শারদ সংখ্যা ২০২০ || গল্প || জয়তী রায়




পোস্ট বার দেখা হয়েছে


তারপর? 
জয়তী রায়
                        
      এরপর সলিল শুরু করলো। চাঁদ এখন মাথার উপর। কনকনে ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে চারজন। বনবাংলোর বারান্দা ছেড়ে তবু নড়তে ইচ্ছে নেই কারো।  গোল টেবিল ঘিরে চার চেয়ার , গ্লাসে তরল, মাংস ভাজা, সামনে আদিগন্ত থমথমে অরণ্য রাতেরচাদর মাথায় দিয়ে বসলেও, চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চতুর্দিক। তবে ঘন পাতার আড়াল তার আলোকে খুব বেশী উজ্জ্বল করতে পারছে না। 
তিমির ঘুম জড়ানো গলায় বলল
   কটা বাজে? চৌকিদার রান্না শেষ করে নি?’
 ‘মোটে আটটা। এখন ঘুম কি রে? শালার হোস্টেলের স্বভাব গেল না? মারবো পাছায় লাথি।’ সনৎ স্বভাবসিদ্ধ তিরিক্ষে মেজাজে বলে উঠলো।
‘ এই তোরা থামবি? ছেলের বাপ হয়ে গেলেও স্বভাব বদলাবে না। আরে তিমির এসেছে আমেরিকা থেকে। ওর কষ্ট হচ্ছে। ‘ চিরকালের গার্জিয়ান অমল শান্ত গলায় থামাতে চাইলো।
‘ ধুর। মুড টাই কেচে গেল। আচ্ছা সেই কলেজ লাইফ থেকে দেখে আসছি, যেই আমার টার্ন আসে তোরা কেমন গুবলেট করে দিস সব। এখন তো আমরা মধ্য বয়েসী। এখনো এমন হিংসে তোদের? ‘
--’হিংসে তোকে? চটকা ভেঙে জেগে উঠলো তিমির
 --আরে তোকে হিংসে করতে যাবো কেন? কি  ছিল তোর ?’ 
---’আমার কি ছিল সে কথা তোর চেয়ে বেশি কে জানে? সে কথা মনে পড়লে এখনো তোকে খুন করতে ইচ্ছে করে। ‘
--সলিল থাম। ‘  - এত দিন পরে আমরা একসঙ্গে হলাম। এখন বয়স হয়েছে। কোথায় নিজেদের সুখ দুঃখ বলবি ,তা নয়,, - আক্ষেপ ফুটে ওঠে অমলের শান্ত স্বরে। 
--আমাকে দোষ দিবি না অমল। শুরু তোরা করেছিস। বললি ডিনার টাইমের আগে পর্যন্ত নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া ভৌতিক ঘটনা বলতে হবে। সবাই বললো ,শুধু আমার সময় শুরু হলো ফালতু কথা।’ সলিল গরগর গলায় বলে চলে।
--কারণ তোর জীবনে কোনো অলৌকিক কিছু ঘটেনি।  পাতিরামের পাতি জীবন তোর।’ এক চুমুকে গ্লাস শেষ করে ঠককাশ করে নামিয়ে , নিজের সোনালী ঢাউস ঘড়ি আর চওড়া কব্জি  ক্ষীণকায় সলিলের সামনে নাচিয়ে বলে উঠলো তিমির। 
-- তবে তিমির, কিছু মনে করিস না__ ব্যাঙ্গের সুরে সনৎ বলে -তোর অলৌকিক গল্প অদ্ভুত। নরবলি দেওয়া হলো একটা লোককে। তারপর সেই লোক স্কন্ধকাটা হয়ে ঘুরে বেড়ায় নিজের বউ এর চারপাশে।  হয় নাকি এমন? 
দর্পণ শারদ সংখ্যা ২০২০( অঙ্কন উষসী রায়)

