শারদ সংখ্যা ২০২০ || নিবন্ধ || বর্ণালী রায় মিত্র




পোস্ট বার দেখা হয়েছে


খেয়ে পরে সযত্নে লালিত হচ্ছে ভবিষ্যতের দুষ্কৃতীরা
বর্ণালী রায় মিত্র

দেশের ক্রমবর্ধমান ধর্ষণ ও তদুপরি নারী-হত্যার ঘটনার প্রেক্ষিতে যে সামাজিক ব্যাধিগুলির শিকড় গভীরে প্রোথিত, তার মূল-অনুসন্ধানের কাজটি করা হয়ে থাকে ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ দিয়ে। বিচ্ছিন্ন মতামতের অনেকাংশই বহুমতের সাথে মিলে যায়। তখন তা জনমানসের সম্মিলিত ভাবনার ফসল হিসেবে গৌণ না হ'য়ে গণ্য হ'য়ে ওঠে। 
ধর্ষণের দ্বারা, নারীর ওপর কেবল কেবল যৌন উৎপীড়ণই নয়, প্রকাশিত হয় পুরুষের দৈহিক শক্তি বা পেশির আস্ফালনও। শক্তি ও প্রাধান্যের নিরিখে পুরুষ যে সমাজের সর্বস্তরে অধিক বলবান তা প্রমাণ করাও ধর্ষণ নামক পৈশাচিকতা'র আরেকটি দিক। যে কারণে, বিভিন্ন প্রদেশের আনাচে কানাচে, প্রত্যন্ত গ্রামের ক্লাবপ্রাঙ্গণে, কর্মক্লান্ত দিনের শেষে ধর্ষণের ভিডিও দেখে গলায় ঝোলানো গামছায় কামোদ্দীপক তৃপ্তির ঘাম মুছে পুরুষ অবলীলায় উচ্চারণ করেন, "কুছ তো সকুন মিলা" এই শকুনদের প্রতিষেধক আজ হাতড়ে চলেছেন সমাজ বিশেষজ্ঞরা। 
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কিছু শব্দের ব্যাকরণসম্মত উদ্ভাবনের কথা ভাবলেও হতাশা বাড়ে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়- ছেলেবেলা, ছেলেখেলা, ছেলেমানুষি, ছেলে-মেয়ে, পুত্রসন্তান ইত্যাদি শব্দগুলি, যেগুলিতে শুরুতেই লিঙ্গনির্দেশ ক'রে পুরুষকে অগ্রগণ্য ও অধিক মর্যাদার আসনে বসানো হয়েছে, যা আমাদের চেতনে-অবচেতনে শিকড় গেড়ে রয়েছে আজন্ম। পরিবারে পুত্র কামনার্থে, 'বংশের সলতে'কে ভূমিষ্ঠ করার মহান ব্রতে, বহু নারীকে বাধ্য  করা হয়েছে অসংখ্যবার মাতৃত্বের বোঝা বইতে। উপেক্ষিত হয়েছে তার স্বাস্থ্যের ভগ্নদশা ও অবনতির দিকটি।সন্তানকে, বিশেষত পুত্রকে  'পিতার বংশধর' বলতে শোনা যায় শিক্ষিত, বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষকেও। জীববিদ্যার ন্যূনতম পাঠ শেখায় একটি শিশুর জন্ম হয় মা ও বাবার সমান জৈবিক অবদানে। ক্রোমোজোমের বৈজ্ঞানিক নামকরণ বা অনুপাত এখানে যুক্তিগ্রাহ্য নয়। 
