শারদ সংখ্যা ২০২০ || ভ্রমণ || অনামিকা বোস




পোস্ট বার দেখা হয়েছে


আমার দেখা গ্রামের দূর্গা পূজো
অনামিকা  বোস

মহালয়ের আগেই পরীক্ষার পর আমার স্কুলে পূজোর ছুটি পড়ে গেছে ৷আমি তখন খুব ছোটো তৃতীয় ক্লাসে পড়ি ৷ বাবার  অফিস থেকেও বেশ কিছু দিনের ছুটি পাবে তাই চিন্তা ভাবনা করা হলো এবারে  দূর্গা পূজোতে সবাই মিলে গ্রামে জেঠুর বাড়িতে ঘুরতে যাবো ৷ মনে মনে খুব আনন্দ হচ্ছে এর আগে আমি কোনও দিন গ্রাম দেখিনি ৷ এক সপ্তাহ আগে থেকেই ব্যাগ গুছানো শুরু করে দিয়েছি ৷ কবে কখন যাবো এই ভেবে ভেবেই দিন গুনছি ৷ ঠিক হলো মহালয়ার আগের দিন আমারা যাবো ৷ কারন জেঠু বারে বারে অনুরোধ করেছে আমরা  মহালয়ার আগেই যেন জেঠুর বাড়িতে চলে যাই ৷ মহালয়ে দেবী পক্ষে মায়ের চক্ষুদান করা হবে ৷ তাই দেরি করে গেলে অনেক কিছুই দেখতে পারবো না ৷ জেঠুর গ্রামের বাড়ি অনেক দূরে ৷ প্রায় চার থেকে পাঁচ ঘন্টা লাগবে ৷ তাই খুব ভোরই আমরা বেড়িয়ে পড়লাম ৷ প্রথমে কৃষ্ণনগর স্টেশন ,তারপর ট্রেন থেকে নেমেই বাসে করে তেহট্ট যেতে হবে ৷ ওখানে গিয়ে আবার বাস পাল্টাতে হলো পলাশির দিকে যাওয়ার বাস যা আর্শীগঞ্জ যাবে সেই বাসে উঠে বসলাম ৷ বাসের মধ্যে প্রচন্ড ভিড় ৷ কোনও রকমে আমরা সবাই বসার জায়গা নিয়ে বসে পড়লাম ৷ খুবই খারাপ রাস্তা বাস যেন নৌকার মতো হেলে দুলে যাচ্ছে ৷ আমি একদম বাসে উঠতে পারিনা ৷ উঠলেই বমি করে ফেলি তার ওপর এতোক্ষন বাসে থাকা আমার জন্য বড়ই শাস্তি ৷ দেখতে দেখতে বেশ অনেক বার বমি করে ফেললাম ৷ খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছি ৷ আর ভাবছি এই দুলন্ত বাস থেকে কখন মুক্তি পাবো ? চারিদিকে গ্রামের মনোরম দৃশ্য দেখতে দেখতে  উপভোগ করছিলাম ৷ সত্যিই আগে এমন সুন্দর দৃশ্য আমি কখনও দেখিনি ৷ চারিদিকে শরতের মনোরম আকাশের দৃশ্য ভীষণই মনকাড়া ৷ তার ওপর কাশের বনের বাহার সব মিলিয়ে আনন্দে আমার মন মেতেছে ৷ তবুও বারে বারে বমি করার জন্য আমার শরীরটা খুব দূর্বল হয়ে গেছে ৷ অনেক কষ্টের পরে এক সময় বাস কন্টাট্রাকটর বলে উঠলো আর্শীগঞ্জ..........আর্শীগঞ্জ এসে গেছে উঠে আসুন ৷ আমরা তড়িঘড়ি করে সবাই বাস থেকে নেমে পড়লাম ৷ এক প্রকার বাস থেকে মুক্তি পেলাম ৷ ধূলো উড়িয়ে বাসটা গ্রামের মাঝে দাড়ালো ৷ বাস থেকে নেমেই দেখি সামনে জেঠু আর দুই দাদা দাড়িয়ে আছে আমাদের নিয়ে যাবে বলে অপেক্ষা করছে ৷ আমাদের নামিয়ে দিয়ে বাসটা  আবার ধূলা উড়াতে উড়াতে অনেক দূরে চলে গেল ৷ চারিদিকের অপরূপ প্রকৃতির শোভা দেখে কখন যেন আমার শরীরের কষ্টটা ভুলে