যীশুখ্রীষ্টের খেলা আমি দেখেছি || দেবু দত্তগুপ্ত




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

 যীশুখ্রীষ্টের খেলা আমি দেখেছি,তথ্যসূত্র, প্রয়াত দেবু দত্তগুপ্ত

ওয়েম্বলী-স্টেডিয়াম, ইংল্যান্ড।

               দেড় লাখ দর্শকাসন কানায় কানায় পূর্ণ। কে-নেই-দর্শকাসনে! মহারানী ভিক্টোরিয়া, প্রিন্স অব ওয়েলস, রাজপুত্র চার্লস, প্রিন্সেস ডায়ানা সহ দর্শকাসনে সপরিবার রাজপরিবার। হাজির মন্ত্রী-সান্ত্রী,ডিউক-ব্যরনস আর অভিজাতদের সঙ্গে  মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সিইও , রকস্টার, ছাত্র-শিক্ষক ফুটবলপ্রেমী কে নেই ! সারা-ইংল্যান্ড যেন স্টেডিয়ামে উপস্থিত। রাজপরিবারের ইচ্ছায় খেলার আয়োজন। ফুটবল খেলা হবে ইংল্যান্ডের ম্যাঞ্চেস্টার-ইউনাইটেড ভার্সাস ইতালির নেপোলির মধ্যে। আসলে সেটা বকলমে ফুটবলের যাদুকর শিল্পের মহানায়কের যাদুর প্রদর্শনী আসর ।

                খেলা শুরু। এক পাঁচফুটিয়া ফুটবলারের শিল্প মুর্ছনায় সম্মোহিত স্টেডিয়াম। শক্তি আর সৌন্দর্যের অপার সম্মিলনে এক চিতাবাঘ যেন সবুজ গালিচায় বিচরণ করছে। তার ক্ষিপ্রতা আর পেলবতায় মিশ্রণে যেন তুলির টান। ম্যাঞ্চেস্টারের বিখ্যাত খেলোয়াড়রাও মাঝে মাঝে খেলা ভুলে সেই সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে যাচ্ছে। 

বাঁ-পায়ের অত্যাশ্চর্য ছোঁয়ায় যেন নেচে উঠছে ফুটবলের সিম্ফনি। খেলা যথারীতি শেষ হল নেপোলি হেরেছে ১-২ গোলে। নেপোলীর একমাত্র গোলটি ছিল স্বয়ং ফুটবলের যাদুকরের। কিন্তু সারা স্টেডিয়াম মুগ্ধ সেই ফুটবলের বরপুত্র মারাদোনার শিল্পের সম্মোহনে। 

             খেলা শেষে প্রথাগত মিট দ্যা প্রেস অনুষ্ঠান। বৃটিশ মিডিয়ার বাঘা বাঘা সাংবাদিকদের উপছে পড়া ভিড় ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের প্রেসরুম। সারা বিশ্বের ফুটবল পাগোলদের আইকন প্রাণোচ্ছ্বল মারাদোনাকে প্রথম প্রশ্ন করা হল-- আপনাকে স্বয়ং পোপ নাকি ভ্যাটিকানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ?

শিশুর মত বলে উঠলেন রাজপুত্র -- হ্যাঁ হ্যাঁ! সপরিবারে আমন্ত্রিত ছিলাম। পোপ নিজে ভ্যাটিকানের প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে আমাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন।

সাংবাদিকদের প্রশ্ন --কেমন লাগলো ভ্যাটিকান ?

 ---- গভীর এবং পবিত্র বোধে মুগ্ধ বিস্ময়ে ভ্যাটিকানের অপূর্ব_নির্মাণ দেখেছিলাম। আরো আশ্চর্য হয়েছিলাম ভ্যাটিকানের প্রাসাদের সিলিং দেখে।পুরু সোনার পাত দিয়ে তৈরি।আবার প্রশ্ন--- পোপ কি বললেন ?