ছেলের পাতে মাছের বড়ো টুকরো তুলে দেওয়া, যেকোনো মহার্ঘ্য খাদ্য বা ভোগ্যবস্তুর সিংহভাগ পুত্রের জন্য আলাদা রেখে, সন্তান-কন্যার বঞ্চিত হওয়ার ঘটনা আমাদের গা-সওয়া।  লিঙ্গবিশেষে ক্ষুধাবোধ বা লোভনীয় খাবারের প্রতি অধিক আকর্ষণের কোনও ব্যাখ্যা বা তত্ত্ব, জীববিদ্যা বইয়ের কোনও পরিচ্ছদেই মিলবে না। 
রামোহন-বিদ্যাসাগরের মহৎ  প্রচেষ্টা, আমরণ সংগ্রামের ফলে সতীদাহ রোধ বা বিধবাবিবাহের প্রবর্তন সাধিত হলেও, আজও সমাজের বৃহৎ অংশ মনের দিক থেকে রয়ে গেছেন সেই তিমিরেই। সন্তান যদি কন্যা হয় এবং সে যদি রন্ধন, গৃহকর্মে অনীহা প্রকাশ ক'রে শিখতে চায় ঘোড়ায় চড়া, বন্দুক চালনা, আগ্রহী হয় ক্যারাটে, দাবা, ফুটবল-শিক্ষায়, অনেকেরই ভ্রু কুঞ্চিত হয়। মেয়েদের এহেন 'পুরুষালি ভাবগতিক' সুনজরে দেখেন না বহু পরিবার। মেয়েকে 'লক্ষীমন্ত' হয়ে ওঠার পাঠ দেওয়া হয় শৈশব থেকেই। মেয়েদের খানিক রান্নাবান্না, সেলাইফোঁড়াই, ঘর গোছানো, আলপনা দেওয়ার দিকে ঝোঁক থাকা, সুলক্ষণ হিসেবে ধার্য করা হয় বহু তথাকথিত 'শিক্ষিত' পরিবারেও। বিবাহের দিন এগিয়ে এলে তাকে রন্ধনপটিয়সী, গৃহকর্মনিপুণা ইত্যাদি তকমা পাওয়ার উপযুক্ত ক'রে তুলতে, উঠে পড়ে লেগে যান মা-কাকিমা-জেঠিমারাই। দাঁড় করিয়ে, হাঁটিয়ে, চুলের দৈর্ঘ্য মেপে পাত্রী দেখার চলন ক্ষীণ হয়ে এলেও পাত্রীকে বাজিয়ে 'দেখতে আসা'র চল অব্যাহত অধিকাংশ পরিবারে। 
সেই আসরে, সে কী খেতে, পাঠ করতে বা শিখতে ভালোবাসে'র চাইতে প্রাধান্য পায় you tube দেখে কোন কোন দেশ বা প্রদেশের রন্ধনে সে হাত পাকিয়েছে। "আমাদের ছেলে কিন্তু বেজায় ভোজনরসিক। তার রসনা তৃপ্ত করার মহান ব্রত তোমায় নিতে হবে বৈকি ! তবে না তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হবেন শ্বশুরকুল !"
বিয়ের পর ছেলের কাছে তার  পিতামাতার প্রাধান্য কমে যাওয়া যতই নিন্দনীয় হোক, বৌয়ের মনে তার পরিবারের প্রতি টান যত ক'মে আসে, শ্বশুরগৃহের প্রতি সে যত নিবেদিত-প্রাণ হয়, ততই আদর্শ বধূর মাপকাঠিতে তার উত্তরণ ঘটে !  
একটি মেয়েকে গাড়ির চালকের আসনে দেখলে উপদেশ দেওয়ার লোভ সংবরণ করতে পারেন না বহু পুরুষ। এক ট্যাক্সি চালকের  আক্ষেপমিশ্রিত উক্তি ভুলতে পারিনা, "ড্রাইভার রাখার ক্ষমতা নেই, তাই গাড়ি চালানের কাজটাও কিনা শেষমেশ করতে হয় লেডিসকে"।পার্কিং করতে স্থানাভাবে সামান্য সময় নিলেই পুরুষ-চালক দূর থেকে খৈনি ডলতে ডলতে মুচকি হেসে সঙ্গীকে বলেন, যার যা কাজ নয়, কেন যে করতে আসে !
