শারদ সংখ্যা ২০২০ || ইতিহাস ও আলোচনা || মহুয়া দত্ত




পোস্ট বার দেখা হয়েছে


'' দাসাঁয় দাঁড়ান'' ( এক ঐতিহাসিক শারদোৎসব এর খোঁজে)
কলমে- মহুয়া দত্ত

শরৎ মূলত শুভ্রতার প্রতীক। পবিত্রতার চিহ্ন। বর্ষাকালের লাগাতার বৃষ্টি প্রকৃতিকে ধুয়ে-মুছে সাফ করে দেয়। শরৎ তাই একটু বেশি পূত-পবিত্র অন্যান্য ঋতু থেকে। 
সকলবেলা দূর্বাঘাসের ডগায় জমে বিশুদ্ধ শিশির জল। বাতাস হয়ে যায় দূষণহীন। চিত্তে বাজে আলাদা গন্ধ, ছন্দ ও রং। ব্যাকুল হয়ে যায় মন। বাঙালির প্রানের উৎসব, শারদোৎসব। মা আসছেন তার বাপের বাড়ি। উমা আমাদের ঘরের মেয়ে, তাই আনন্দ আতিশয্যের কিছুই কম হতে পারেনা। 
এতো গেল আমাদের কথা। কিন্তু আজ আমি এমন একটা সমাজের রীতির কথা লিখবো যা তাদের জীবনের সঙ্গে জুড়ে থাকে। আমাদের দুর্গাপূজা যত আনন্দের ঠিক ততটাই দুঃখে এই দিনগুলো কাটায় আদিবাসী সমাজের মানুষজন।

সাঁওতাল জনজীবনের অন্যতম উৎসব দাঁশায় যা দুঃখের পরব হিসেবে চিহ্নিত। 
এই দূর্গাপূজা আসলে এক অজানা ইতিহাস বহন করে। এই ইতিহাস হল বহিরাগত শত্রুর সাথে এ দেশের অধিবাসীদের লড়াই এর ইতিহাস।

দাঁশায় দাঁড়ান নিয়ে যে সমস্ত সাঁওতাল আদিবাসী কথা, গল্প কথা, উপকথা, মিথ ,আছে সে গুলো নিতান্তই মিথ বা গল্পগাথা নয়। এগুলো ইতিহাস । এই দেশের ইতিহাস । দাঁশায় সম্পর্কিত গান গুলো তে এই ইতিহাসের আভাস পাওয়া যায় 

এই দাঁশায় দাঁড়ান এক ধরনের নাচের মধ্য দিয়ে সংগঠিত হয়ে থাকে। পশ্চিমবঙ্গে মূলত সাঁওতালদের মধ্যেই এই সুপ্রাচীন ইতিহাস লালিত পালিত হয়।

