা পঞ্চমী থেকে।পুরাতন কাঠামোর উপর মাটির ও খর দিয়ে নির্মাণ হয় নতুন প্রতিমা।জন্মাষ্টমী তিথিতে এই কাঠামো টি পুজো করার পর শুরু হ নতুন করে মূর্তি গড়া।পুরো পর্ব টাই চলে নাট মন্দিরে।পঞ্চমীর পূর্বেই পুরো নির্মাণ সমাপ্ত করা ও দেবীর সাজ পড়ানো শেষ করা হয়।পঞ্চমীর দিন  সায়ন কালে দেবীর বোধন হয় ষষ্ঠী তলায়।বাড়ির মহিলারা উপবাস সহ পুজোয় যোগদেন।বেল গাছ সহ ষষ্ঠী তলায় পুজো অন্যতম উপাচার এই দিনের জন্য।
ষষ্ঠীর পুজো হয় ষষ্ঠী তলায়।এছাড়াও আছে সন্ধ্যা আরতি।ষষ্ঠীর দিন কলা বউ সাজানো হয়। জোড়া বেল ও অপরাজিতা গাছ দিয়ে এই দিন কলা গাছ কে নারী রূপ দান করা হয়।সঙ্গে নতুন হলুদ শাড়ি গামছা ও অন্যান্য উপাচার থাকে। বেশীর ভাগ মানুষই জানেন কলা বউ হলো গণেশের বউ। তা আদৌ নয়।এটি দেবী দুর্গার সর্বত্র বিরাজমান একটি রূপ।সপ্তমীতে আসছি সেই প্রসঙ্গে।
মহাসপ্তমীর প্রভাতে নির্ঘণ্ট অনুযায়ী কলা বউ স্নান ও নবপত্রিকা স্থাপনা করা হয়।মানব সভ্যতার এক অপূর্ব নিদর্শন হলো নব পত্রিকা।এই নবপত্রিকা হল:
১.কদলী বা রম্ভা: কদলি গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ব্রহ্মাণী।
২.কচু: কচুগাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী কালিকা।
৩.হরিদ্রা : হলুদ গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী উমা।
৪.জয়ন্তী: জয়ন্তী গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী কার্তিকি।
৫ .বিল্ব :বেল গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী শিবা।
৬.দাড়িম্ব : এই গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী রক্ত দন্তিকা।
৭.অশোক : অশোক গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী শোকরহিতা।
৮. মান:এই গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী চামুণ্ডা।
৯.ধান:গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী লক্ষী।
এই নয় দেবী প্রকৃতির সর্বত্র যাদের অবস্থান একত্রে নবপত্রিকা বাসিনী‌ নবদূর্গা নামে "ওম নবপত্রিকা বাসিন্যই নবদূর্গায়ৈ নম:"মন্ত্রে পূজিত হন।এর অর্থ হলো প্রকৃতি দেবী ।তাকে তুষ্ট করলে সমগ্র জগতের অস্তিত্ব সুরক্ষিত। মহা সপ্তমীর সকালে কলা বউ স্নান করিয়ে প্রথা অনুযায়ী মা দুর্গাকে গৃহে নিয়ে আসেন সকলে।ঘোষ বাড়ির নিয়ম অনুসারে নাট মন্দির উঠোনের মাঝখানে মাটির বেদী প্রস্তুত করে আতর ,অগরু, সুগন্ধী,প্রদীপ,তেল,ফুল দিয়ে সাজানো কলা বউকে পুজো করা হয় ও নবপত্রিকা স্থাপনা করা হয়।
অষ্টমীর দিন অপরাজিতা,বেল, বকুল,কুদ ও জবা ফুল সহযোগে পূজা করার বিশেষ নিয়ম প্রচলিত।এছাড়া প্রতিদিন থাকে শিউলি ফুল।অষ্টমী পুজো সমাপ্ত হলে অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে শুরু হয় সন্ধি পুজো।এই পুজোয় থাকে কিছু বিশেষ উপাচার।
