শারদ সংখ্যা ২০২ || গল্প || অযান্ত্রিক




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

দিনার-ই- জিন্নাৎ
অযান্ত্রিক

লোকটা টাকা কটা হাতে নিয়ে গুনে দেখে চিত্তবাবুকে বলল ,”ব্যশ ! এই কটা টাকা?এমন একটা ঐত্যিহাসিক জিনিষ আপনাকে দিলাম তার ব্দলে মাত্র সাত হাজার টাকা? শুধুত ইতিহাস নয়, এর সোনারও একটা দাম আছে?
“দেখেন আমরা ওইসব ইতিহাস ফিতিহাস বুঝি না, আর এমন ইতিহাস কলকাতার সদর স্ট্রিট এ ঢেলে ফুটপাতে বিক্রি হয়, যা দিয়েছি সেটা ওই সোনারই দাম, যদি না পোষায় এই নিন আপনার ইতিহাস আর ফেরত দিন আমার টাকা, আপনি বরং অন্য দোকান দেখুন” বললেন চিত্তরঞ্জন সরকার, সরকার জুওেলারস এর বর্তমান মালিক । বছর পঞ্চাশের , চিত্তবাবুর দোকান নৈহাটির ঘোষ পাড়ায় । বাড়িতে বয়স্ক বাবা সত্য রঞ্জন সরকার, স্ত্রী প্রতিমা সরকার, মেয়ে প্রমিলা সরকার, মতের উপর ছোট্ট সরকার, যদিও বাড়িটা একান্নবর্তী । বছর দশেক হবে, ছিত্তবাবু ঐ সোনার দোকানের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন , মালিক হিসাবে। খুবই শান্ত ,অমায়িক ,নির্বিবাদী মানুষ হলেন এই চিত্তবাবু,। যাকে ঐ বলে না মেন্তামাড়া গোছের , ঠিক ঐ রকম।
“ অন্তত আর হাজার খানেক দিন ?, আল্লা আপনাকে বরকত দেবে”” কাতর মিনতি করল লোকটা ।
“দাদা পারলে তো দিতাম, কিন্তু পারবনা বিশ্বাস করুন,দেখছেন তো দোকান বন্ধ করে দিয়েছি, পকেটে যা ছিল, দিয়ে দিলাম আর পারবোনা” বললেন চিত্তবাবু।
লোকটা করুণ মুখ করে বলল, “ মেয়েটাকে বাঁচাতে পারবোনা, ও ছাড়া আমার আর কেউ নেই, দেখুন না যদি হয় পাঁচশ অন্তত দিন “
চিত্তবাবু পকেট হাত্রাতে শুরু করলেন , এটাই অনার মুদ্রাদোষ কাউকে মুখের উপর না বলতে পারেন না ,তার উপর কারোর মেয়ের কস্তের কথা শুনলে অনার নিজের মেয়ের মুখের ছবি ভেসে ওঠে চোখের সামনে।আর চিত্তবাবু যে মেয়ে বলতে অজ্ঞান সেটা মোটামুটি সারা শহর জানে।কিছুক্ষন পর হাতরে পকেট থেকে দুত একশ টাকার নোট বার করলেন। টাকাটা লোকটার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন , কি হয়েছে তোমার মেয়ের?
“এপেন্দিক্স, আজ টাকা জমা করলে কাল ডাঃ অপারেশন করবেন বলেছেন। আট হাজার টাকা লাগবে,বিশ্বাস করুন যন্ত্রণায় মেয়েটা একদম নীল হয়ে গেছে। অন্য কোথাও থেকে যে যোগার করব সে সময়ও আর নেই।“কাতরভাবে  বললেন লোকটি।
“আচ্ছা ঠিক আছে, আপাতত আপনি এটা রাখুন,কাল স্কালে একবার আসুন, তখন না হয় এটা ভাল করে দেখে যদি আর কিছু করে দেওয়া যায় ,দেখবো , আমি কাউকে ঠকাই না , নাহলে আমাদের পাঁচ পুরুষের এই ব্যবসা চলতনা । বললেন চিত্তরঞ্জন সরকার।
“ আমি জানি হুজুর, তাই ভরসা করে আপনার কাছেই এলাম “ বলল লোকটা ,”বিপদে না পরলে কেউকি বংশের জিনিষ বাইরে বার করে? ঠিক আছে আমি কাল আসবো, সকালে না পারলেও বিকালে অবশ্যই আসবো , খোদা আপনার উপর মেহেরবান হোক , খুব বরকত দিক আপনাকে , আজ তাহলে আসি “ বলে অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেল লোকটা । চিত্তবাবু যে কিছু বলবেন অথবা মেয়েটির ব্যপারে আরও কিছু জানবেন সে সুযোগই পেলেন না ।উনি একবার পকেটে হাঁট দিয়ে দেখে নিলেন মসলিন কাপড়ের থলিটা ঠিক আছে কিনা। বাড়ি যদিও সামনেই চিন্তার কিছু নেই তেমন,তবুও সাবধান থাকা ভালো, হাতঘরিতে দেখলেন রাত নটা বাজে । বেশী অবশ্য হয়নি, এতোটা দেরী অন্যদিন হয় না , আজ হয়ে গেল।তাও ঐ লোকটার জন্য। চিত্তবাবু দোকান বন্ধ করছিলেন তখনি ঐ ভদ্রলোক , ছুটতে ছুটতে এলেন, এসেই কোন কথা নেই বাতরা নেই সোজা চিত্তবাবুর পা দুটো জড়িয়ে ধরে তুমুল কাকুতি মিনতি করতে লাগলেন, প্রথমে চিত্তবাবু ভেবেছিলেন সাহাজ্য চাইতে এসেছে বোধ হয়, তাই এড়িয়ে যাচ্ছিলেন । আর ঠিক তখনই , লোকটা কোঁচড় থেকে ঐ মসলিনের থলিটা বার করে পায়ের কাছে রাখল ।