সাঁওতালি দাঁশায় নাচের ইতিহাসে এ কথা বলা হয় যে- প্রাচীন কালে যখন ভারতবর্ষে আর্য বা দিকু দের আগমন হয় নি তখন এই দেশে হুদূড়দূর্গা নামে এক মহান সাঁওতাল আদিবাসী যোদ্ধা ছিলেন। যিনি রাজ্যের তথা দেশের প্রধান ছিলেন। “হুদূড়” শব্দ টি সাঁওতালি শব্দ; উদাহরন- ‘হুদূড় হুদূড় হয় এদা (জোরে বাতাস) ‘হুদূড় হুদূড় এ উদুর এদা(জোরে নাক ডাকা) এবং “দূর্গা ” শব্দ টিও পুংলিঙ্গ । 
যাই হোক; এই হুদূড়দূর্গা কিন্তু খুব সৎ স্বাধীনচেতা স্বদেশপ্রেমী প্রজাবৎসল শাসক ছিলেন। তাঁর শাসনেই এই দেশ এবং তার দেশবাসী সুখে শান্তিতে শস্যশ্যামলায় পরিপূর্ণ থাকতো। এর পরেই আসে বহিরাগত দের আগমন ।বহিরাগত বলতে এখানে আর্য দের কথা বলা হয়েছে। আর্য দের সাথে এই দেশের মানুষ(যাদের আর্য রা অনার্য বলে) দের সরাসরি সংঘর্ষ হয় ।এই সংঘর্ষ যুদ্ধ বিগ্রহ অনেক দিন ধরে চলেছিল কিন্তু আর্য রা পেরে ওঠেনি । বার বার প্রতিহত হয়ে তারা হত্যদম হয়ে পড়ে । তাঁরা অনেক দিন ধরেই খন্ড যুদ্ধ চালিয়ে যায়। যে হেতু তখন কার দিনে কেল্লা বা fort ; (সাঁওতালিতে “গাড়”) নির্ভর যুদ্ধ ব্যবস্থা ছিল তাই বহিরাগত শত্রুরা প্রবেশ করতে পারে নি। এই ” গাড়” গুলির নাম এখনো সাঁওতাল ইতিহাসে আছে। সাঁওতাল 12 টি titles এর জন্য বারো টি গাড় এর নাম আমরা পাই। 
ক্রমাগত আক্রমণ করেও যখন আর্যরা এই দেশের অধিবাসীদের রক্ষণ কে ভাঙতে পারে নি তখন তারা নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করে। আর্যরা তাদের নারী দের কে লড়াই এ সামনে নিয়ে আসে এবং তারা এদের খুবই নিপূণভাবে ব্যবহার করে। 
হুদূড় দূর্গা একজন সৎ স্বাধীনচেতা বীর ও মহানুভব যোদ্ধা;তিনি নারী দের সঙ্গে লড়াই করতেন না। এই মহান যোদ্ধা কে মারার জন্য বহিরাগত আর্যরা তাদের এক গণিকা নারীকে সমর্পণ করে শান্তি প্রক্রিয়ার আছিলায়। ওই নারীর মূল উদ্দেশ্য ছিল যেন তেন প্রকারে ছল চাতুরির মাধ্যমে হুদূড়দূর্গার গোপন শক্তির রহস্য ভেদ করা। তাই এই নারী তার ছলনাময় প্রেম ভালোবাসার জালে হুদূড়দূর্গা কে আবদ্ধ করেন। হুদূড়দূর্গা এতই সরল মহানুভব ছিলেন যে প্রতিপক্ষের এই চাল কে বুঝতে পারেন নি। তার এই মহানুভবতা সরলতা প্রজাবাৎসল্য চরিত্র এবং নারীদের প্রতি সম্মান জানানো প্রভৃতি গূনের পরিচয় পাবার পর ওই নারী সত্যি সত্যিই হুদূড়দূর্গার প্রতি অনুরক্ত হয়েযায় এবং তারা বাপ্লা(বিবাহ) বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এর ফলে ওই  নারী হুদূড়দূর্গার এবং তার জাতির সাথে মিশে যায়। কিন্তু তার মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয় নি কারন যাদের দ্বারা প্রেরিত হয়েছিলেন তারা কিন্তু তার মাধ্যমে হুদূড়দূর্গার গোপন খবর সংগ্রহ করে যেতেন।
