শারদ সংখ্যা ২০২০ || গল্প || বিমল কুমার আগারওয়াল




পোস্ট বার দেখা হয়েছে


জীবন বৈঠা
বিমল কুমার আগারওয়াল 

দিন কয়েক ধরে লাগাতার বৃষ্টিতে মাঠ ঘাট সব ভেসে গেছে- যেদিকে তাকাই শুধু জলে থৈ থৈ করছে। মালদা থেকে বেশ কিছুটা দূরে গঙ্গা নদীর চরের গা ঘেষে জেলেদের একটা ছোট গাঁ। না, ঠিক গাঁ বললে ভুল বলা হবে, গুটিকয়েক ঘর। তারই মাঝে বেশিরভাগ ঘরই মুসলমান জেলেদের, শুধু দু-ঘর মাঝিদের।

তারই এক ঘরে বউ বাসুনি আর তিন বছরের ছেলে বসন্তকে নিয়ে বাসা বেঁধেছে হারাণ মাঝি। বছর তিরিশের ছেলেটা যেমন পরিশ্রমী তেমনি সাহসী। সারাটা দিন একখানি ডিঙি নিয়ে নদীর বুকে দাপিয়ে বেড়ায়। সারাটা বছর নদী পারাপারের কাজ করলেও বছরের এই সময়টা সে জেলেদের নিয়ে যায় মাঝ দরিয়ায়। চার পাঁচদিন পরে ফেরে। ডিঙিতে বোঝাই থাকে নানান রকম মাছ। চরে এসে খালি করে ডিঙিখানা। রুপোলি মাছে চক্ চক্ করে ওঠে নদীর চর।

তবে এসবের প্রতি কোন লোভ নেই হারাণের। ওর চাহিদা শুধু ইলিশ। আর এর লোভে কখনো কখনো নদীপথে পৌঁছে যায় প্রতিবেশী দেশের সীমানায়, কখনো বা আরো গভীরে।
এইতো দিন দুয়েক আগেকার কথা। হারাণ সবে মুখ ধুয়ে মুড়ি আর ছোলা সেদ্ধ নিয়ে খেতে বসেছে, বাইরে থেকে আব্দুলের গলা শুনতে পায়–

"ও হারাণ... ঘরে আছিস?" সাত সকালে আব্দুলের হাঁকডাকে কোমরে লুঙ্গি বেঁধে খাবার ছেড়ে বেরিয়ে আসে হারাণ।  
"খবরটা পেয়েছিস।"
"কিসের খবর রে ? কোন খবরের কথা বলছিস?"
"এক ঝাঁক ইলিশ ঢুকেছে গঙ্গায়। কাল সন্ধ্যায় মির্জাপুরের হাটে গিয়েছিলাম। হাবিব মিঞার সাথে দেখা। খবরটা সেই দিলো, বললো ওপর থেকে খবর আছে। ইলিশের এক বিশাল ঝাঁক ঢুকেছে নদীর মোহনায়। 
"আর কি বললো আড়তদার ব‍্যাটা? মস্ত চামার একটা। আমাদের রক্ত চুষে খাচ্ছে। শ্লা শুয়োরের বাচ্চা.. বাগে পেলে একদিন ওর কি আমার..."

'কি আর বলবে? বললো, খবরটা দিলাম, জাল নামা। দরকার হলে আমি জাল দেবো, চারা দেবো,
তবে...'
' তবে কি?' বলে ফেল -
'তবে মাছের অর্ধেক ভাগ ওর। হিসাব অর্ধেক অর্ধেক হবে। তুই রাজি থাকলে বল কথা বলবো হাবিব মিঞার সাথে। তুই গেলে যেতে পারিস। তবে  তোর যা মাথা গরম, তাই চিন্তা। দেখিস সব ভেস্তে না যায়।'

সন্ধ্যার একটু পরেই ওরা গিয়ে ওঠে হাবিব মিঞার গদিতে। হারাণকে দেখে মিঞার মুখে বিরক্তি থাকলেও একটা তেতো হাসির ঝিলিক দেখিয়ে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয় হারাণের দিকে ...