চিত্তবাবু কিছু করেননি ,লোকটাই থলির থেকে বার করে দেখাল একটা সোনালী চাকতি , চিত্তবাবুর জহুরীর চোখ , দেখেই বুঝেছিলেন ,ওটা সোনার তবে খাঁটি নয়। লোকটা মোহরটা চিত্তবাবুর হাতে দিয়ে বললে, এটা জমা রেখে কিছু টাকা, অন্তত হাজার দশেক টাকা ধার দিন । আজ চিত্তবাবুর তেমন বিক্রিবাটা হয়নি, তাই পকেটে তেমন টাকা করি নেই , জা ছিল তাই দিয়েই রফা করার চেষ্টা করলেন , উনি ঠকাতে চাননা। যাই হোক , কোন রকমে রফা করে উনি মসলিনের থলিটা পাঞ্জাবীর পকেটে ঢুকিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করে দিলেন ।
রাত নটা বাজে , রাস্তায় তেমন লোকজন নেই । এমনিতেই নৈহাটির ঘোষপাড়া ,তেমন জমজমাট নয়। তবে অজপাড়া বলা যাবে না। চিত্তবাবুর হাঁটতে হাঁটতে মনে হল , বাঃ বেশ লাগছে তো, শ্রাবণ মাসের সন্ধ্যে হলেও বেশ ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে। চাঁদের আলোটাও আজ যেন একটু বেশী পরিস্কার, নিজের বাড়ির রাস্তাটায় ঢুকতেই ঝপ করে চারিদিক অন্ধকারে ডুবে গেলো  ,”এমাহ ,ভাবলাম বাড়ি গিয়ে মোটরটা চালিয়ে একটু ঠাণ্ডা জলে স্নান করব , সারা শরীর ঘামে চিটচিটে হয়ে আছে, তাও গেলো “মনে মনে বললেন চিত্ত বাবু । বুক পকেট থেকে মোবাইল বার করে টর্চ জ্বালালেন ,যদিও চাঁদের আলোতে নাহলেও চলতো কিন্তু সাবধানের মার নেই। বাড়ির কাছে পৌঁছে দরজায় কড়া নাড়তে যাবেন, ঠিক সেই সময়ই দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো প্রমিলা , চিত্তবাবুর মেয়ে।
“কি রে , তুই হঠাৎ করে এতো রাতে যাচ্ছিস কোথায়? কি হয়েছে?” জানতে চাইলেন চিত্তবাবু।
“ কোথায় আবার যাচ্ছি, তোমাকে বারান্দা থেকে আসতে দেখলাম দেখে নিচে এসে দরজা খুললাম” বলল প্রমীলা “ আচ্ছা বাপী , তোমার সাথে আর কেউ এলো নাকি গো?”
“ ওঃ তাই বল , বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলি ? তা বেশ করেছিস, না আমার সাথে তো কেউ আসে নি , কেন বলতো ?”
“ সেকি তোমার পিছনে পিছনেই তো আসছিল , বোরখা পরা বলেই মনে হলো, যাই হোক চল ভিতরে চলো , বাপী তুমি হঠাৎ করে আঁতর লাগালে কেন গো আজ, বিকেলে তো পাউডার মেখে গেলে।তারুপর আবার আতর,ক্ষেপে গেলে নাকি “ হাস্তে হাস্তে বলল প্রমীলা ।
কথা গুলো শুনেই , চিত্তবাবুর যেন মাথায় রক্ত চরে গেলো , মেজাজ একদম সপ্তমে নিয়ে গিয়ে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললেন “চোপ বেয়াদপ ,জুতিয়ে তোমার মুখ ছিঁড়ে নেবো , জানো না ? কার সাথে কি ভাবে কথা বলতে হয়, তেয়জিব কি সব ভুলে গেছো নাকি? এবারের মত মাফ করে দিলাম পরের বার কোন রেয়াত হবে না জেনে রেখ ।  যাও অন্দর মহলে যাও” বলেই গট গট করে ঘরে ঢুকে গেলেন।
প্রমীলা বাবার এই রুপ কোনদিন দেখেনি , আর হঠাৎ করে ঘটায় কেমন একটু হকচকিয়ে গেল। ওর এখন মাথায় ঢুকছে না ও এমন কি বলল যে ওর অমন নরম সরম বাপী , ক্ষেপে অগ্নিশর্মা হয়ে গেলো । হতে পারে দোকানে কোন গণ্ডগোল হয়েছে তাতেই মেজাজ সপ্তমে চরে রয়েছে। এনিয়ে আর মাথা না ঘামিয়ে প্রমীলা দরজা বন্ধ করে দিতে গেলো, কিন্তু দরজা দিতে গিয়ে ওর মনে হলে বাইরে অন্ধকারের মধ্যে ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ হছছে,অথচ এমন সুন্দর চাঁদের আলোতেও প্রমীলা কিছু দেখতে পেল না শুধু আতরের গন্ধটা যেন বাড়ছে । ও দরজা বন্ধ করে ঘরের ভিতরে মাকে ডাকতে গেলো। ওদিকে চিত্তবাবু ঘরে ঢুকে হইচই বাঁধিয়ে দিয়েছেন। তাকে কেউ বাগে আন্তে পারছেনা, আজ বাড়ি ফেরা থেকেই অনার মাথার মধ্যে যেন দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে, প্রতিমা দেবী , তুমি চা খাবে ? জিজ্ঞাসা করতেই ,সেই একই রকম ভাবে রেগে উঠলেন