শারদ সংখ্যা ২০২০ || গল্প || জয়িতা ঘোষ




পোস্ট বার দেখা হয়েছে


বইবাহিক
জয়িতা ঘোষ

বই পেলে বাঈ ওঠে আমার! কতক্ষণে তা পড়া শেষ হবে, মনের ভিতর রীতিমতো সভা বসে যায়। বাড়িতে যে-ক'টা বই আছে, সব পড়া শেষ। কিলোদরে আজকাল তাই পুরোনো পত্রিকা পড়া ধরেছি। সেদিন খবরের-কাগজের ছেলেটাও রসিকতা করতে ছাড়লোনা, "মাসিমা, বলেন তো রবি ময়রার দোকান থেকে জিলিবির ঠোঁঙা এনেদি।" আমিও ছাড়বো কেন? বললাম, "শোনো বাবা, তুমি কি জানো ঠোঁঙ্গা পড়েও জ্ঞান অর্জন করা যায়!"

বরুণ বাবু পাড়ার লাইব্রেরিটা আঠ বছর খুললেও, পড়ার ভিড় তাতে মোটে নেই। সত্যিই বলতে কি আমার খুব খারাপ লাগে। আমি তাই আগ বাড়িয়ে ঠিক করলাম, লাইব্রেরিয়ানের দায়িত্বটা আমিই নেবো। এতে এক ঢিলে দু'পাখি। বই পড়াও হবে, আর সাথে সংরক্ষণ ও। বরুণ বাবু অসুস্থ। প্রায় শয্যাশায়ী। ওনার ছেলেকে গিয়ে জানালাম নিজের ইচ্ছের কথা। ছেলে শুনে খুব খুশি হলেও, বলল "মাসিমা, তাও একবার বাবার সাথে কথা বলে যান। বাবা এমনিতেও বাইরে আজকাল বেরোতে পারে না। চলাফেরা সম্পূর্ণ বন্ধ। এখন তো মানুষ ভুলতেও শুরু করেছে। আপনি এলে, বাবার ভালো লাগবে। জানেন ই তো, লাইব্রেরী টা অনেক সখ করে বানিয়েছিল।"

মনে মনে ভাবলাম, "এমনি এমনি কি আর বই পাগল হয়েছি? একাকিত্ব যে কি বেয়াক্কেলে জিনিস সে আমি হাড়ে হাড়ে টের পাই! "

বরুনবাবু আমাকে দেখে যে খুব একটা চিনতে পারলেন বলে মনে হলোনা। তবে দেখলাম, লাইব্রেরীর কথাটা ওনার এখনও বেশ ভালোই মনে আছে। লাইব্রেরী বানানোর সূত্র থেকে শুরু করে কিভাবে বই বাছাই করে সংরক্ষণ করতেন সেসব নিয়ে বিস্তর আলোচনা করলেন। অবশেষে আমার মতে সহমত পোষণ করলেন। লাইব্রেরীর ভার এখন আমার। 

মনে মনে খুব আনন্দ নিয়ে, দিন শুরু করলাম। আজ লাইব্রেরীর প্রথম দিন। জানা অজানা কতো পুরনো বই এর গন্ধ শুঁকবো সেই উত্তেজনায় নিজের চশমা খানাও নিতে ভুলে গেছি। বরুণ বাবুর ছেলে সুপ্রকাশ আমাকে লাইব্রেরীর চাবিটা দিয়ে বলল, "মাসিমা, অনেক শুভেচ্ছা রইল।  আপনার মতো শুভাকাঙ্ক্ষী খুব কমই দেখা যায়। "

সকাল থেকে মাত্র একজন এলো লাইব্রেরীতে। সত্যি এই মোবাইলের যুগে সব যেন লাটে উঠেছে। "আচ্ছা, মোবাইলেও কি ওরকম বই এর নির্ভেজাল গন্ধ পাওয়া যায়? বই পড়লে যেন মনে হয় ঐ বই এর লেখক নিজের আতরের শিশি ভেঙে ফেলেছে বই এর ওপর!" 

