শারদ সংখ্যা ২০২০ || ভ্রমণ || জয়িতা বন্দ্যোপাধ্যায়




পোস্ট বার দেখা হয়েছে


অরুণাচলের অন্দরে
জয়িতা বন্দ্যোপাধ্যায়

"THE LAND OF RISING SUN" এটা বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই রাজ্য যেখানে রবির প্রথম কিরণে মনের গ্লানি দূরীভূত হয়ে নির্মল আনন্দে মেতে ওঠে অন্তর।
হ্যাঁ ,সে আর অন্য কোনো জায়গা নয়,সে আমার আমাদের সবার সূর্যোদয়ের অরুণাচল।

অরুণাচল ভ্রমণের ঠিক আগেই যখন এর সম্বন্ধে জানতে শুরু করি মনের মাঝে একটু একটু করে জমতে থাকে সেই সব জায়গার কথা যেগুলো বহু জন হয়তো শুধু স্বপ্নেই ভ্রমণ করতে পারে।
অরুনাচল ভ্রমণ, সাথেই ছিল আসাম,অনেক দিন ধরে কেটে রাখা টিকিট এর কথা খুব একটা লোক কে বলিনি, যদি নজর লাগে।তো  21শে অক্টোবর  2018 সাল,শুরু হল আমাদের যাত্রা,ভোর ছটায় আমরা শিয়ালদহ থেকে কান্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস ধরে একঘেঁয়ে ট্রেন যাত্রার পর নামলাম ভোর চার টে গুয়াহাটি স্টেশন এ।দীর্ঘ ক্লান্তি,তাও মনে আনন্দেরা কিলবিল করছ।
,হোটেল এ গিয়ে ফ্রেশ হলাম, বিকালে বিখ্যাত  উমানন্দ ঘাটের সৌন্দর্য উপভোগ করার পর  গেলাম কামাখ্যা মন্দিরে মায়ের দর্শনে। কিন্তু ও সন্ধ্যার বেশ কিছুক্ষণ আগে অনেক দেরী হয়ে যাওয়ায় মন্দির বন্ধ।তাই দর্শনের আর সুযোগ মিলবে না।কিন্তু আসামের একটু খানি এলাম অথচ কামাখ্যা মা দর্শন করবো না!মন খুব খারাপ কিন্তু ভগবান আমার স্বহায় ,অতএব পরের দিন হঠাৎ বনধ ডাকার জন্যে ভাগ‍্যে জুটে গেল কামাখ্যা মায়ের মন্দির ও গর্ভগৃহ দর্শনের,সেই ভোরের বেলা থেকে পাক্বা নয় ঘন্টা লাইনের পর, কিন্তু মাকে না দেখলে যে আসামযাত্রা অসম্পূর্ণ,স্বহায় হলেন তিনি।দীর্ঘ নয় ঘন্টার প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে হলো মায়ের দর্শন।এরপর হোটেলে ফিরে খেয়ে দেয়ে পাততাড়ি গুটিয়ে রওনা হলাম আসামের বিখ্যাত কাজীরাঙা অভয়ারণ্য এর উদ্দেশ্যে, বেশ কয়েক ঘন্টা পর ছমছমে চাঁদের আলোয় পৌঁছলাম আমাদের রিসর্টে।রিসর্টটি একটি অপূর্ব সুন্দর জায়গায় অবস্থিত, তবে মাঝে মধ্যে জন্তুজানোয়ার আসে না যে তা নয়,কিন্তু এত শান্ত নিরিবিলি স্থান না দেখলে বিশ্বাস ই হবে না,রাত কাটিয়ে সক্বাল সক্বাল অভয়ারণ্যের উদ্দেশ্যে সেখানকার বিশিষ্ট জীব গন্ডারমশাইকে এবং ভাগ‍্য ভালো হলে আরও বেশি কিছু দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে চল্লাম,প্রায় একঘন্টা ধুলো খাবার পর মাইলখানেক দূরে মশাই দের দেখতে পেলাম,বনের গভীরে একটি ওয়াচ টাওয়ার এ উঠে চেষ্টা করলাম উনাদের আরো কিছু টা স্পষ্ট দেখার,কিন্তু সেটি হবার নয়।অগত্যা বহু সময় অতিবাহিত হবার জন্য ফিরতে বাধ্য হলাম।