আর সব থেকে অদ্ভুত লাগছে , এতো উগ্র ভাবে চিত্তবাবুকে কথা বলতে কেউ কোনোদিন দেখেনি। ঘরে ঢুকতেই বেশ মেজাজের সঙ্গে বললেন “ এই কে আছিস? গোসলখানায় ঠাণ্ডা জল ভরে দে , আমি গোসল করব “ প্রতিমা দেবী চা এর কথা বলতেই “দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বললেন “বেশরম অওারত , এটা রাতের খানার সময় এখন কি কেউ পান করে ? যত সব ফালতু লোকে ভরে গেছে প্রাসাদ”। প্রমীলা ঘরে ঢুকে দেখল, মা দরজার পাশে সিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আর ভয়ে ওনার মুখ সাদা হয়ে গেছে। আর চিত্তবাবু ঘরের মাঝে পায়চারি করছেন , সারা ঘর তিব্র আতররের গন্ধে ভরে গেছে। “বাপী, তুমি এসব কি বলছ? কি হয়েছে তোমার?” কথাটা প্রমীলা বলার সঙ্গে সঙ্গে ঝপ করে ঘরের আলো  গুলো জ্বলে উঠলো ।  আলো জ্বলে উঠতেই , চিত্তবাবু কেমন যেন চমকে উঠেই ,এলিয়ে পরলেন পাশের সোফার উপর। প্রতিমা দেবী ছুটে গিয়ে ধরলেন চিত্তবাবুকে, ধরতেই বুঝলেন প্রচণ্ড জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে চিত্তবাবুর। চোখ দুটো ,রক্ত জবার মতো লাল আর সেই সঙ্গে সারা শরীর থেকে কেমন একটা বিকত গন্ধ আসছে। প্রতিমা দেবী ছিতকার করে উঠলেন “ মামন , দেখ তর বাপির সারা শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে, ঐ জন্যই বোধ হয় এমন করছিল । কি গো ? শুনছ ? শরীর কি খুব খারাপ লাগছে ? চল ঘরে গিয়ে শোবে চল,আমায় ধর ,ধরে ধরে চল । মামন তুই দেখত বাপী কাকু এসেছে কিনা , নাহলে ফন করে ডাকতো বাপী কে?বল বাবা শরীর খুব খারাপ এক্ষুনি আসতে।“
প্রতিমা  দেবী ,চিত্তরঞ্জন বাবুকে ধরে শোবার ঘরে নিয়ে যেতে গিয়ে দেখলেন , চিত্তবাবুর মুখ থেকে লালা ঝরছে, অজানা একটা ভয়ে আতঙ্কে প্রতিমা দেবির বুক কেপে উঠলো । চিত্তবাবুকে খাটে শুয়ে দিয়ে প্রমীলা ফোন করল বাপিকাকাকে, মানে চিত্তরঞ্জন সরকারের ছোট ভাই ডঃ আলক রঞ্জন সরকারকে। ফোন রাখতেই দরজায় টোকা পড়ল । প্রমীলা দরজা খুলে দেখল , বাপিকাকা
“কি হয়েছে দাদার , আমি সবে ঢুকে উপরে যাচ্ছিলাম তার মধ্যেই তোর ফোন “
“এই তোঁ দেখো না , দোকান থেকে ফিরে আসা থেকে কেমন করছিল , তারপর ঝিমিয়ে পড়ল, তখন গায় হাঁট দিয়ে দেখি খুব জ্বর, এখন জ্ঞানও নেই” বলল প্রমীলা।
“ দোকানে কি কিছু খেয়ে ছিল ?কিম্বা শরীরের কোথাও কাটা ছেঁড়া চোখে পড়েছে ? “ জানতে চাইলেন বাপী কাকা।
“তুমি তো জানোই ,ওর বাবা বাইরে কিচ্ছু খায় না , তবে জামা কাপড় তো ছাড়ানো হয় নি, বলতে পারব না গো “ বললেন প্রতিমা দেবী।
দর্পণ শারদ সংখ্যা ২০২০( অঙ্কন : উষসী রায়)

“আচ্ছা ঠিক আছে দেখি,” বলে নিজের ব্যাগ থেকে সব সরঞ্জাম বার করে পরীক্ষা করা শুরু করলেন ডঃ আলোক রঞ্জন সরকার।“ওঃ এতো দেখছি অনেক জ্বর, প্রেশার পালস দুটোই অনেক বেশী আছে। তবে বৌদি ভাই, এটা কোন ইনফেকশান নয়, কোন কারনে খুব ভয় পেয়েছে দাদাভাই তার জন্যই জ্বর এসছে মনে হছছে।চিন্তার কিছু নেই আমি একটা ইঞ্জেকশান দিচ্ছি, ভাল ভাবে ঘুমাক মনে হয় তাতেই ঠিক হয় যাবে, জ্বরও কমে যাবে”
“এই জ্বরের জন্যই কি তোমার দাদা অমন করছিল ?আমার কিন্তু খুব ভয় করছে ,ঠাকুরপো “ ভয় ভয় কথাগুল বললেন প্রতিমা দেবী।
অত ভয়ের কিছু নেই , ঘুমাচ্ছে ঘুমাক ,কাল ঠিক হয়ে যাবে । আচ্ছা , বাবা কোথায়? এতক্ষন দেখছি না তো, আড্ডা থেকে ফেরেনি নাকি?”
“না গো , এখনো ফেরেননি, অন্য দিন চলে আসেন, কিন্তু আজ অনাদের আড্ডায় , কোন বিশেষ বন্ধু আসবেন , এলাহাবাদ থেকে, তাই হয়ত দেরী হছছে। তোমার কথায় খুব জোর পেলাম ভাই ।  এই দ্যাখো, তুমি চা খাবে তো একটু? করাই আছে ,” বললেন প্রতিমা দেবী।
“ দাও , চায়ে না বলতে নেই ? তাহলে মামন,তোর খবর বল, আজকাল খুব একটা দেখছি না , কি ব্যাপার ?”