পূজনীয় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি যোগাযোগ উপন্যাসে লিখেছেন, "মেয়েরা নিজেদের আলো নিজেরা নিভিয়ে বসে আছে"। মেয়েদের অন্তরে যিনি জ্বালতে চেয়েছেন হাজার দীপের আলো, সেই রবি ঠাকুরের সহজ পাঠ বইয়ের নানা অধ্যায়ে পাই, শ্রম ও খাদ্যের অসম বন্টন ! দাদা, বাবা কাজে যায়। মা খাজা গজা চান দাদা খাবে, বাবা খাবে। বিনিপিসি আর দিদি ঘাটে যায়, ঘটি মাজে।  আ-কার, ই-কার বানানের সহজ উদাহরণ বা সে সময়ের সমাজব্যবস্থার নিরিখে এ হয়তো বাস্তব ছবিকেই তুলে ধরা।  
সংস্কারের প্রয়োজন ব্যাকরণ বইগুলির নানা পরিচ্ছদেও।  লিঙ্গ পাঠের পাতায়, নবতম সংস্করণেও-- কবি-মহিলাকবি, লেখক-লেখিকা, অধ্যাপক-অধ্যাপিকা, পুরুষমানুষ-মেয়েমানুষ, পুত্রসন্তান-কন্যাসন্তান, বেটাছেলে-মেয়েছেলে ইত্যাদি চোখ ও মনের পীড়ার কারণ হয়। 
'ক্রিয়া' শিক্ষণের অধ্যায়ে, উদাহরণস্বরূপ আজন্মকাল দেখে আসছি, 'মা সুস্বাদু রান্না করেন', 'ঠাকুরদা বই পড়েন', 'বাবা আপিস যান', 'রীতা সেলাই করে', 'রহিম ভালো ফুটবল খেলে' ইত্যাদি। 
শিশুদের মগজে আদর্শ ঘটনা বা দৃশ্যরূপে এগুলি খোদাই ক'রে দেওয়া হয়।  
'মা অফিস থেকে গাড়ি চালিয়ে ফেরেন' 'রোহিত রান্না শিখতে ভালোবাসে' বা 'ঝর্ণা ক্রিকেট খেলায় পারদর্শী' এমন উদাহরণ থাকলে অনেকেই হয়তো মুদ্রণ-প্রমাদ হিসেবে গণ্য করবেন। 
মুখে বোল ফুটতে না ফুটতেই আমরা শিশু কন্যার হাতে তুলে দিই ঘরকন্নার প্রতীকী খেলনা-পত্র, সন্তানপুত্রের হাতে দিই  চিকিৎসা-সরঞ্জাম, স্থপতি-বিদ্যা বিষয়ক 'গেমস'। গোড়াপত্তন করে দিই আমরাই। পিকনিকের ছবিতে  কন্যার হাতে ফুল-ফোটা গাছের ডাল এবং পুত্রের আকাশের দিকে ব্যাট উঁচিয়ে ছক্কা মারার ভঙ্গি, আমাদের চোখকে অধিক তৃপ্ত করে।  'মানুষ অভ্যেসের দাস' প্রবাদ ভ্রান্ত নয়। জন্ম-ইস্তক দেখে আসা ব্যাপারগুলিকেই স্বাভাবিক ভেবে নেওয়া, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মনোবিদ্যা-স্বীকৃত রীতি। 
আশৈশব অসংখ্য সাহিত্য পাঠ-করা মহিলাকে বলতে শুনেছি, "স্ত্রী যদি স্বামীর চাইতে অধিক উচ্চপদে বা উচ্চবেতনে কর্মরতা হন, তার মনে স্বামীর প্রতি খানিক অবজ্ঞার ভাব থাকবে এটাই স্বাভাবিক।" আমার সেইযুগের, বইয়ের ফাঁকে আঙ্গুল রেখে রান্না করা, দিদিমার কাছে মামারাই ছিলেন পরম আদর ও সম্ভ্রমের।  তাদের হাতে-পাতে সেরা জিনিসটি তুলে দেবার পর উচ্ছিষ্ট জুটতো মা-মাসিদের কপালে, এ গল্প আজও পরিবারের সকলের মুখে মুখে ফেরে। বিরাগের সাথে নয়, সকৌতুকে! 
যে কোনও ঘরোয়া অনুষ্ঠানের ভোজের আসরে, "ছেলেদের আগে বসিয়ে দেওয়া হোক, আমরা, মেয়েরা পরে বসবো" মহিলা সদস্যের এই নিদান কি আজও শুনিনা আমরা ? কে কে অধিক ক্ষুদার্ত, সে বিষয়টি বিবেচনাধীন হয় ক'টি পরিবারে ?