এই দিন কুড়ি কেজি ওজনের চালের ভোগ দেওয়া হয় তার ওপর দেওয়া হয় একটি রাজ নাড়ু। মাকে সোনার নথ ও রূপার নোয়া দেওয়া হয় নতুন বস্ত্রের সঙ্গে।একশো আট   
পদ্ম  ও একশো আট প্রদীপ সহযোগে দেবীর আরাধনা করা হয়। পুজো শেষে ব্রাহ্মণ কে দান করা হয়। প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী গুরু বাড়িতে বাসন শয্যা দান করার প্রথা প্রচলিত।পূর্বে সন্ধী পুজো শুরু হবার পাঁচ মিনিট পূর্বে বাড়ির কামান দাগা হতো।এবং সন্ধি পুজো শুরু হবার সময় আবার দাগা হতো।এতে এলকাবাসী বুঝতেন পারতেন যে পুজো শুরু হবার সময় এসেছে এবং সকলে যোগ দিতেন।
সন্ধি পুজো শেষ হবার পর যে অনুষ্ঠানটি হয় সেটি হলো বলি।তবে ঘোষ বাড়ির সদস্যরা হিংস পন্থায় বিশ্বাসী নন।তাই এখানে অহিংস বলির জন্য ব্যাবহার করা হয় চালকুমড়া,আখ ও আদা।শোনা যায় মা এসময় চামুণ্ডা রূপ ধরেন এবং সেই কারণে মার আসন থেকে বলির স্থান পর্যন্ত পথ শূন্য করে রাখা হয়। যাতে মা বলি গ্রহণ করতে পারেন।বলির পর নবমীর পুজো শুরু হয়।নবমীর পুজো শেষে হোম ও পুজো উদযাপন হয়।
পুজোর প্রতিদিন মাকে নিরামিষ ভোগ নিবেদন করা হয়।লুচি ভাজা মিষ্টি নৈবেদ্য সহ ভোগ নিবেদন করা হয়।বাড়িতে কেবল মাত্র অষ্টমী বাদে সব দিন আমিষ খাবার প্রথা প্রচলিত।নবমীর পুজো শেষে বাইরের অতিথি দের খাওয়াবার নিয়ম আছে।শোনা যায় পূর্বে পাঁঠার মাংস সহ মহা ভোজ প্রচলিত ছিল।
দশমীতে মার দশমীর পুজো ও ঠাকুর বরণের রীতি আছে।বাড়ির সকল মহিলারা  মিলে মা কে বরণ করেন।বরণ শেষে সব মা সহ সমস্ত দেবদেবীর হাতে জিলিপি ঝুলিয়ে দেবার নিয়ম আছে।পুরাতন প্রথা অনুযায়ী মা এদিন তার সন্তান সহ কৈলাস যাত্রা করেন।ঠিক যেমন মেয়েরা বাপের বাড়ি ছেড়ে শ্বশুর বাড়ি রওয়ানা দিলে বাপের বাড়ি থেকে তার হাতে মা রা খাবার পাঠান তেমনই এবাড়ির রীতি অনুযায়ী মা ও তার সন্তানদের মিষ্টান্ন সহযোগে বিদায় জানানো হয় বছরকার মত।বরণ শেষে সিঁদুর খেলার রীতি প্রচলিত।
1972 সনে পারিপার্শ্বিক অবস্থার অবনতি হওয়ায়  মূর্তি পুজো বন্ধ হয়ে যায়।তবে ঘট পুজো প্রচলিত ছিল।পরবর্তীতে 2018 সনে পুনরায় মূর্তি পুজো শুরু হয়েছে এক বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করেন।পশ্চিমবঙ্গের মাননীয় বিধায়ক ও ক্রীড়া মন্ত্রী লক্ষ্মী রতন শুক্লা এই ঠাকুর দালানে তার পুজোর গানের অ্যালবাম শুটিং করার আবেদন জানান বাড়ির সদস্যদের কাছে।এর জন্যে প্রয়োজন ছিল একটি দুর্গা মূর্তি।বাড়ির সকলে আবার মাকে বরণ করে ঘরে তুলে আনেন প্রায় চার দশক পরে ফের ঝলমলিয়ে ওঠে ঠাকুর দালান।শুরু হয় মহা সমারোহে মার পুজো।এ প্রজন্মের যাদের কাছে ঘোষ বাড়ির পুজো কেবল গল্প কথা ছিল তারা সশরীরে ঘটনার সাক্ষী হতে পারলেন।

মাতলো রে ভুবন..
বাজলো তোমার আলোর বেনু ।।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