 উত্তরে তিমির কি একটা বলতে যাচ্ছিল, তখনই অন্ধকার চিরে রাতজাগা পাখির স্বর শোনা গেল ক্যাওঁ ক্যাওঁ ক্যাওঁ। জোর হাওয়ায় বড় বড় পাতা দুলে সর সর আওয়াজ যেন ধমকে উঠে চুপ করতে বললো। চৌকিদারের কোন সাড়া নেই। শুধু তার পোষা কুকুরের করুণ ডাকশোনা যাচ্ছে। কোনো অজানা জায়গা থেকে তক্ষক ডাকছে। তখ তখ তখ ... বারান্দার  কোণে রাখা লণ্ঠনের মৃদু আলো ছড়িয়ে রেখেছে এক বিষণ্ন হলুদ আভা। অমল ধীর স্বরে বললো --’ সলিল শুরু কর তোর গল্প।’ 
 একটু আগের ঝাঁঝালো পরিবেশ থমকে রয়েছে আসন্ন দুর্যোগের আগের আকাশের মত। কারো কি মুড আছে আর গল্প শোনার? সলিল তিমিরের বাদানুবাদ যে অনেক ইতিহাস বহন করে আনে। যার মধ্যে তিক্ততা হিংস্রতা লোভ সবই মিশে আছে। চারজনের নিবিড় বন্ধুত্বে তবু ফাটল ধরেনি, তার কারণ অমল। সে তার অমোঘ কতৃত্ব দিয়ে ,মাতৃসুলভ আচরণ দিয়ে বন্ধুদের কাছে টেনে আনে। চার সওয়ারীর সম্পর্কের নৌকোর সে হলো মাঝি। তাই এবারেও হাল ধরে বললো
  ‘ শুরু কর সলিল। অলৌকিকত্ব আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশঃ। আমাদের তিনজনের গল্প শুনলাম। বিশ্বাস করা না করা যার যার ইচ্ছে। কিন্তু শোনা হোক যাই হোক গল্প গুলো আমাদের চারপাশে পূর্বপুরুষ বা কারো সঙ্গে ঘটেছিল।’ 
 
বনবাংলোর বারান্দার দেওয়ালে তিনটি ছায়া কেঁপে কেঁপে উঠছে। আলো আঁধারীর রহস্যময় রাত ভেদ করে সলিল বলে উঠলো
 কিন্তু আমার গল্প শোনা নয়, পূর্বপুরুষের সঙ্গেও হয় নি, আমার নিজের অভিজ্ঞতা। আমি বুলবুল কে ভালোবাসতাম। পাগলের মত। খুব কষ্ট করে গোপন করে রেখেছিলাম ভালোবাসাকে বুকের মধ্যে। গরিবের ছেলে , টিউশন করে খাই, প্রেম আমার কাছে দুঃস্বপ্ন মাত্র। তার উপরে বুলবুল? তুখোড় স্মার্ট আর সুন্দরী। তবু পৃথিবীতে এমন অনেক কিছু ঘটে যার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। বুল বুল আমার প্রেমে পড়ে গেল। ভরসা দিলো। শক্তি জোগাল। আমরা সুখী কবুতরের মত হাওয়ায় ভেসে গেলাম। 
সব ঠিক ছিল। শুধু ওই তিমিরটার সহ্য হলো না আমার সুখ। কোনোদিন হয় নি। আড়ালে ভিখিরী বলতো আমাকে। ভালো রেসাল্ট করলে মুখ বাঁকাত। এসব তবু ঠিক আছে। কিন্তু ওর কু নজর পড়তে লাগলো বুলবুলের দিকে। 
দর্পণ শারদ সংখ্যা ২০২০( অঙ্কন উষসী রায়)