'কি ঠিক করলি তোরা, যাবি? নাকি আমি অন্য কারুর সাথে কথা বলবো? আব্দুল আমার পুরনো লোক, তাই খবরটা আগে তোদের জানালাম। এবার তোরা ঠিক কর, যাবি কি না।'-
'ভাগ অর্ধেক অর্ধেক না, ষাট চল্লিশ হবে। ডিঙি আমার, জাল আপনার ...রাজি হলে কাল-ই  বেরোবো...' হারাণের সোজা সাপ্টা কথা।

রাত্রে খাবার সময় বাসুনিকে পুরো ব্যাপারটা জানায় হারাণ। কথাটা শুনে বুকটা ছ‍্যাত্ করে ওঠে তার। কেমন যেন একটা অজানা আশঙ্কা ঘিরে ধরে মনে। তবুও মুখে কুলুপ এঁটে থাকে। বাসুনি ভালো করেই জানে এই মানুষটা কতটা ইলিশ পাগল। সে যাবেই, শত বাঁধা দিলেও সে যাবে।

আজ তিনদিন হল হারাণ তার তিন সাথী আব্দুল, জব্বর আর আলী কে নিয়ে গেছে মাঝ দরিয়ায় রুপোলি ইলিশের সন্ধানে। গতকাল থেকে হটাৎ একখণ্ড মেঘ সারা আকাশ জুড়ে ছেয়ে গেল, সাথে ঝড়ের তান্ডব লীলা। গঙ্গা যেন কাল নাগিনীর মতো ফুঁসছে। তার ক্রোধের আগুনে যে কোন মুহূর্তে ভেসে যাবে চর। ভাসিয়ে নিয়ে যাবে তাদেরও। বাসুনির একটাই চিন্তা ছেলেটাকে নিয়ে কোথায় যাবে সে।

◆◆◆◆      ◆◆◆◆      ◆◆◆◆    ◆◆◆◆

বাঁশ হোগলার ঘরে এখন এক হাঁটু জল। বাসনগুলো তারই মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছে। কাঠের চৌকির অর্ধেকটা জলে ডুবে গ্যাছে। তাই একপাশে ছেলেকে নিয়ে কোনোরকমে দিনযাপন করছে বাসুনি। ঘরে যা কিছু শুকনো খাবার ছিল, এখন তার বেশীর ভাগই ভিজে গেছে বৃষ্টির জলে।  অবস্থা দিনে দিনে খারাপ হচ্ছে। এখানে থাকাটা আর নিরাপদ ঠেকছে না বাসুনির, তবু সে নিরুপায়... হারাণের অনুপস্থিতিতে এখন বাড়ি ছেড়ে কোথায় যাবে। মানুষটা ফিরে এলে কোথায় খুঁজবে তাদের .....

এই সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘরের ছাদটা হাওয়ার দাপটে উড়ে গেছে খেয়ালই করে নি সে। বসন্তের কান্নায় সম্বিৎ ফিরে পায় সে। জড়িয়ে ধরে তাকে... না আর এখানে থাকা যাবে না। নিজেকে নিয়ে চিন্তা করে না বাসুনি। তার চিন্তা একমাত্র ছেলে বসন্তকে নিয়ে। চরের সবাই নিরাপদ জায়গার খোঁজে ঘর ছাড়ছে। জব্বারের বউ তো বলেই দিলো ...
'দিদি আগে নিজেদের বাঁচাও, ওরা ব‍্যাটা ছেলা, নিজেদের বাঁচাতে জানে গো। বেঁচে থাকলে তবে না হারাণ ভাইজানের সাথে দেখা হবে। আমরা যাচ্ছি, তোমরাও চলো আমাদের সাথে।

বাসুনি জানে এই জায়গা ছেড়ে চলে যাওয়া ছাড়া তার আর কোনো উপায় নাই। তাই সে'ও বাকিদের সাথে বসন্তকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে নতুন আস্তানার খোঁজে, পিছনে ফেলে রেখে শেষ সম্বলটুকু। মনে শুধু একটাই চিন্তা, মানুষটা এখন কোথায় আছে কে জানে।

এদিকে আজ দুদিন ধরে সমানে বৈঠা টানার পর হারাণের ডিঙি মোহনার কাছাকাছি এসে পড়েছে। দূরে যতদূর চোখ যায় জল আর জল। তারই মাঝে দুই তিনটি জেলেদের নৌকাও দেখতে পায় সে। আলী কে জাল নামাতে বলে হারাণ।

বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বিছিয়ে ফেলে জাল। এখন শুধুই সময়ের প্রতীক্ষা। তারই মাঝে হাল্কা ঝড়ের আভাস ভেসে আসে। হারাণের মতো অনুভবী মাঝি স্পষ্ট বুঝতে পারে দারিয়ার ভাষা। ঘন্টা কয়েক পর ধীরে ধীরে জাল গোটাতে থাকে আলী, জব্বার আর পুরো জালটা গুটিয়ে এনে ফেলে ডিঙির  পাটাতনে।
রুপোলি ইলিশে ভরে যায় ডিঙির পাটাতন। হারানের চোখের কোণে দু'ফোঁটা জল নেমে আসে। এই জয়ের খুশি দেখা যায় চারজনের চোখে মুখে। সত্যি আল্লা মেহেরবান আজ ওদের ওপর। ইলিশের সাইজও ভালো, এক কিলো থেকে দেড় কিলো হবে।