“আমার সামনের সপ্তাহে থিসিস সাবমিট করতে হবে গো, তাই নিয়ে খুব চাপে আছি গো কাকাই, কাম্মা জানে তো,” বলল প্রমীলা। কাকা ভাইঝির কথা চলতে চলতে প্রমীলা বাবার গায়ের খুলে ঘরে পরার পাঞ্জাবীটা পরিয়ে দিল, জামাটা পাট করে আলনায় রাখতে যেতেই জামার পকেট থেকে একটা মসলিন কাপড়ের থলি মেঝেতে এসে পরল আর ঠং করে একটা শব্দ হল । প্রমীলা কৌতূহলবশত থলিটা তুলে দেখতে লাগলো ।
“হ্যাঁ রে, কি ওটা ?” জানতে চাইলেন আলোক বাবু ।
“কে জানে ! বাবার পকেট থেকেই পরল, কি সুন্দর ব্যাগটা দ্যাখো? ভিতরে একটা কয়েনও রয়েছে গো কাকাই , ওমা ! দ্যাখো এটা একটা মোহোর “ অবাক হয়ে বলল প্রমীলা মানে মামান।
আলোক বাবু উঠে এসে হাতে নিয়ে দেখলেন, “ সত্যি তো, এটা তোঁ মোহর , আর দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব পুরনো , দ্যাখ দ্যাখ কি সুন্দর একটা গন্ধও বেরোচ্ছে ,সেই আতরের মতো “
“হ্যাঁ গো কাকাই, আআজ যখন বাবা বাড়ি এলো তখন ঐ গন্ধটা বাপির গা থেকেও বেরচ্ছিল। জানতো , সারা বাড়ি এই গন্ধে ভরে গেছিল ।কিন্তু তারপর যেই কারেন্ট এলো ,আর বাপী অজ্ঞান হয়ে গেলো তখন এই গন্ধটা নিজে নিজেই গায়েব হয়ে গেলো “
আলোক আর প্রমীলার কথাবাত্রার মাঝ খানে ঘরে এসে ঢুকলেন সত্যরঞ্জন সরকার,অ একজন সম বয়স্ক এক জন অপরিচিত ব্যেক্তি।
“দিদিভাই, বাবুর কি হয়েছে রে? তোর মা বলল ওর নাকি খুব শরীর খারাপ , দোকান থেকে ফিরেই শুয়ে পরেছে।“জানতে চাইলেন সত্যরঞ্জন বাবু।
 “হ্যাঁ গো দাদুভাই, বাবা দোকান থেকে ফিরেই খুব অসুস্থ হয়ে পরেছে, বেদম জ্বর কাকাই দ্যাখে বলল কোন কারনে বাপী খুব ভয় পেয়ে জ্বর বাধিয়েছে”
“তাহলে চিন্তার কিছু নেই তো, বাপী?” আলোক বাবুর কাছে জানতে চাইলেন সত্যরঞ্জন বাবু।
“ না বাবা , চিন্তার কিছু নেই, প্রেশারটা একটু বেড়েছে , আমি ওষুধ দিয়েছি, জ্বরটা একটু পরে কমে যাবে , কাল সকাল নাগাদ দাদাও ঠিক হয়ে যাবে , স্ট্রেস থেকে হয়েছে চিন্তার কিছু নেই। তুমি কি সবে ফিরলে? খাবে কখন ? ওনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না।“ বলল আলোক রঞ্জন ।
“ ওঃ হো , দেখেছিস একদম খেয়াল নেই । তোর মনে নেই ? উনি সুধাংশু দা , আগে আমাদের এখানে কত এসেছেন, বাবুর মনে নিশ্চয়ই থাকবে, খুব স্নেহ করতেন বাবুকে সুধাংশু দা, তারপর এলাহাবাদ চলে গেলেন চাকরী নিয়ে । এইত এলেন চল্লিশ বছর পর, কি বলো ?সুদুদা,” বললেন সত্যরঞ্জন বাবু। 
“হ্যাঁ, তাতো হবেই ,তবে তোমাকে অনেক ছোট দেখেছি তোমার মনে না থাকটাই স্বাভাবিক,তোমার দাদার আর আমার পচ্ছন্দের বিষয়টা একই,তাই ওর সাথে পরিচয়ই বেশী ছিল ।তোমার দাদা ইতিহাসের ছাত্র আর আমি ইতিহাসের প্রফেসসের  এলাহাবাদ ইউনিভার্সিটির।“ বললেন সত্যরজন বাবুবুর সাথে আসা ভদ্রলোক।
“তাই হবে হয়তো, আমারও তেমন খেয়াল নেই। আর আমার সত্যিই ইতিহাস সম্নধে তেমন কোন আগ্রহ নেই , বিজ্ঞানের ছাত্র তার বাইরে কোন জিনিষ বিশেষ জানি না কাকাবাবু । আচ্ছা এবার আমায় একটু ক্ষমা করতে হবে, হাস্পাতাল থেকে ফিরে ঘরে যেতে পারিনি আবার কাল সকালে বেরোনোও আছে কাল বাড়ি ফিরে কাকাবাবুর সাথে জমিএ আড্ডা হবে “ বেশ বিনিত ভাবে বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলো আলোক রঞ্জন , কিন্তু,
“ কি ব্যাপার রে বাপী ? তুই এখন এখানে ? কার কি হোল ? আরে, বাবা তুমিও এখানে , মামন কই ? ঈশ দেখেছ জামা ছাড়তে ছাড়তে ঘুমিএ গেছি। মামন , অ্যাই মামন তোর মাকে এক গ্লাস জল দিতে বলতো” খুব স্বাভাবিক ভাবে কথা গুলো বলতে বলতে বিছানায় উঠে বসলেন চিত্তরঞ্জন সরকার।
আলোক বাবু ,এগিয়ে এসে কপালে হাত দিয়ে দেখলেন  জ্বর আর নেই । তাও জিজ্ঞাসা করলেন “ খন কেমন লাগছে ? “ “মানে” অবাক হয়ে জানতে চাইলেন চিত্তবাবু । আলোক বাবু সবিস্তারে জানাতে তখন তো তার একেবারে হতবম্ব অবস্থা। তারপর , সুধাংশু বাবুর দিকে চোখ পড়তে , এক্কেবারে বাচ্চা ছেলের মত খুশি হয়ে চিত্তবাবু বললেন, “ আরে ,সুদু জ্যেঠা!, কবে এলেন?” শুরু হয়ে গেলো এক প্রস্থ কুশল বিনিময় ।  এক সময় ,রাতের খাওয়ার জন্য ডাক এলো , সবাই গল্প করতে করতেই বসে পরল খাওয়ার টেবিলে।  রুটি , আর তরকারি সবাই মোটামুটি তৃপ্তি করেই খেলেন ,শুধু চিত্তবাবু বাদে। সাধারনত চিত্তবাবু নিজেও খুব সাধারন খাবার পছন্দ করেন ,তেল মশলা ছাড়া খাবার। কিন্তু আজ অনার নিজেরি সে খাবার পছন্দ হচ্ছে না । কেউ যেন ভিতর থেকে বার বার বলছে এসব খাওয়ার মুখে তোলার মতো নয়। বড্ড সাদা খাবার, কিন্তু সবার সামনে সেই অস্বস্তিটা প্রকাশ করলেন না । সবার মত খেয়ে দেয়ে শুতে চলে গেলেন । কিন্তু বাদ সাধল শুতে গিয়ে, শুয়ে তো পরলেন কিন্তু ঘুম আসছে না , বার বার মনে হচ্ছে একটু বাইরে থেকে ঘুরে এলেই হয়, অথচ উনি কোনোদিন রাতের বেলায় বাইরে যান না। প্রতিমা দেবী সংসারের বাকি কাজ সেরে শোওয়ার ঘরে এসে দেখলেন আলো নেভান , আর সারা ঘর উগ্র আতরের গন্ধে ভরে গেছে। চিত্তবাবুকে ঘুমোতে দ্যাখে উনি খুব সাবধানে পাশে গিয়ে শুয়ে পরলেন। কিন্তু কিছুতেই দু চোখের পাতা এক করতে পারছেন না, আতরের গন্ধটা যেন উত্তর উত্তর বেড়েই চলছে। একটা অসস্তি বোধ নিয়ে প্রতিয়া দেবী পাশ ফিরে শুয়ে পরলেন ।  পাশ ফিরতে গিয়ে চিত্তবাবুর গায়ে হাত ঠেকতেই উনি, চমকে উঠলেন । সেই জ্বর আবার ফিরে এসেছে,কপালে হাত দিয়ে দেখলেন তাপমাত্রা যেন আগুনকেও হার মানিয়ে দিচ্ছে। প্রতিমা দেবী তাড়াতাড়ি  উঠে দরজা খুলে পাশেই প্রমিলার ঘরের দরজায় ,টোকা দিলেন।
“ মামন, এই মামন, ঘুমিয়ে পরেছিস? তোর বাবার জ্বরটা ফিরে এসেছে আবার , একবার বাপীকে ডাকবি ?”
