ভরদুপুরে ভূতুড়ে গ্রামে || সাবিত্রী জানা ষন্নিগ্রহী




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

 ভরদুপুরে ভূতুড়ে গ্রামে

(ভ্রমনমূলক কাহিনী)

সাবিত্রী জানা ষন্নিগ্রহী

রাজস্থান নাম শুনলেই মনে হয় কেবল রাজরাজড়াদের বাস-বৈভব সমৃদ্ধ এক রাজ‍্য। --সেই রাণা প্রতাপাদিত্যের যুদ্ধ--হলদি নদীর পাড়ে ভূলুণ্ঠিত বিশ্বস্ত  ঘোড়া চৈতক--। চিতোর--রাণী পদ্মিনী-- "সোনার কেল্লা"--সত‍্যজিৎ রায়-- ফেলুদা- সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-- মুকুল-- ময়ূর--ভারতের একমাত্র মরুভূমি থর-।

১৯৮৮সাল থেকে মনের ভেতর রাজস্থান দেখার সুপ্ত ইচ্ছে মাঝে মাঝে উঁকি দিত। কিন্তু কোন উপায় ছিল না। ছেলের কাছে ব‍্যক্ত করেছিলাম। অবশেষে ২০১৪ পূজোর ছুটিতে সুযোগ মিললো। জুনমাসে টিকিট হয়ে গেছে-হোটেল বুকিং সহ।

--বোধহয় বিধি বাম--বাড়িতে পা মচকে গেল। ডাক্তারবাবু বললেন-- তিনমাস বিশ্রাম। ডাক্তারবাবুকে বললাম-- মলম আর ব‍্যাথা কমার ঔষধ দিয়ে ছেড়ে দিন। তাই হোল। ছেলে ও যেতে রাজী হছিল না। বললো টিকিট ক‍্যানসিল করে দিই। আমি বললাম-- অসম্ভব-- আমি যাবোই--এই ফেটে যাওয়া হাড় নিয়ে। অগত্যা হাড়ে চিড়ধরা পা নিয়েই ফ্লাইটে উঠলাম।--ভ্রমণের পাঁচদিন পর দেখা পেলাম জয়সলমীর স্টেশন। স্টেশন ঢোকার আগেই রেলের কামরার ভেতরে হৈ হৈ রব--ঔ সোনার কেল্লা দেখা যাচ্ছে। ঠিক। চড়া রোদে হালকা হলুদ রঙের কেল্লা--কুম্ভলগড়ের আদলে।

বিকেলে কেল্লা দর্শনে গেলাম। আমরা কলকাতা থেকে গিয়েছি শুনে এক দীর্ঘদেহী যুবক এগিয়ে এলো। সে দেখাবে "কলকাত্তার দাদার কেল্লা- সোনার কেল্লা"। ধীরে ধীরে এগিয়ে চললো আমাদের নিয়ে--আর একটি বাক‍্যের পর বলছে "কলকাত্তার দাদা"। আমি তো বুঝতে পারছি না ও কলকাত্তার দাদা কাকে বলছে। জিজ্ঞেস করায় বললো- সোনার কেল্লার সত‍্যজিৎ রায়। দেখালো-মুকুলের ওঠানামার সিঁড়ি--সেই গলি যে গলিতে মুকুল ময়ূরের পেছনে ছুটছে-- মুকুলের পেছন পেছন ফেলুদা। 

----পরেরদিন গন্তব্যস্থল থর মরুভূমি। মরুভূমি দেখবো- মনের ভেতর এ ও এক উত্তেজনা।

সোনার কেল্লার গাইড বললো এসি গাড়ি ঠিক করে দেবে। আমার পছন্দ অটো -- বেশ খোলামেলা ---দেখতে দেখতে যাবো।ছেলের বা ছেলের বাবার অনিচ্ছা ছিল কারণ খুব গরম হবে--লু বইবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও অটোই নেওয়া হোল। গাইড ঠিক করে দিয়েছে। অটো থর মরুভূমির টেন্টে পৌঁছে দেবে আবার যেয়ে নিয়ে আসবে। টেন্টে একরাত বুকিং আছে।

---পরের দিন সকালে স্নান সেরে টিফিন খেয়ে জল, পেঁয়াজ, কিছু শুকনো খাওয়ার কিনে অটোতে উঠলাম। সবার মাথায় পুরু তোয়ালে। থর মরুভূমি যাওয়ার পথে---গিনেস বইতে স্থান পাওয়া ""কুলধারা ভূতুড়ে গ্রাম""পড়বে। আমরা দেখে তারপর যাবো। অটোভাই বোধহয় কিন্তু করছিল। না খুব খুশি মনে রাজি হোল দেখিয়ে দেবে।