 --- পোপ বলেছিলেন 'বিশ্বের দরিদ্র শিশুদের দায়িত্ব বহন করে চার্চ।' তখন মনে হল পোপ যেন একজন গোলকিপার। এক বিপুল সম্পদের রক্ষক। ভ্যাটিকানের সিলিংটা বিক্রি করে আরো ভালো করে দায়িত্ব পালন করেন না কেন ! পেনাল্টিতে গোল হলে কেউ তো গোলকিপারকে দোষ দেয় না ! কৌতুকহাস্যে বললেন মারাদোনা।

----  পোপ নিশ্চয়ই আশির্বাদ করেছিলেন?

---- হ্যাঁ। সকলকে একটা করে জপের মালা দিয়েছিলেন। আমার মা, স্ত্রী, পরিবারের সকলকে। আমাকেও একটা মালা দিয়ে ইটালিয়ানে বললেন"এটা সাধারণদের জন্য নয়, শুধু তোমার জন্য।" সে কথা শুনে  আমি মা আর স্ত্রীর মালাটা যাচাই করে দেখলাম। দেখলাম একই রকমের,বিশেষত্ব কিছু নেই। তাই একটু এগিয়ে পোপকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম ,-"সবইতো একরকমের কোনো পার্থক্যতো চোখে পড়ল না?"

পোপ কোন উত্তর দেন নি,আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে পিঠে হাত রেখে হাঁটতে লাগলেন। না একজন ফুটবলারের প্রতি কোনো শ্রদ্ধা বা আশির্বাদ দেখাতে পাইনি। আসলে আমি নিশ্চিত ছিলাম এই গোলকিপারটি পেনাল্টি বাঁচাতে পারবেন না।

----আপনার জীবনের আদর্শ পুরুষ কে ?

---- ফিদেল! ফিদেল কাস্ত্রো!! সুস্থ মানবিক জীবনের উনিই প্রেরণা। কিছুক্ষণ থেমে বললেন আর একজন আছেন, কার্যতঃ আমার হৃদয়ের অন্তঃস্থলে।বলেই জামাখুলে কাঁধের নীচে হাতটা মেলে ধরে সাংবাদিকদের দিকে চোখ মটকে তাকালেন।

  সাংবাদিকরা অবাক অবাক বিস্ময়ে দেখলেন হাত জুড়ে ট্যাটুতে চে গুয়েভারার ছবি।

জোঁকের জাত সাংবাদিকরা ছাড়বে কেন। তাঁরা

তাঁর কোকেন সেবনের অভিশপ্ত কথা স্মরণ করাতে এবার প্রশ্ন করলেন ---পৃথিবীর কোন জিনিসটা আপনার কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত মনে হয় ?

নিঃসংকোচে জবাব এলো -- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের আসনে বসা।

 স্তম্ভিত সাংবাদিককূল । গুঞ্জন উঠলো সারা সম্মেলন জুড়ে।

আবার প্রশ্ন--

-----আপনার দু'পাকে লক্ষ্য করে বিপক্ষের যে মুগুর চলে তারা আপনাকে ছুঁতে পারে না কেন? এই ক্ষিপ্রতার রহস্য কি ?

 শিশুর মত হেসে মাথা দোলাতে থাকেন রাজপুত্র।

-----আপনার এই সর্পিল গতির বিদ্যুৎ শৈলী, আচম্বিতে মোচড় দেওয়া ডিব্রিলের মূল্য কত?

 মুচকি সরল হাসি ছড়িয়ে পড়ে তার মুখে।

----আজকের এই অভূতপূর্ব ফুটবল শৈলীর পারিশ্রমিক কত ?

ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি তুলে বললেন ----এক বিলিয়ন ডলার।

    আয়োজকরা ওই একশ কোটির চেক যখন যখন তুলে দেয় তখন মারাদোনা বাঁহাতে দুটি আঙুল দিয়ে তা তুলে নিয়েছিলেন ।যা নাকি ছিল ইংরাজ এটিকেট তথা সহবতহীন অসম্মানসূচক।

এ যেন ছিল তার সাথে দরদাম করার এক সজোরে চপোটাঘাত।

      সেদিনের গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে যেত । কিন্তু হয় নি। প্রেস কনফারেন্স শেষ করে বাইরে আসবেন দেখেন তাকে দেখার অনুরাগীদের বিশাল ভীড়ে ভীষণ কুন্ঠা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন একজন কৃষ্ণাঙ্গ বিশপ। মারাদোনার চোখ পড়ল তাঁর দিকে। একজন বিশপ এখানে ? মারাদোনা তাঁকে কাছে ডাকলেন। জিজ্ঞাসা করলেন-- কেমন লাগলো তাঁর খেলা ?