কথা শেষ হওার আগেই খুত করে একটা শব্দ হোল আর দরজা খুলে বাইরে বেড়িয়ে এলো প্রমিলা।‘আবার জ্বর ?, কখন এলো ?”উৎকণ্ঠিত  হয়ে জানতে চাইল প্রমীলা।
“ কে জানে? এখন ঘরে শুতে গিয়েই দেখলাম । একবার চলনা “ বলে মেয়ের হাত ধরে নিজেদের শোওয়ার ঘরের দিকে নিয়ে গেলেন প্রতিমা দেবী । দুজনে ঘরের দিকে যেতে গিয়ে লক্ষ্য করলেন, সারা বাড়ি আতরের গন্ধে ম ম  করছে। আর বাড়ির আবহাওয়া কেমন যেন লাগছে, একটা হাল্কা গান বাজনার শব্দ ভেসে আসছে কোথাও থেকে। চিত্তবাবুর শোওয়ার ঘরের দরজা ভেজান ছিল , সেটা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই দুজনের চক্ষু চড়ক গাছ। এ কোথায় এসে পরলেন , এতো আর ওনাদের সাধারন শোওয়ার ঘর নেই , এতো কোনো রাজপ্রাসাদ, এই ঘরে বসেছে গানবাজনার মেহফিল । সারা ঘর ঝলমল করছে বিশাল বিশাল ঝাড়বাতির আলোয় , একজন বাইজী  অপূর্ব ভঙ্গিমায় নেচে চলেছে ঘরের ঠিক মাঝখানটাতে , আর তাকে সঙ্গত করছে কয়েক জন তবলচী আর সারেঙ্গী বাদক । একটু আগে যেখানে খাটখানা ছিল সে খানে একটা মখমলের গদিতে বসে আছেন চিত্তবাবু। এ চিত্তবাবু, ওনাদের সেই চেনা চিত্তবাবু নন, তার চেহারা বদলে গেছে অনেকটাই । মুখে মেহেন্দি করা , বাদামী রঙের বড় বড় দাড়ি, চকচকে বাদামী চুল , আর ঠিক তার পাশটাতেই বসে আছেন একজন অপরুপ সুন্দরী মহিলা, দুজনেরি সাজ পশাক একদম রাজকীয় । ভদ্র মহিলাকে দেখতে একদমই আরব্য রজনীর , রাজারানির মত। প্রতিমা দেবী আর সহ্য করতে পারলেন না একটা তিব্র আর্তনাদ করে লুটিয়ে পরলেন ঘরের সামনে । প্রমীলা তখনও ঘরে ঢুকতে পারেনি , প্রতিমা দেবী লুটিয়ে পরতেই ওদের মুখের উপর দরজাটা নিজে নিজেই বন্ধ হয়ে গেলো । 
প্রমীলা মায়ের মুখে জলের ছিতে দিতেই, প্রতিমা দেবী চোখ খুললেন, যদিও ভয় আর আতঙ্কের ছায়া তখনও জ্বলজ্বল করছে ওনার মুখে। এতক্ষনে প্রতিমা দেবীর আর্তনাদে , সত্যরঞ্জন বাবু, সুধাংশু বাবু, আলোক বাবু অনার স্ত্রী সকলেই ছুটে এসছেন । প্রতিমা দেবীর কাছে সব শুনে সকলে মিলে দরজার বাইরের থেকে ডাকতে লাগ্লেন চিত্তবাবুকে , কিন্তু অনারা নিজেরাই বুঝতে পারছিলেন ভিতরে ঘুঙুরের আর বাদ্য যন্ত্রের আওয়াজে সে ডাক চিত্তবাবুর কানে যাচ্ছে না। এদিকে সেই আতরের গন্ধটা এত তীব্র হয়ে উঠেছে যে সকলে কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে ধীরে ধীরে সংজ্ঞাহিন হয়ে পরলেন। ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফুটতেই সব কিছু শান্ত স্বাভাবিক হয়েগেল। আশ্চর্য ভাবে,পরদিন সকালে কারোরই কিছু মনে রইলো না যেন কিছুই হয়নি, শুধু একজন বাদে “সুধাংশু চক্রবর্তী”। উনি কিছুতেই ভুলতে পারছিলেন না গতরাতের ঘটনা । পরে যখন দুপুরে খাওয়ার টেবিলে সবাই এক জায়গায় হলেন , সুস্থ স্বভাবিক চিত্তবাবু , সুধাংশু বাবুকে মসলিনের কাপড় এর সেই থলিটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, “ আচ্ছা কাকাবাবু? আপনি এই জিনিষটা সম্মন্ধে কিছু বলতে পারেন ?”
সুধাংশু বাবু , থলিটা হাতে নিয়ে দ্যাখে বললেন “এতো প্রাচিন আমলে মোহর রাখার থলি , ওমা এর এর ভিতরে একটা মোহরও আছে দেখছি”বলে থলিটার থেকে একটা ধাতব চাকতি বার করে দেখতে লাগলেন, “ এ জিনিষ আমার চেনা তবে তুমি এটা পেলে কথা থেকে ?”
