ধারাবাহিক নিবন্ধ || সাহিত্যে আগমনী || প্রথম পর্ব || অলিপা পাল




পোস্ট বার দেখা হয়েছে
অঙ্কন : ঊষসী রায়

____________________________________

সাহিত্যে আগমনী      

      প্রথম পর্ব

    অলিপা পাল

__________________________


যাঁকে দেখে মন উল্লসিত হয়ে ওঠে ,তাঁকে আবাহন করার গানই আগমনী ৷শুধু দেখে নয়,তাঁকে ভেবেই আনন্দ ৷স্মরণে মননে তিনি আচ্ছন্ন করে রেখেছেন যে !তাই তো তাঁর আসার ক্ষণ উপস্থিত হলেই ধৈর্য আর বাঁধ মানে না ৷রবীন্দ্রনাথের পূরবী গ্রন্থের আগমনী কবিতায় এই উচ্ছ্বাসের অপূর্ব প্রকাশ—

' গোপনে এল,স্বপনে এল,এল সে মায়া পথে,

পায়ের ধ্বনি নাহি ......'

ছায়াতে এল, কায়াতে এল, এল যে মনোরথে '

আসলে প্রিয়জনের আগমন লগ্নের উচ্ছসিত আনন্দ বাঁধ মানে না যে !তাই কি ভাবে যে প্রকাশিত হবে তার কোন বাঁধাধরা লক্ষণ নেই ৷

ওয়ার্ডসওয়ার্থ বসন্তের অগ্রদূত কোকিলের আগমনে একই ভাবে তাকে উচ্ছ্বিস ভরা অভিনন্দন ও অভ্যর্থনা জানচ্ছেন—

'O blithe new comer!I have heard,

I hear thee and rejoice,.....' 

আগমনধ্বনিই অনন্দসূচক ৷আগমনের ভাবনা আনন্দ বয়ে আনে ৷কে আসছে, কেন আসছে ভাবার অবকাশ থাকে না ৷রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'আগমনী' শীর্ষক 'লিপিকা'র গল্পে বলেছেন—

' মন চার দিকে তাকিয়ে দেখলে ৷

কি দেখতে পেলে ৷

শরৎপ্রভাতের শুকতারা ৷

কেবল ঐটুকু ?

হাঁ, ঐটুকু ৷আর দেখতে পেলে! শিউলিবনের

শিউলি ফুল ৷

কেবল ঐটুকু ?

হাঁ, ঐটুকু ৷আর দেখা দিল লেজ দুলিয়ে ভোরবেলাকার একটি দোয়েল পাখি ৷

আর কি ?

আর, একটি শিশু, সে খিলখিল করে হাসতে হাসতে মায়ের কোল থেকে ছুটে পালিয়ে এল বাইরের আলোতে ৷

তুমি যে বললে আগমনী, সে কি এরই জন্যে 

হাঁ, এরজন্যই তো প্রতিদিন আকাশে বাঁশি বাজে,ভোরের বেলায় আলো হয় 

এর জন্যে এত জায়গা চাই?

হাঁ গো, তোমার রাজার জন্যে সাতমহলা বাড়ি,তোমার প্রভুর জন্যে ঘর ভরা সরঞ্জাম ৷আর, এদের জন্যে সমস্ত আকাশ, সমস্ত পৃথিবী ৷'

এ একেবারে বাঙালির মনের কথা মনের ভাব ৷ এক মায়ের কোল থেকে ছুটে বেরিয়ে এল হাজার বাঙালি মায়ের কোলে ধরা দিতে ৷ বাংলা মায়ের কাছে শিশুটি আলোকবর্ণা 

মেয়ে ৷তার জন্যই সারা বছর অধীর প্রতীক্ষা ৷

বাঙালির এ এক অনন্য বৈশিষ্ট্য ৷বাৎসল্যের ভাবে ঈশ্বরকে পাওয়ার সাধনা বাঙালির একান্ত নিজস্ব ৷

যিশু যখন আবির্ভূত হলেন,জ্ঞানীরা আকাশের তারা দেখে তাঁর জন্মস্থানে গিয়ে দেখেন,আস্তাবলের অতি সাধারণ শয্যায় মায়ের কোলে শুয়ে রাজার রাজা ৷কিন্তু এঁরা যখন বিরাট সাধকের রূপে প্রকাশিত হলেন তখন কিন্তু তাঁরা বিরাট রূপেই অভিবন্দিত হয়েছেন ৷সিদ্ধার্থ যখন বুদ্ধদেব হয়ে কপিলাবস্তুতে ফিরলেন,শুদ্ধোধন তাঁকে প্রণাম করেছিলেন ,এমনকি তিনি ও সিদ্ধার্থের মা গৌতমী বৌদ্ধধর্ম গ্রহন করেছিলেন অর্থাৎ শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন ৷কিন্তু বাঙালি মনোভাব অন্যরকম ৷ ভগবান যিশু যখন নিজেকে ঈশ্বরের পুত্র বলে অভিহিত করেছেন,রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বলেছেন মানব