দর্পণ শারদ সংখ্যা ২০২০( অঙ্কন উষসী রায়)

ফিরে এসে তৈরি হয়ে রওনা হলাম ভালুকপং,যেটি অরুণাচল প্রদেশের পশ্চিম কামেঙ এর দক্ষিণে অবস্থিত একটি ছোট শহর,তার উদ্দেশ্যে। রাস্তা যে কি পরিমাণে খারাপ তা না এলে বোঝার উপায় নেই, দুদিকে জঙ্গলে শোনা যায় আলফাদের বসবাস, যেকোনো মূহুর্তে বিপদ,বেশ একটা রোমাঞ্চকর গোছের, কিন্তু সত্যিই শুনলাম একসপ্তাহ আগেই নাকি কিছু ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছে। তাই একটু ভয় ও লাগছিল, মনে রোমাঞ্চ।কিন্তু আমাদের পথের একমাত্র সাথী আমাদের ড্রাইভার অমিতদা।ভীষণ দক্ষতা সহকারে বিপদের মধ্যেও সদাহাস্য মুখে যেভাবে আমাদের বোঝচ্ছিলেন যেন মনে হল আমরা ড্রাইভার কাম গাইড পেয়ে গেছি।ভালুকপং এ প্রবেশের আগে আমাদের অরুণাচল প্রদেশের প্রবেশের পাস করতে হয়েছিল অর্থাৎ অনুমতি নেওয়া হয়েছিল। বহু পথ পেরিয়ে পৌঁছলাম ভালুকপং এর কোলে, ছোট শহর,চারিদিক শুনশান পাহাড়ে ঘেরা ছোট্ট গ্রামটির নিঝুম রাত বড়ই সুন্দর।পাহাড়ের কোলে সন্ধ্যা তাড়াতাড়ি তার কৃপাদৃষ্টি করে।তাই নিশুতি রাতে ছোট্ট শহর মুড়ে গেল,তার সঙ্গে আমরাও।
পরের দিন ভোরবেলা সাড়ে চারটে নাগাদ হোটেল ছাড়বার কথা, বাইরে বেরিয়ে প্রকৃতির অকৃত্রিম শোভা ও সৌন্দর্য আগে কোনোদিন বোধহয় বোধগম্য হয়নি, মনে হচ্ছে,"একটু ধেই ধেই করে নেচে দিই।কোথায় এলাম!এ যে স্বর্গ!" হোটেল ছেড়ে বাস প্রায় 140 কিমি দূরে অরুনাচল প্রদেশের পশ্চিম কামেঙ্গ জেলার ছোট একটি গ্রাম দিরা্ং এর উদ্দেশ্যে এগোচ্ছে।অসম্ভব ভয়ংকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তার সাথে ভয়াবহ খারাপ রাস্তা।ব্যাপারটা ছিল যেমনি বুনো ওল তেমনি বাঘা তেঁতুল,পাহাড় ভয় দেখাবে,আর আমিও ছাড়বো না।
ওপর থেকে পড়লে যে কোনো মূহুর্তে শেষ, ঠাকুরের নাম জপতে জপতে পৌছলাম দিরা্ং।ছোট্ট একটি গ্রাম।
একটি চায়ের দোকানে গিয়ে দিরাং এর স্পেশাল মোটা দুধের চা খেয়ে সব ক্লান্তির অবসান হলো।ভেড়ার দুধের চা ছিল।আর দোকানের মেয়েটির দারুণ ব্যবহার।

এত্ত পথ যাওয়ার পর ওই চা পান এর সুবাদে শ‍রীরে কোনো ক্লান্তি রইলো না, দুম্ করে বেরিয়ে পড়লাম দিরা্ং এর বৃহত্তম মনাস্ট্রীর জন্যে, ওরে বাবা!