গেলাম ৷ বাবা বললো তোমরা সবাই জেঠুকে আর দাদাদেরকে প্রণাম করো ৷ আমরাও জেঠু আর দুই দাদাকে প্রণাম করে আর্শীবাদ নিলাম ৷ এবার জেঠু হাসতে হাসতে বলে উঠলো মামনিরা এবার কিন্তু অনেকটা রাস্তা হাঁটতে হবে এখানে আর কোনও যান বাহন পাওয়া যায় না ৷ আমরা ভয়ে বোনেরা একে অপরের দিকে তাকাতে থাকলাম ৷আর আমি মনে মনে ভাবছি কেন আসলাম এই জমপুরীতে ৷ জেঠু সামনেই আখ থেকে গুড় তৈরী করার কারখানায় নিয়ে গেল আখের রস খাওয়ালো ৷ তারপর শরীরটা খুব ভালো লাগছিল ৷ অনেকক্ষন আমরা কেউ কিছুই খাইনি এমন কি জল টুকুও খাইনি ৷ এই আখের রসটা যেন আমাদের প্রাণ ফিরিয়ে দিলো ৷ তারপর হেঁটেই চলেছি অনেকক্ষন ধরে আর পাচ্ছি না হাঁটতে ৷ রাস্তার পাশে একটা মস্ত বড়ো বট গাছের তলায় বেশ মেলার মতো অনেক লোকের ভিড় ৷ আমি জেঠুকে জিঙ্গাসা করলাম এখানে এতো লোকের ভিড় কেন ? এখানে সবাই কি করছে ? আমার কথায় জেঠু বললো এখানে সবায় গ্রামের নিয়ম অনুযায়ী বিশেষ পূজো করছে ৷এই পূজোতে গ্রামের সকল মানুষ অংশ গ্রহন করে আর খুব নিষ্ঠার সাথে পূজো করে ৷ আমরা ওখানে কিছুক্ষন দাড়িয়ে থেকে আবার আমরা হাঁটা শুরু করলাম ৷ প্রচন্ড রোদের মধ্যে খুব কষ্ট হচ্ছে কিন্তু ভয়ে মুখে কিছুই বলতে পাচ্ছি না ৷ মুখ বুজে হেঁটে চলেছি ,সামনে একটা ছোটো গ্রামের পাঠশালা দেখতে পেলাম ৷ সেখানে গ্রামের সব কচিকাচারা পড়তে আসে ৷ বাচ্চারা সবাই খুব হৈ হুল্লোর করছে ৷ তখনও জেঠু হেসে হেসে বলছে মামুনিরা এখনও কিন্তু আরও অনেক দূর হাঁটতে থাকো ,হাঁটতে থাকো.......... ৷ এবার সত্যিই আমার খুব রাগ হচ্ছে আর মাকে আড়ালে বলছি আমি আর হাঁটতে পাচ্ছি না ৷ মাও তেমনি বলে উঠলো বাড়াতে এসেছো কেন ? একটু কষ্ট তো করতেই হবে ৷ ছোটো বেলায় আমরা চার বোনেরা যেখানেই যেতাম কেন জানি না খুব হাসতাম একে অপরের দিকে তাকিয়ে ৷মা মাঝে মাঝে খুব বকছে আর বলছে কি হচ্ছে চুপচাপ হাঁটো ৷ এমন সময় হঠাৎ একটা সুন্দর বাড়ির মধ্যে জেঠু  চলে গেল ৷ ফিরে এসে বললো চলো মামনিরা আরোও অনেক রাস্তা বাকি আছে চলো চলো হাঁটতে হবে বলেই হেসে যাচ্ছে জেঠু ৷ তারপর অবশেষে বললো মাননিরা আমরা এসে গেছি এটাই আমার বাড়ি ৷ অবশেষে জেঠুর বাড়িতে এসে গেছি দেখে আমরা সবাই শান্তি পেলাম ৷ সামনেই জেঠিমাকে দেখে আমরা প্রণাম করলাম ৷ জেঠিমা সাথে সাথে বলে উঠলো তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধূয়ে খেয়ে নাও  কেনে ৷ সকলের তো খিদে পেট মোরে গেছে কেনে ৷ আমি তো অবাক হয়ে জেঠিমার কথা মন দিয়ে শুনছি ৷ প্রথম প্রথম আমি জেঠিমার ভাষা কিছুই বুঝতে পারতাম না ৷ এবারে