 মাথা নাড়িয়ে আনন্দ অভিব্যক্তি প্রকাশ করলেন বিশপ। আর তাঁর এখানে আসার কারণ যে শুধু খেলা দেখা নয় তাও বললেন। এই জনসমাগমে তিনি অর্থ সংগ্রহ করতেও এসেছেন। মারাদোনা তার কাছে জানতে চান কিসের অর্থ সংগ্রহ ?বিশপ বললেন--তার দেশ আফ্রিকা। গৃহযুদ্ধে দেশটা শেষ হয়ে যাচ্ছে। যাদের পিতামাতারা যুদ্ধে মারা গেছে সেই অনাথ শিশুদের নিয়ে তিনি একটা আশ্রম চালান। বাচ্চাদের বই, খাবার, পোষাক, চিকিৎসা,খেলনা কিছু নেই। এমনকি আশ্রমের ছাদটা উড়ে গেছে বোমায়। সব জায়গায় সাহায্য চেয়েছেন। সবাই মূল্যবান উপদেশ দেন কিন্তু জীবনধারণের জিনিসগুলি দেন না। হয়তো বা সেটা সম্ভব নয় কেননা এই যুদ্ধের বিপুল অস্ত্র আর ঘৃণা তারাই প্রচার-যন্ত্রে টিকিয়ে রেখেছেন।

     খর্বকায় রাজপুত্রের চোখ চিকচিক করে ওঠে।  হয়ত মনে পড়ে তার শৈশবের কথা। আর তখনই তাঁর ঔদ্ধত্য যেন ওই সমাবেশের গণ্যমান্যদের অভব্যতাকে ছিন্ন করে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। নিজের অর্জিত চেকটি ডান হাতে নিয়ে কুন্ঠা ভরে সেই বিশপের হাতে তুলে দিয়ে বললেন--

----সামান্যই পারি। শিশুগুলির মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা থামাবেন না‌।

     বিস্ময়ের ঘোর কাটে না বিশপের। একশ কোটি ডলার!! দু'চোখে বেয়ে নেমে আসে জলের ধারা। অস্ফুট স্বরে বলেন -- যীশুখ্রীষ্ট এভাবেই উপশম আর নিরাময় দিতেন দুঃস্থদের। আপনার আজকের খেলা নিয়ে কিছু বলা সম্ভব নয়।ঘোর কাটতেই বেশ কিছুদিন লাগবে। শুধু নিজেকে বলব--যিশুখ্রীষ্টের খেলা আমি দেখেছি। উপশম আর নিরাময়ের আশ্চর্য খেলা।

এটা কোন রূপকথা নয়।

এটাই আর্মানন্দো দিয়াগো মারাদোনার জীবন।

শিশুর মতো সরল, হরিণের মতো চঞ্চল,

ঘাসের মতো সবুজ, মাঠের মতো খোলামেলা। 

হয়তো বেহেমিয়ান তবুও

খ্যাতির তুঙ্গে থেকেও সাধারণ।

আপনার সৌরভ নিঃশেষিত হবার নয়।  

মৃত্যু সব মুছে দেয় না।

আপনি অবিনশ্বর ।


তথ্য সূত্র: প্রয়াত দেবু দত্তগুপ্ত।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

3 মন্তব্যসমূহ

  1. সত্যি উপশম আর নিরাময়ের আশ্চর্য খেলা ৷
    ফিদেল কাস্ত্রোর শিষ্য আর বুকের বাদিকে চে
    ভাটিক্যান পোপ পেনাল্টি বাঁচাতে পারবে না...

    ভ্যাটিক্যান দেখেছে কোভিড 19
    -র মৃৃৃত্যু মিছিল

    উত্তরমুছুন