পাহাড়ি রাস্তায় দেড় কিমি পথ,সে যে কি প্যাঁচানো ভয়ংকর সৌন্দর্য তা বোধহয় বুঝিয়ে বলা যাবেনা, সবাই পৌঁছুতে না পারলেও আমরা কয়েকজন গেলাম সেখানে, "যাহা দেখিলাম জন্ম জন্মান্তরেও ভুলিবনা",নীচে অতল গহ্বর আর মাথার উপর অসীম আকাশ, খোলা আকাশ মন ভোলানো মেজাজ ঠিক করা আবহাওয়া,অবর্ণনীয় অতুলনীয়।বেশ ফাঁকা জায়গাটি অনেকনখানি উঁচু,শহরের বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে বলা যেতে পেতে।মনাস্ট্রির চারিদিকে সুন্দর সুন্দর ফুলের বিপুল সমাহার এক কথায় বোধহয় এভাবে বোঝানো যাবে না।
রাতে মাইনাস এক থেকে মাইনাস দুইডিগ্ৰি ঠাণ্ডা।
আমরা পুরো জড়োসড়ো, হাত পা আর কিছুই চলছেনা।পরদিন চা জলখাবার  খেয়ে রওনা দিলাম তাওয়াং এর উদ্দেশ্যে,পথে এলো অরুনাচলের ছোট্ট শহর তাওয়াং আর পশ্চিম কামেঙ  শহরের মাঝে অবস্থিত সেলা পাস।
"সে" আর "লা",এই "লা"শব্দের অর্থ হলো গিরিখাত।সেলা পাসের একটি কাহিনী এখানে আমরা শুনি,যেটি অনুসারে এটির নাম।ভারতীয় সেনা বাহিনীর একজন সিপাহী যশবন্ত  সিং রাবত ইন্দো-চীন যুদ্ধে চৈনিক সেনাদের সাথে একা লড়াইয়ে নেমেছিলেন। সাথে ছিলেন এক আদিবাসী মহিলা।নাম ছিল সেলা।একাকী ভাবে বিপজ্জনক যুদ্ধের পর অনিবার্য সাফল্য আসে।
এখানে আসার পথটি ভীষণ বিপজ্জনক।পথের ধারে ধরে মৃত্যু ওঁৎ পেতে বসে আছে।গাড়ি যখন এক একটি বাঁক টার্ন নিচ্ছে ঠিক তখনই মনে হচ্ছে এবার নির্ঘাত স্বর্গে যাওয়া নিশ্চিত।কিন্তু সবটাই যে তাঁর হাতে!কালো রুক্ষ শুষ্ক পাহাড় এর আগে এরকম ভাবে চোখে পড়েনি।গাড়ি থেকে উঁকি মারতে ভয় করলেও দেখেছি যতদূর নীচে অব্দি চোখ যায়।শুধু অন্ধকার গহবর চোখে পড়ছিল আর সাথে অজানা আতঙ্ক মনকে গ্রাস করছিল।

অসাধারণ ভয়ংকর ব‍্যাপার,সামনে দৃশ্যমান সেলা পাসের লেকটি কুচিকুচি বরফে পূর্ণ,মনে হচ্ছে কেউ যেন সাজিয়ে রেখেছে,ওখানে যিনি মোটামুটি পাহাড়ি এলাকায় অভ্যস্ত তিনি আগে থেকে বলে দিলেন যে ওখানে অনেকেরই শ্বাসকষ্ট হয়,আমি তো ভাবলাম আমার মতো সাহসী মেয়ের এইটা হবে না, কিন্তু সব মনের ভুল ধারণা ছিল, সেলা পাস এ যেতেই কি জানি একটা বিশাল ভয় আমাকে গ্ৰাস করলো আর আমি হঠাৎই শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যার মুখোমুখি হলাম ।
বেশ কিছুক্ষণ পর আমরা সবাই রওনা দিলাম ,পথে যশওয়ান্তগড় ওয়ার মেমোরিয়াল এর উদ্দেশ্যে,বিখ্যাত এক জওয়ান এর বীরত্বের নিদর্শন পেলাম যেখানে সেখানকার জওয়ান দের দ্বারা সবসময় ব্যবস্থা থাকে বিনা শুল্কে চা আর বিস্কিট,সেখানে আর এক অপূর্ব সৌন্দর্য, আমরা বেশ খানিকক্ষণ ফটোগ্রাফি করে একটু ফ্রেশ হয়ে আবার রওনা দিলাম।
দর্পণ শারদ সংখ্যা ২০২০(অঙ্কন উষসী রায়)