এখানে একটা কথা বলে রাখি ৷এই জেঠু আমার বাবার দাদা বা নিজের জেঠু নয় ৷ বাবার অফিসে এই জেঠু বাবার কাছে ট্রেনিং এ এসেছিল ৷ তার থেকে ঘনিষ্ট বন্ধুত্ব ,আর এমন বন্ধুত্ব যে আমরাও এখন মনে করি জেঠু অামাদের নিজেদের খুব আপন ৷ নানা রকমের গল্প করতে করতে দুপুরের খাবারের পর্ব সারা হলো ৷ আমি দুপুরের খাবারের পর কিছুক্ষন ঘুমিয়ে নিলাম ৷ আসলে বাসে বমি করার ফলে খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম ৷ বিকেলে ঘুম থেকে উঠেই সব দাদারা আমাদেরকে গ্রাম দেখাতে নিয়ে গেল ৷ ঠাকুর দেলানে নিজের চোখে এই প্রথম ঠাকুর বানাতে দেখে খুব আনন্দ হচ্ছিলো ৷পরের দিনটাই ছিল মহালয়া দেবীপক্ষ মা দূর্গার চক্ষুদান করা হবে ৷ গ্রামের সকল মানুষ সবাই ঠাকুর দেলানে ভিড় করে বসে আড্ডা দিচ্ছে ৷  চারিদিকে যেন উৎসবের মেজাজ ৷ গ্রামের দূর্গা পূজাতে যে এতো প্রাণবন্ত হতে পারে আগে কখনও উপলব্ধি করিনি ৷ আর এতো কাছ থেকে দূর্গা পূজা কখনও দেখিনি ৷ সামনেই কাশফুলের বন শারি শারি ৷ শরতের নীল আকাশ সবাই যেন সেজে উঠেছে মা আসার আনন্দে ৷ গ্রামের  প্রতিটি মানুষ আমাদেরকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে স্পর্শ করে অনুভব করছিল ৷ মনে করছে আমরা যেন অন্য কোন গ্রহের জীব ৷ ওরা অনেকেই এর আগে কখনই কলকাতা শহরের মানুষ দেখেনি ৷ তার ওপর আমার মাকে দেখার জন্য সে কি ভিড়  ৷ আমার মায়ের হাতকাটা ব্লাউজ পড়া দেখে গ্রামের সবাই ভিড় করেছে শুধু মাকে দেখার জন্য ৷আমার মা দেখতে খুবই সুন্দরী আর ভীষন ফর্সা ৷ সবাই মায়ের গায়ে হাতে স্পর্শ করে দেখছে আর ততই অবাক হচ্ছে ৷ তখন যেন গ্রামের মানুষদের কাছে আমাদের যাওয়াটাই একটা বড় উৎসব হয়ে উঠেছে ৷ অবশ্য আমার মায়ের খাওয়া নিয়ে খুব অসুবিধা হচ্ছিলো ৷ গ্রামে কাঠের উননে রান্না করা খাবার আমাদের খাওয়ার অভ্যাস নেই ৷ মা নিজের হাতে রান্না করা খাবার খেতে পছন্দ করে ৷ কিন্তু আগে কোনও দিন কাঠের উনুন জ্বালায়নি তাই নিজে হাতে রান্নাও করতে পাচ্ছিলো না ৷ তাই অগত্যা মাকে ওদের রান্না করা খাবারটাই খেতে এক প্রকার বাধ্য হয়েছে ৷ আমাদের কোনও অসুবিধা হচ্ছিলো না ৷ জেঠুর বাড়িতে একটা ভাড়ার ঘর ছিলো সেখানে মুড়ি , ছোলা ভাজা , মোয়া আরওকতো কিছু ছিলো ৷সেই সব খাবার সারাদিন খেয়ে চলেছি ৷কোনও সময়ের জন্য আমাদের মুখটা বন্ধ ছিলো না ৷ আমরা এর আগে এই ধরনের খাবার চোখেই দেখিনি ৷ আমি এই গ্রামের মনোরম পরিবেশে হারিয়ে গেছিলাম ৷ সারাদিন পূজো মন্ডপে আর গ্রামের মধ্যে ঘুরে বেরানো ৷ খাওয়া দেওয়া ঘুম সব ভুলে গেছিলাম কটা দিন ৷পরের দিন ছিল মহালয়া দেবীর চোখ আঁকা হবে সেটা আমার কাছে এক আশ্চর্য ঘটনা ৷ সকালে উঠেই ঠাকুর দেলানে সবাই স্নান করে গেলাম সেখানে সবাই গানের অনুষ্ঠান দিয়ে দেবীর চক্ষুদান করা হলো ৷ মা দূর্গাকে বরণ করে নেওয়া হলো ৷ নিজের চোখে না দেখলে এই উপলব্ধি করা যায় না ৷ আমি তখন ছিলাম সর্ব ঘটের কাঠালি কলা ৷ কখনও জেঠুর সাথে চাষের খেতে গিয়ে পটল, মূলো, ফুলকফি, আলু সব সব্জি নিজে হাতে তোলা আমার এক অপরূপ এক অনন্য উপলব্ধি ৷ সেই স্মৃতি এখনও আমার মনে জ্বল জ্বল করছে ৷ দাদাকে যখন দেখলাম গরুর দুধ দোয়াতে তখন আমিও ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেলাম নিজে হাতে করবো বলে ৷ কিন্তু গরু যদি পা দিয়ে লাথি মারে ৷ তাও যখন আমি নিজে হাতে গরুর দুধ দোয়ালাম সে কি আমার আনন্দ মনে পড়লে এখনও আনন্দে নেচে উঠি ৷ জেঠিমার সাথে কাঠের উনানে কাঠ , শুকনো পাতা দেওয়া সেটাও কম আনন্দের ছিল না ৷ একটু একটু করে দূর্গা মা সেজে উঠছে আর সেই প্রতিটি মুহুর্ত যখন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি আনন্দে বিভোর হয়ে গেছি ৷ পরের দিন সকালে জেঠিমা বললো তোমরা কেউ যাবে কেনে আমার সাথে পুকুরে স্নান করতে ৷ আমিও তেমনি বলে উঠলাম আমি যাবো জেঠিমা তোমার সাথে ৷ চলে গেলাম পুকুরে স্নান করবো বলে , দেখে তো আমি অবাক ৷ একি  গ্রামের বাচ্চারা সবাই একবার করে গাছে উঠছে আর লাফ দিচ্ছে সোজা পুকুরে ৷ এটাই নাকি স্নান করার মজা ৷ আমাকেও জেঠিমা বললো তুমিও করো কেনে ৷ আমি তো  খুবই ভয় পাচ্ছি ৷ আমি যে সাঁতার জানি না ৷ কি ভাবে এতো উঁচু গাছ থেকে পুকুরের জলে ঝাপ দেবো ৷ আর যদি ডুবে যাই ,  আগে কোনও দিন এমন করিনি ,চোখেও দেখিনি কখনও ৷ তার ওপর পিছল খেঁজুর গাছ দিয়ে পুকুরের ঘাট বাঁধানো ৷ একে তো পিছল ঘাট কি ভাবে স্নান করবো তাই বুঝতে পাচ্ছি না ৷  ওখানে সব বাচ্ছারা আমাকে ডাকছে আর বলছে ভয় করছো কেনে ? আমি ওদের ভাষা শুনে মনে মনে খুব অবাক হচ্ছিলাম ৷ বেশ একটু সাহস সঞ্চয় করে এক ঝাপ দিলাম সোজা পুকুর জলে ৷ জলে পড়তেই হাবুডুবু খাচ্ছি ৷ বেশ কিছুটা পুকুরের জল আমার পেটে চলে গেল ৷ তখন আমিও যে খুব ছোটো ৷ সাথে সাথেই পুকুরে থাকা জেঠিমার সাথে আরোও কিছু কাকিমা,জেঠিমা আমাকে ধরে তুললো ৷ কিন্তু ভয়টা ছিল কিছূক্ষনের জন্যই ৷ আবারও আমি গাছে উঠে পুকুরে ঝাপ দিয়ে অনেকক্ষন এই ভাবেই স্নান করলাম ৷  তারপর এমন হলো জেঠিমা  একপ্রকার জোর করেই পুকুর থেকে তুলে নিয়ে গেল আমাকে ৷ এর পর থেকে যতো দিন ওখানে ছিলাম এই ভাবেই পুকুরের জলে ঝাপাঝাপি করে স্নান করেছি ৷ এতো আনন্দ এক জীবনে করেছি ভেবে এখনও খুশিতে মেতে ওঠে আমার মন ৷