এই রাজা প্রচন্ড শক্তিশালী এই রাজা মায়াবলে বিভিন্ন রুপ ধারন করতে পারত। যেমন, অনাবৃষ্টির সময়ে মেঘের রুপ ধারন করে বৃষ্টিপাত ঘটাত,। যুদ্ধের সময় কালোমেঘের ভেতরে প্রবেশ করে তা থেকে শিলাবৃষ্টি রুপে আক্রমন করে শত্রুপক্ষকে পরাস্ত করত। এছাড়াও বিভিন্ন ভয়ংকর জন্তু জানোয়ারের রুপ অনায়াসে ধারন করে প্রতিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করে হারিয়ে দিত। এ সবের কারনে রাজা 'দুরগা' কে সকলেই সমীহ করত। ভয় পেত। কিন্তু রাজার এক মস্তবড় গুন ছিল তা হল কোন অবস্থাতেই মহিলাদের আক্রমন করত না বা তাদের ক্ষতি করত না। মহিলাদের প্রতি রাজার এই দুর্বলতাকে কাজে লাগানোর প্রয়াসে শত্রুপক্ষ একজোট হয়ে দুজন মহিলাকে 'দুরগা'র বিপক্ষে যুদ্ধের জন্য পাওয়া যায়। একজনের নাম "লাংতিতি লুখী", অপর মহিলার নাম "দিবি"। ভয়ংকর যুদ্ধে দুই মহিলাই পরাস্ত হয় এবং তাদের বন্দি করা হয়। পরে রাজা 'দুরগা' দিবিকে সসম্মানে স্ত্রীর আসন অলংকৃত করার প্রস্তাব দেয়। 'দিবি' সম্মতি জানায়। আসলে, দুরগাকে স্বামী হিসাবে স্বীকার করার অন্তরালে রয়েছে দুরগা নিধন। দিবি তাই সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। ঘটনাচক্রে, একদিন রাজা দুরগা আবেগবশতঃ 'দিবি' কে তার মহিষরুপ ধারনের গোপন ক্ষমতার কথা জানায় এবং এ নিয়ে খেলায় মেতে ওঠে। খেলাটি এই রকম - রাজা দুরগা তার মায়াবলে মহিষরুপ ধারন করে মহিষদলের ভিড়ে মিশে যাবে। এরই মাঝখান থেকে দিবি তাকে চিনতে পারবে কিনা - এই খেলা শুরু হয়।
হাতে চাঁদ পেল দিবি কেননা সে এই ধরনের সুযোগের অপেক্ষাতেই দিন গুনছিল। খেলা শুরু হল। চলতে থাকে। দিবি আসলটিকে চেনার চেষ্টা করে। একদল মহিষের মাঝে দুরগাকে চিনতে পেরে এবং পুর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী অস্ত্রের এক কোপে মহিষরুপী দুরগার মুন্ডকে ধড়হীন করে দেয়। রাজা দুরগার মৃত্যু হয়।
এরপর থেকে 'দিবি'-র পরিচয় হয় 'ঠাকরান ' বা 'দেবী' নামে। এরপর থেকেই আতঙ্ক ছেয়ে গেল সর্বত্র। দুরগা নিধনের পর অজ্ঞাত কারনে দেবী সমস্ত পুরুষদের একের পর এক হত্যা করতে লাগল। হাহাকার ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হতে লাগল আকাশে বাতাসে। দেবীর ক্রোধাগ্নী থেকে মহিলারা পরিত্রান পাওয়ায় পুরুষেরা প্রাণভয়ে মহিলাদের পোষাক পরিধান করে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে।
দাঁশায় কিন্তু উৎসব নয়। দাঁশায় হল খোঁজ; দুঃখের খোঁজ। ইতিহাসের; পূরানো ঐতিহ্যের অনুসন্ধান। বিশ্বাসঘাতকতার বদলা নেবার বাসনায় আজও এই খোঁজ চলে। তাই একে সাঁওতালি ভাষায় “দাঁশায় দাঁড়ান” বলা হয়। সাঁওতালি “দাঁড়ান” কথাটির অর্থ হল ভ্রমণ বা Travelling. “দাঁড়ান” কথাটি সাঁওতালি তে এখানে ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয় । “দাঁশায়” সাঁওতালিতে একটি মাসের নাম (ইংরেজি সেপ্টেম্বর- অক্টোবর মাস)। দাঁশায় মাসের পূর্ণচন্দ্র ওঠার পাঁচদিনের পর থেকে এই “দাঁশায় দাঁড়ান ” শুরু হয়। এই মাস টি বাংলায় শরৎ কালের সমসাময়িক । দূর্গাপূজার সময়। দূর্গা পূজার সাথে দাঁশায়ের বহু পুরানো, গভীর শত্রুতা – ভালোবাসা- বিশ্বাসঘাতকতার সম্পর্ক।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