“ কাল এক ভদ্রলোক , এটা বান্ধা রেখে কিছু টাকা নিয়ে গেছে, বলে ছিল এর নাকি খুব পুরনো ইতিহাস আছে আর এর ঐতিহাসিক গুরুত্বও অপরিসীম ,জিনিষটা যে প্রাচিন আর খাঁটী সেটা চোখের বিচারে দেখেই বুঝে ছিলাম । কিছু টাকা দিয়ে দিলাম , ভেবে রেখেছিলাম বাড়ি ফিরে বাবাকে দেখাব কিন্তু কই যে হল , কিচ্ছু মনে পড়ছে না ‘
“ দেখে তো মনে হচ্ছে এটা মুঘল আমলের , কারণ এই সময় আশরফিতে ফার্সিতে লেখা থাকতো “বলে সুধাংশু বাবু মোহরখানা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলেন, কিছু একটা দেখে অনার ছখ মুখ উজ্জল হয়ে উঠলো। “এটা তোমার কাছে বিক্রি করেছেন , নাকি বন্ধক রেখে গেছেন, তবে যাই করে থাকুন, তুমি এ জিনিষ বাড়িতে রেখো না । এটা আমি হলপ করে বলতে পারি ?”
“ বিক্রি , বন্ধক জা কিছুই বলা যেতে পারে , সেই লোকটাকে পুরো টাকা আমি দিতে পারিনি, উনি আবার বিকালে আসবেন বাকি আর কিছু টাকা নিতে । কেন কাকা বাবু বিশেষ কিছু দেখলেন?”
“ বিশেষ বলে বিশেষ, এ একেবারে সাংঘাতিক ব্যাপার, যদি আমার খুব ভুল না হয় , এটা মুঘল আমলের মানে বাহাদুর শাহ জাফরের সময়ের, ধর মোটামুটি ১৮৪৬-৪৭ সালের , এতে জিনাত মহলের নাম উল্লেখ আছে দেখছি । এর উল্লেখ আমরা পাই “দ্য লাস্ট মুঘল” বইটিতে , অখানে বলা ছিল বাহাদুর শাহ্র আমলে বিশেষ সম্মাননা জন্য বানান হয়েছিল গোটা দশেক মুদ্রা, বাহাদুর শাহের বেগম জিন্নাৎ মহলের নামে । এখনও পর্যন্ত নয় খানা পাওয়া গেছে, যার সব কটাই দিল্লীর লালকেল্লার জাদুঘরে রাখা আছে । লোক মুখে শোনা যায়, এর প্রত্যেকটা  মোহর অভিশপ্ত, প্রচুর মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে এই মোহর। আমি নিশ্চিত এই মোহরটা সেই দশটার একটা” বলে সুধাংশু বাবু আশরফিটা চিত্তবাবুর হাতে ফেরত দিলেন ।
“তারমানে, এই মোহর গুলো , মানুষের ক্ষতিকর বলছেন, মানে প্রাণ হানিও হতে পারে ? লোকটা কি ওইজন্যি আমায় দিয়ে গেলো নাম মাত্র মুল্যে”
“দ্যাখো চিত্ত, অভিশপ্ত তো অবশ্যই। তবে কথিত আছে , বাহাদুর শাহ জাফরের বংশের কারোর কাছেই এই মোহর অভিশপ্ত নয়, বরং আশীর্বাদ । তবে তারা যদি কাউকে সৎ উদ্দেশ্যে এই মোহর দেয় তাহলেও এই মোহর কোন ক্ষতি করে না , কিন্তু কেউ যদি অসৎ উপায়ে এই মোহর অধিকার করে তাহলে অধিকারির বংশ নির্মূল করে দিয়ে এই মোহর নিজের স্থানে ফিরে যায়, তাই বলছে এটা কাছে রেখনা । আমি নিজের চোখে এই মোহরের সংহার লীলা দেখেছি ।“
‘তাহলে তো ভয়ানক ব্যাপার , আচ্ছা সুদুদা কে এই জীনাৎ মহল? কেন এই মোহরগুলি অভিশপ্ত ?” জানতে চাইলেন , সত্যরঞ্জন বাবু, । এতক্ষন কথাবাত্রায় ঐ মোহর সম্নধে বেশ আগ্রহ জন্মে গেছে টেবিলের সবারই। প্রমীলা শুরু থেকেই শুনছিল এবার সেও বলল “ হ্যাঁ কাকাদাদু, তোমার আসুবিধা না থাকলে একটু বিস্তারিত বোলো না”
“ সেকি !, তোমাদের আর কোন কাজ নেই ? সবাই এখন গল্পের আসরে বসবে / আমার বলতে কোন অসুবিধা নেই । কিন্তু লম্বা ইতিহাস তোমাদের শুনতে অনেক সময় লেগে যাবে, তাতে যদি তোমাদের অসুবিধা না থাকে আমার কোনও অসুবিধা নেই” বললেন সুধাংশু বাবু’
‘ না না কাকাবাবু আমাদের কোন অসুবিধা নেই আপনি বলুন “ বললেন চিত্তবাবু ।
“ ঠিক আছে , তাহলে  শোনো “ বলে শুরু করলেন সুধাংশু চক্রবর্তী “ জিন্নাৎ বিবি বা জিন্নাৎ মহল  ছিলেন বাহাদুর শাহ জাফরের পত্নি। ওনার সাথে বাহাদুর শাহের বয়সের ফারাক ছিল বিস্তর , বাদশহের সাথে যখন ওনার নিকাহ হয়, তখন বাদশাহের বয়স পঁয়ষট্টি আর জিন্নাৎ এর সতেরো । বাদশহের অন্য বেগমের ছেলেরা কেউ কেউ মেয়েটির থেকে বয়সে বড়। সতেরো বছরের মেয়েটি লাল্কেল্লায় নামলো পালকি থেকে , নববধূর বেশে। লোকজনের চাপা গুঞ্জন আর বুড়োর ভিম্রতির কথা কানে আসছিলো । মীর্জা আবু জাফর , মানে বাদশাহ হওয়ার আগে বাহাদুর শাহ জাফরের কিছু চারিত্রিক দোষ ছিল । যার কারনে , বাদশা দ্বিতিয় আকবর শাহের এই শাহজাদা আবু জাফরকে বাতিল করে , বেগম দ্বিতিয় মমতাজ মহলের পরামর্শ অনুযায়ী, তারই ছেলে মীর্জা জাহাঙ্গীরকে উত্তরাধিকার করবেন বলে স্থির করলেন। যদিও , বাদশাহি বলতে তেমন কিছু নেই, ঐ যমুনা ন্দির পারে কইক্তা শহর ঘিরেই রাজত্ব, জায়গীর দারী বলাই ভালো । দেখতে গেলে , আওয়াধের নবাবের ট্যাঁকের জোর মঘল বাদশাহ থেকে বেশী ছিল । তাও বংশ , পারিবারিক স্মমান বলে ব্যাপার।