হঠাৎ মনে হলো দু নম্বর তাকের একটা মোটা সাহিত্য উপন্যাসের বই যেন কে জোর করে বন্ধ করে ওখানে গুঁজে রেখে গেছে। বই এর এরকম অযত্ন আমি শুধু মাত্র যে সহ্য করতে পারিনা তা নয়, মনে মনে তাকে বেশ খানিক গাল ও দি। বের করে দেখলাম, একটা চিরকুট গোঁজা বই এর মধ্যে, "চশমা খানা না পরলেই তো পারো। তোমার চোখ দুখানা বেলপাতার মতো চিরযৌবন। কেমন আছো?"
দর্পণ শারদ সংখ্যা ২০২০ ( অঙ্কন উষসী রায়)

চিঠি খানায়  অনেক খানি অনাবৃত আদিখ্যেতা থাকলেও, শেষ লাইন খানা যেন অনেক দিনের আকাঙ্ক্ষার; কতো দিন যে এই জিজ্ঞাসা শুনিনি তার কোনও হিসেব নেই। আর না শুনতে শুনতে না শোনার অভ্যাস টাই গড়ে নিয়েছিলাম। 

বাড়ি যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। ব্যাগ গুছোতে গুছোতেও মন আমার তখনও ঐ অচেনা লেখকের অজানা ঠিকানায় পাঠানো চিঠিতে আঁটকা। দরজায় তালা দেওয়ার আগে কি মনে হতে, ঐ চিঠিটা বের করে নিয়ে ব্যাগে পুরলাম।

সারারাত মন খুব ভালো ছিল। কে যেন এক আকাশ তারা, না চাইতেই আমার জীবনে মিশিয়ে দিলো জলরঙের মতো। সকালে এসেই আবার ঐ দু নম্বর তাকের মোটা বই টার খোঁজে এগোলাম। হন্তদন্ত হয়ে খুঁজতে লাগলাম চিঠি। চিঠি নেই! মন টা অদ্ভুত ভাবে ভেঙে গেলো। মনে মনে ভাবলাম, "আমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেলো? কার না কার চিঠি পড়ে, ভাবছি আমার চিঠি। শুধু ভাবছি না, আবার আশাও করছি আরো চিঠির! বই পড়তে পড়তে আমিও  উন্মাদ হয়ে গেছি দেখছি।" কাল রাতের স্বপ্নে বেশি তারা দেখার ফল আজ দুপুরে হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। চোখ খুলে যেন রাখতে ই পারছিনা। এখন অপেক্ষা ঘড়িতে কখন সাড়ে পাঁচটা বাজবে। 

"মাসিমা, আমি একটু বেড়োচ্ছি। কিছু প্রয়োজন হলে মালোতি দি উপরে আছে, চেয়ে নেবেন।", সুপ্রকাশের গলা পেয়ে ঐটুকু ক্ষীর ঘুমেরও জলাঞ্জলি! তখনও সোয়া তিনটে মাত্র। দেওয়াল ঘড়ি তে চোখ যেতেই চোখ পরলো দু নম্বর তাকে। মোটা বই এর পাশের চটি বই টা হঠাৎ বেখাপ্পা মনে হলো। উঠে গিয়ে হাতে নিতেই লক্ষ্য করলাম, এক্কেবারে প্রথম পাতাতেই কি যেন পেন্সিলে লেখা , "ভেবেছিলাম উত্তর পাবো। অভিযোগ করছিনা। তবে অভিমান করলাম। এখন তোমার দায়িত্ব।"

সব হিসেব আবার গুলিয়ে গেলো। এটাও কি আগের চিঠির মতোই? নাকি নিছক মনের ভুল। একটা কাকতালীয় মাত্র! বুকের ভিতর টা দূরপাল্লা ট্রেনের মতো দুরদুর করতে লাগল। কিন্তু মনের ভিতরের জমাট বাঁধা প্রশ্ন গুলো যে কিছু তেই হার মানছে না। তাড়াতাড়ি ডায়েরির পাতা ছিঁড়ে লিখলাম, "এই মুহূর্তে ভীষণ ভালো আছি। ভালো থাকার সব দাওয়াই তো তোমার কলমেই।" বাড়ি ফিরে এসেও নিজেকে মানসিক নিধন না করে পারছিলাম না। জানিনা এই ছেলেমানুষির দায় কতটা। 

আজ একটু আগেই পৌঁছে গেলাম। আমি জানি না, তবে মন জানে কেন। দু নম্বর তাকের বই যেন ইশারা করেই কাছে ডেকে নিলো। আজ আবার সেই মোটা বই টার মধ্যেই জোর করে রাখা নতুন চিঠি, "তোমার উত্তরই আমার দক্ষিণা বাতাস। আর তুমি আমার ভালো থাকার দাওয়াই। আজকাল কি আমার জন্যই চশমা পরা ছাড়লে?" চিঠি টা পড়েই ভীষণ লজ্জা পেলাম। সত্যি সত্যিই চশমা টা আজকাল আর পরতে মন চায় না। আমার এই পঞ্চান্নৈ লাজুক মুখের খবর আবার যাতে না পাঁচকান হয়, সে খেয়াল রেখে চশমা খানা ব্যাগ থেকে বের করে চোখে আঁটলাম। আজ কেন বা কিভাবে জানিনা লাইব্রেরীতে সাত জন এলো। সব মিলিয়ে আমার চোখে মুখে মনে এক নতুন রামধনু। 