দুদিন ধরে দফায় দফায় চলতে থাকে জাল ফেলার আয়োজন। অনুভবী মাঝির হাতে আছে ডিঙির ভার, তাই বাকিরা নিশ্চিন্ত। একমাত্র হারাণ জানে আগামী দিনগুলো কতখানি বিপদসঙ্কুল। যে করেই হোক এবার তাদের ফিরতে হবে, যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব। ডিঙির পাটাতন এখন প্রায় ইলিশে ভরা।  তাড়াতাড়ি না ফিরলে মাছগুলোও নষ্ট হয়ে যাবে।

 শক্ত হাতে হারাণ বৈঠা টানতে থাকে। বিদ্যুৎ ঝলকানি আর মেঘ গর্জনের সাথে সমান তালে বাড়তে থাকে ঝড়ের দাপট। সবকিছু লন্ডভন্ড হবার উপক্রম। এমনিতেই ইলিশে ভরা ডিঙি তার ওপর চারটে মানুষ , ঝড়ো হাওয়া জলের বড় বড় ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে ডিঙির পাটাতনে। সবার মুখে আল্লার নাম। সবার এক চিন্তা- শেষে কি ভরাডুবি হবে! এত কষ্ট কি বৃথা যাবে! বিশাল মোহনার মাঝে ডিঙিটা আজ কাগজের নৌকা মনে হচ্ছে। সময়ের সাথে ঝড় আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে থাকে। এখন শুধু জীবন বাঁচানোর চেষ্টা।

সমবেত প্রার্থনায় হোক আর পরমায়ুর জোরই হোক, তট রক্ষাবাহিনীর একটি ওয়্যাচিং বোট তাদের উদ্ধার করার জন্য এসে পড়ায় হারাণ তার তিন সাথীকে তাতে তুলে দেয়, কিন্তু সে তার পৈতৃক ডিঙি কিছুতেই ছাড়তে চায় না। অগত্যা তাকে ফেলে রেখেই ফিরে যায় তারা।

হারাণের জীবন যুদ্ধ এবার তার একার। জলের থাপ্পড় খেতে খেতে নিজের অজান্তে কখন যে তার ডিঙি প্রতিবেশী দেশের সীমানায় ঢুকে পড়েছে সে তা বুঝতেও পারেনি।
পুব আকাশে তখন উঁকি দিচ্ছে রবির প্রথম কিরণ। নদী এখন শান্ত। গতকাল রাত্রের তান্ডবের কোনো চিহ্ন নেই কোথাও। 
ঈশ্বরের অসীম কৃপায় আজ সে জীবিত। 

দূর থেকে প্রতিবেশী দেশের তট রক্ষাবাহিনী দেখে তার কাছে সবই জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যায়। ডিঙি ঘিরে চলতে থাকে জবাবদেহী। চলতে থাকে তার ডিঙির চিরুনী তল্লাশি। সমস্ত কথা শুনে ও ডিঙির পাটাতনে মাছের ভান্ডার দেখে তার কথায় বিশ্বাস করলেও এ দেশের জলসীমা রক্ষীর সাথে কথা বলে তবেই ছাড় পেল সে। বিনিময়ে তার শখের ইলিশ মাছের অনেকটা অংশই তাকে তুলে দিতে হয় তাদের হাতে। কিছুটা রেখে বাকিটুকু নষ্টের ভয়ে স্থানীয় বাজারে জলের দরে বিক্রি করতে হয় তাকে। 

 দীর্ঘ দুদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের শেষে অবসন্ন মনে হারাণ ফিরে আসে গঙ্গা নদীর চরে। কিন্তু কোথায় চর? কোথায় তাদের ঝুপড়ি ঘর? কোথায় তার বউ, ছেলে?
মাতাল নদী তার পথবদল করেছে। দূরে কোথাও দেখতে পায় মাতাল নদীর বুকে গড়ে ওঠা নতুন এক চর। 
ভেসে আসে মাতাল নদীর কুলকুল বয়ে যাওয়া ধ্বনি।

সন্ধ্যা নেমে এলো। বিষণ্ন মনে একটা একটা করে সব ইলিশ ফেলে দেয় সে গঙ্গার জলে। হাহাকারের বাঁশী বেজে ওঠে হারাণের মনে। খোলা আকাশের নিচে পাটাতনে শুয়ে আজ একলা হারাণ মাঝি প্রহর গুনছে সূর্যোদয়ের।
প্রতীক্ষা...শুধু আপনজনের....

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