সত্যি ওখানে যে জওয়ানরা আছেন তারা প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের যে কিভাবে পাশে থাকেন তা বোধহয় না দেখলে বোঝা যাবে না, রাস্তায় একটা জায়গা দেখে লাঞ্চ সারতে সারতে দূরের দৃশ্যে চোখ আটকালো।ভগবান সব সৌন্দর্য কি এখানেই দিয়েছেন।পাহাড়ের গায়ে বরফ দেখে মনে হলো একটা চামচ দিয়ে একটু তুলে নি।সত্যি আমার মন এটাই বলছিলো, এবার আবার গাড়িতে বসে জার্নি করার পালা।বেশ কিছুটা দূরে গাড়ি পার্কিং করে নামলাম নুরাণাং জলপ্রপাত এর উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করলাম।এখানে নাকি খুব ছোটবেলায় দেখা হিন্দি সিনেমা "কোয়েলা"র শুটিং হয়েছিল।জাং হাইড্রো ইলেক্ট্রিক পাওয়ার স্টেশন ছিল সেখানে চোখে পড়ার মত।জলপ্রপাতের জলের আওয়াজের সাথে যেন প্রতিযোগিতা করছে।চারিদিকে রামধনুর রঙের অপরূপ খেলা।
বেশ কিছুটা পাহাড়ি পথ অতিক্রম করে যখন আমরা বেশ অনেক নীচে,একদম নুরাণাং জলপ্রপাতের সামনে,তখন সেই একদম কাছ থেকে জলের বাষ্পের মৃদু তিরস্কার আমাদের মন ভীষণ ভালো করে দিলো।চারদিকে ফাঁকা,শুধুই জঙ্গল,আর ওই অত গভীর জঙ্গলের মধ্যে ছোট ছোট একটি কি দুটি বাড়ি।সে এক অনবরত অনবদ্য দৃশ্য।
দীর্ঘ পথ পেরিয়ে পৌঁছলাম ভারতবর্ষের অরুণাচল প্রদেশ সীমান্তের শেষ ছোট শহর তাওয়াং এ।আর সৌভাগ্যবশত শুনলাম তার পরের দিন ই তাওয়াং এর লোকাল ফেস্টিভ্যাল ডে।অসম্ভব ক্লান্তি,তার ওপর সমতল থেকে প্রায় 13000 ফুট ওপরে উঠে এসেছি, তাই হঠাৎ ই একটু শ্বাসকষ্ট হতে শুরু করলো।রাতের দিকে একটু অক্সিজেনের অভাব বোধ করলেও ধীরে ধীরে তা সয়ে গেল।
বিভিন্ন রকমের পোশাক পরিহিত হয়ে বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন ধরণের নৃত্য আমার মন কে ছুঁয়ে গেল।জীবনেও ভাবিনি একটি রাজকীয় দিনের সাক্ষী আমি এইভাবে হতে পারবো।উৎসবের মাঝে দেখলাম ওখানকার সম্মানীয় অতিথিদের সেই মুহূর্তে বরণ করা হচ্ছে আর ছোট ছোট কাঁচের একটি করে পাত্রে গরম কিছু খাবার পরিবেশিত হচ্ছে।খুব ইচ্ছা হলো সেই স্বাদ উপভোগ করবার এবং তার সুযোগ ও পেলাম।অসামান্য স্বাদের বিভিন্ন ড্রাই ফ্রুটস এর সমন্বয়ে তৈরি সেই খাদ্য ওইটুকু পাত্রে পরিবেশিত হলেও শেষ যেন কিছুতেই হচ্ছিলনা।এত সুন্দর আতিথেয়তা বোধহয় আর কোথাও এভাবে পেয়েছি বলে স্মরণে আসেনা।নাম না জানা বাদ্যযন্ত্রের সমাহারে মুখরিত সেই উৎসব আজও চোখের সামনে ভাসতে থাকে।সকাল সকাল বেরিয়ে উৎসবের আনন্দে মেতে আমরা রওনা দিলাম তাওয়াং মনাস্ট্রির পথে।পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ মনাস্ট্রি এটি যেখানে লাইব্রেরি থেকে শুরু করে মিউজিয়ামে(Tawang Gaden Lamgyal Lhatse Monastery) মাননীয়া ইন্দিরা গান্ধীর ছবি থেকে বিবিধ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ছাপ ও যাবতীয় পুরানো স্মৃতি বিদ্যমান।এরপর এলাম তাওয়াং বুদ্ধ স্ট্যাচুর সামনে।আমার আইপ্যাড এর ক্যামেরাও যাঁর ছবি নিতে হিমশিম খেয়েছে,কারণ বুদ্ধ মূর্তিটি তাওয়াং এর অন্যতম বৃহত্তম মূর্তি।সারাদিন জার্নি করে এসে পৌঁছালাম তাওয়াং ওয়ার মেমোরিয়ালে যেখানে কবিগুরুর সুরে আবার গেয়ে উঠলাম "জনগণমনঅধিনায়ক জয় হে"।ভারতের শেষ প্রান্তে এসে ঠিক সন্ধ্যার আগে তার জয়ধ্বনি মনকে আবেগপ্রবণ করেছিল বৈকি।সাথে চোখে জলের ছোঁয়া