প্রত্যেক দিনের দিনলিপি তে জুড়লো এক নতুন অভ্যাস -- প্রেমে পরা। চিঠি র পিঠে চিঠি।
--"আজ যদি হিসেব করো আমরা কিন্তু ছ'মাস পেরোলাম। আচ্ছা, তোমার দেখা করতে ইচ্ছে করেনা? "

মনে মনে ভাবলাম, "আহা, আবদার কত! "
উত্তরে লিখলাম, "...আর তুমি যদি জোনাকি পোকা হও! আমার রূপলী চুলে কি ধরে রাখতে পারবো তোমায়?"
- "তাই বুঝি প্রমাণ করতে আবার চশমা পরা শুরু করেছো? রূপলী চুলে তোমার রূপ বাড়ে বলে তুমি আমায় জোনাকি পোকা বললে? "
-"ওরে বাবা, ঘাট হয়েছে। সমস্ত টা এখনও বিশ্বাস হয়না কিনা।"
-" যদি আমার হাত ধরে সত্যিই ভালো থাকো, তাহলে সবটাই জানবে সত্যি। "
-"জানিতো। তাইতো বই এর পাতার ভাঁজে তোমাকে রোজ খুঁজি। তোমার গায়ের গন্ধ শুঁকি। মাঝে আর একটা দিন। তারপরই ষষ্ঠী। পাঁচদিন পর ভুলে যাবে না তো? "
- "ভুলে গেলে মনে করিয়ে দিও। অষ্টমীর দিন একটা লাল শাড়ি পড়বে তো? কথা দিয়েছিলে।"

দৈনিক ঐ একখানা চিঠি, আমার বয়স যেন মনেমনে এক্কেবারে কমিয়ে দিয়েছে। এবারের পুজোটা সেই কলেজের দিন গুলোর মতো কাটলো। লাল শাড়ি পড়ার উত্তেজনাটা ছিল চুরান্ত। বাড়ির গেটেই দেখা হওয়া পাড়ার  মহিলারাও তারিফ জানাতে ছাড়লোনা। অনেক বছর পর মন্ডপে সারা সন্ধ্যেটা কাটালাম। সমস্তটাই যেন একটা ম্যাজিকের মতো। 

ঘোর কাটলো বাড়ি ফেরার পর। সুপ্রকাশ ফোন করলো, বরুণ বাবু মারা গেছেন, "লাস্ট কার্ডিয়াক টা বাবা আর নিতে পারলো না মাসিমা।"
আমি বুঝলাম আমার ম্যাজিক শেষ। এতদিন বরুন বাবু ছিলেন বলেই লাইব্রেরী টার অস্তিত্ব ছিল। এখন সুপ্রকাশ কি লাইব্রেরী রাখবে? হয়তো বেচে দেবে। তার সাথে বিকিয়ে যাবে আমার সমস্ত অক্সিজেন, আমার জোনাকি পোকা। 

শ্রাদ্ধের কাজ মেটার দিন কিছুটা ইতস্ততঃ হয়েই জিজ্ঞেস করলাম, "সুপ্রকাশ, তোমার বাবার লাইব্রেরী টা নিয়ে কিছু ভাবলে?"
- "মাসিমা, ওটা বাবার খুব সাধের। ওখানে আমি হাত দেবো না। তাছাড়া এখন তো আপনি দেখভাল করছেন। চলুক ওটা যেমন চলছে। "
অনেকটা স্বস্তির আশ্বাস পেলাম। 

"পাঁচদিন বলে পনেরো দিন পর দেখা হবে। হয়তো আবার অভিমান করে বসে থাকবে। এখন একটা গোটা দিন লাগবে বাবুর মান ভাঙাতে। ", লাইব্রেরীর জন্য তৈরি হতে হতে আমার মনের মধ্যে অগুনতি জল্পনা কল্পনা চলছে। সুপ্রকাশের থেকে লাইব্রেরীর চাবিটা নিয়েই ছুটলাম দু নম্বর তাকের দিকে। দু নম্বর, তিন নম্বর, চার নম্বর সব ঘেঁটে ফেললাম। কোথাও কোন ও চিঠি নেই। সারা গায়ে ধুলো, চোখে জল, মনের মধ্যে একটাই ভাবনা, "পুজোর লাল শাড়ি পড়ার উন্মাদনা আমাকে নিঃস্ব করে দিলো। জোনাকি পোকা তুমি কোথায়?"
হঠাৎ মনে হলো, এই অভিমান তো আমারই ভাঙানোর দায়িত্ব। চিঠি লিখলাম, "অনেক হয়েছে অভিমান করা। ক্ষমা চাইছি তো। বললে নাতো লাল শাড়ি তে কেমন লাগছিলো? "
দর্পণ শারদ সংখ্যা ২০২০ ( অঙ্কন উষসী রায়)