ইংরেজ কোম্পানি  ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিল দ্বিতীয় আকবর শাহের সিধান্ত ।  যার বিরুদ্ধে উচ্ছ্রিঙ্কলতার এতো অভিযোগ টাকে কোন ভাবেই বাদশাহ করা যাবে না ।  প্রতিবাদে মীর্জা জাহাঙ্গীর চার্লস সেটন নামে এক রেসিদেন্ত অফিসারকে দিলেন গুলি চালিয়ে । কোম্পানির কর্তারা দিলেন মীর্জা জাহাঙ্গিরকে দিল্লী থেকে তাড়িয়ে , একদম এলাহাবাদ। আর সেখানে চরম উতস্রিঙ্খলতায় খুব অল্প বয়সেই বেহস্ত যাত্রা করলেন শাহজাদা মীর্জা জাহাঙ্গীর। 
এরপর, দ্বিতীয় আকবর শাহের মৃত্যুর পর বাষট্টি বছর বয়সে মীর্জা আবু জাফর বসলেন , দিল্লীর তকতে । তাজপোশির পরেই তারই নাম হল বাহাদুর শাহ জাফর। তকতে বসার আগেয় থেকেই কবিতা জ্ঞান মানে উর্দু সাহিত্যের প্রতি ছিলেন ভীষণ অনুরাগী । তার জ্বলন্ত উদাহরণ ছিলেন মীর্জা গালিব, বাহাদুর শাহ নিজেও ছিলেন উচ্চ মানের গীতিকার ।উর্দু ফার্সি ভাষায় তার দখল ছিল অসামান্য। তার আলফায কবিতা প্রেমী শুধু নয় , দিল্লীর আপামর মানুষের খুব প্রিয় ছিল ।
মোঘল বাদশাহর দিন কাটছিল কোম্পানির মোটা পেনশনে । কোম্পানির সিভিল সার্জেন্ট ঠিক করে দেন প্রশাসনিক কর্তব্য , আর উনি তাতে সিলমোহর করে দেন। তিন বছর বাদশহি জীবন কাটানোর পর বাদশাহ একশ টঙ্কার বিমিময়ে নিকাহ করলেন এক সতেরো বছরের মেয়েকে। তিনিই হলেন জিন্নাৎ বানু, বা জিন্নাৎ মহল । বাদশহের খুব মনে ধরেছিল মেয়েটিকে , চঞ্চল, মেয়েলী তেহজিবের আরস্থতা নেই, বেশ ডাকাবুকো ধরনের মেয়ে ছিলেন জিন্নাৎ, বাদশাহের চতুর্থ বেগম । অল্প সময়ের মধ্যে , অন্দরমহলের চৌহদ্দি পেরিয়ে প্রজাদের মধ্যেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন বেগম জিন্নাৎ মহল ।বৃদ্ধ বাদশাহের যুবতী ভার্যা , তাই বাদশাহ উপর প্রভাব ছিল বেশী । লাল কুওাতে ওনার নিজের একটা প্রাসাদও ছিল । ১৮৪৬ সালে বাদশাহি খাজানার অনেকটাই খরচ করে তৈরি হয়েছিলো এই প্রাসাদ আর এই মুদ্রা , লাল কুওাতে সেই প্রাসাদ আজ আছে তবে অযত্নে। অন্য বেগমরা ওনাকে হিংসা করত, কুৎসা রটানো চলতো ওনার নামে কিন্তু নিজের পরিকল্পনায় এবং কৌশলে অবিচল থাকতেন তিনি । সত্যিই জিন্নাৎ ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া । মহলের পর্দানশিন বেগম তিনি ছিলেন না । সহচরী , সহচর সবাই ছিল তার বিশশ্ত । যে যাই ব্লুক উনি কারোর তোঁয়াক্কা করতেন না ।
দর্পণ শারদ সংখ্যা ২০২০( অঙ্কন : উষসী রায়)

বাদশাহের ছিল বাইশটা ছেলে, কিন্তু জিন্নাৎ আর বাহাদুর শাহের একটাই সন্তান , মীর্জা জাওয়া বখত। শাহজাদা দারা বখত এর পর তাকেই উত্তরাধিকার ঘোষণার পরিকল্পনা করেন জিন্নাৎ মহল । কিন্তু সাহেবরা এক বাক্যে না করে দিলেন , তার বদলে বাদশহের অন্য ছেলে মীর্জা ফকরু কে উত্তরাধিকার দিলেন । জিন্নাৎ এর স্বপ্নভঙ্গ হলেও উনি দমে গেলেন না । তার বদলে বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্র চালাতেই থাকলেন কোম্পানির বিরুদ্ধে।অনেকের মোটে ১৮৫৬ সালে দিল্লীর রেসিডেন্ত অফিসার স্যার টমাস মেতকেফ যখন মারা যান তাতেও নাকি জিন্নাৎ মহলের হাত ছিল ।  কোম্পানির অভিজ্ঞ প্রশাসকরা ভালোই বুঝছিলেন, লালকেল্লা নয়, শাসন চলছে লালকুয়া থেকে। যাইহোক , দেখতে দেখতে আরও কয়েক বছর কাটল , ইতিমধ্যে ১৮৫৬ সালে বাদশাহ উত্তরাধিকারী মীর্জা ফক্রুরও ইন্তেকাল হল। আর জিন্নাৎ মহলের স্বপ্ন সফল হল । যদিও , দিল্লীর মশনদের ব্যাপারে বাইরের কারোর নাক গলানো , পছন্দ করতেন না রানি সাহেবা জিন্নাৎ মহল। কিন্তু সে সুখও বেশী দিন গেলো না । দিল্লীর দরজায় কড়া নাড়ল , “সিপাহী বিদ্রোহ “, সালটা তখন ১৮৫৭ এক ধাক্কায় মোড় ঘুরিয়ে দিল সবার ভাগ্যের । কোম্পানির কর্তারা জানতেন অসুস্থ বৃদ্ধ বাহাদুর