পরের দিন আমাদের যাত্রা শুরু বুম লা পাসের জন্য,তাওয়াং শহর থেকে প্রায় 37 কিমি দূরে,যার শুধু নামটি শুনেছিলাম।অত্যন্ত খারাপ বিপদসংকুল ভয়ংকর পথ আমি জীবনের এর আগে দেখিনি,বোলেরো গাড়িটি পুরো রাস্তা লাফিয়ে লাফিয়ে চলে সামনে এলো সেই দৃশ্য,"ফুলে ফুলে সাদা"নয়,বরফে বরফে সাদা সেই অভূতপূর্ব সৌন্দর্য আমি চোখ দিয়ে গিলতে লাগলাম।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে পনেরো হাজার ফুট ওপরে অবস্থিত বুম লা পাস,যার ঠিক ওপারে কিছু দূরেই অবস্থান করছে চীন দেশ।এই বুম লা পাস ভারতের তাওয়াং ও চীনের তিব্বতের মধ্যে ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্র বলা যেতে পারে।
আকাশ নীল সমুদ্রে মিশতে কখনো দেখেছেন?আমি দেখেছি এই বুম লাতে।এটিকে চিন দেশ ও ভারতের মধ্যে একটি এগ্রিড বর্ডার পার্সোনাল মিটিং পয়েন্ট  বলা যেতেও পারে।
"সারে যাঁহাসে আচ্ছা হিন্দুস্তা হামারা"
চিৎকার করে গাইতে ইচ্ছে করেছিল যখন ওই অসম্ভব কষ্টকে উপেক্ষা করে আমাদের বীর নির্ভীক জওয়ানদের দেখেছিলাম  চব্বিশ ঘন্টা একটি পলক ও না ফেলা চাহনি,অনুভব করতে পেরেছিলাম তাদের দেশপ্রেম।
নিঃশ্বাসের কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও সেখানকার সেই নীলাভ আকাশের দূর দিগন্তের হাতছানি আজও ডাকে আমায়।যতদূর চলেছি,বোর্ডে লেখা,"ইউ আর আন্ডার এনিমি অবজারভেশন"অর্থাৎ যে কোনো মুহূর্তেই শত্রুর হাতে প্রাণ যেতেই পারে,কিন্তু এই যে আমাদের দেশ আর তার বীর সিপাহীরা,সেই আশঙ্কা একেবারে ধূলিসাৎ করলো এবং সবসময়ই করে।পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে এখানে সেখানে সেনাবাহিনীর ছাউনি,যেন কেউ লোহার কবচ দিয়ে পুরো ভারতবর্ষকে ঘিরে রেখেছে।ফেরার পথে মাধুরী লেকের অপার্থিব সৌন্দর্য,যেখানে অভিনেত্রী মাধুরী দীক্ষিত শুটিং করেছিলেন, চারিদিকে বরফাবৃত পাহাড়ে ঘেরা আর সুন্দর সুন্দর ফুলে ঘেরা এই উপত্যকার পারিপার্শ্বিক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য আপনার অন্তরে প্রেম আবার নতুন করে জেগে উঠতে বাধ্য।
যেহেতু তাওয়াং এর লোকাল ফেস্টিভ্যাল ছিল,তাই সন্ধ্যায় আবার বেরিয়ে পড়ি সন্ধ্যাউৎসবের সাক্ষী হতে।অনেকদূর থেকে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নৃত্য, সঙ্গীত ও অন্যান্য ভাষায় কথোপকথন আমাদের বিমুগ্ধ করে।ক্ষনিকের জন্য মনে হচ্ছিল,"এই তো আছি নিজের জায়গাতেই যেন"।