"দশদিন কেটে গেছে। আজ ও বললে না লাল শাড়িতে আমায় কেমন লাগছিলো। কাল রাতে ঘুমের ওষুধ খেতে হলো। আমার আকাশের জোনাকি পোকার মতো তারাগুলো সব হাড়িয়ে গেছে। ", ঝাপসা চোখে চিঠিটা কোনও ভাবে লিখে, আজ দুপুরেই লাইব্রেরীর চাবিটা মালোতি  কে দিয়ে বাড়ি চলে এলাম। শরীর টা খুব একটা ভালো লাগছিলো না। বিকেলে সুপ্রকাশ ফোন করলো, "মাসিমা, মালোতি দি বললো আপনি আজ তাড়াতাড়ি চলে গেছেন। সব ঠিকাছে তো?"
-- "নানা, ও কিছু না। ঐ প্রেশার টা দুদিন ধরে একটু ভোগাচ্ছে। শোনো বাবা, আমি, তিন চারদিন এখন যেতে পারবোনা।"
--"আরে বাবা ওসব নিয়ে একদম ভাববেন না। বরং কিছু দরকার হলে আমাকে জানাবেন।"
সুপ্রকাশ ছেলে টা সত্যিই খুব ভালো। আমাকে এতো শ্রদ্ধা করে, যে কি বলব। 

সাতদিন হয়ে গেছে লাইব্রেরী যাইনি। যাওয়ার ইচ্ছে টাও যেন হাড়িয়ে গেছে আজকাল। বইপত্র পড়তেও আর ভালো লাগে না একদম। চুপ করে বারান্দায় চোখ বন্ধ করে বসে থাকি। জোনাকি পোকার দল আমার বন্ধ চোখের ওপারে ভিড় করে আসে। আর সেই ভিড়ে আমি হাড়িয়ে যাই অনেক চিঠির সাথে। 

--"ও মাসিমা, মাসিমা। ঘুমিয়ে পড়েছেন নাকি? অনেকক্ষন বেল বাজাচ্ছি।"
সুপ্রকাশের গলা। সত্যিই মনে হলো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খুলে দিলাম। 
--"সুপ্রকাশ বসো। কি করে যে ঘুমিয়ে পড়লাম.."
--"আরে আমি তো চিন্তা করছিলাম, আপনি অনেক দিন হয়ে গেলো আসছেন না। তাই ভাবলাম একবার খবর নিয়ে যাই। "
--"খুব ভালো করেছো। অন্ততঃ খবর নেওয়ার জন্য ও তো আসা হলো। নাহলে তো সারাদিন বাড়িতে আমি একাই। তুমি ভালো আছো বাবা?"
--"আমরা সব ঠিক আছি। ছেলেটার একটু ঠান্ডা লেগেছে এই যা। মাসিমা, আমি ভাবলাম  আপনি একা, এই বই গুলো তাই দিয়ে গেলাম। সময় কাটবে। "
বলতে বলতেই, সুপ্রকাশের মোবাইলে প্রীতির ফোন ঢুকলো। প্রীতি সুপ্রকাশের বৌ। আমি একটা বই নিয়ে এ পাতা ও পাতা করতে লাগলাম; বোধহয় একটু ভালো থাকার ক্ষীণ আশার বোঝাটা অনেক খানি। হঠাৎ চোখ পড়লো, ২৫ নম্বর পাতায়। পেন্সিলে লেখা সেই পরিচিত হাতের লেখা, "নাহয়, একটু অভিমান করেই ছিলাম। তা বলে দেখা করাটা একদম বন্ধ করে দেবে? লাল শাড়িতে কেমন লাগছিলো তোমার চোখ তোমায় বলেনি বুঝি! " বুকের ভিতরে আবার দূরপাল্লার রেলগাড়ি চলার আওয়াজ। সুপ্রকাশ না গেলে ঠিক করে সেই আনন্দটুকুও চেটেপুটে অনুভব করতে পারছিলাম না। 
--"মাসিমা, আমাকে বেরোতে হবে। প্রীতি নীচে ওয়েট করছে। একটু দোকানে যাবো আমরা। "
--"হ্যাঁ হ্যাঁ সাবধানে যাও। আর শোনো কাল থেকে আমি আবার লাইব্রেরী আসবো। তুমি না থাকলে, মালোতি কে বলে দিও চাবিটা আমাকে দেওয়ার জন্য।"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