ডেঙ্গু জ্বর এবং তার প্রতিকার || মনোজ মাইতি




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

 ডেঙ্গু জ্বর এবং তার প্রতিকার , লিখছেন মনোজ মাইতি (শারীরবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক, বাজকুল মিলনী মহাবিদ্যালয়)

অনাক্রমণ তন্ত্রের  দুর্বলতা বা পরাজয় মানবদেহে রোগের একমাত্র কারণ। জীবাণু দ্বারা রোগ সৃষ্টি যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের দ্বারা সর্দি-কাশি, এন্টামিবা হিস্টোলাইটিকা দ্বারা আমাশয়, মাইক্রোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকিউলোসিস দ্বারা টিভি রোগ, ডেঙ্গু ভাইরাস দ্বারা ডেঙ্গু জ্বর ইত্যাদি এগুলি সংক্রামক রোগ অন্যদিকে কিছু কিছু রোগ জিনগত বা বংশগত বা অন্য কোনোভাবে হয়ে থাকে এগুলি এক আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে অন্য সুস্থ ব্যক্তির দেহের ছড়ায় বা সংক্রামিত হয় না এদের অসংক্রামক রোগ বা নন কমিউনিকেবল ডিজিজ বলে যেমন ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, পিত্তপাথর ইত্যাদি। সংক্রামক রোগ গুলির জন্য জীবাণু বা অনুজীব গুলির বাহক যেমন জল, বাতাস বা পতঙ্গ ইত্যাদি দরকার, যার মাধ্যমে জীবাণু নির্দিষ্ট জীবদেহে প্রবেশ ও সংক্রমণ ঘটায় প্রতিটি জীবাণুর নির্দিষ্ট সংক্রামক প্রাণী বা উদ্ভিদ রয়েছে যেমন করোনাভাইরাস ও নিউমোনিয়া মানবদেহে ফুসফুস, কলেরার জীবাণু মানবদেহে ক্ষুদ্রান্ত্রে, ডেঙ্গি ভাইরাস মানবদেহে রক্ত কণিকা কোষগুলিকে আক্রমণ করে ইত্যাদি।

স্পেনীয় শব্দ  ‘ডিঙ্গা’ থেকে ডেঙ্গু শব্দটি এসেছে এর অর্থ হল সাবধানী। ডেঙ্গু মহামারী প্রথম বিবরণ 1779 ও 1780 সালে এশিয়া, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকার ঘটেছিল। ডেঙ্গু ফিভার ভাইরাস (DENV) Flaviviridae জিনের  পরিবারের একটি আর এন এ ভাইরাস। এই ভাইরাসটির বাহক হল এডিস মশা, এই মশা সাধারণত দিনের বেলায়, সকালে কনুই নিচে বা হাটুর নিচে কামড়ায়। 13 থেকে 15 দিনের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গ বা লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়। গাঁটে ব্যথা, মাংসপেশিতে ব্যথা, মাথা ধরা, ক্লান্তি ভাব, বমি, গায়ে ফুসকুড়ি,  ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার ও মৃত্যু ঘটতে পারে, মারাত্মক রক্তক্ষরণ থেকে অনুচক্রিকার সংখ্যা দ্রুত কমে যায় এবং রক্তচাপ কমে যায়।স্বাভাবিক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে অনুচক্রিকা বা প্লেটলেটের সংখ্যা প্রতি মাইক্রোমিটার রক্তে 15 লক্ষ থেকে 45 লক্ষ। 80 থেকে 90 শতাংশ ডেঙ্গু ফিভার জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তির অনুচক্রিকার সংখ্যা কমে প্রতি মাইক্রো লিটারে এর সংখ্যা কুড়ি লক্ষ বা তার থেকেও কম হয়, এইরকম ক্রিটিক্যাল অবস্থায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে অনুচক্রিকা বা রক্ত দিতে হয় ডেঙ্গু ভাইরাসের আক্রমণ ঘটে থাকে তাই এটি কোন এন্টিবায়োটিক দ্বারা প্রতিরোধ সম্ভব হয়না। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির জ্বর কমাতে প্যারাসিটামল খাওয়ানো হয়, শিরায় স্যালাইন দেওয়া হয় কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিক ও নন-স্টেরয়েডাল ঔষধ প্রয়োগ করা যায় না কারণ এগুলি  রক্তপাত বৃদ্ধি করবে। এডিস ইজিপ্টি মশা আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত পান এর সময় জীবাণু ভাইরাসটি মশার দেহে চলে আসে এবং 8 থেকে 10 দিনের মধ্যে মশার দেহে বংশ বিস্তার করে মশার লালাগ্রন্থি ও লালায় চলে আসে তখন ওই মশাটি সুস্থ ব্যক্তিকে কামড়ালে সুস্থ ব্যক্তি আক্রান্ত হয়। ডেঙ্গু ফিভার আক্রান্ত ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করতে ন্যূনতম 7 থেকে 14 দিন সময় লাগে। আক্রান্ত ব্যক্তিকে মসলাযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলতে হয়, এই সময় দরকার লেবু, পেঁপে, হারবাল চা, ফলের রস, ভিটামিন, মিনারেল, প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য বস্তু গ্রহণ এবং নিয়মিত শরীরচর্চা, যোগব্যায়াম। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা, মহাদেশের 110 টির বেশি দেশে প্রতিবছর প্রায় 5 থেকে 50 কোটি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় এর মধ্যে প্রায় দশ থেকে কুড়ি হাজার মানুষ মারা যায়। ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ, যেহেতু এটি মশাবাহিত রোগ তাই মশার বংশ বৃদ্ধি প্রতিরোধী দরকার। মশা জলের মধ্যে ডিম পাড়ে অর্থাৎ এদের বংশ বৃদ্ধির জন্য জলের প্রয়োজন হয়। কাপ, টপ, টায়ার, ডাবের খোলা, ছাদ, পচা নর্দমা জল পরিষ্কার করা, শরীরের বেশিরভাগ অংশ পোশাক দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে, ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার, মশা মারার জন্য নির্দিষ্ট রাসায়নিক পদার্থও ধুপ ব্যবহার, বাড়ি ঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা যাতে মশা লুকিয়ে থাকতে না পারে। এগুলির মাধ্যমে ডেঙ্গু প্রতিরোধ অনেকাংশেই সম্ভব। ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তিকে আলাদাভাবে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে রেখে এবং সঠিকভাবে চিকিৎসার মাধ্যমে ও  বিশেষ প্রয়োজনে ব্যক্তিকে রক্ত দেওয়ার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলা সম্ভব।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