---’ সলিল’ চাপা ধমক দিল অমল। এ গুলো আমরা জানি। আমার কথায় তিমির সরেও এসেছিল। বুলবুল আর তোর বিয়েতে ওই সবচেয়ে বেশি  কাজ করেছিল। তারপর তো আমেরিকা চলে যায়। নিজেও সংসার করেছে। ‘ 
--’সংসার ? অন্ধকারে ঝলসে ওঠে সলিলের হাসি
 কিছু সংসার করেনি।  একটার পর একটা ডিভোর্স। মারপিট। একটা জানোয়ারের চেয়েও খারাপ ছিল তিমির।’ 
‘ কিন্তু দু তিন বছর অন্তর অন্তর যখন মিলতাম, কিছু বুঝিনি তো। তুই বা এত কি করে জানলি?
--কারণ ও বুলবুল কে ফোন করতো। রেগুলার। হাউহাউ করে কেঁদে কেঁদে নাটক করত।  সরল বুলবুল এতে কোনো দোষ দেখেনি। আমাকে চিন্তা করতে বারণ করতো। ও তখন সংসার ছেলে স্কুলের চাকরি নিয়ে ব্যস্ত, আমিও ভালো চাকরি করি। প্রেমের শেষে জীবন হয়েছে থিতু। এমন সময় কালো মেঘের মত তিমির প্রবেশ করলো আমাদের জীবনে। ওর অভিশপ্ত দীর্ঘশ্বাস নিয়ে রোজ ফোন করতো বুলবুলকে। মেয়েটা কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল। বার বার বলতো আহা কি কষ্ট। আমি সজোরে নাড়া দিতাম ওকে -- বারণ করতাম তিমিরের ফোন ধরতে। বুলবুল শুনতো না। ও ভাবতো তিমির কে আমি ভুল বুঝি। এক অসহায় পাখির মত ওই শয়তানটার পাতা ফাঁদে জড়িয়ে পড়ছিল বুলবুল। 
--’ সাট আপ। সলিল। এক ঘুঁষিতে তোর নাক ভেঙে দেব শালা। মুরোদ আছে তোর বুলবুলকে ধরে রাখতে? আরে ওমন পাখী রাখতে সোনার খাঁচা লাগে। ‘
-- এই এই কি হচ্ছে এ সব ,কি হচ্ছে কি-- অমল শঙ্কিত স্বরে বলে উঠলো--সনৎ তুই কিছু জানিস?’
বিমূঢ় সনৎ মাথা নাড়লো হতভম্বের মত। ঘটনার আকস্মিকতায় সে স্তব্ধ হয়ে গেছে। মানে কি? বুলবুল কি আর সলিলের সঙ্গে নেই ? 
--সলিল ! কি হয়েছে ভাই বল আমাকে! আমরা তো কিছুই জানি না।’
বিষণ্ন হাসি কি দেখা গেল? কোথা থেকে এক টুকরো কালো মেঘ হামলে পড়েছে চাঁদের উপর। অন্ধকার হয়ে গেছে বারান্দা। লণ্ঠনের আলো আরো ঢিমে। কুকুরটা কেমন তীব্র আর্তনাদ করে উঠলো ভয়ঙ্কর ভাবে। 
--’সলিল--ভাই,,
--দুঃখ করিস না অমল।  কি বলবো বল। কি বলতে পারি আমি। বুলবুল  আমার বুলবুল ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছিল আমার থেকে। ‘ হাহাকার করে উঠলো সলিল না অন্ধকার এক ছায়া?
--বোঝালাম কত। ও কেমন রাহুগ্রস্তের মত এগিয়ে গেল তিমিরের দিকে। গতকাল বুলবুল সব ছেড়ে  ছেলে নিয়ে চলে গেছে বাপের বাড়ি। আর আজ সকালে আমি সুইসাইড করেছি। ‘
  
 ঝপ করে একটা শব্দ হলো কোথাও। দম চাপা গলার গোঙানি । লণ্ঠন নিভে নিকষ কালো অন্ধকারে এক চাপা তীব্র ফ্যাসফ্যাসে সর্দি বসা গলা আক্রোশে ফেটে পড়ছে যেন। অমল প্রাণপনে চিৎকার করে উঠল
 সনৎ সনৎ , চৌকিদার চৌকিদার। লাইটার জ্বালা লাইটার সনৎ সনৎ...তিমির তিমির কোথায় তুই? তিমির...ওরে তিমিরকে বাঁচা...! 
   
তারপর? 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