দর্পণ শারদ সংখ্যা ২০২০ ( অঙ্কন উষসী রায়)

পরের দিন হোটেলের জানালা খুলতেই চোখে পড়ে টুকরো টুকরো মেঘ বরফের পাহাড়ের গায়ে,আর তার গা ঘেঁষে উঠছে আমাদের সবার প্রিয় মামা।তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে এবার ফেরার পালা।পথে একটি জায়গায় বরফে মোড়া পাহাড়ের গা থেকে ঝুলন্ত স্টালাকটাইট পাই,যেগুলো দেখে সেই চিরাচরিত প্রবাদ "মিছড়ির ছুরি"র কথা মনে পড়ে যেগুলো আজ বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।ধীরে ধীরে আদরের তাওয়াং আমায় পিছনে ফেলে আসতে হয়।পথে পাই দিরাং এর উষ্ণ প্রস্রবনের দেখা।প্রায় সাড়ে তিনশো সিঁড়ি নেমে তার দেখা পেলাম আর নিজেদের সেঁকে নিলাম।দীর্ঘ 173 কিমির অক্লান্ত ভ্রমণের পর আমরা এসে পৌঁছাই বোমডিলা যা অরুণাচল প্রদেশের পশ্চিম কামেঙ জেলার একটি ছোট্ট শহর বলেই খ্যাত।এর সাথে এটিকে পশ্চিম কামেঙ্গ জেলার হেডকোয়ার্টার ও বলা যেতে পারে।বোমডিলাতে ঠিক আমরা যেখানে ছিলাম একরাত, ঠিক তার পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে ছোট্ট একটি ঝর্ণা, যা এত রাতের বাইরের ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের সাথে একটু মায়াবী অনুভূতি জাগরিত করেছে।পরের দিন ভীষণ ভোর এ তৈরি হয়ে যখন নামলাম চারিদিকের মোহময়ী রূপ এক অনবদ্য রূপকথা সৃষ্টি করেছিল,মায়াবী রাতের পর ভোরের নিশ্ছিদ্র প্রতিচ্ছবি মনের অন্দরে প্রবেশ করেছিল যা বেলা বাড়ার সাথে সাথে ক্রমশঃ হারিয়ে যাচ্ছিল বোধ করি।ফেরার দিন আমরা গুয়াহাটি স্টেশন আসার জন্য ধানসিড়ি নদীর ধার ধরি।সিদ্ধান্ত হয় এই নদীর তীরে বেশ কিছুক্ষনের জন্য আমাদের ঘাঁটি ফেলা হবে।
"আবার আসিব ফিরে/ধানসিড়িটির তীরে /এই বাংলায়"।সেই জীবনানন্দ।
বাঙালীর বোধ,মনন,অন্তরের অন্তঃস্থলে যাঁর বিদ্যমানতা কখনোই অস্বীকার করা যায় না যে।ফেরার পথে ব্রহ্মপুত্র নদের বুকের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় আমরা বেশ খানিকক্ষণ মাতালের মত ছিলাম।মনে পড়ছিল,"এই সেই ব্রহ্মপুত্র নদ,যার কথা আমরা ইতিহাসের পাতায় সর্বদাই পড়েছি"।
আমাদের সাথে যিনি ড্রাইভার দাদা ছিলেন এই কদিনে তিনি ভীষণ আপন হয়ে যান।বিভিন্ন চড়াই উৎরাই খাড়াই অতিক্রম করে দীর্ঘ দিনের পর আমরা সমতলে অবশেষে গুয়াহাটি স্টেশন যেখান থেকে আমাদের ভ্রমণের সূচনা।অবশেষে ট্রেনে করে ফেরা সেই পরিচিত কলকাতায়।
এত বছরের জীবনে বহু ভ্রমণ করলাম,কিন্তু এই যে অরুনাচলের রূপকথা তাকে তো ভাষায় কক্ষনো প্রকাশ করা সবটা যেতেই পারেনা, মনের মণিকোঠায় তার স্মৃতি ক্রমশঃ এক এমন জায়গা নিতে থাকে যেটি কোনোদিন চেষ্টাতেও বোধহয় পুরানো হয়ে যাবে না,যার স্মৃতি ধূসর বর্ণ নেবেই না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