জীবনের প্রতি পদক্ষেপে পুরুষের প্রাধান্য, তার মতামতকে অধিক গুরুত্ব দিতে দিতে মুক্তচিন্তার বাতাস ঢোকার পথ আমরাই রুদ্ধ করে রেখেছি। ২৫ শে বৈশাখ, রবীন্দ্রনাথের 'চিত্রাঙ্গদা' মঞ্চস্থ করার প্রস্তাব যিনি সগর্বে পাড়ার ক্লাবে পেশ করেন, বাড়ি ফিরে তিনিই হয়তো কন্যাকে চোখ রাঙিয়ে বলেন, মেয়েদের অত 'মর্দা-পনা' ভালো নয়"। পুত্র কোনও ব্যাপারে বীরত্ব দেখাতে অপারগ হলে কেউ-বা বলেন, "ওর হাতে চুড়ি পরিয়ে দিলেই হয়"।  অর্থাৎ যাবতীয় সাহসিকতার কাজ, প্রতিবাদ, প্রতিরোধে অগ্রণী ভূমিকায় থাকবে পুরুষ, আর আদর্শ নারীর চিত্রটি হবে, কোমল বাহুযুক্ত, ঢলোঢলো লাবণ্যময়ী মুখশ্রী, লজ্জাবনত চাহনি ইত্যাদি। সংস্কৃত শ্লোকের রচয়িতাও পুরুষ, তাই, "স্বদেশে পূজ্যতে রাজা, বিদ্বান পূজ্যতে সর্বত্র" দুটি বিশেষ্যের লিঙ্গেই অবধারিতভাবে জ্বলজ্বল করছেন পুরুষ"। এক্ষেত্রে অবশ্য ভাবা যেতেই পারে, লিঙ্গ গৌণ, অর্থ ও বিদ্যার গুরুত্বের প্রভেদ বোঝাতেই শ্লোকটির প্রবর্তন।
মেয়েদের পোশাক-আশাক নিয়ে ফতোয়া, বিতর্কের অন্ত নেই, অথচ জানু'র উর্ব্ধে উঠে থাকা হাফ-প্যান্টের তলায় দৃশ্যমান লোমশ-পা, স্মার্ট পৌরুষের প্রতীক হিসেবে, তারিফের দৃষ্টিতে চেয়ে দেখেন কিছু মেয়েরাও। ছেলেদের অভিধানে (বা ব্যাকরণে) যেন 'শালীনতা' নামক গুণবাচক-বিশেষ্যের প্রবেশ নিষেধ।
সবশেষে আসা যাক অপরাধ প্রবণতার ক্ষেত্রে। জন্ম হওয়ার ক্ষণ থেকে, সমাজের মাথায় চ'ড়ে থাকা পুরুষরাই কিন্তু অধিকাংশ অপরাধ-চক্রে জড়িত।  সে, জীবনদায়ী ওষুধের ব্যবহারযোগ্যতার সময়সীমা (রাসায়নিকের সাহায্যে) লোপাট ক'রে তাকে পুনর্জীবিত করার কাজ থেকে শুরু ক'রে-- সহপাঠী-খুন, নকল নোট-ছাপানো, নাশকতার ছক কষা, বোমা বাঁধা, অন্য দেশ থেকে জল বা স্থলপথে প্রবেশ ক'রে শতাধিক নির্দোষ মানুষের ধড়-মুন্ড আলাদা করা, ব্যাংক-ডাকাতি, ছিনতাই, বধূ নির্যাতন ইত্যাদি তাবড়-তাবড় বা ছোটোখাটো যে কোনও অপরাধের তালিকায় নারীদের সংখ্যাটা নেহাতই অকিঞ্চিৎকর হবে পরিসংখ্যান অনুযায়ী।  ধর্ষণের জন্য স্বয়ং প্রকৃতি পুরুষকে বিশেষ ক্ষমতাদানপূর্বক তার অপব্যবহারের পথটি প্রশস্থ করেই রেখেছেন। 
তাহলে কী দাঁড়ায় ব্যাপারটা ? সমাজ, পরিবার ভালো খাইয়ে-পরিয়ে এবং পড়িয়ে 'সাধের পুত্রসন্তানদের' অনেককেই 'ভবিষ্যতের দুষ্কৃতী' তৈরী করছেন সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে। বহু পরিবারেই  মেয়েরা বঞ্চনার বেদনা ব'য়ে বেড়াচ্ছেন নিজ-বাড়িতে, বিবাহিত জীবনে। সমাজ তার ওপর নানান অলিখিত নিষেধাজ্ঞা চাপাচ্ছে অহরহ। সে ধর্ষিত, লাঞ্ছিত, অপদস্থ হচ্ছে পদে পদে এবং অন্যের অপরাধের বোঝায় ভারাক্রান্ত হয়েও  ক'রে চলেছে সংসার ও বহিৰ্জগতের যাবতীয় কর্তব্য !
মহাভারতের পাতা থেকে নারীর লাঞ্ছনা সেই-যে শুরু হয়েছে 'সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে'। অনেকেই অনেক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত দেখাবেন,  যা এই নিবন্ধ লেখকের অভিজ্ঞতাতেও  মজুত আছে, তবে সে ব্যতিক্রম সংজ্ঞাধীন ! 
ব্যতিক্রম কি আর উপসংহারের অভিমুখ বদল করে !

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