একটা করে দিন চলে যাচ্ছে ততই দূর্গা পূজোর আনন্দ আমাকে ঘিরে মাতিয়ে রেখেছে ৷ গ্রামের পূজোর প্রতিটি নিয়ম নিষ্ঠা খুবই মনোরম মনোগ্রাহি ৷ সবকিছু নিজে হাতে করা এর মতো বড়ো আনন্দ আর কি হতে পারে ৷ আস্তে আস্তে ঢাকের সাজে সেজে উঠেছে এক চালার দূর্গা প্রতিমা ৷ কি অপরূপ সুন্দর মায়ের করুনাময়ী ,মমতাময়ী রূপ ৷ মাঝে মাঝে বৃষ্টি এসে আমার মনটা খারাপ করে দিচ্ছিলো ৷ গ্রামে তখন রাস্তা বলতে একচিলতে কাঁদি মাটির রাস্তা ৷ চারিদিকে কাঁদায় পা হাটু অবধি ডুবে যাচ্ছিলো ৷ রাস্তা দিয়ে হাঁটাই বড়ই দূরাবস্থা ছিলো ৷ একটু রোদের দেখা দিলেও আবার বৃষ্টিতে আকাশ ছেয়ে যাচ্ছে বারে বারে ৷ যাই হোক  আমাদের বাঙালির মনে প্রাণে দূর্গা পূজো নিয়ে যে উৎসাহ আছে তা কখনই একটু বৃষ্টির জন্য কম হতে পারে না ৷আমার মনে আছে গ্রামের বড় দাদারা সেই সময় এতো বৃষ্টি হচ্ছে বলে ঠাকুর দেলানে দুটো ব্যাঙ মেরে উল্টিয়ে রেখেছিল ৷ তাতে নাকি বৃষ্টি থেমে যায় ৷ পড়ে সত্যি সত্যিই বৃষ্টি থেমে গেছিলো ৷ পূজোর প্রতিটি দিন খুব আনন্দে কাটালাম ৷ অষ্টমীতে খুব সকালে স্নান সেরে অঞ্জলি দেওয়া প্রসাদ খাওয়া ৷ ঢাকের শব্দে সাড়া গ্রাম গমগম করছিলো ৷ নবমীর দিনে গ্রামের সকলে একসাথে ভোগ প্রসাদ খাওয়া ৷ গ্রামের সবাই একসাথে মাটিতে বসে মাংস ভাত খাবারের প্রতিযোগাতা দেওয়া ৷ আমি তো দেখেই অবাক কেউ একসাথে এতো খাবার খেতে পারে ৷ কিন্তু গ্রামের সব দাদারা আনন্দ করে কেউ কেউ এক দুই বালতি মাংস ভাত খেয়ে নিলো ৷ সত্যিই এই সব আনন্দের কথা আমি আমার শেষ জীবন অবধি মনে রাখবো কোনও দিন ভুলবো না ৷তখনও যেন সব কিছু আমার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিলো ৷ শেষের দিন মানে দশমীর দিন পূজোর সব নিয়ম মেনেই মায়ের বির্ষজনের আয়োজন করা হলো ৷ মাকে কনকাঞ্জলি  দেওয়া হলো ৷ গ্রামের সকল মা , কাকিমা, জেঠিমারা পান সিন্দুর দিয়ে বরণ করলো মা দূর্গাকে ৷ মাকে মিষ্টি মুখ করানো হলো ৷ সকলে মন খুব ভার মা দূর্গা আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে ৷ এক সময় আমার যেন মনে হলো মায়ের প্রতিমার চোখে জল ৷ মাও যেন আমাদের ছেড়ে যেতে চাইছে না ৷ আবার একটা বছর পর আমাদের কাছে আসবে এই আশায় মাকে বিদায় দিচ্ছি আমরা ৷ গ্রামের নিয়ম অনুযায়ী বাঁশের পালকিতে মা দূর্গাকে কাঁধে করে জলঙ্গী নদীতে নিয়ে যাবে বির্ষজন দেওয়ার জন্য ৷ গ্রামের সব ছেলেরা মা দূর্গাকে কাঁধে করে জলঙ্গী নদীতে পায়ে হেঁটে খুব  কষ্ট করে নিয়ে