শাহ ,যাই ভাবুন বা করুন, রানীসাহেবা ইংরেজদের বিপক্ষেই যাবেন । আর হলও তাই , উনি  লাল কেল্লার দরজা খুলে দিলেন মিরাটের বিদ্রোহীদের , অথচ সুকৌশলে নিজের ছেলেকে সরিয়ে রাখলেন এসবের থেকে । বাদশাহের অন্য ছেলেরা নেমে পড়ল ইনকিলাব ডাক দিয়ে । ১২ই মে , বৃদ্ধ বাহাদুর শাহ্‌ আবার দরবার ডাকলেন । নেপথ্যে কিন্তু , ছিলেন জিন্নাৎ মহলই । বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব দেওয়ার আর্জিও মেনে নিলেন বৃদ্ধ বাহাদুর শাহ । বেশ কয়েক মাস ধরে চলল সেই অসম সংগ্রাম । তারপর , একসময় কোম্পানির ফৌজ ঘিরে ফেললো বিদ্রোহী সেনা দের ।  উপযুক্ত সেনাপতি ও পরিচালনার অভাবে হার মানল সিপাহী বিদ্রোহ। বাবরের বংশধরেরা চারশ বছরে যুদ্ধ করতেই ভুলে গেছিলেন । বিরাশী বছরের বাহাদুর শাহ আত্মগোপন করলেন , সম্রাট হুমায়ূন এর স্মৃতি সৌধে , তাতেও শেষ রক্ষা হল না । বাদশাহের উজির এহসান  উল্লার বিশ্বাসঘাতকতায় ধরা পরলেন পরিবার সমেত বাহাদুর শাহ জাফর ।  ৪১ দিন ধরে একাধিক অপরাধের দায়, ২১ জন সাক্ষী ও ১৯টি শুনানির পর, বৃদ্ধ বাহাদুর শাহ জাফর, জিন্নাৎ মহল , ও তার পরিবারকে নির্বাসন দেওয়া হল । যাকে এতদিন , ইতিহাস জানত “অথর্ব বৃদ্ধ , নেতৃত্ব অক্ষম নবাব “ সেই কিনা হয়ে গেলো সিপাহী বিদ্রোহের মূল অভিযুক্ত । দণ্ডিত হলেন ভারতের শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর । মুঘল সূর্য গেলো বরাবরের জন্য অস্তাচলে ।
নির্বাসনের সঙ্গে সঙ্গে কেড়ে নেওা হল , যাবতীয় সম্পত্তি, অর্থ, শোনা যায় , তার মধ্যে এই দশটি  মোহরও ছিল । যে গুলো ইংরেজ ও ভারতীয় সৈন্যরা লুট করে ছিল, যাদের সকলেই কোন অজানা অজ্ঞাত কারনে মারা গেছেন , একেবারে নির্বংশ হয়েও গেছেন কেউ কেউ । স্বাধীনতার পর,মানে প্রায় ১৯৬৩ সালে ভারত সরকারের প্রত্নতাত্বিক বিভাগ অনেক কাথ পুড়িয়ে ৯ খানা মোহর উদ্ধার করে লাল্কিলা মিউজিওামে রাখে। একটা পাওয়া যায় নি , আমার বদ্ধমূল ধারণা এই মুদ্রাটি সেই না পাওয়া মুদ্রা । “ এতদুর বলে থামলেন  সুধাংশু বাবু ।
সবাই এতক্ষন তন্ময় হয়ে শুনছিল । এবার প্রমীলা বলল , তাহলে তো এটাকে এক্ষুনি বিদায় করতে হয় ।
“সেতো একশবার ঠিক । কিন্তু কথায় কথায় কখন দিন ফুরিয়ে সন্ধ্যে  হয়ে গেছে  দেখেছিস ? বিদায়টা করব কি করে ? ‘ বললেন চিত্তরঞ্জন বাবু , আর ঠিক তখনই দরজায় কড়া নাড়ার  শব্দ।
প্রমীলা দরজা খুলতে যেতে গিয়ে দেখল আবার সেই আতরের গন্ধটা তিব্র হয়ে উঠেছে । গতকাল সব ঘটনা ছবির মতো মনে পড়তে লাগলো প্রমিলার । দরজা খুলতেই হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেলো প্রমীলা । সামনে দাড়িয়ে , রানীর পোশাকে এক ভদ্রমহিলা । আর তার সাথে তরোওয়াল উঁচিয়ে জনা পঞ্ছিশেক সৈন্য । প্রমীলা কিছু বলার আগেই তারা সবাই হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পরল । ভদ্রমহিলয়া মিষ্টি অথচ কঠিন স্বরে বললেন “মেরা কুছ সামান আপকে পাশ গলতি সে আ গ্যায়া হ্যাঁয় , হুম লোগ বশ উশে লেনে অ্যাঁয় হ্যাঁয় , বে বক্ত তাক্লিফকা গুস্তাখি মাফ কর দিজিয়ে গা” প্রমীলা বলতে চাইল , “ কে আপনি ? কি সামান ? “ কিন্তু একটা দমকা হাওয়া ওকে মাটিতে আছড়ে ফেলে দিল । আর একটা আগ্রাসি ঝড় তোলপাড় করে দিতে লাগলো । উঠতে গিয়ে কিসে একটা ধাক্কা খেয়ে সাম্নের দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ল প্রমীলা । সারা পৃথিবী  যেন কোন বিশাল দইত্য নির্বিচারে ধ্বংস লীলা চালিয়ে চলে গেলো । কোন রকমে উঠে ঘরের ভিতরে গিয়ে দেখল , বাবা, সুধাংশু দাদু, কাকাই, মা সবাই রক্তাক্ত আর অজ্ঞান হয়ে পরে আছে ।  টেবিলের উপর রাখা মসলিনের থলিটি আর নেই তার জায়গায় দখল করে দাঁড়িয়ে আছে, একটা সুদৃশ্য বাদশাহি আতরদান, আর তার ঠিক নীচেই কিছু টাকা আর একটা হলুদ মতো কাগজ । তাতে লেখা আছে ,
“ উমর এ দরাজ , মাঙ্গকে লায়ে থে চারদিন,
দো কাট গ্যায়ে আরজু মে, দো ইন্তেজার মে “

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