অঙ্কন : ঊষসী রায়
পুত্র ৷ রবীন্দ্রনাথ তাঁকে মনে রাখতে চাইছেন মায়ের কোলের শিশুরূপে ৷এই বাঙালি মানসিকতাতেই মা দুর্গা হয়ে গিয়েছেন ঘরের মেয়ে ৷তাঁকে যেমন দেখি সিংহাসনে আবার দেখি আটপৌরে কিশোরী মেয়ে রূপে ৷এই মা দুর্গা আদ্যাশক্তি,পরমাপ্রকৃতি,জগজ্জননী,

অশিবনাশিনী,দনুজদলনী ৷দশভুজে তিনি দশপ্রহরণধারিণী ৷ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন—

' ত্বং হি দুর্গা দশপ্রহরণধারিণী,

কমলা কমলদলবিহারিণী,

বাণী দিদ্সাদায়িনী,নমামি ত্বম্ ' ৷

যখন বঙ্কিমচন্দ্র মা ও দেশকে অভিন্ন ভাবলেন,তখনি একটি সাধারণ মাতৃরূপের কল্পনা করতে হল ৷তিনি তখন দূর্গা ছাড়া আর কারো কথা ভাবতে পারেননি ৷তিনি দেশ জননীকে শুধু দুর্গা নায়,মহালক্ষ্মীও মহাসরস্বতী রূপেও বান্দনা করেছেন ৷

শ্রীশ্রীচণ্ডীতে দেখায়ায় মহাকালী মহালক্ষ্মী ও মহাসরস্বতী রূপে আরাধিতা মহাশক্তি ৷ সেখানে মহাকালী দশভুজা,তাঁর দশটি মুখ,দশটি পা আর তাঁর গাত্রবর্ণ নীল প্রভাবিশিষ্ট ৷মহালক্ষ্মী প্রবালপ্রভা আর তিনি অষ্টাদশভুজা ৷মহাসরস্বতীর আট হাত ,বর্ণে চন্দ্রের স্নিগ্ধতা ৷এঁরা সব মা দুর্গার বিভিন্ন প্রকাশ ৷

দুর্গা শব্দের আভিধানিক অর্থ পরমাপ্রকৃতি, শিবপত্নী আবার রাগিণী বিশেষ ৷

মা দুর্গা সকলের কাছেই বরদায়িনী,সে দেবতা,রাজা বা বৈশ্যই হোন ৷ আর দীনের থেকে দীন যারা ৷

সেই কাঙালের মা রূপে তাঁকে দেখি কবিকঙ্কন মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল এ ৷ঈশ্বর পাটনীকে তিনি কৃপা করেন,আর সেও মায়ের কাছে চেয়ে নিল উত্তর প্রজন্মের নিশ্চিন্ত জীবন ৷  'আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে ' ৷ কিম্বা

রবীন্দ্রনাথের স্পর্শমণি কবিতার কথা ৷সেখানে আছে বর্ধমান জেলার মানকরের দরিদ্র ব্রাহ্মণ জীবন মহাদেবের প্রত্যাদেশ পেয়ে বৃন্দাবনে সনাতন গোস্বামীর পায়ে লুটিয়ে পড়লো—কারণ, সে জেনেছে যে, সনাতনের কাছে আছে দারিদ্রমুক্তির উপায় ৷ সনাতন তাকে এক সময়ের কুড়িয়ে পাওয়া স্পর্শমণি দিয়ে

 দিলেন ৷ প্রথম আনন্দের উদ্ভাস মিলিয়ে যাওয়ার পর জীবন অদ্ভুত কাণ্ড করে বসল —

' যে ধনে হইয়া ধনী মণিরে মান না মণি

তাহারি খানিক,

মাগি আমি নতশির' এত বলি নদী নীরে

ফেলিল মানিক ৷'

যে যেমনটি চায় মা তাকে তাই দেন ৷ বৈশ্য সমাধিই বুদ্ধিমান ৷তিনি ভাবলেন,যিনি আদ্মাশক্তি,কল্পতরু -সদৃশা বরদায়িনী,তাঁর কাছে সামান্য ঐহিক জিনিসের প্রার্থমা জানাই কেন ! যিনি অঘটন ঘটন পটীয়সী, যে কোন বর চাইলেই দিয়ে দিতে পারেন,তাঁর কাছে তাহলে ছোট জিনিস চাইব কেন? বিরাটতম চাওয়াটাই চরিতার্থ করে নিই না কেন!


     চলবে...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

4 মন্তব্যসমূহ

  1. চমৎকার লিখেছ
    খুব ভালো লাগলো
    পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম...

    উত্তরমুছুন
  2. ভীষণ সুন্দর গোছানো লেখা ... চলুক এই ধারাবাহিক লিখন 👍❤️

    উত্তরমুছুন
  3. খুব ভালো লাগলো লেখাটি। চলুক আরো অনেকগুলো পর্ব। তবে একটা অনুরোধ লেখা সূত্রগুলো লেখার শেষে দেবার চেষ্টা করবে।

    উত্তরমুছুন