যায় ৷ অনেক কষ্ট করে একচালা মা দূর্গার মূর্তি পালকিতে তোলা হলো ৷ বাঁশের পাটাতনের পালকি করে সবাই পায়ে হেঁটে জলঙ্গী নদীর দিকে রওনা দিলাম ৷ সবাই ঢাকের তালে তালে নাচতে নাচতে হৈ হুল্লোর করে খুবই আনন্দ করতে করতে যাচ্ছি মায়ের ভাসানে ৷ রাস্তা খুব খারাপ হাঁটার পরিস্থিতি নেই এতো কাঁদা যে মায়ের প্রতিমাকে নিয়ে যাওয়া যাবে না ৷ তাই সবাই ঠিক করলো তাড়াতাড়ি যাওয়ার জন্য পাটের খেতের উপর দিয়ে যাবে ৷ কিছুদিন আগেই পাট গাছ কাটা হয়েছে তাই ফাকা আছে যাওয়া যাবে ৷ কিন্তু কাঁদায় আমাদের জুতো গুলো সব খারাপ হয়ে গেছে তাই জুতো পড়ে হাঁটতে পাচ্ছিলাম না ৷ তার ওপর  সবার খুব অসুবিধা হচ্ছিলো  পাট গাছের কাটা অংশ মাটিতে পোতা ছিলো ৷ যা আমাদের খালি পায়ে গেলে কেটে রক্ত বেড়োচ্ছিলো ৷ এতোটা রাস্তা এই ভাবে হেঁটে যাওয়া খুব কষ্টের ছিল ৷ তাতে কি আনন্দও খুব হচ্ছিলো ৷ এরকম আনন্দ আগে কখনও করিনি ৷ কখনও চোখেও দেখিনি ৷ নদীর পাড়ে কতো মানুষের সে কি ভিড় ৷ সবাই নৌকা খুঁজছে দরদাম করে আমরাও একটা নৌকা পেলাম যেখানে আমাদের একচালা মায়ের মূর্তিকে তোলা হলো  ৷ আর সব গ্রামের ছেলেদের নেওয়া হলো ৷ আর বাকি আমরা মেয়ে বৌদের একটি নৌকায় এতো মানুষের জায়গা হলো না ৷ আমার সাথে অনেকেরই  তো মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো ৷ এতো কষ্ট করে আসলাম আর নৌকায় চড়তে পারবো না ভেবে ৷ ভাবতে ভাবতেই একটা দাদা এসে খবর দিলো আরও একটা নৌকার ব্যবস্থা করা হয়েছে ৷ আমি তো শুনে খুব খুশি হয়ে গেলাম ৷ আমরা সবাই নৌকায় উঠে পড়লাম ৷ মনে মনে এতো আনন্দ হচ্ছিলো যে বলে বোঝাতে পারবো না ৷ এতো সুন্দর অনুভূতি আগে কেন এর পড়ে আর কোনও দিন এমন ভাবে আনন্দ উপভোগ করিনি ৷ শুরু হলো নৌকার প্রতিযোগিতা ৷পুরো জলঙ্গী নদীতে চারিদিকে  নৌকা আর নৌকাতেই ভরে গেছে ৷ সবাই হৈ চৈ করে যে যার নৌকাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ৷ এই ভাবে আমরা অনেকক্ষন নৌকায় কাটালাম ৷ সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে গভীর নদীতে কোনও অঘটন হতে পারে তাই ভেবে বড়োরা মায়ের প্রতিমা তাড়াতাড়ি বিষর্জন দিয়ে দিতে বললো ৷ সবার চোখের জলে আমরা মা দূর্গাকে বির্ষজন দিয়ে বিদায় দিলাম ৷ সবার চোখের সামনে অতুল জলে তলিয়ে গেলে মায়ের প্রতিমা ৷ আমাদের সবার চোখে তখন জল ,এক অদ্ভুত দৃশ্য যা কলকাতা শহরে এমন প্রতিমা বির্ষজন দেখিনি ৷ কিন্তু গ্রামের পুজোতে এতো মনের আন্তরিকতা আগে সত্যিই কখনও পাইনি ৷ সবাই আস্তে আস্তে ঘরে ফিরে আসলাম ৷ একে অপরের