----অটো ছুটছে জয়সলমীর -- সোম--ধানানা রোড ধরে।  প্রায় ২ ঘন্টা চলার পর সাতা গ্রাম। সাতা পেরিয়ে অটো বামদিকে ঘুরে গেল। লাল-হলুদ চওড়া মোরাম রাস্তা। ধূলো উড়ছে--বইছে গরম হাওয়া--মুখ মাথা তোয়ালায় ঢাকা। দুপুর ---১.৪০ অটো থামলো এক কেল্লার সামনে। পথে বোর্ডে লেখা আছে--

---খাবা ফোর্ট। কুলধারা গ্রামে অবস্থিত। গেটের ভেতর কার্পেটে বসে আছেন এক বৃদ্ধ। জগে জলপান করালেন। টাকা দিয়ে ঢুকতে হবে। তাই হোল। ভেতরে ভাঙাচোরা হলেও মন্দির-বাড়ির অলঙ্করণ-সিঁড়ির ধাপ বহন করছে কেল্লার ঐতিহ্যবাহী জীবনযাত্রা। মাটির পাতলা ইঁট দিয়ে তৈরী। এত মজবুত এককনা মাটিও আলাদা করা যায় না। বহুদূর পর্যন্ত ভাঙাচোরা ঘরবাড়ির নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। --কিছু গল্প -- কিছু  সত্যি লুকিয়ে আছে এই গ্রামে-এই ভাঙাচোরা কেল্লার ভগ্নাবশেষের মধ্যে। -সিংহ পরিবারের এক উদ্ধত মানুষ ব্রাহ্মণ পরিবারের সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করার বাসনা প্রকাশ করায়-৮৩ টি পালি ব্রাহ্মণ পরিবার একরাতের মধ্যেই নিজেদের সম্মান-ঐতিহ্য-  রক্ষার্থে এই কুলধারা গ্রাম ত‍্যাগ করেন। --তাদের কোন খোঁজ মেলেনি।--

সেই রাতের পর ঐ গ্রামে নাকি সহজে কেউ যেত না। রাতে কান্না শোনা যায় এখনো। এ গল্প এখনো স্থানীয় মানুষদের মুখে মুখে।

আমরা ঘুরে ঘুরে চারদিক দেখলাম। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম। দূরে গ্রামের বাড়িগুলো সারাই চলছে। মেয়েরা মশলা যোগান দিচ্ছে। ---অটো ভাই মন্দিরে ঢুকতে বারণ করলো। ভেতরে নাকি সুড়ঙ্গ আছে। আমাদের দেখার খুব ইচ্ছে ছিল কিন্তু নিরাপদ নয়। ভগ্নগ্রামে 

 ছাগল গরু নিয়ে বালক- বালিকা হাতে ছড়ি-গায়ে গামছা নিয়ে ইতস্ততঃ ঘুরে বেড়াচ্ছে।

কেল্লা থেকে বেরিয়ে পাশেই জুরাসিক পার্ক। রকমারি- বাহারি ক‍্যাকটাস প্রজাতির সমাহার। রং বেরংয়ের ফুল ফুটে আছে। আছে ছোট ছোট বাবলা গাছ। ক‍্যাকটাস ঘেরা জায়গায় ছোট্ট একটি পরিত্যক্ত জলাশয়। মাঝে ছোট্ট মন্দির। ডাঙায় একটি কাঠের নৌকা দেহ এলিয়ে শুয়ে আছে। দেখে মনে হয়--এখনো মনিবের আশায় প্রতিক্ষারত‌। পাশে একটি ঘোড়া বাবলা গাছের কাঁটাসহ পাতা খেতে ব‍্যস্ত। দুজন মাঝবয়সী পুরুষ গামছা মাথে মাটিতে বসে বসে গল্প করছে। আমরা বেরিয়ে এলাম। ঝাঁ ঝাঁ করছে দুপুরের রোদ। জিভ শুকনো হয়ে যাচ্ছে। চোখ জ্বালা জ্বালা করছে। জল ছিটিয়ে আবার অটোতে উঠলাম। গন্তব্য--থরমরুভূমি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

3 মন্তব্যসমূহ

  1. এত সুন্দর বর্ণনা মনে হল সবকিছুই নিজে চাক্ষুষ করলাম.. কিছুটা সময় কাটালাম গা ছমছমে পরিতক্ত এক মরুগ্রামে!

    উত্তরমুছুন

  2. সত্যজিৎ রায় এর সোনার কেল্লা আর ফেলুদার টাটকা আবেগকে ছুঁয়ে রাজস্থানের একটু অংশ চোখের সামনে ভেসে উঠলো অসাধারণ সাহিত্যরসে ৷

    উত্তরমুছুন