মিষ্টি মুখ করালাম ৷ তারপর পুরো গ্রাম জুরে সবার ঘরে ঘুরে ঘুরে মিষ্টি নাড়ু মোয়া গজা না জানি আরোও কতো কি খেতে খেতে পেট ভরে গেলো ৷ কিন্তু তাও গ্রামের মানুষরা কিছুতেই ছাড়বে না ৷ সবার ঘরে নাকি যেতেই হবে এটাই নাকি নিয়ম ৷ আমরা বেশ অনেক দিন হলো জেঠুর বাড়িতে আছি ৷ এবার বাড়ি ফেরার পালা ৷ আমাদের সাথে সাথে গ্রামের সকলের খুব মন খারাপ আমরা চলে আসবো বলে ৷ আর থাকা যাবে না বাবার অফিসের আর ছুটি নেই ৷ তাই পরের দিনই সকালে বাড়ি ফিরতে হবে ৷ এবার তো সত্যি সত্যিই কান্না পাচ্ছে ,এই কটা দিন এতো আনন্দ করেছি যে কি ভাবে কাটিয়ে দিলাম দিন গুলো বুঝতেই পেলাম না ৷ জেঠু জেঠিমা দুই দাদা ,দিদি আর গ্রামের সকল মানুষকে ছেড়ে আর বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না ৷ আমরা ফিরে আসবো বলে সবাই কান্না কাটি শুরু করে দিয়েছে ৷ বাবা সবাইকে বোঝালো আমরা আবার এখানে চলে আসবো ৷ এদিকে আমরা বাড়ি আসবো বলে জেঠু জেঠিমা সঙ্গে করে কি দেবে আর কি দেবে না তাই ভেবে পাচ্ছে না ৷ বিশাল বিশাল ব্যাগ বস্তা ভরে ভরে চাষের ডাল, আলু , ছোলা ভাজা, মুড়ি ,পটল ঘরে বানানো গুড় , গাছের নাড়কেল ,শাক সবজি আর না জানে কতো কি ৷ আমরা সবাই রাতের খাবার খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম ৷ কাল খুব সকালে উঠে বেড়োতে হবে ৷ সকালে উঠতেই দেখতে পেলাম এক অবাক কান্ড ৷ গ্রামের সকল মানুষ জন তাদের মনের ভালোবাসা জানানোর জন্য রাত ভোর থেকে জেঠুর বাড়ির গেটের বাইরে অপেক্ষা করছে ৷ সেই রাত ভোর থেকে এসে হাজির ৷সবার চোখে জল আমরা চলে আসছি বলে ৷ প্রত্যেকে হাতে করে কিছু না কিছু নিয়ে এসেছে ৷ কেউ গাছের লাউ ,কেউ কুমড়ো ,কেউ বা এক বস্তা পটল ,কেউ মূলো ,কেউ বা ডালের বড়ি ,ছোলার ছাতু ,নাড়ু ৷ বাবা দেখে অবাক সবাইকে অনুরোধ করে বললো এই সব নিয়ে যান আপনারা কি করেছেন ? আমি এই সব কিছুই নিতে পারবো না আপনারা সবাই এই সব নিয়ে ফিরে চলে যান ৷ আমি এই সব কিছুই নিয়ে যেতে পারবো না ৷ সবাই বাবার কথা কিছুতেই শুনবে না ৷ তখন জেঠু একটি উপায় বার করলো ৷ গ্রামের দুই জনকে আমাদের সাথে পাঠালো ৷ কিন্তু সবার মন রক্ষা করার জন্য প্রত্যেকে কাছ থেকে কিছু কিছু জিনিস নিয়ে বাকি সব ফিরিয়ে দেওয়া হলো ৷ শেষ অবধি গ্রামের ঐ দুই দাদারা আমাদের বাড়িতে এসে সমস্ত সবজি দিয়ে গেলো ৷ সত্যিই গ্রামের প্রত্যেকের আন্তরিকতা চিরদিন মনে রাখার মতো ৷গ্রামের দূর্গা পূজোর এতো সুন্দর স্মৃতি আমি কোনও দিনই  ভুলতে পারবো না ৷

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